সিরিয়া সংকটে ফ্রান্সের দরকার নেই
এ বছরের ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী ডানপন্থী মেরিন লা পেন বৈরুতে কিছুটা বাজিমাত করার চেষ্টা করছেন। তিনি যেন ফ্রান্সের নির্বাচনী প্রচারণার তোড়ে ভাসতে ভাসতে সেখানে গেছেন। ওই দেশে গিয়ে আবার সুন্নিদের বড় মুফতির সঙ্গে বোরকা পরে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। লেবাননের প্রেসিডেন্টকে তিনি যেসব কাণ্ডজ্ঞানহীন কথা বলেছেন এবং সেখানকার ফরাসি ভাষার সংবাদপত্রকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তা অনেক লেবানীয় নাগরিকের কাছে মনে হয়েছে, তিনি লেবাননের মুসলমানদের অপমান করার জন্যই সেখানে এসেছেন। অবশ্যই, এটা ছিল তাঁর প্রচারণা চমক। মেরিন লা পেন ফরাসি পাসপোর্টধারী লেবানীয় খ্রিষ্টানদের নিয়ে মাথা ঘামান না। তাঁর সংগঠন ফ্রন্ট ন্যাশনাল যেভাবেই হোক এটা চায় যে দ্বৈত নাগরিকেরা যেন একটি দেশ বেছে নেন।
ফলে লেবাননের বেচারা খ্রিষ্টানেরা যদি চায়, ফ্রান্স তাদের ‘মুসলমানদের’ হাত থেকে বাঁচাবে, তাহলে তাদের জন্মভূমি ছাড়তে হবে। সম্ভবত, লেবাননের খ্রিষ্টানদের প্রতি লা পেনের ভালোবাসা রয়েছে। তবে তিনি যে দেশটির বড় মুফতির প্রতি সম্মান জানাতে স্কার্ফ পরেননি, সেটা একটি ইঙ্গিত, যার লক্ষ্য ছিল তাঁর নিজ দেশের মানুষেরা। লেবাননের দ্রুজ নেতা ওয়ালিদ জুমব্লাট যে প্যারিস সফরের সময় ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে লা পেনের সফরকে লেবানীয় জনগণের জন্য অপমানজনক আখ্যা দিয়েছেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। ওই বৈঠকে লা পেনেরও উপস্থিত থাকা উচিত ছিল। ওয়ালিদের কণ্ঠস্বর মৃদু হলেও তিনি দৃঢ়চেতা মানুষ। তিনি মৃদুস্বরেই ওলাঁদকে বলেছেন, ‘আমি আশা করি, ফ্রান্স লা পেনের মতো ডানপন্থী ফ্যাসিস্টের চেয়ে ভালো কাউকে পাঠাবে।’ লা পেন যে লেবানন-সিরিয়া সংকটে হস্তক্ষেপ করে নানা কোন্দল তৈরির চেষ্টা করেছেন, বোরকা সেই সত্যকে সফলভাবে আড়াল করেছে। যে কারণে লেবানন ৪০ বছর ধরে ক্ষণে ক্ষণে আক্রান্ত হয়েছে। এই লা পেন প্রথম যে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তিনি হলেন লেবাননের নতুন প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন। প্রাসাদে ঢোকার আগ পর্যন্ত যাঁর পরিচিতি ছিল অনেকটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতোই। একসময় এই মিশেল সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফেজ আল-আসাদের জাত শত্রু ছিলেন। তবে পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে সিরিয়ার বন্ধু হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি লেবাননের প্রেসিডেন্ট হতে এতই মরিয়া ছিলেন যে সিরিয়ার মিত্র বাহিনী অর্থাৎ লেবাননের শিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর সঙ্গে তিনি জোট বাঁধেন। ফলে লা পেন যখন আইএসবিরোধী যুদ্ধে হাফেজের ছেলে বাশারের সঙ্গে,
তখন আউন খুব একটা বিরোধিতা করেননি। কিন্তু আউনের সুন্নি প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি হঠাৎ করেই লা পেনের ওপর খেপেছেন। কারণ লা মুসলিম বিশ্বাসের সঙ্গে ইসলামি মৌলবাদকে এক করে ফেলেছেন। তিনি তাঁকে কড়াভাবে বলেছেন, ‘মধ্যপন্থী মুসলমানরা’ ব্যাপক হারে ‘সন্ত্রাসবাদের’ প্রথম শিকারে পরিণত হচ্ছে। ওদিকে লেবাননের যে খ্রিষ্টান নেতারা তাঁকে সমর্থন করবেন বলে লা ভেবেছিলেন, তাঁরাও তাঁর সমালোচনা করেছেন। কারণ, লা বলেছেন, ফ্রান্স সিরিয়ার যুদ্ধে বাশার আল-আসাদকে সমর্থন করবে। তো লা পেনকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, তিনি বাশার আল-আসাদের সঙ্গে দেখা করবেন কি না, তখন তিনি জবাব দেন, ‘অবশ্যই। কারণ, আমি সবাইকে পাশে চাই। ফ্রান্স ও জার্মানি যদি শান্তিচুক্তি করতে পারে, তাহলে লেবানন ও সিরিয়াও পারবে। আর লড়াইটা যেহেতু অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে, তাই আশা করি, শান্তি স্থাপন করা সম্ভব। দৃশ্যত, এই অভিন্ন শত্রু হচ্ছে ইসলামিক স্টেট...