ওটিতে ভুল টেকনিশিয়ান by রাশেদ রাব্বি
নাপিতের
ফোঁড়া কাটার গল্পের সঙ্গে বেশ মিল। যেখানে সেখানে নয়, খোদ জাতীয় হৃদরোগ
ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে কয়েক বছর ধরেই একজন সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ানকে চিফ
হার্ট-লাং টেকনিশিয়ানের দায়িত্বে রেখে চলছে ওপেন হার্ট সার্জারির মতো
অত্যন্ত স্পর্শকাতর কাজটি। অতি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি পরিচালনায়
সংশ্লিষ্ট অপারেটরের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার অভাবে অপারেশনের সময় সৃষ্টি
হচ্ছে নানা জটিলতা। অস্ত্রোপচারের সময়ই মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ছে রোগীর জীবন।
আলোচিত ও অভিযুক্ত এই ব্যক্তির নাম রুকুনুজ্জামান সিদ্দিক। তার মূল পদ চিফ
সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ান হলেও তাকে তার মর্জি মোতাবেক চিফ হার্ট-লাং
টেকনিশিয়ানের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে ওটিতে সঠিক
যন্ত্রের ‘ভুল টেকনিশিয়ান’ নিয়ে ওপেন হার্ট সার্জারির মতো জটিল অস্ত্রোপচার
করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের।
সংশ্লিষ্ট একাধিক চিকিৎসক ও কর্মচারীর অভিযোগ, রুকুনুজ্জামানের ভুলের কারণে বিভিন্ন সময় শিশুসহ বেশ কিছু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অথচ এসব অভিযোগের কথা জানার পরও কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা রোগীদের নিরাপত্তায় বারবার বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরকে অবহিত করলেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের একটি সূত্র জানায়, রুকুনুজ্জামান সিদ্দিক ২০০৪ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সার্জিক্যাল বিভাগে প্রধান টেকনিশিয়ানের পদে নিয়োগ পান। একই বছর তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে পারফিউশন বিভাগে হার্ট-লাং (হৃদপিণ্ড ও ফুসফুস) শল্য চিকিৎসার প্রধান টেকনিশিয়ান হিসেবে বদলি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের অভিযোগ হচ্ছে, অভিজ্ঞতা না থাকায় রুকুুনুজ্জামান ওইসব যন্ত্রপাতি ঠিকমতো চালাতে পারেন না। ফলে ঝুঁকিতে পড়ছে রোগীদের জীবন। এমনকি এই টেকনিশিয়ানের অদক্ষতার কারণে কখনও কখনও অপারেশনই বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে হাসপাতালের স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম। নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, ওপেন হার্ট সার্জারিতে একজন হার্ট-লাং টেকনিশিয়ানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার সামান্য ভুলেই রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত। ওপেন হার্ট অপারেশনের সময় একজন রোগীর হার্ট ও লাং-এর স্বাভাবিক কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। এ সময় কৃত্রিম ব্যবস্থায় তাকে বাঁচিয়ে রেখে চিকিৎসা চালানো হয়। আর এটা করতে পারফিউমারি মেশিনের সহায়তা নিতে হয়। ওই যন্ত্রটি পরিচালনা করেন একজন হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান। যদিও সামগ্রিক প্রক্রিয়াটির তত্ত্বাবধানে থাকেন একজন পারফিউমিস্ট (চিকিৎসক)। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, ওপেন হার্ট সার্জারির সময় হার্ট-লাং মেশিনের সাহায্যে রোগীর শরীরে সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। এছাড়া হিটারকুলার মেশিনের সাহায্যে উচ্চতা, ওজন ও বয়স ভেদে রোগীর শরীরে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই মেশিনের সাহায্যে রোগীর ব্লাডগ্যাস রিপোর্ট অনুযায়ী কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ, বাইকার্বনেট, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, হিমোগ্লোবিন নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখতে হয়। যন্ত্রের মাধ্যমে এসব বিষয় দেখভাল করেন হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান। অন্যদিকে সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ানের কাজ হচ্ছে ওটিতে রোগীর পজিশন ঠিক করা। সার্জনের চাহিদা মতো ডায়োথার্মিন মেশিন (রক্ত বন্ধ ও সঞ্চালন) অপারেট করা। সার্জারি লাইট সেটিংস ও ডিসি শক মেশিন (ইলেকট্রিক শক) অপারেট করা। এ ছাড়া সার্জিক্যাল যন্ত্র সার্জনের চাহিদামতো সরবরাহ করা।
