সহজ শর্তের ক্ষুদ্রঋণ ও সুযোগ
উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তা চিহ্নিত করার লক্ষ্যে গবেষণা করছে কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার। অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের জন্য ভিশন ২০২১ অর্জনে এই গবেষণাভিত্তিক কিছু নিবন্ধ প্রকাশ করছে প্রথম আলো। আজ প্রকাশ করা হলো দশম নিবন্ধটি। স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর গত কয়েক দশকে ঋণগ্রহীতাদের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার কৌশল তাঁদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি দারিদ্র্যও কমিয়ে দিয়েছে। এতে করে অনেকের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে প্রায় ৭০০টি ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে, যেগুলো ৩ দশমিক ৪ কোটি সক্রিয় ঋণগ্রহীতার মধ্যে আনুমানিক ৬৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বণ্টন করছে। ক্ষুদ্রঋণ খাত থেকে এখন জিডিপির আয়ের প্রায় ১০ শতাংশ আসে এবং তা আনুমানিক প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কাজের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বিশ্বের অনেক জায়গায় ক্ষুদ্রঋণের প্রাথমিক সাফল্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সব সমস্যার সমাধান হিসেবে কিছু মানুষ এর প্রশংসা করেছিল। অতিসম্প্রতি, সমালোচকেরা এই ক্ষুদ্রঋণের কিছু দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে, অতিদরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের ঋণের চক্রে আটকা পড়ে যাওয়া, অথবা লাভজনক সংস্থাগুলোর অন্তর্ভুক্তিতে ক্ষুদ্রঋণের নৈতিক পরিধি হারানো ইত্যাদি। বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণে ক্ষুদ্রঋণ হয়তোবা কোনো সমাধান নয়, কিন্তু এটি ইতিবাচক ফলাফল ও সুবিধা বয়ে আনতে পারে। ‘বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ’-এর নতুন গবেষণা ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে একটি অত্যাধুনিক উপায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে, যা মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে সহায়তা করতে পারে। (বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের সহযোগিতায় কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টার গবেষণা ও পরামর্শবিষয়ক প্রকল্প বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ গঠন করে। এ প্রকল্পে বাংলাদেশ, আশপাশের অঞ্চলসহ সারা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ডজন খানেক অর্থনীতিবিদ কাজ করছেন। বাংলাদেশ উন্নয়নের জন্য যে টাকাটা ব্যয় করছে, কীভাবে তার সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়—এ বিষয়েই তাঁরা গবেষণা করছেন এবং পরামর্শ দিচ্ছেন।)
ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের (আইপিএসএস) কৃষি অর্থনীতিবিদ সুবীর বৈরাগী, আইপিএসএসের নির্বাহী পরিচালক এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমেট্রিকস বিভাগের প্রভাষক ওয়াসেল বিন শাদাতের নতুন গবেষণায় দেখা যায়, ক্ষুদ্রঋণের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ পরিশোধের ধারা যোগ করা হলে, বিশেষ করে ঋণগ্রহীতারা সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। এই লক্ষ্যে ব্যয়িত প্রতি টাকা ২ টাকার বেশি সামাজিক কল্যাণ সাধন করে থাকে।
বাংলাদেশকে পরীক্ষা করার জন্য আমাদের গবেষকেরা একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিচালনা করেছেন। অনুসন্ধানে তাঁরা দেখেছেন যে গতানুগতিক ক্ষুদ্রঋণ থেকে ব্যয়িত প্রতি টাকা ১ দশমিক ৭ টাকার উন্নতি সাধন করে। তাই ক্ষুদ্রঋণ অবিশ্বাস্য রকম বেশি প্রতিদান দিতে না পারলেও, সেখানে এক টাকা মূল্য পরিশোধ করার পর বস্তুত নিট শূন্য দশমিক ৭ টাকার সুবিধা পাওয়া যায়। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণগ্রহীতাদের জন্য শূন্য দশমিক ৩ টাকার নিট সুবিধা ছেড়ে দিয়ে নিজেরা লাভের শূন্য দশমিক ৪ টাকা রেখে দেয়।
