এবার চলনবিলে কৃষকের স্বপ্নভঙ্গ
অতিবৃষ্টিতে শস্যভাণ্ডারখ্যাত নাটোরের চলনবিল ডুবে গেছে। বিলদহর-কৃষ্ণনগর বাঁধ দিয়ে আসা আত্রাই ও গুড় নদীর পানিতে ভেসে গেছে দেশের সবচেয়ে বড় এ বিল। তলিয়ে গেছে বোরো ধান, আলু, বাদাম, ভুট্টা, পাট, তরমুজ, করলাসহ অন্যান্য ফসল। সেই সঙ্গে ডুবেছে এ অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষকের স্বপ্ন। ধান কাটার জন্য মাইকিং করে শ্রমিক ডাকা হচ্ছে। বাড়তি মজুরি দিয়েও শ্রমিক মিলছে না। ফলে চোখের সামনেই ধানসহ অন্যান্য ফসল পানির নিচে পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পুকুর উপচে ভেসে গেছে লাখ লাখ টাকার মাছ। সব হারিয়ে কৃষক নিঃস্ব। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠছে চলনবিলের বাতাস। নাটোর, সিংড়া, নিয়ামতপুর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে এসব জানা গেছে। কয়েক দিনের অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং সিলেট অঞ্চলের সব হাওর ডুবে গেছে। এতে লাখ লাখ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে। এরপর শস্যভাণ্ডারখ্যাত সবচেয়ে বড় চলনবিলও ডুবে গেল। এতে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান, পাট, আলু, ভুট্টা, বাদাম ও করলাসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল ভেসে গেছে। এতে এবার বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হতে পারে। ফলে আরও বাড়তে পারে চালের দাম। এছাড়া অতিবর্ষণে সবজির ক্ষতি হওয়ায় আসন্ন রমজানে কাঁচাবাজারে এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। নাটোরে সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, নলডাঙ্গা, নিয়ামতপুর, চন্দননগর, ভাবিচা, শ্রীমন্তপুর, বাহাদুরপুরে কয়েক হাজার হেক্টর জমি থেকে কোনো ফসল তোলা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এসব এলাকার ছোটবড় সব চাষী বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন। স্থানীয় বিশিষ্টজনদের মতে, বিল এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা, কালভার্ট নির্মাণ এবং ফসলি জমিতে ইচ্ছেমতো পুকুর খননই এ দুর্যোগের মূল কারণ। নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, অসময়ে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে এসেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের জন্য তালিকা তৈরি করতে কৃষি অধিদফতরের উপপরিচালককে চিঠি দেয়া হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে ত্রাণ সহায়তা দেয়ার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কর্মকর্তাকেও চিঠি দেয়া হয়েছে। উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, আকস্মিক বর্ষণ ও ঢলের পানিতে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বিষয়ে জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ ফসল রক্ষায় একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আত্রাই নদীতে ঢলের পানি উপচে চলনবিলে প্রবেশ করায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে নদীর পানি কমে গেলে কৃষকের ক্ষতি কম হতে পারে। স্থানীয়রা জানান, সিংড়া এলাকায় আত্রাই নদীর কাছে বিলদহর-কৃষ্ণনগর এলাকায় বাঁধ আছে। নিজেদের সুবিধার জন্য স্থানীয় মৎস্যজীবীরা ২০১১ সালে বাঁধের একটি অংশ কেটে দেন। এ বাঁধের কাটা অংশ দিয়ে আত্রাই নদী থেকে প্রচণ্ড সে াতে মঙ্গলবার বিকাল থেকে চলনবিলে পানি ঢুকতে দেখা গেছে। এতে পাকা-আধাপাকা ধান, পাট, ভুট্টা, বাদাম, আলু, করলা, তরমুজের জমি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক কৃষক বলেন, বাঁধ কাটার কারণে প্রতিবছর চলনবিলের লক্ষাধিক কৃষক আতঙ্কে থাকেন।
