দাদনের টাকা শোধে দিশেহারা
আকস্মিক অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে হবিগঞ্জের প্রায় সব হাওরই। পানিতে তলিয়ে গেছে প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ফসল। এর মাঝে অধিকাংশই কাঁচা ধান, যা পানির নিচে থাকায় পচতে শুরু করেছে। চোখের সামনে ফসল নষ্ট হতে দেখে জেলার লক্ষাধিক কৃষক পরিবারে হাহাকার দেখা দিয়েছে। অনেকেই দাদন নিয়ে চাষাবাদ করলেও সে টাকা পরিশোধ নিয়ে এখন তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এদিকে হাওরে ৯টি প্রকল্পের অধীন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ৩৯টি স্থানে ৮ কিলোমিটার এলাকা সংস্কার করা হয়েছিল। এতে ব্যয় হয় ১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা, যা কোনো কাজে আসেনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম জানান, বিভিন্ন নদীসহ হাওর এলাকায় জেলায় ৪শ’ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মাঝে ২৫০ কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধ। এগুলো এপ্রিলের ৩০ তারিখের পর পানিতে প্লাবিত হয়। কিন্তু গত ২০ বছরের পরিসংখ্যানে এ বছর অন্যান্য বছরের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে পানি হাওরে ঢুকে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নদীগুলোর পানিও ২ এপ্রিল থেকেই বিপদসীমার উপরে ছিল। কুশিয়ারা নদীর পানি এখনও বিপদসীমার অনেক উপরে রয়েছে। এতে দিনে দিনে নদীর বাঁধগুলোও দুর্বল হয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যে খোয়াই নদীর লাখাই উপজেলার বুল্লায় ২২০ মিটার বাঁধ ভেঙে গেছে। বাঁধ সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারের মাধ্যমে ৮ কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধের সংস্কার হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান মণ্ডল জানান, জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। বুধবার পর্যন্ত ৫৫ হাজার ৫৬৫ জনের তালিকা পাওয়া গেছে। তালিকা তৈরির কাজ শেষ হয়নি। সময় লাগছে কারণ একেকটি ইউনিয়নে মাত্র একজন করে লোক কাজ করছে।
পুরো তালিকা তৈরিতে আরও বেশ কয়েক দিন সময় লাগবে। বুল্লা ইউপি চেয়ারম্যান শেখ মুক্তার হোসেন বেনু জানান, তার ইউনিয়নের অধিকাংশ কৃষকই দাদন নিয়ে চাষাবাদ করেছিলেন। ধান তুলে সে টাকা পরিশোধের কথা ছিল। প্রতি বছরই কৃষকরা দাদন নিয়ে চাষাবাদ করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ১ হাজার টাকার বিনিময়ে ২ থেেেক ৩ মণ করে ধান দেয়ার কথা থাকে। ধান কাটার পর তারা তা পরিশোধ করে। কিন্তু এ বছর আকস্মিক বন্যায় সব তলিয়ে যাওয়ায় এখন তারা সে টাকা কীভাবে পরিশোধ করবে এ নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি কৃষকদের সরকারি সহায়তা দেয়ার দাবি জানান। লাখাই উপজেলার বুল্লা ইউনিয়নের বাসিন্দা কৃষক জমির আলী জানান, ২০ হাজার টাকা দাদন নিয়ে ৪ কাঠা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছিলাম। কিন্তু পানিতে সব জমি তলিয়ে গেছে। এখন ঋণের টাকা কিভাবে শোধ করবো তা নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলার ৮টি উপজেলায় মোট ১ লাখ ১৬ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছিল। এপ্রিলের শুরুতেই ভারি বৃষ্টিপাতে জেলার হাওর এলাকার আবাদকৃত প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমি পানিতে তলিয়ে যায়। বাকি জমি কিছুটা রক্ষা পেলেও কয়েক দিনের অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে তাও শেষ রক্ষা হয়নি। জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৫৩ হাজার ৫৬৫ জন কৃষকের তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যা ক্ষতিগ্রস্তদের অর্ধেকের বেশি হবে না। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বানিয়াচংয়ে ২৫ হাজার ৭২০, লাখাইয়ে ৮ হাজার ১৭০, আজমিরীগঞ্জে ৮ হাজার ৫৯৫, নবীগঞ্জে ৫ হাজার ৫শ’, সদরে ২ হাজার, বাহুবলে ১ হাজার ৮শ’, মাধবপুরে ১ হাজার ৩শ’ ও চুনারুঘাটে ৩৫০ জন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, জেলার বানিয়াচং উপজেলায় মাকালকান্দি হাওর প্রকল্প, কুশিয়ারা বাম বাঁধ প্রকল্প, শুঁটকি নদী এফসিডি প্রকল্প, ঝিংড়ি নদী প্রকল্প, সদর, চুনারুঘাট, বাহুবল, বানিয়াচং ও লাখাই উপজেলায় খোয়াই নদী প্রকল্প ও গুইংগাজুরী এফসিডি প্রকল্প, আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচংয়ে বসিরা নদী বামতীর ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ ও কৈয়ারঢালা-রতœা এফসিডিআই প্রকল্প এবং মাধবপুরে হরিসীমা ও ধনিসমীমা হাওর এফসিডি প্রকল্পের মোট ৩৯৯ কিলোমিটার ২৭০ মিটার বাঁধ রয়েছে। এর মাঝে ২৫০ কিলোমিটার হাওরে ডুবন্ত বাঁধ। এ প্রকল্পগুলোর আওতায় ৩৯টি অংশে মোট ১ কোটি ৯৪ লাখ টাকার সংস্কার হয়, যা কৃষকদের কোনো কাজে আসেনি।
No comments