ভিক্ষুকমুক্ত এলাকায় ভিক্ষা by সুদীপ অধিকারী
সমাজসেবা
অধিদপ্তর ও ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে রাজধানীর
বিভিন্ন এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে বেশ কিছু দিন আগেই লাগানো হয়েছে
ত্রিভুজাকৃতির সাইনবোর্ড। কিন্তু পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে ভিক্ষুকমুক্ত
এলাকাগুলোতে এখনো বহাল তবিয়তে চলছে ভিক্ষাবৃত্তির ব্যবসা। ২০১১ সালে
সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রথম এক জরিপে জানা যায়, শুধুমাত্র রাজধানীতে প্রায়
১০ হাজার মানুষ ভিক্ষা করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ
থেকে এদের মধ্যে ২ হাজার জনকে বাছাই করা হয় পুনর্বাসনের জন্য। তবে তাদের
মধ্যে শুধুমাত্র ৬৬ জন ভিক্ষুককেই বিভিন্ন জেলায় পুনর্বাসন করা সম্ভব
হয়েছিল। কিন্তু জানা যায়, স্বাবলম্বী করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া
ভ্যান, রিকশা, সেলাইমেশিনসহ বিভিন্ন সাহায্যের জিনিসপত্র বিক্রি করে তারা
আবারও ফিরে যায় পুরানো ব্যবসায়। ভিক্ষুকমুক্ত দেশ গড়াতে প্রথমভাগে ব্যর্থ
হয়ে সংস্থাটি জেলা প্রশাসকদের সহায়তায় আবারও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে
রাজধানী ঢাকাসহ প্রতিটি জেলাতে। এর আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর ও ঢাকা
উত্তর-দক্ষিণ সিটি করপোরেশন যৌথভাবে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী,
বাড়িধারা, এয়ারপোর্ট, ধানমন্ডির বিভিন্ন অংশসহ হোটেল সোনারগাঁও, রূপসী
বাংলা, রেডিসন ব্লু এলাকাতে সাইনবোর্ড লাগিয়ে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করে। জানা
যায়, এসব সাইনবোর্ড লাগানো এলাকাগুলোতে কাউকে ভিক্ষা করতে দেখলে জরিমানাসহ
শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু সরজমিনে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। বিদেশি ও
ভিআইপিদের নিয়মিত রুট হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও এলাকাকে
ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়। সোনারগাঁও হোটেল এলাকা কাওরান বাজার গোলচত্বরে
কিছু দিন আগেও দেখা যেত ঢাকা সিটি করপোরেশনের লাগানো সেই সাইনবোর্ডটি।
কিন্তু বর্তমানে এলাকাটিতে সাইনবোর্ড আছে। কিন্তু তাতে নেই কোনো লেখা বা
ছবির চিহ্ন। স্টিল সিটের তৈরি ত্রিভুজাকৃতির খালি সাইনবোর্ডটি দাঁড়িয়ে আছে
মাঝ রাস্তা বরাবর। এলাকাটিতে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাকর্মীদের বিচরণ থাকলেও
ট্রাফিকের কারণে হোটেলটির সামনে দাঁড়ানো গাড়িতে চলছে ভাসমান ভিক্ষা ব্যবসা।
ধানমন্ডি ৮ নম্বর রবীন্দ্র সরোবর এলাকাকে ভিক্ষুকমুক্ত হিসাবে ঘোষণা করে
সমাজসেবা অধিদপ্তর। আনাম র্যাঙ্গস শপিংমলের পাশ দিয়ে ধানমন্ডি লেকের কোল
ঘেঁষে মুক্ত মঞ্চের দিকে যেতেই চোখে পড়ে ভিক্ষুক মুক্ত এলাকার সাইনবোর্ড।
আর সেই সাইনবোর্ডের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কিছু শিশু। যারা লোক-জন দেখলেই দৌড়ে
কাছে যাচ্ছে। কারোর জামা টানছে কারোর বা প্যান্ট। টাকা না পাওয়া পর্যন্ত
সহজে কারোরই পিছু ছাড়ে না তারা। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীই তাদের টার্গেট। টাকা
না দেয়া পর্যন্ত জোকের মতো লেগে থাকে পিছনে। বিকাল হলেই আবার সেখানে
অবস্থান নেয় এক দল হিজড়া। আপসে টাকা না দিলে, বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে
কিছুটা জোর করেই মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয় তারা। এ বিষয়ে তাদের কেউ কিছু
বললেই আইডি কার্ড বের করে বলে, আমাদের কাছে সরকারি কার্ড আছে। এতে পুরুষের
পাশাপাশি ঘুরতে আসা নারীরাও পরছেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী
বেসরকারি চাকরিজীবী আশিকুর রহমান বলেন, রাস্তার যানজট ও সময় বাঁচানোর জন্য
আমার মতো অনেকেই প্রতিদিনই এই লেকের মধ্য দিয়ে যাতায়াত করেন। নগর জীবন
থেকে একটু স্বস্তি পেতে পরিবারের সদস্যের পাশাপাশি অনেক শিক্ষার্থীকেও
নিত্যদিন আনাগোনা হয় এখানে। কিন্তু ঘুরতে আসা প্রায় সব মানুষকে পরতে হয়
ভিখারিদের কবলে। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এলাকাটিতে ভিক্ষুকমুক্ত
ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ভিক্ষাবৃত্তি তো আর থেমে নেই। এখনো দেদারছে চলছে
ভিক্ষা ব্যবসা। তিনি বলেন, শুধু মাত্র সাইনবোর্ড টানিয়ে রাখলেই এলাকা
ভিক্ষুকমুক্ত হয়ে যায় না। এর জন্য সরকারের সঠিক নজরদারি ও পদক্ষেপ প্রয়োজন।
রাজধানীর বারিধারা, বনানী ও গুলশানের বিভিন্ন স্থানে ‘নবীর শিক্ষা, করো না
ভিক্ষা, ইনকাম করতে হবে, স্বয়ং সম্পূর্ণ হতে হবে, যে মানুষ ভিক্ষা করে তার
যেমন ইজ্জত থাকে না, জাতি হিসাবে তাদেরও ইজ্জত থাকে না’ বিভিন্ন স্লোগানে
ভিক্ষুকমুক্ত সাইনবোর্ড লাগানো থাকলেও দেখা যায় এলাকাগুলোতে ঠিকই চলছে
ভিক্ষাবৃত্তি। গুলশানে অবস্থিত আমেরিকা, কানাডা, জর্মান দূতাবাসের কাছে
পুলিশ বক্সের পাশে বসেও ভিক্ষা করতে দেখা যায় এক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুককে।
এবিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (কার্যক্রম) আবু মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন,
ভিক্ষুকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা এর আগেও কাজ করেছি কিন্তু ব্যর্থ
হয়েছি। এজন্য এখন আমরা নতুন করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরকে
ভিক্ষুকমুক্ত করার লক্ষ্যে, স্ব স্ব জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই কাজ
শুরু করেছি। এই প্রকল্পের আওতায় আমরা বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতার মাধ্যমে
পেশাদারি ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু দেখা যায়
পুনর্বাসিত হওয়ার পরও তারা আবার ভিক্ষা করা শুরু করছে। এজন্য তাদের চিহ্নিত
করে তাদের সাজার মাধ্যমে ভিক্ষা পেশা থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করছি। ঢাকার
পাশাপাশি নিলফামারি, কিশোরগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন
জেলা শহরকেও ভিক্ষুকমুক্ত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
No comments