হাসপাতালেও হামলা হয়েছে
আসুন, আমরা বিভীষিকার কথা না বলি। এরপর চলুন, সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশের শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের সারিন নামের যে বিষাক্ত গ্যাস দেওয়া হলো, তার জন্য জরুরি বৈঠক করে আমাদের ঘেন্না প্রস্তাব পাস না করি। ‘সবচেয়ে কঠোর ভাষায়’ আমরা ঘোষণা না দিই। যে কাজ আমরা কোনোভাবে এড়াতে পারব না, আসুন, তার সম্পর্কে আমরা আর ক্লিশে কথা না বলি। আর এই হামলার নিন্দা করাও আমরা বাদ দিই; কারণ, আমাদের নিন্দাগুলো বড় ফাঁপা শোনায়। আমরা জানি, এ ধরনের রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারে মানুষের কী হতে পারে। আপনার পাকস্থলী যদি যথেষ্ট শক্তিশালী হয়, তাহলে আপনি এই ছবিগুলো দেখতে পারেন। সার্ডিন মাছের মতো করে শুইয়ে রাখা শিশুদের মৃতদেহগুলো আপনি দেখতে পারেন।
তারা কীভাবে মারা গেছে, তার বিবরণ আপনি পড়তে পারেন: ‘ওদেরশরীর যন্ত্রণায় মুচড়ে গেছে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ওরা নিশ্বাস নেওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করেছে; ওদের মুখে ফেনা উঠে গিয়েছিল।’ নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, এই শিশুদের এত বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে মারা হয়েছিল যে ‘অনেক উদ্ধারকর্মী মৃতদেহের কাছে গিয়ে অসুস্থ বোধ করে ধরাশায়ী হয়ে যান।’ আমরা জানি, যুদ্ধবিমান থেকে বোমাবর্ষণের পর বিষ ছড়িয়ে পড়ে। আবার কয়েক ঘণ্টা পর যুদ্ধবিমান ফিরে এসে ছোট একটি ক্লিনিকে হামলা চালায়, যেখানে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। ওই এলাকার বড় হাসপাতালে দিন দুয়েক আগে বোমা হামলা হওয়ায় ছোট ক্লিনিকটিতে আহত ও মুমূর্ষু ব্যক্তিদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। আমরা প্রায় নিশ্চিতভাবেই জানি, কারা এই হামলা চালিয়েছে। সব লক্ষণই বলে, বাশার আল-আসাদের সরকার এই হামলা করেছে। কিন্তু আসাদের পান্ডা ও রুশ সহযোগীরা ভিন্ন বয়ান দিয়েছে, সিরিয়ার বিমান নার্ভ এজেন্টের এক স্তূপে হামলা চালালে ওই গ্যাস দুর্ঘটনাবশত বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। ভ্লাদিমির পুতিনের সরকারের ঘোষণা কতটা গুরুত্বসহকারে নিতে হবে, আমরা তা জানি। এর চেয়ে বরং হামিশ ডি ব্রেটন গর্ডনের কথা বেশি বিশ্বাসযোগ্য। এই ব্যক্তি একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রাসায়নিক অস্ত্রবাহী রেজিমেন্টের প্রধান ছিলেন।
তিনি এখন ডক্টরস আন্ডার ফায়ার নামের এক সংগঠনের পরিচালক। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, মস্কোর ব্যাখ্যা ‘অলীক কল্পনাপ্রসূত’, যা ‘ধোপে টেকে না’। তিনি বলেন, ‘সারিন গ্যাসে বোমা মারা মানে সেটা ধ্বংস করা।’ আমরা সবাই এটা জানি। আমরা এ-ও জানি, সিরিয়ায় ছয় বছর ধরে রক্তাক্ত যুদ্ধ চলছে, কিন্তু কিছু হচ্ছে না। এই বিচারহীনতা শুধু এই সর্বশেষ হামলার পরিণতি নয়, বরং এটি তার কারণ। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসন আসাদ সরকারকে আর কিছু না বললেও এটা বলেছে যে তিনি যত খুশি মানুষকে হত্যা করতে পারেন। তা সে যে কায়দায়ই হোক না কেন। মাত্র এই সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলেছেন, ‘দীর্ঘ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট আসাদের কী অবস্থা হবে, তা নির্ধারণ করবে সিরিয়ার জনগণ।’ অন্য কথায়, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়াকে উৎপাত করবে না। গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জাতিসংঘ দূত নিকি হ্যালি বলেছেন, ‘আমরা এখন আর আলোচনা করে আসাদকে হটানোর উপায় বের করব না।’ তবে ট্রাম্প প্রশাসনের দিকে আঙুল তোলা সহজ হলেও আসাদের বাসনা কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে বিস্তৃত। ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তা করেছে। কিন্তু রাশিয়া এতে ভেটো দেয়। হ্যাঁ, তারা তো খুনি বন্ধুকে থামানোর চেষ্টা করবে না। কিন্তু এতে চীনও ভেটো দেয়। তারা শুধু নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেটাও অনেক বেশি কিছু। পৃথিবী তো সিরিয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত অনেক আগেই নিয়েছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই মানুষদের দুঃখ-কষ্ট থামানোর সক্ষমতা তাদের নেই। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেই সদিচ্ছা তাদের নেই। যদিও সেখানে ৪ লাখের বেশি মানুষ মারা পড়েছে এবং ১০ লাখের বেশি মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে। ওবামা প্রশাসনের আন-মেরি শ্লটার আসাদের বিমান যে রানওয়ে ব্যবহার করে, সেখানে হামলা চালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। এটা দখলদারি নয়।
পূর্ণাঙ্গ সামরিক অভিযানও নয়। বরং সিরিয়াকে কৃতকর্মের জন্য একরকম শাস্তি দেওয়া। কিন্তু আপনারা জানেন, এটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করা হবে। এটার বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে এর নিন্দা করা হবে, যদিও আসাদ নিজে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন করেছেন। এমনকি তিনি রাসায়নিক অস্ত্রবিরোধী শতাব্দীপ্রাচীন রীতি ও ঐকমত্য ভেঙেছেন। কথা হচ্ছে, পৃথিবীতে যদি রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা না থাকে বা তা ব্যবহারের শাস্তি না থাকে বা সেটা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে যায়, তাহলে ব্যাপারটা মারাত্মক হয়ে যাবে। আর নিশ্চিতভাবেই এ কথা বলা যায়, আসাদের বিচার না হওয়ার খবরটা বিশ্বের সবচেয়ে নির্মম সরকারগুলো টুকে রাখছে, অর্থাৎ নজির স্থাপন হয়ে গেল। এই ধারণা তৈরি হয়ে গেল, এসব করে পার পাওয়া যায়। এক দশকের বেশির ভাগ সময় ধরে আমরা সঠিকভাবেই ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণের মারাত্মক পরিণতির কথা গুরুত্বসহকারে বলে আসছি। মানুষের দুঃখ-কষ্টের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে আসছি। এর জন্য আমাদের কী মূল্য দিতে হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা সবাই সচেতন। কিন্তু খান সিকনের হামলায় মৃত ব্যক্তিরা আমাদের নতুন হিসাব করতে বাধ্য করছে। আমরা বাধ্য হয়ে দেখছি, ব্যবস্থা না নেওয়ার পরিণতিও মারাত্মক হতে পারে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।
জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড: দ্য গার্ডিয়ান–এর কলামিস্ট।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।
জোনাথন ফ্রিডল্যান্ড: দ্য গার্ডিয়ান–এর কলামিস্ট।
No comments