ওপেন হার্ট সার্জারির সময় পারফিউমারি মেশিন অপারেটে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে বা টেকনিশিয়ানের সামান্য কোনো ভুল হলেও রোগীর তাৎক্ষণিক অথবা পরে মৃত্যু অনিবার্য বলে জানান চিকিৎসকরা। তারা বলেন, এই মেশিন পরিচালনায় কোনো রকম ভুল হলে রোগীর ব্রেন সেল নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিডনি অকেজো হতে পারে, লিভারে সমস্যা হতে পারে। এমনকি রোগীর হেমোডুরিয়া বা রক্তেও হেমোগ্লোবিন ভেঙে যেতে পারে- যা রোগীকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যাবে।
টেকনিশিয়ান নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে হাসপাতালের চিকিৎসক বিলকিস বানু ২০১০ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে এ বিষয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ করেন। অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, প্রধান টেকনিশিয়ান অস্ত্রোপচার কক্ষের যন্ত্রপাতি চালাতে পারছেন না। এতে নানা সমস্যা হচ্ছে। ওই পদে চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু রুকুনুজ্জামানের তা নেই। বিলকিস বানু জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে মহাপরিচালকের কাছে অনুরোধ জানান। এছাড়া কার্ডিয়াক সার্জারির তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. খাজা এন মাহমুদের সুপারিশক্রমে ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি বিলকিস বানু হাসপাতাল পরিচালক বরাবর আরেকটি লিখিত অভিযোগ করেন। তাতে তিনি বলেন, ৮ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে বেলা দেড়টায় কিছু চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী চিফ হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান রুকুনুজ্জামানের পক্ষ নিয়ে তার সঙ্গে অপ্রীতিকর আচরণ করে। এছাড়া তাকে আইসিইউতে ডেকে নিয়ে ভয় দেখায় এবং হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়।
হাসপাতাল পরিচালকের কাছে ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি একই ধরনের অভিযোগ করেন সিনিয়র হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান শফিকুল ইসলাম। সেখানে তিনি বলেন, জরুরি অস্ত্রোপচার চলাকালে রুকুনুজ্জামানসহ চার-পাঁচজন তাকে গালমন্দ করে ওটি থেকে বের করে দেয়। পরে ওটিতে কর্মরত সহযোগী অধ্যাপক ডা. এসএএম সবুর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। রুকুনুজ্জামানের বিরুদ্ধে অসদাচরণ, কাজকর্মে বাধা দেয়াসহ নানা বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ডা. এসএএম সবুর।
এসব অভিযোগসহ আরও অনেক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সুপারিশক্রমে ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফী মজুমদার রুকুন্জ্জুামানকে ‘তিরস্কার’ করেন এবং নেতিবাচক আচরণের ব্যাপারে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করেন। তবে এতকিছুর পরও রুকুনুজ্জামান রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
হাসপাতাল সুত্রে জানা গেছে, রুকুনুজ্জামান সিদ্দিক চিফ সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ান হিসেবে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে যোগদান করেন। বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশায় ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর তিনি চিফ হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান হিসেবে পদায়নের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। ওই সময় হাসপাতালের পরিচালক বিভাগীয় প্রধানের মতামত না নিয়েই তাকে পদায়নের জন্য আবেদনে সুপারিশ করেন। নিয়ম অনুযায়ী বিভাগীয় প্রধানের মতামত নেয়ার কথা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রুকুনুজ্জামানের ওই আবেদনপত্রে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার সুপারিশ ছিল। এমনকি আবেদনপত্রটি অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে ওই নেতাই পৌঁছে দেন। এরপর তৎকালীন মহাপরিচালক নিজেই তার বদলির আদেশ দেন। রুকুনুজ্জামানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকরা যত অভিযোগ দিয়েছিলেন তার কোনোটিই গুরুত্ব পায়নি। সেই থেকে বেশিরভাগ চিকিৎসক-কর্মচারী তার বিরুদ্ধে আর কিছু বলার সাহস পান না।