গতানুগতিক ক্ষুদ্রঋণের একটি সমস্যা হলো, এটি ধারাবাহিক এবং সম্ভাব্য আয়ের ঋণগ্রহীতাদের জন্য কল্যাণকর হলেও কৃষক অথবা অনিয়মিত আয়ের লোকদের কাজে আসছে না। গতানুগতিক ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যের সবচেয়ে চরম সীমায় থাকা মানুষের কাছে পৌঁছাতেও ব্যর্থ হতে পারে আংশিকভাবে অনমনীয় ঋণ পরিশোধব্যবস্থার কারণে।
তাই গবেষকেরা এসব বাধা অতিক্রম করার একটি কৌশল পরীক্ষা করে দেখেছেন। সেটা হচ্ছে পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো। অর্থাৎ ঋণ দেওয়ার পর ঋণগ্রহীতাদের তাঁদের ফসল বা উৎপাদন থেকে আয় না পাওয়া পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। এর মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণের বাজার আনুমানিক ২ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা যাবে।
২০০৮ সাল থেকে, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে করা একটি কর্মসূচি বাংলাদেশে সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে আসছে। জুন ২০১৩ সাল পর্যন্ত এটি ৫ লাখ ১২ হাজার ঋণগ্রহীতার মধ্যে মোট ৯৬০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। ২০১২ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, এই নমনীয় কর্মসূচির আওতায়, ঋণগ্রহীতাদের আয়ের মধ্যে তাঁদের সুবিধা ছিল গতানুগতিক ক্ষুদ্রঋণের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি।
সামগ্রিকভাবে, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন যে, সহজ শর্তের ক্ষুদ্রঋণে ব্যয়িত প্রতি টাকা ২ দশমিক ২ টাকার কল্যাণ সাধন করে। ১ টাকা মূল্য পরিশোধ করার পর ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের প্রায় শূন্য দশমিক ৪ টাকাই রেখে দেবে; কিন্তু এর পরেও ঋণগ্রহীতারা শূন্য দশমিক ৮ টাকা পাবেন, অথবা যেটিকে লাভের প্রায় তিন ভাগ বলা যায়।
কেন ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো সহজ শর্তে ঋণ পরিশোধের কৌশল ব্যবহার করতে সম্মত হবে? এর কারণ একটি নতুন ঋণসেবা প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়মিত আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছে বাজারে একটি নতুন স্থান তৈরি করবে এবং তাদের মুনাফার ভাগও বজায় থাকবে।
‘বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ’ দেখিয়েছে, সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ ব্যয়িত প্রতি টাকায় ২ টাকারও বেশি সামাজিক কল্যাণ সাধন করতে পারে। গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে সরে এসে এটা করা সম্ভব। বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ থেকে পাওয়া অনেকগুলো ফলাফলের মধ্যে এটি একটি, যা আমাদের দেখায় যে ভিন্ন ভিন্ন সমাধানের ওপর মনোনিবেশ করে আমরা কতটা কল্যাণ সাধন করতে পারি। আমরা আপনার মতামত জানতে চাই: ক্ষুদ্রঋণ কি দেশের শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি হওয়া উচিত? https://copenhagen. fbapp. io/microfinancepriorities-এ আপনার বক্তব্য শোনা যাক এবং বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলো বাছাইয়ে আমাদের সহায়তা করুন।
ড. বিয়র্ন লোমবোর্গ: কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির একজন।
ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের (আইপিএসএস) কৃষি অর্থনীতিবিদ সুবীর বৈরাগী, আইপিএসএসের নির্বাহী পরিচালক এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোনমেট্রিকস বিভাগের প্রভাষক ওয়াসেল বিন শাদাতের নতুন গবেষণায় দেখা যায়, ক্ষুদ্রঋণের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ পরিশোধের ধারা যোগ করা হলে, বিশেষ করে ঋণগ্রহীতারা সুবিধাপ্রাপ্ত হবেন। এই লক্ষ্যে ব্যয়িত প্রতি টাকা ২ টাকার বেশি সামাজিক কল্যাণ সাধন করে থাকে।
