পরিবহন ধর্মঘটে দিন–রাত দুর্ভোগ
পরিবহনশ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে সারা দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা থেকে দূরপাল্লার কোনো বাস ছাড়েনি, ঢাকার বাইরে থেকে কোনো বাস আসেওনি। অভ্যন্তরীণ পথেও বাস চলেনি। রাজধানীতে বাস চলেছে হাতে গোনা। সারা দেশে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় মানুষকে দিন-রাত চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। চলেনি ট্রাকও। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাইক্রোবাস, অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচলেও ধর্মঘটী শ্রমিকেরা বাধা দিয়েছেন। কোথাও কোথাও এসব যানের চালকদের মারধর ও যান ভাঙচুর করা হয়েছে। রাতে রাজধানীর গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের সামনে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে পুলিশের চারজন সদস্যসহ আটজন আহত হয়েছেন। সংঘর্ষের সময় টার্মিনালের সামনের সড়কে অ্যাম্বুলেন্সসহ ৩০-৪০টির মতো যান ভাঙচুর করা হয়। রাজধানীতে বাসের অভাবে অনেককে দূরদূরান্ত থেকে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হয়েছে। অনেকে অভিযোগ করেন, আন্দোলনরত শ্রমিকেরা মাঝপথে বাস আটকে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়েছেন। দাবি আদায়ে এভাবে যাত্রীদের জিম্মি করার তীব্র নিন্দা জানান তাঁরা। তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীরসহ পাঁচজনের মৃত্যুর মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া বাসচালক জামির হোসেনের মুক্তির দাবিতে প্রথমে গত বৃহস্পতিবার থেকে চুয়াডাঙ্গায় এবং রোববার থেকে দক্ষিণাঞ্চলের ১০ জেলায় ধর্মঘট ডাকেন পরিবহনশ্রমিকেরা। সোমবার খুলনায় প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠকের পর সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১০ জেলার ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে সোমবার ঢাকার এক আদালত ট্রাকচালক মীর হোসেনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এরপর রাতেই এ দুজনের মুক্তির দাবিতে গতকাল সকাল থেকে সারা দেশে ধর্মঘট শুরু করেন পরিবহনশ্রমিকেরা।
বিকেলে গাবতলীতে সমাবেশ করে শ্রমিকনেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। তাঁরা নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। শাজাহান খান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। রাতে সংঘর্ষ সন্ধ্যায় গাবতলী টার্মিনালের সামনের সড়কে অবস্থান নেন পরিবহনশ্রমিকেরা। রাত আটটার দিকে তাঁরা ওই সড়কে চলাচলকারী যানবাহন ভাঙচুর শুরু করেন। পুলিশ বাধা দিলে তাঁরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান। সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুই পাশে অসংখ্য মানুষ আটকা পড়ে। শ্রমিকেরা টার্মিনালের পাশের একটি পুলিশ বক্স ও রেকার ভ্যানে আগুন ধরিয়ে দেন এবং রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, জলকামান থেকে পানি ও ছররা গুলি ছোড়ে। এ সময় কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। সংঘর্ষে পুলিশের চার সদস্যসহ আটজন আহত হন। তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে যান স্থানীয় সাংসদ আসলামুল হক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ব্যর্থ হয়ে রাত সাড়ে ১২টার দিকে গাবতলী টার্মিনালের সামনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কয়েক বছর আগে যারা আগুন-সন্ত্রাস চালিয়েছিল, তারাই এখানে যুক্ত হয়েছে। তাঁর সন্দেহ, এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার পেছনে বিএনপি-জামায়াতের হাত রয়েছে। রাত একটায়ও ওই এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল। সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের সহকারী কমিশনার সৈয়দ মামুন মোস্তফা বলেন, পরিস্থিতি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দিন-রাত চরম দুর্ভোগ ধর্মঘটের কারণে গতকাল দিন-রাত রাজধানীবাসীকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তিনটি আন্তজেলা বাস টার্মিনাল গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালীতে বাসের জন্য শত শত নারী-পুরুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে বিফল হয়ে ফিরতে হয়েছে। টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, আরামবাগ, কলাবাগানসহ দূরপাল্লার বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির কাউন্টারের সামনে গিয়েও একই চিত্র দেখা গেছে। সকালে গাবতলী গরুর হাট মোড়ে ও দারুস সালামে সড়কে প্রতিবন্ধকতা দিয়ে অবরোধ করেন শ্রমিকেরা। তাঁরা স্বল্পসংখ্যক প্রাইভেট কার ও লেগুনা ছাড়া আর কোনো যান চলতে দেননি। বাস না চলায় সকালে অফিসগামী ও বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত অফিসফেরত মানুষকে যাতায়াতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিআরটিসির বাস ও অল্প কিছু বেসরকারি বাস, লেগুনা, পিকআপ ভ্যান, অটোরিকশা, রিকশা ছিল বাহন। তবে অনেককে দীর্ঘ পথ হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। দিনে যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মতিঝিল, গুলিস্তান, পুরানা পল্টন, মৎস্য ভবন, শাহবাগ,
সায়েন্স ল্যাব, রাসেল স্কয়ার, আসাদগেট, ফার্মগেট, মিরপুর, বিমানবন্দরসহ প্রতিটি মোড়ে যাত্রীদের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। হঠাৎ কেউ কেউ বাস পেলেও শ্রমিকদের বাধায় মাঝপথে নামতে হয়েছে। রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হয়েছে বলে কিছু যাত্রী অভিযোগ করেন। পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে জানা যায়, বিকেল পাঁচটার দিকে মিরপুর ১ নম্বরে স্বাধীন বাংলা সুপার মার্কেটের সামনে বিআরটিসির একটি দোতলা বাস ভাঙচুর করেন শ্রমিকেরা। কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে মেয়েকে নিয়ে এক ঘণ্টার বেশি বাসের অপেক্ষায় ছিলেন খালেদা আকতার। কল্যাণপুরে বোনের বাসায় এসেছিলেন সোমবার রাতে। যাবেন যাত্রাবাড়ী। তিনি বলেন, ‘কাল আসলাম ভালো। আজকে কী এমন হয়ে গেল যে কোনো বাসই নাই। সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে কী লাভ।’ ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা বিকেলে গাবতলীতে সমাবেশে বাংলাদেশ আন্তজেলা ট্রাকচালক ইউনিয়নের সভাপতি তাজুল ইসলাম দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘সংবাদপত্র, অ্যাম্বুলেন্সের মতো জরুরি গাড়ি ছাড়া কোনো রকম গাড়ি চলবে না, চালাতে দেব না।’
No comments