ভয়াবহ রূপ নিয়েছে চেক জালিয়াতি
ব্যাংকের চেক জালিয়াতির ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। প্রতি মাসেই ২০ থেকে ২৫টি চেক জালিয়াতির অভিযোগ আসছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র চেক জালিয়াতির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আবার মেয়াদি হিসাব জামানত রেখে ঋণ সৃষ্টি, অতঃপর ভুয়া চেকের মাধ্যমে অর্থ অন্য হিসাবে স্থানান্তরের ঘটনা অহরহ ঘটছে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের হিসাবে অর্থ ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলেও অনেক ব্যাংক বিভিন্ন অজুহাতে তা মানছে না। আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্নের নামে ব্যাংক প্রক্রিয়া বিলম্বিত করার অভিযোগ উঠেছে। এমনি পরিস্থিতিতে চেক জালিয়াতি ঠেকাতে ব্যাংকগুলোর জন্য কঠোর নির্দেশনা আসছে। আজ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিতব্য ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের বৈঠকে গভর্নর ফজলে কবির কঠোর বার্তা দেবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং খাতে চেক জালিয়াতির ঘটনা হঠাৎ বেড়ে গেছে। গত অর্থবছরে চেক জালিয়াতিসংক্রান্ত অভিযোগ ছিল ২০৯টি। আর এবার প্রতি মাসেই ২০ থেকে ২৫টি চেক জালিয়াতিসংক্রান্ত অভিযোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রাহক স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রে (সিআইপিসি) জমা পড়েছে। গত অর্থবছরে চেকসংক্রান্ত অভিযোগের বেশির ভাগই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় নিষ্পত্তি করা হয়েছিল।একটি সঙ্ঘবদ্ধ চক্র অহরহই এ চেক জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের হিসাব থেকে লাখ লাখ টাকা তুলে নিচ্ছে। গ্রাহকের চেকের বইয়ের পাতা হুবহু নকল কিভাবে করে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, তাদের তদন্তে চেক জালিয়াতির সাথে চেক প্রস্তুতকারী কিছু কোম্পানি লোকজন জড়িত থাকতে পারে বলে তাদের কাছে মনে হয়েছে। আর এ কাজে সহযোগিতা করছে ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। বিভিন্ন সময়ে তদন্তে এর সত্যতাও মিলছে। এ ছাড়া গত মাসে এক সার্কুলারে চেক জালিয়াতি ইস্যুতে গ্রাহককে সুরক্ষা ও তার ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে। ওই সার্কুলার কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বীকার করে বলেছে, চেক জাল করে গ্রাহকের হিসাব হতে অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতি বা প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। ব্যাংকের কিছু কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হতে পারে। তা ছাড়া চেকের পাতা বা চেকবই চুরি করে, চেক জালিয়াতি বা সিস্টেমের ত্রুটিজনিত কারণে এবং আইটি সিস্টেম অপব্যবহারের মাধ্যমেও এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত হতে পারে। এতে আরো বলা হয়, সাধারণত অর্থ জালিয়াতির ঘটনা উদঘাটিত হওয়ার সাথে সাথে ব্যাংক কর্তৃক আদালতে মামলা দায়ের করা হয়। মামলা নিষ্পত্তি সময়সাপেক্ষ বিধায় এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের নিজস্ব তদন্তে গ্রাহকের কোনোরূপ সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হলে গ্রাহকের কাছ থেকে মুচলেকা (ইনডেমনিটি বন্ড) গ্রহণপূর্বক আত্মসাৎকৃত অর্থ গ্রাহককে প্রদান করা যুক্তিযুক্ত হবে। সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক ব্যবস্থার নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রাহকের চেক ইস্যুতে ম্যাগনেটিক ইঙ্ক ক্যারেক্টর রিকগ্নিশন (এমআইসিআর) বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরও নকল চেকের প্রবণতা ঠেকানো যাচ্ছে না।
ব্যাংক গ্রাহককে নির্দিষ্ট পাতার একটি চেক বই হস্তান্তর করে। কিন্তু এর মধ্যে একই সিরিয়ালের কয়েকটি ভুয়া পাতা তৈরি করা হচ্ছে। ডুপ্লিকেট ওই পাতা ব্যবহারের মাধ্যমে গ্রাহকের হিসাব থেকে অর্থ তুলে নিচ্ছে। তবে অর্থ হস্তান্তরের আগে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের স্বাক্ষর যথাযথভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যাংকের উদাসীনতা রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার প্রমাণও পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, সাধারণ চেকের জালিয়াতি ঠেকানো ও লেনদেনে গতি আনতে ম্যাগনেটিক ইঙ্ক ক্যারেক্টার রিকগ্নিশন (এমআইসিআর) নামের আধুনিক চেক বাংলাদেশে চালু করা হয় ২০০৯ সালে। তবে ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে তা সব ব্যাংকের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়। সূত্র বলছে, অনলাইন ব্যাংকিং চালু, এমআইসিআর চেক প্রচলন ও অটোমেটেড কিয়ারিং হাউজ চালু হওয়ার পর ব্যাংকিং খাতে চেক নিষ্পত্তিতে নতুন গতি পায়। অনলাইন ব্যাংকিংয়ের কারণে গ্রাহকেরা যে শাখায় অ্যাকাউন্ট, সেই শাখা ছাড়াও ব্যাংকের অনলাইনভুক্ত অন্যান্য শাখা থেকেও টাকা তুলতে ও জমা দিতে পারেন। এতে চেক উপস্থাপনকালীন সময়ে তা যাচাইয়ের জন্য ফিজিক্যালি প্লেস ব্যাংকের কাছে যেতে হয় না। ইমেজ দেখেই সব কিছু করে থাকে পেয়িং ব্যাংক। ফলে চেকের যেকোনো ধরনের টেম্পারিং সহজে বোঝার উপায় থাকে না। তা ছাড়া বাজারে এমন কিছু কেমিক্যাল পাওয়া যায়, যা দিয়ে আসল চেকের অনেক তথ্য তুলে ফেলা যায়। পরে পছন্দমতো নামে সেই চেক হুবহু প্রিন্ট করা যায়। সিগন্যাচারও স্ক্যান করা যায়। এ জন্য চেক জালিয়াতি করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে জালিয়াতচক্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, চেক জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কাছে সম্প্রতি কোনো একটি ব্যাংকের গ্রাহক আবেদন করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন তিনি। সেই আলোকে ব্যাংকার্স সভায় এ-সংক্রান্ত একটি এজেন্ডা রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন গভর্নর।
No comments