বাংলাদেশকে পরীক্ষা করার জন্য আমাদের গবেষকেরা একটি দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা পরিচালনা করেছেন। অনুসন্ধানে তাঁরা দেখেছেন যে গতানুগতিক ক্ষুদ্রঋণ থেকে ব্যয়িত প্রতি টাকা ১ দশমিক ৭ টাকার উন্নতি সাধন করে। তাই ক্ষুদ্রঋণ অবিশ্বাস্য রকম বেশি প্রতিদান দিতে না পারলেও, সেখানে এক টাকা মূল্য পরিশোধ করার পর বস্তুত নিট শূন্য দশমিক ৭ টাকার সুবিধা পাওয়া যায়। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণগ্রহীতাদের জন্য শূন্য দশমিক ৩ টাকার নিট সুবিধা ছেড়ে দিয়ে নিজেরা লাভের শূন্য দশমিক ৪ টাকা রেখে দেয়।
গতানুগতিক ক্ষুদ্রঋণের একটি সমস্যা হলো, এটি ধারাবাহিক এবং সম্ভাব্য আয়ের ঋণগ্রহীতাদের জন্য কল্যাণকর হলেও কৃষক অথবা অনিয়মিত আয়ের লোকদের কাজে আসছে না। গতানুগতিক ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্যের সবচেয়ে চরম সীমায় থাকা মানুষের কাছে পৌঁছাতেও ব্যর্থ হতে পারে আংশিকভাবে অনমনীয় ঋণ পরিশোধব্যবস্থার কারণে।
তাই গবেষকেরা এসব বাধা অতিক্রম করার একটি কৌশল পরীক্ষা করে দেখেছেন। সেটা হচ্ছে পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো। অর্থাৎ ঋণ দেওয়ার পর ঋণগ্রহীতাদের তাঁদের ফসল বা উৎপাদন থেকে আয় না পাওয়া পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ করতে হবে না। এর মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণের বাজার আনুমানিক ২ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা যাবে।
২০০৮ সাল থেকে, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে করা একটি কর্মসূচি বাংলাদেশে সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে আসছে। জুন ২০১৩ সাল পর্যন্ত এটি ৫ লাখ ১২ হাজার ঋণগ্রহীতার মধ্যে মোট ৯৬০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। ২০১২ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী, এই নমনীয় কর্মসূচির আওতায়, ঋণগ্রহীতাদের আয়ের মধ্যে তাঁদের সুবিধা ছিল গতানুগতিক ক্ষুদ্রঋণের তুলনায় ৮ শতাংশ বেশি।
সামগ্রিকভাবে, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন যে, সহজ শর্তের ক্ষুদ্রঋণে ব্যয়িত প্রতি টাকা ২ দশমিক ২ টাকার কল্যাণ সাধন করে। ১ টাকা মূল্য পরিশোধ করার পর ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো লাভের প্রায় শূন্য দশমিক ৪ টাকাই রেখে দেবে; কিন্তু এর পরেও ঋণগ্রহীতারা শূন্য দশমিক ৮ টাকা পাবেন, অথবা যেটিকে লাভের প্রায় তিন ভাগ বলা যায়।
কেন ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো সহজ শর্তে ঋণ পরিশোধের কৌশল ব্যবহার করতে সম্মত হবে? এর কারণ একটি নতুন ঋণসেবা প্রবর্তনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো অনিয়মিত আয়ের মানুষের কাছে পৌঁছে বাজারে একটি নতুন স্থান তৈরি করবে এবং তাদের মুনাফার ভাগও বজায় থাকবে।
‘বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ’ দেখিয়েছে, সহজ শর্তে ক্ষুদ্রঋণ ব্যয়িত প্রতি টাকায় ২ টাকারও বেশি সামাজিক কল্যাণ সাধন করতে পারে। গতানুগতিক পদ্ধতি থেকে সরে এসে এটা করা সম্ভব। বাংলাদেশ প্রায়োরিটিজ থেকে পাওয়া অনেকগুলো ফলাফলের মধ্যে এটি একটি, যা আমাদের দেখায় যে ভিন্ন ভিন্ন সমাধানের ওপর মনোনিবেশ করে আমরা কতটা কল্যাণ সাধন করতে পারি। আমরা আপনার মতামত জানতে চাই: ক্ষুদ্রঋণ কি দেশের শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি হওয়া উচিত? https://copenhagen. fbapp. io/microfinancepriorities-এ আপনার বক্তব্য শোনা যাক এবং বাংলাদেশের জন্য শীর্ষ অগ্রাধিকারগুলো বাছাইয়ে আমাদের সহায়তা করুন।
ড. বিয়র্ন লোমবোর্গ: কোপেনহেগেন কনসেনসাস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। টাইম ম্যাগাজিনের মূল্যায়নে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির একজন।
No comments