কিছু মানুষের উন্নতি দেশের উন্নয়ন নয়
দেশের মুষ্টিমেয় মানুষের উন্নতি আসল উন্নয়ন নয় এবং এর ফল কখনো ভালো হয় না বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ডেনভারের অর্থনীতির শিক্ষক অধ্যাপক হায়দার আলী খান, যিনি একজন বাংলাদেশি। তাঁর কাছে উন্নয়ন মানে দেশের আপামর জনগণের উন্নয়ন, ঢাকার অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী অভিজাত কিছু মানুষের উন্নতি নয়। প্রথম আলোর কার্যালয়ে অতিথি হিসেবে এসে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে হায়দার খান বলেন, শুধু মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ যদি ভালো থাকে, তার ফল ভবিষ্যতে মোটেই ভালো হবে না। যারা গুলশান-বনানীতে বাস করে, বিদেশে যায়, বিদেশে বাড়ি কেনে, বিদেশে ছেলেমেয়েদের পড়ায়; সেটা তাদের উন্নতি, দেশের উন্নয়ন নয়। হায়দার খান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। বাংলাদেশে এসে তিনি গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর কার্যালয়ে আসেন। এ সময় সংবাদকর্মীদের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা বৈশ্বিক পরিস্থিতি, বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের অর্থনীতি, সুশাসন, বিভিন্ন দেশের উন্নয়ন অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে কথা বলেন তিনি। হায়দার আলী খানের পরিচয় অনেক। একাধারে তিনি অর্থনীতিবিদ, লেখক, কবিতার অনুবাদক। গান গাইতে পছন্দ করেন।
বর্তমানে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ইউনাইটেড ন্যাশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) জ্যেষ্ঠ অর্থনীতি-বিষয়ক পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। ছাত্রজীবনে তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিল গণিত, পদার্থবিদ্যা ও সাহিত্য। যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে পড়া শেষ করে তিনি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ (এডিবি) বিভিন্ন সংস্থায় পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। জাপান, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। হায়দার আলী খানের আলোচনায় শুরুতে আসে বৈশ্বিক পরিস্থিতি। তিনি বলেন, বিশ্বায়ন কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। শুরুতে মনে করা হয়েছিল বাজার খুলে দিলে সব দেশ উন্নয়নের দিকে ধাবিত হবে, সবার উন্নতি হবে। তবে দেখা গেল, তা হয়নি। এ ছাড়া চীন ও ভারতের মতো কিছু দেশ সেভাবে বিশ্বায়নের দিকে যায়নি। তিনি বলেন, যেসব দেশে উন্নয়ন হয় তাও পুরোটা বিশ্বায়নের জন্য নয়, এর পেছনে ভালো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আছে। ইউরোপে গ্রিস, পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইতালিসহ কিছু দেশ অন্যদের তুলনায় উন্নতি করতে পারেনি উল্লেখ করে হায়দার আলী খান বলেন, এসব দেশের মানুষকে আর বুঝিয়ে-সুজিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তারা দেখছে তাদের উন্নতি হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তীব্র ডানপন্থীদের উত্থান হচ্ছে ঠিকই, কিছু শুভচিন্তাও থেমে নেই। তাই তিনি হতাশ নন। বাংলাদেশের উন্নয়নবাদিতা ও গণতন্ত্র নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করা হয় হায়দার আলী খানকে। এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের সমস্যা বাংলাদেশকেই সমাধান করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সাহেবদের এনে সমস্যার সমাধান হবে না, সাহেব যত ভালো মানুষই হোন না কেন। অনেক পয়সা খরচ করে বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে লাভ নেই। তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে না, জানার সুযোগও নেই। কারণ তারা ভাষা জানে না। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে তাকানো দরকার।
অনেক পরনির্ভরতার ভেতরেও উন্নতি করেছে। তারা স্নায়ুযুদ্ধে প্রথম সারির দেশ ছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের অনেক কথাই তাদের মেনে চলতে হয়েছে। তারা খুব চতুরতার সঙ্গে সুযোগটাকে ব্যবহার করেছে। অভ্যন্তরীণ নীতিতে শক্তিশালী ছিল। তবে তারা পুঁজিবাদী দেশ, রাজনৈতিক ক্ষমতা কখনোই জনগণের কাছে যায়নি। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব পেলে কী কী সমস্যা সমাধানে জোর দিতেন—এ প্রশ্নের জবাবে অবকাঠামো, দক্ষতার ঘাটতি—এসব গতানুগতিক কথা বলেননি হায়দার আলী খান। তাঁর মতে, বাংলাদেশে দরকার ভূমির সুষম বণ্টন, যেখানে কৃষকেরা সমবায় ভিত্তিতে উৎপাদন করবেন। আরেকটি দরকার কারখানায় মালিক-শ্রমিক সমঝোতা। এ ক্ষেত্রে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘটনা উল্লেখ করেন, যেখানে মার্কিন শ্রমিকনেতারা প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের কাছে গিয়েছিলেন তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে। প্রেসিডেন্ট শ্রমিক নেতাদের বলেন, ‘দেন মেক মি ডু ইট’ (তাহলে আমাকে এটা করতে বাধ্য করাও)। হায়দার আলী খান বলেন, রুজভেল্ট মূলত শ্রমিকনেতাদের আন্দোলন করতে বলেছিলেন, যাতে সিদ্ধান্তগুলো নিতে তাঁর সুবিধা হয়। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এসে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আওয়ামী লীগেও এমন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোক আছে। আলোচনা শেষ হয় মৃণাল সেনের নীল আকাশের নিচে নামের একটি চলচ্চিত্রে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা দুটি গান দিয়ে। হায়দার আলী খান নিজ গলায় এ গান দুটি শোনান। একটি হলো ‘নীল আকাশের নিচে’, অন্যটি ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’।
No comments