সূত্র জানায়, রুকুনুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার মেলান্দহ থানার ঘোষেরপাড়ায়। তারা বাবা রউফ সিদ্দিক ওরফে সুরুজ স্থানীয় ৯নং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। তার পুরো পরিবারই বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে সুযোগ-সুবিধা পেতে ভোল পাল্টে এখন আওয়ামী রাজনীতির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রুকুনুজ্জামান।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রধান সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ান পদে প্রথমে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল স্থাপন (২য় পর্ব) প্রকল্পে নিয়োগ পান রুকুনুজ্জামান। পরে হাসপাতালটি প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে একই পদে তার চাকরি নিয়মিতকরণ হয়। কিন্তু তার আগেই প্রধান সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ান পদ থেকে তাকে প্রধান হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান পদে বদলি করা হয়। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতাও সৃষ্টি হয়। এ জটিলতা নিরসনে প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফী মজুমদার ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে রুকুনুজ্জামানের বদলির আদেশ বাতিলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। কিন্তু রুকুনুজ্জামান এতটাই প্রভাবশালী যে, অধিদফতর শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এ বিষয়ে রুকুনুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, শূন্য পদে নিয়ম অনুযায়ী তার পদায়ন হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো জটিলতা নেই। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছেন তারা ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করতেই এসব করেছেন বলে তিনি দাবি করেন। রুকুনুজ্জামান আরও বলেন, যে পদে কাজ করছেন তিনি সেই পদের একজন যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ থাকার কথা নয়। কর্মস্থলে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। তাই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রয়েছে। এর বেশি কিছু নয়।
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান মিলন এ বিষয়ে বলেন, সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ান হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের আদেশ বলেই রুকুনুজ্জামান হার্ট-লাং টেকনিশিয়ানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ভিন্ন বিভাগ থেকে আসার কারণে টেকনিশিয়ানরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আগে ওটি বন্ধ করাসহ বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করেছেন। তবে বর্তমানে সেই সমস্যা নেই।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা, আবু আজাম বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এ প্রসঙ্গে উপ-পরিচালক ডা. মো. বেলাল খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এই প্রতিষ্ঠানে নতুন এসেছি। তাই বিষয়টি আমার জানা নেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট) অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলেন, বিষয়টি পরিচালক প্রশাসনের আওতাধীন। তবে এটি অনভিপ্রেত।
সংশ্লিষ্ট একাধিক চিকিৎসক ও কর্মচারীর অভিযোগ, রুকুনুজ্জামানের ভুলের কারণে বিভিন্ন সময় শিশুসহ বেশ কিছু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। অথচ এসব অভিযোগের কথা জানার পরও কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা রোগীদের নিরাপত্তায় বারবার বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরকে অবহিত করলেও কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের একটি সূত্র জানায়, রুকুনুজ্জামান সিদ্দিক ২০০৪ সালে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সার্জিক্যাল বিভাগে প্রধান টেকনিশিয়ানের পদে নিয়োগ পান। একই বছর তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে পারফিউশন বিভাগে হার্ট-লাং (হৃদপিণ্ড ও ফুসফুস) শল্য চিকিৎসার প্রধান টেকনিশিয়ান হিসেবে বদলি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের অভিযোগ হচ্ছে, অভিজ্ঞতা না থাকায় রুকুুনুজ্জামান ওইসব যন্ত্রপাতি ঠিকমতো চালাতে পারেন না। ফলে ঝুঁকিতে পড়ছে রোগীদের জীবন। এমনকি এই টেকনিশিয়ানের অদক্ষতার কারণে কখনও কখনও অপারেশনই বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে হাসপাতালের স্বাভাবিক সেবা কার্যক্রম। নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, ওপেন হার্ট সার্জারিতে একজন হার্ট-লাং টেকনিশিয়ানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার সামান্য ভুলেই রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত। ওপেন হার্ট অপারেশনের সময় একজন রোগীর হার্ট ও লাং-এর স্বাভাবিক কার্যকারিতা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। এ সময় কৃত্রিম