এই যুদ্ধের শুরুতে একমাত্র আমি এ কথা বলেছিলাম যে বাশার আল-আসাদের পতনে সাহায্য করা মানে আইএসকে সিরিয়া দখল করতে দেওয়া।’ এই তুলনা যে মিথ্যা, তাতে সন্দেহ নেই। ব্যাপারটা কৌতূহলোদ্দীপক, লা পেন লেবাননের সঙ্গে ফ্রান্স এবং সিরিয়ার সঙ্গে সাবেক নাৎসি জার্মানির তুলনা করেছেন। কিন্তু সত্য হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ইউরোপ কোনো অভিন্ন শত্রুর মোকাবিলা করতে শান্তি স্থাপন করেনি। বরং এটা নিশ্চিত করতে শান্তি স্থাপন করা হয়েছিল যে ইউরোপীয়রা আর কখনো যুদ্ধ করতে চায় না। কিন্তু লা পেন যেন থামার মানুষ নন। এমনকি তিনি এ-ও মনে করেন, লেবানন তো লাখ লাখ সিরীয় শরণার্থীর চাপে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে, তাই তাদের উচিত হবে, যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র এদের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া। এর মাধ্যমে তিনি নিজের অভিবাসীবিরোধী রাজনীতি লেবাননের গায়ে চড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। ব্যাপারটা খারাপ হয়েছে, কারণ লা পেন পরিষ্কারভাবে জানতেন না, লাখ লাখ লেবানীয় নাগরিকের সঙ্গে সিরীয়দের আত্মীয়তা আছে।
তারা অনেকেই সিরীয়দের সম্প্রসারিত পরিবারের মতো। বস্তুত, বিপুলসংখ্যক লেবানীয় নিজেদের প্রথমত সিরীয় ভাবতে পছন্দ করে। হ্যাঁ, লা পেনের প্রিয় ফ্রান্স প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন সিরিয়া কেটে লেবানন এবং দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত বানাল, তার আগ পর্যন্ত ব্যাপারটা এমনই ছিল। লা পেন লেবানীয় প্রেসিডেন্ট আউনকে দেশটির খ্রিষ্টানদের বিশেষ রক্ষক মনে করেন। এ মাসে মিসর সফরে যাওয়ার সময় তিনি প্রকাশ্যে বলেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যূহে হিজবুল্লাহও লেবাননের অংশ, কারণ লেবানীয় সেনাবাহিনী ‘দুর্বল’। কিন্তু লেবানীয় সেনাবাহিনী যদি ফ্রান্সের প্রতিশ্রুত ৩০০ কোটি ডলারের অস্ত্র পায়, তাহলে তারা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। যে অস্ত্রের টাকা পরিশোধ করবে সৌদি আরব। কিন্তু যে সেনাবাহিনী শিয়া হিজবুল্লাহকে নিয়ে যুদ্ধ করছে, সুন্নি সৌদিরা তার জন্য কেন অস্ত্র কিনে দেবে? কারণ, এই হিজবুল্লাহরা বাশার আল-আসাদের বাহিনীর সঙ্গেও যুদ্ধ করছে, যে আসাদকে সৌদি আরব উৎখাত করতে চায়। কিন্তু আউনের এই কথা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৭০১ নম্বর প্রস্তাবের লঙ্ঘন। জাতিসংঘ লেবাননের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে ইসরায়েল-লেবানন সীমান্তে সেনা পাঠিয়েছে। বৈরুতে নিযুক্ত জাতিসংঘের প্রতিনিধি যখন আউনের কথায় আপত্তি জানালেন, তখন তাঁকে বলা হলো, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কিন্তু একটি ব্যাপার নিশ্চিত। লা পেন যত দিন প্রেসিডেন্ট না হচ্ছেন, তত দিন সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ লা পেনের ব্যাপারে অনেক সতর্ক থাকবেন। তিনি ও তাঁর মিত্ররা এখনো আইএস, নুসরাসহ অন্যান্য বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিতে চলেছেন, যার মধ্যে রাশিয়াও আছে। এর জন্য তাঁদের ফ্রান্সের সহায়তা লাগেনি। এখন তাহলে ফ্রন্ট ন্যাশনালকে কার দরকার হবে?
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।
No comments