অনুচ্ছেদ ৭০-এর যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে
দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দিলে সংসদ সদস্য পদ থাকবে না, এমন বিধানসংবলিত সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে এবার প্রশ্ন তুলেছেন খোদ দেশের প্রধান বিচারপতি। ২৪ মে বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের উদ্দেশে বলেছেন, ‘সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ রেখেছেন কেন?’ তিনি আরও প্রশ্ন রাখেন, সরকার কি তার নিজ সংসদ সদস্যদের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না? ইতিপূর্বেও ৭০ অনুচ্ছেদের যৌক্তিকতা নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ সুশীল সমাজ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে প্রোথিত হতে পারেনি, সেখানে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করা কতটা যৌক্তিক হবে তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গৃহীত এবং ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া বাংলাদেশের সংবিধানে (অতঃপর মূল সংবিধান বলে অভিহিত) সংসদ সদস্যদের ইচ্ছাধীন স্বাধীনতা খর্ব করা সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ ৭০ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে বলা হয়, কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি (ক) উক্ত দল হতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট প্রদান করেন, তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে গৃহীত সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ৭০ অনুচ্ছেদে ব্যাখ্যা সংযোজন করা হয়। ব্যাখ্যায় বলা হয়, যদি কোনো সংসদ সদস্য, যে দল তাকে নির্বাচনে প্রার্থীরূপে মনোনীত করেছে, সে দলের নির্দেশ অমান্য করে- (ক) সংসদে উপস্থিত থেকে ভোট দানে বিরত থাকেন, অথবা (খ) সংসদের কোনো বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেছেন বলে গণ্য হবেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের আমলে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনঃপ্রবর্তিত হয়। এ সংশোধনীতে ৭০ অনুচ্ছেদে আরও দুটি ব্যাখ্যা সংযোজন করা হয়। একটি হল, কোনো সময় কোনো রাজনৈতিক দলের সংসদীয় দলের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে এবং স্পিকার বিভক্তি ভোটের দ্বারা উক্ত দলের নেতৃত্ব নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নিলে, কোনো সংসদ সদস্য ভোটদানের ব্যাপারে এরূপে নির্ধারিত নেতৃত্বের নির্দেশ অমান্য করলে তিনি উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং সংসদে তার আসন শূন্য হবে। দ্বিতীয়টি হল, কোনো ব্যক্তি নির্দলীয় প্রার্থীরূপে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করলে তিনি উক্ত দলের প্রার্থীরূপে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বলে গণ্য হবেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিগত শাসনামলে (২০০৯-১৩) সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দ্বাদশ সংশোধনী পর্যন্ত সংশোধিত ৭০ অনুচ্ছেদটি মূল সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদের যৌক্তিকতা নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশসহ সুশীল সমাজ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের যুক্তি হল, অনুচ্ছেদ ৭০ সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এটি সংসদ সদস্যদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে। তাছাড়া, অনুচ্ছেদটি ভোটারদের স্বার্থরক্ষায় সংসদ সদস্যদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করেছে।
তাই তারা ৭০ অনুচ্ছেদের যথোপযুক্ত সংশোধন বা এটি বিলোপের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের অনেকে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭০ থাকার পক্ষে মতপ্রকাশ করেছেন। তাদের মতামতে যেসব বিষয় উঠে এসেছে সেগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল- (ক) সংসদীয় সরকার পদ্ধতিকে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করার জন্য সংবিধানে অনুচ্ছেদ ৭০ অন্তর্ভুক্ত করা হয়; (খ) দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করতে হবে। এখন দেখা যাক আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের সংসদ সদস্যদের আসন শূন্য হওয়া সম্পর্কে কী বিধানাবলী রয়েছে। ভারতের সংবিধান মোতাবেক কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য যেসব কারণে রাজ্যসভা বা লোকসভার সদস্যপদে বহাল থাকার অযোগ্য হবেন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- (ক) স্বেচ্ছায় দলের সদস্যপদ ত্যাগ; অথবা (খ) দলের নির্দেশ উপেক্ষা করে ভোটদান বা দলের অনুমতি ব্যতিরেকে ভোটদানে বিরত থাকা। পাকিস্তানে একজন পার্লামেন্ট সদস্য তার পদে বহাল থাকার অযোগ্য হবেন যদি তিনি নির্বাচনে মনোনয়ন দানকারী দল থেকে পদত্যাগ করেন, অথবা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে, অথবা আস্থা বা অনাস্থা প্রস্তাবে, অথবা অর্থ বিল পাসে, অথবা সংবিধান সংশোধন প্রস্তাবে দলের নির্দেশ অমান্য করে ভোট দেন অথবা ভোটদানে বিরত থাকেন। নেপাল প্রজাতন্ত্রের সংবিধান মোতাবেক কোনো রাজনৈতিক দলের মনোনয়নে নির্বাচিত ফেডারেল পার্লামেন্টের একজন সদস্য তার আসন হারাবেন, যদি তিনি দলত্যাগ করেছেন মর্মে সংশ্লিষ্ট দল বিজ্ঞপ্তি জারি করে। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধান থাকলেও সংবিধান গৃহীত ও কার্যকর হওয়ার তিন বছর পার হতে না হতেই একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর দু’জন সামরিক শাসকের সামরিক ও বেসামরিক পোশাকে প্রায় ১৫ বছর দেশ শাসন, নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে পরবর্তী ১৬ বছর দুই বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের পালাক্রমিক দেশ শাসনকালে তাদের হিংসাত্মক কার্যকলাপের ফলে গণতন্ত্রের পাদপীঠ জাতীয় সংসদ প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়া, কার্যত একদলীয় দশম সংসদ নির্বাচন ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে প্রোথিত হতে পারেনি। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুক্তি ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’ শুধু ভ্রান্ত নয়, বরং তা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও অগ্রগতির পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলেছে। ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’- এ তত্ত্ব অনুসরণ করে চললে গণতন্ত্র তো পাওয়া যাবেই না, এতে দেশের কোনো টেকসই উন্নয়নও ঘটবে না। নির্ভেজাল গণতন্ত্র অনুসরণ করে যে উন্নয়ন করা যায়, পশ্চিমা দেশগুলো এবং পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালে তার অকাট্য প্রমাণ মেলে। সবচেয়ে বড় কথা, যে গণতন্ত্রের জন্য জনগণ মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং তাদের জীবন উৎসর্গ করেছে, সে গণতন্ত্র বাদ দিয়ে উন্নয়ন নয়।
জনগণ চায় গণতন্ত্র ও উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলুক। দেশে গণতন্ত্র, বিশেষ করে সংসদীয় গণতন্ত্র এখনও পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারেনি। সংসদ সদস্যদের ভোটদানে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা কিছুটা খর্ব না করা হলে এবং দলীয় নির্দেশাবলী উপেক্ষার কারণে তাদের আসন শূন্য ঘোষিত হওয়ার বিধান না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্র বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তিন বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ কোনো দলই এখন পর্যন্ত ৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের পক্ষে মত প্রকাশ করেছে বলে মনে পড়ে না। তবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭০ বিলোপ করা না হলেও এটির কিছু সংশোধন প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ভোটদানের ‘অপশন’ সংসদ সদস্যদের ইচ্ছাধীন করা যেতে পারে। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছে- ক. যখন সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তখন সংসদ সদস্যরা তাদের নিজ নিজ দলের অবস্থানের বিপরীতে ভোট দিতে পারবেন না; খ. সংসদে অর্থ বিল পাসের ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা ভোটদানে নিজ নিজ দলের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করতে পারবেন না; গ. সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিলে সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ দলের অবস্থানের বিপরীতে ভোট দিতে পারবেন না; ঘ. স্পর্শকাতর প্রতিরক্ষা বিষয়ে বা অন্য কোনো বিষয়ে অনুষ্ঠিত সংসদের গোপন বৈঠকে সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ দলের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করতে পারবেন না। এসব বিষয়ে দলের নির্দেশ অমান্য করে দলীয় অবস্থানের বিপক্ষে ভোট দিলে অথবা সংসদে উপস্থিত থেকে ভোটদানে বিরত থাকলে, অথবা সংসদের বৈঠকে অনুপস্থিত না থাকলে তিনি ওই দলের বিপক্ষে ভোটদান করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং সংসদে তার আসন শূন্য হবে। অন্য সব ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা ভোটদানে স্বাধীনতা ভোগ করবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে এরূপ সংশোধনী আনা যেতে পারে। এতে সংসদীয় গণতন্ত্র স্থিতিশীল ও শক্তিশালী হবে। আশা করি, ক্ষমতাসীন দলসহ অন্য সব রাজনৈতিক দল বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
No comments