ব্যবস্থায় তাকে বাঁচিয়ে রেখে চিকিৎসা চালানো হয়। আর এটা করতে পারফিউমারি মেশিনের সহায়তা নিতে হয়। ওই যন্ত্রটি পরিচালনা করেন একজন হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান। যদিও সামগ্রিক প্রক্রিয়াটির তত্ত্বাবধানে থাকেন একজন পারফিউমিস্ট (চিকিৎসক)। ওই চিকিৎসক আরও বলেন, ওপেন হার্ট সার্জারির সময় হার্ট-লাং মেশিনের সাহায্যে রোগীর শরীরে সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। এছাড়া হিটারকুলার মেশিনের সাহায্যে উচ্চতা, ওজন ও বয়স ভেদে রোগীর শরীরে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই মেশিনের সাহায্যে রোগীর ব্লাডগ্যাস রিপোর্ট অনুযায়ী কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ, বাইকার্বনেট, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, হিমোগ্লোবিন নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখতে হয়। যন্ত্রের মাধ্যমে এসব বিষয় দেখভাল করেন হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান। অন্যদিকে সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ানের কাজ হচ্ছে ওটিতে রোগীর পজিশন ঠিক করা। সার্জনের চাহিদা মতো ডায়োথার্মিন মেশিন (রক্ত বন্ধ ও সঞ্চালন) অপারেট করা। সার্জারি লাইট সেটিংস ও ডিসি শক মেশিন (ইলেকট্রিক শক) অপারেট করা। এ ছাড়া সার্জিক্যাল যন্ত্র সার্জনের চাহিদামতো সরবরাহ করা।
ওপেন হার্ট সার্জারির সময় পারফিউমারি মেশিন অপারেটে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে বা টেকনিশিয়ানের সামান্য কোনো ভুল হলেও রোগীর তাৎক্ষণিক অথবা পরে মৃত্যু অনিবার্য বলে জানান চিকিৎসকরা। তারা বলেন, এই মেশিন পরিচালনায় কোনো রকম ভুল হলে রোগীর ব্রেন সেল নষ্ট হয়ে যেতে পারে, কিডনি অকেজো হতে পারে, লিভারে সমস্যা হতে পারে। এমনকি রোগীর হেমোডুরিয়া বা রক্তেও হেমোগ্লোবিন ভেঙে যেতে পারে- যা রোগীকে মৃত্যুর পথে নিয়ে যাবে।
টেকনিশিয়ান নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে হাসপাতালের চিকিৎসক বিলকিস বানু ২০১০ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে এ বিষয়ে লিখিতভাবে অভিযোগ করেন। অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, প্রধান টেকনিশিয়ান অস্ত্রোপচার কক্ষের যন্ত্রপাতি চালাতে পারছেন না। এতে নানা সমস্যা হচ্ছে। ওই পদে চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু রুকুনুজ্জামানের তা নেই। বিলকিস বানু জরুরিভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে মহাপরিচালকের কাছে অনুরোধ জানান। এছাড়া কার্ডিয়াক সার্জারির তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. খাজা এন মাহমুদের সুপারিশক্রমে ২০১১ সালের ২০ জানুয়ারি বিলকিস বানু হাসপাতাল পরিচালক বরাবর আরেকটি লিখিত অভিযোগ করেন। তাতে তিনি বলেন, ৮ জানুয়ারি ২০১১ তারিখে বেলা দেড়টায় কিছু চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী চিফ হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান রুকুনুজ্জামানের পক্ষ নিয়ে তার সঙ্গে অপ্রীতিকর আচরণ করে। এছাড়া তাকে আইসিইউতে ডেকে নিয়ে ভয় দেখায় এবং হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়ার হুমকি দেয়।
হাসপাতাল পরিচালকের কাছে ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি একই ধরনের অভিযোগ করেন সিনিয়র হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান শফিকুল ইসলাম। সেখানে তিনি বলেন, জরুরি অস্ত্রোপচার চলাকালে রুকুনুজ্জামানসহ চার-পাঁচজন তাকে গালমন্দ করে ওটি থেকে বের করে দেয়। পরে ওটিতে কর্মরত সহযোগী অধ্যাপক ডা. এসএএম সবুর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। রুকুনুজ্জামানের বিরুদ্ধে অসদাচরণ, কাজকর্মে বাধা দেয়াসহ নানা বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ডা. এসএএম সবুর।
এসব অভিযোগসহ আরও অনেক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সুপারিশক্রমে ২০১২ সালের ৪ নভেম্বর হাসপাতালের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফী মজুমদার রুকুন্জ্জুামানকে ‘তিরস্কার’ করেন এবং নেতিবাচক আচরণের ব্যাপারে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করেন। তবে এতকিছুর পরও রুকুনুজ্জামান রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
