সাবেকদের নির্বাচনী মেলা
ফুটবলের তৃতীয় বিশ্বেও বাংলাদেশ একটি বিন্দুর মতো। কিন্তু একটা জায়গায় বোধ হয় বিশ্ব রেকর্ডই গড়ে ফেলেছে এ দেশের ফুটবল। এমন কোনো ফেডারেশন সম্ভবত গোটা পৃথিবীতে নেই, যেখানে এত বিপুলসংখ্যক সাবেক খেলোয়াড় অংশ নিয়ে থাকেন ফেডারেশনের নির্বাচনে! গতবার ২১টি পদে ১৮ জন ছিলেন। এবার ২০টি পদে ৪৬ জন প্রার্থীর ২১ জনই সাবেক ফুটবলার। শতকরা হিসাবে প্রায় ৪৬ ভাগ! বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়া জ্যেষ্ঠ সহসভাপতিও একজন সাবেক ফুটবলার—সালাম মুর্শেদী। এত বিপুলসংখ্যক সাবেক ফুটবলারের প্রার্থী হওয়ার বড় কারণ, ইচ্ছে করলে যে কেউ দাঁড়াতে পারেন নির্বাচনে। তবে বিদায়ী কমিটির কর্মকর্তারা ভোটার হতে পারেন না। বাকি সাবেকদের মধ্যে এবার ভোটার মাত্র পাঁচজন। উন্মুক্ত এই নির্বাচনে প্রার্থী তালিকায় অনেক বড় বড় নাম। সম্মিলিত পরিষদ থেকে কাজী সালাউদ্দিন সভাপতি প্রার্থী, তাঁর সঙ্গে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাম মুর্শেদী, সহসভাপতি পদে বাদল রায়। সত্যজিৎ দাস রুপু, ইলিয়াস হোসেন, আরিফ হোসেন মুন, অমিত খান শুভ্র সদস্য প্রার্থী। এই পরিষদে সদস্যপ্রার্থী বরিশালের আলমগীর খান আলো সংগঠক হিসেবে পরিচিতি পেলেও তিনিও সাবেক ফুটবলার। ‘ফুটবল বাঁচাও’ আন্দোলনের পতাকাতলে সহসভাপতি প্রার্থী আশরাফউদ্দিন চুন্নু ও খুরশিদ বাবুল। সদস্য—নওশেরুজ্জামান, হাসানুজ্জামান বাবলু, আবদুল গাফফার, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, কায়সার হামিদ, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে গোলাম রব্বানী হেলাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সভাপতি পদে, সহসভাপতি তাবিথ আউয়াল ও সদস্যপদে বিজন বড়ুয়া, আমের খান, ইকবাল হোসেন, সাইফুর রহমান মনি। অথচ বিশ্ব ফুটবলের দিকে তাকালে বড় তারকাদের ফেডারেশনে সংশ্লিষ্টতা তেমন পাওয়া যাবে না। উয়েফা সভাপতি হিসেবে মিশেল প্লাতিনি ছিলেন, এখন তো তিনিও আর নেই। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সাবেক ফুটবলার অনেক আছেন। কিন্তু দেশটির ফেডারেশনে বড় কোনো ফুটবলার নেই। নেপালে গণেশ থাপা ছিলেন, তিনিও এখন বাদ। শ্রীলঙ্কায়ও সাবেক খেলোয়াড়েরা সেভাবে নেই। বাংলাদেশই একমাত্র ব্যতিক্রম, ফেডারেশনের নির্বাচনে যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সাবেক খেলোয়াড়েরা। তাঁরাই আসলে সব। শুধু নির্বাচনই করছেন না, সাবেক খেলোয়াড়েরা জিতেও আসছেন। গতবার ১৮ জনের ১০ জনই জয়ী। গত দুটি নির্বাচনে কাজী সালাউদ্দিন সভাপতি হয়েছেন, দুবারই ২১ সদস্যের কমিটির অর্ধেকই ছিলেন সাবেক ফুটবলার। পোড়-খাওয়া সংগঠকদের ঠাঁই পেছনের পাতায়। সালাউদ্দিন বলছেন, ‘বাফুফের গ্ল্যামার বেড়েছে অনেক। তাই এখানে নির্বাচিত হতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন সবাই।’ সালাম মুর্শেদীর মুখেও প্রায় একই কথা, ‘২০০৮ সালে কাজী সালাউদ্দিন নির্বাচিত হওয়ার পর ফেডারেশনে সাংগঠনিকভাবে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সাবেকেরা তাই এখন উৎসাহিত হচ্ছে আগের চেয়েও বেশি।’ কিন্তু ভালো ফুটবলার মানে ভালো সংগঠক নন, এটা তো জানাই। তাহলে? সালাম বলছেন, ‘অবশ্যই। মাঠে ভালো খেলা মানেই দক্ষ সংগঠন হবেন না। যাঁদের সাংগঠনিক দক্ষতা আছে তাঁরাই টিকে থাকেন।’ বিষয়টি আশরাফউদ্দিন চুন্নুর চোখে ইতিবাচক, ‘ফুটবলাররা টেকনিক্যাল দিকটা ভালো বোঝে। তাদের ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারলে ফুটবলে উন্নয়ন হবে।’ কিন্তু বাফুফেতে দেখা যায় সাবেক খেলোয়াড়েরা নির্বাচিত হলেও কাজ করেন গুরুত্বপূর্ণ পদের দু-তিনজন। বাকিদের আসলে ভূমিকা রাখার সুযোগও নেই। তবে বাদল রায় বিষয়টাকে দেখছেন ভিন্নভাবে, ‘সবাই ভালো খেলোয়াড় ঠিক আছে, খেলা ছেড়েই দেখা গেল সবাই বাফুফেতে আসতে চায়। কিন্তু বিভিন্ন ক্লাব-সংস্থায় দায়িত্ব পালন করে ধাপে ধাপে উঠে আসা উচিত। এমনও জানি, দীর্ঘদিন খেলার সঙ্গে নেই তারাও এখন নির্বাচনে আসছেন। তৃণমূল থেকে উঠে আসার প্রবণতা দেখছি না, এটাই খারাপ লাগছে।’ একই মতের অনুসারী অভিজ্ঞ সংগঠক হারুনুর রশিদও। সাবেক খেলোয়াড়েরা একজন আরেকজনকে দেখে আসছেন বলে তাঁর মনে হচ্ছে। কিন্তু অনেক সাবেকই কোনো পর্যায়ে সংগঠক হিসেবে অবদান রেখে আসেন না। যেটিতে অশনিসংকেত দেখছেন হারুন, ‘হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া এই নির্বাচনে বেশির ভাগ সাবেক ফুটবলার প্রার্থী কোথাও সাংগঠনিক কাজ করেননি। শুধু চেয়ার পাওয়ার জন্যই অনেকে আসে। এটা ফুটবলের জন্য খারাপ এবং এ কারণেই সংগঠক হারিয়ে যাচ্ছে।’
No comments