এ অঞ্চলের কৃষকের স্বপ্ন জোয়ার-ভাটার মতো চলনবিলের পানিতে ভাসতে থাকে। এবার আতঙ্কই সত্যি হয়েছে। এবারের স্বপ্ন ভাটার টানে ভেসে গেছে। পানিতে ডুবে যাওয়া অন্যান্য ফসল ঘরে তুলতে না পারলেও জরুরিভাবে ধান কাটতে কয়েক দিন ধরেই স্থানীয়ভাবে মাইকিং করে দিনমজুর ডাকা হচ্ছে। বিলদহর বাজার এলাকার কৃষক মো. আবদুল কাদের মণ্ডল জানান, তার চাষ করা ৪৫ বিঘা জমির সবই পানিতে ডুবে গেছে। ধান কাটার জন্য তিনি দিনমজুর পাচ্ছেন না। অন্যান্য মৌসুমে ২৫০ টাকা চুক্তিতে শ্রমিক পাওয়া গেলেও এবার ৭০০ টাকা দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে স্থানীয়রা জানান, পানিতে ডুব দিয়ে ধান কাটা খুব কষ্টের। শ্রমিকরা সারা দিন পানিতে ডুবে ধান কাটতে চাচ্ছেন না। ফলে বেশি মজুরি দিয়েও শ্রমিক মিলছে না। রংপুর, দিনাজপুর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ধান কাটতে আসা অনেক শ্রমিক তাদের সরঞ্জাম নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। কৃষ্ণনগর গ্রামের কৃষক আবু সাঈদ ও মজিবুর রহমান বলেন, চলনবিলের অধিকাংশ কৃষক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করেন। হঠাৎ ঢলের পানিতে ফসল ডুবে যাওয়ায় তাদের স্বপ্ন পানির নিচে চলে গেছে। এখন কীভাবে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবেন, সেই চিন্তায় তাদের ঘুম চলে গেছে। গুরুদাসপুরে টানা কয়েক দিনের ভারি বৃষ্টিতে পাকা ধান পানিতে ডুবে যাওয়ায় কৃষক দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। গুরুদাসপুর উপজেলার দরদমা, বিলশা, পিপলা, হাঁড়িভাঙা, চাকলবিলে বৃষ্টির পানি জমে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অতিবৃষ্টিতে জমিতে পানি আটকে থাকায় আতঙ্কে কৃষক পাকা ধানের পাশাপাশি আধাপাকা ধান কাটতে শুরু করেছেন। একদিকে দ্রুত পানি ঢুকছে, অন্যদিকে টাকা দিয়েও শ্রমিক মিলছে না। বিলশা গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন বলেন, এলাকায় সর্বনাশ হয়ে গেছে। ধান ডুবার পাশাপাশি পুকুর থেকে লাখ লাখ টাকার মাছও ভেসে গেছে। আমরা কী খেয়ে বাঁচব, এখন এ চিন্তায় আছি। পিপলা গ্রামের বেলাল হোসেন জানান, তার ৩০ বিঘার প্রজেক্ট। ধান চাষ করতে ঋণ নিয়েছেন। এখন কীভাবে ঋণ পরিশোধ করবেন, তা নিয়েই বিপাকে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘ধান কাটব যে কামলাও মিলছে না। ভুট্টারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।’ বিয়াঘাট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেন, চলনবিল অধ্যুষিত এলাকায় কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবার অনেকে আতঙ্কে কাঁচা ধান কাটছেন। তিনি বলেন, অপরিকল্পিত অবৈধ পুকুর খননের কারণে মূলত এ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বড়াইগ্রাম উপজেলায় জালোরা বিল, চিনিডাঙ্গা বিল, ভিটাকাজীপুর বিল ও কচুগাড়িবিল, মাড়িয়া, বাজিতপুর, শ্রীরামপুরসহ বিভিন্ন নিন্মাঞ্চলে বৃষ্টির পানিতে ফসল ডুবে গেছে। এতে করে বড়াইগ্রামের সহশ্রাধিক কৃষক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। স্থানীয় কৃষক জানান, বড়াইগ্রামে ধানের তেমন ক্ষতি না হলেও পাট, তরমুজ, করলা ভুট্টার জমি বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করলা এবং পাটক্ষেত প্রায় সবটাই পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেক জায়গায় কাঁচা-পাকা তরমুজ পানিতে ভাসতে দেখা গেছে।
No comments