হাসপাতাল সুত্রে জানা গেছে, রুকুনুজ্জামান সিদ্দিক চিফ সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ান হিসেবে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে যোগদান করেন। বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশায় ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর তিনি চিফ হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান হিসেবে পদায়নের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেন। ওই সময় হাসপাতালের পরিচালক বিভাগীয় প্রধানের মতামত না নিয়েই তাকে পদায়নের জন্য আবেদনে সুপারিশ করেন। নিয়ম অনুযায়ী বিভাগীয় প্রধানের মতামত নেয়ার কথা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রুকুনুজ্জামানের ওই আবেদনপত্রে আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতার সুপারিশ ছিল। এমনকি আবেদনপত্রটি অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে ওই নেতাই পৌঁছে দেন। এরপর তৎকালীন মহাপরিচালক নিজেই তার বদলির আদেশ দেন। রুকুনুজ্জামানের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকরা যত অভিযোগ দিয়েছিলেন তার কোনোটিই গুরুত্ব পায়নি। সেই থেকে বেশিরভাগ চিকিৎসক-কর্মচারী তার বিরুদ্ধে আর কিছু বলার সাহস পান না।
সূত্র জানায়, রুকুনুজ্জামানের গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলার মেলান্দহ থানার ঘোষেরপাড়ায়। তারা বাবা রউফ সিদ্দিক ওরফে সুরুজ স্থানীয় ৯নং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি। তার পুরো পরিবারই বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তবে সুযোগ-সুবিধা পেতে ভোল পাল্টে এখন আওয়ামী রাজনীতির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রুকুনুজ্জামান।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রধান সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ান পদে প্রথমে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল স্থাপন (২য় পর্ব) প্রকল্পে নিয়োগ পান রুকুনুজ্জামান। পরে হাসপাতালটি প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত হলে একই পদে তার চাকরি নিয়মিতকরণ হয়। কিন্তু তার আগেই প্রধান সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ান পদ থেকে তাকে প্রধান হার্ট-লাং টেকনিশিয়ান পদে বদলি করা হয়। এর ফলে প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতাও সৃষ্টি হয়। এ জটিলতা নিরসনে প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আল সাফী মজুমদার ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে রুকুনুজ্জামানের বদলির আদেশ বাতিলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান। কিন্তু রুকুনুজ্জামান এতটাই প্রভাবশালী যে, অধিদফতর শেষ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
এ বিষয়ে রুকুনুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, শূন্য পদে নিয়ম অনুযায়ী তার পদায়ন হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো জটিলতা নেই। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে যারা অভিযোগ করেছেন তারা ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় করতেই এসব করেছেন বলে তিনি দাবি করেন। রুকুনুজ্জামান আরও বলেন, যে পদে কাজ করছেন তিনি সেই পদের একজন যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তি। তার বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ থাকার কথা নয়। কর্মস্থলে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। তাই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রয়েছে। এর বেশি কিছু নয়।
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান মিলন এ বিষয়ে বলেন, সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ান হলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের আদেশ বলেই রুকুনুজ্জামান হার্ট-লাং টেকনিশিয়ানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ভিন্ন বিভাগ থেকে আসার কারণে টেকনিশিয়ানরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আগে ওটি বন্ধ করাসহ বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করেছেন। তবে বর্তমানে সেই সমস্যা নেই।
হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা, আবু আজাম বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। এ প্রসঙ্গে উপ-পরিচালক ডা. মো. বেলাল খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এই প্রতিষ্ঠানে নতুন এসেছি। তাই বিষয়টি আমার জানা নেই।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হসপিটাল সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট) অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলেন, বিষয়টি পরিচালক প্রশাসনের আওতাধীন। তবে এটি অনভিপ্রেত।
No comments