‘জীবনের ২০ বছরই কেটেছে কারাগারে’ by কাজী সুমন
প্রাথমিকে
ফার্স্ট হতেন প্রতি ক্লাসেই। ভাল ছাত্র হওয়ায় বড়ভাই গ্রাম থেকে নিয়ে এলেন
শহরে। তখনও কৈশোর পার হয়নি। ভর্তি করালেন ঐতিহ্যবাহী সেন্ট গ্রেগরিজ
স্কুলে। ভাষা আন্দোলনে তখন উত্তাল দেশ। আন্দোলনের রসদ যোগাতে ছাত্রলীগের
দুই নেতা যান ওই স্কুলে। চোখ পড়ে নবম শ্রেণীর ছাত্র শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের
ওপর। তাকে অফার দেন মিছিলে যাওয়ার। স্কুলের কঠোর বিধিও রুখতে পারেনি
মাতৃভাষার প্রতি তার প্রেম। আবেগী মোয়াজ্জেম রাজি হয়ে যান সঙ্গে সঙ্গেই।
পরদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি। দুই বন্ধুকে নিয়ে জড়ো হন ঢাকা মেডিকেলে কলেজের
আমতলায়। নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সহপাঠীদের নিয়ে বেরিয়ে
পড়েন রাজপথে। শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ। রক্তাক্ত আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার
হন তিনি। দুই বন্ধুসহ পুলিশ তাকে নিয়ে যায় লালবাগ থানায়। সেখানে শুনতে পান
গুলিতে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন ছাত্র। এরপর গ্রেপ্তারকৃত আরও শতাধিক
আন্দোলনকারীর সঙ্গে তাকে পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় কারাগারে। বের হন মাসখানেক
পর। সেই থেকে শুরু জেল ও রাজনৈতিক জীবন। ৭৮ বছরের জীবনের প্রায় ২০ বছর
কাটিয়েছেন জেলে। বারবার জেলে যাওয়ার জন্য বন্ধুরা তাকে নাম দিয়েছিলেন
‘কারাগারের পাখি’।
দশম শ্রেণীতে পড়াকালে ছাত্রলীগের সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হন শাহ মোয়াজ্জেম। ১৯৫৪ সালে মেট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ওই বছরই ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৫৬ সালে আইএ পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ হতে ডিগ্রি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং এলএলবি পাস করেন। কলেজে পড়াকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল মুবিন তালুকদার তাকে নিয়ে যান নওয়াবপুর রোডে তখনকার আওয়ামী লীগের অফিসে। সেখানেই পরিচয় করিয়ে দেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। এরপর তাকে গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগের জেলা সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে পাঠানো হয়। ওই সম্মেলনে রাখা তার বক্তব্য প্রশংসিত হয়। বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে এনে পুরস্কৃত করেন। এরপরই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। পরপর দুইবার ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধেরও অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। যুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় পার্লামেন্টে তার আড়াই ঘণ্টার তুমুল বক্তৃতায় কেঁপে ওঠে আইয়ুব খানের মসনদ। এরপরই জ্বালিয়ে দেয়া হয় তার মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থানার দোগাছির পৈতৃক বাড়ি।
তবে কারাগারের পাশাপাশি মসনদের সঙ্গেও সখ্য ছিল শাহ মোয়াজ্জেমের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকারের আমলে চিফ হুইপ, মোশতাক সরকারের মন্ত্রিসভার একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রিসভার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চিফ হুইপ নিযুক্ত হন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ফের এমপি হয়ে চিফ হুইপ হন। ১৯৭৫ সালে খোন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। ১৯৭৬ সালে নতুন রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেটিক লীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হন এবং জেল থেকে বের হওয়ার পর পুনরায় ১৯৭৭ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত জনদলের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে জনদল জাতীয় পার্টিতে রূপান্তরিত হলে তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রেসিডিয়ামের সদস্য নির্বাচিত হন। একই বৎসর তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিব নির্বাচিত হন। সে বছরই তিনি সরকারের উপ-প্রধান মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৮৮ সালে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের রংপুর পীরগঞ্জ থেকে উপ-নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করে যোগ দেন বিএনপিতে। বর্তমানে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ এই নেতাও মামলার শিকার হয়েছেন দেড় ডজন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় বিএনপিতেই থাকতে চান তিনি। দলটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেন, রাজনীতিতে উত্থান-পতন আছেই। আমি বিএনপিতে কোন ক্রাইসিস দেখি না। সরকারের এত অত্যাচার-নির্যাতনের পরও বিএনপি টিকে আছে। সরকারের উদ্দেশে সাবেক এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, এত উন্নয়ন করলে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেন। জনগণ যাকে ভোট দেবে সেই ক্ষমতায় যাবে। জেলহত্যা মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ৬২ জন নেতা সাক্ষ্য দিয়েছেন। কেউ আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। আর্মিদের বন্দুকের নলের মুখে আমি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলাম। দেশের অনেক জনহিতকর কাজও করেছেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। ঢাকা-মাওয়া বিশ্বরোডের তিনিই উদ্যোক্তা এবং রূপকার। তার এলাকার ৬টি কলেজ ও বেশ কয়েকটি স্কুল, মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা, স্টেডিয়াম, হেলিপ্যাড, অসংখ্য রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন। লেখালেখির জগতেও তার বিচরণ রয়েছে। জেল জীবনের প্রথম স্মৃতিকথা নিয়ে লেখেন ‘নিত্য কারাগার’। এছাড়া ‘বলেছি বলছি বলবো’, ‘ছাব্বিশ সেল’ ও ‘জেল হত্যা মামলা’, উপন্যাস ‘বিচলনে’ পাঠক মহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
দশম শ্রেণীতে পড়াকালে ছাত্রলীগের সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য হন শাহ মোয়াজ্জেম। ১৯৫৪ সালে মেট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ওই বছরই ঢাকা কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৫৬ সালে আইএ পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ হতে ডিগ্রি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং এলএলবি পাস করেন। কলেজে পড়াকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুল মুবিন তালুকদার তাকে নিয়ে যান নওয়াবপুর রোডে তখনকার আওয়ামী লীগের অফিসে। সেখানেই পরিচয় করিয়ে দেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। এরপর তাকে গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগের জেলা সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে পাঠানো হয়। ওই সম্মেলনে রাখা তার বক্তব্য প্রশংসিত হয়। বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে এনে পুরস্কৃত করেন। এরপরই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। পরপর দুইবার ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধেরও অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। যুদ্ধ চলাকালীন ভারতীয় পার্লামেন্টে তার আড়াই ঘণ্টার তুমুল বক্তৃতায় কেঁপে ওঠে আইয়ুব খানের মসনদ। এরপরই জ্বালিয়ে দেয়া হয় তার মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থানার দোগাছির পৈতৃক বাড়ি।
তবে কারাগারের পাশাপাশি মসনদের সঙ্গেও সখ্য ছিল শাহ মোয়াজ্জেমের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সরকারের আমলে চিফ হুইপ, মোশতাক সরকারের মন্ত্রিসভার একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মন্ত্রিসভার উপ-প্রধানমন্ত্রী ও খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চিফ হুইপ নিযুক্ত হন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ফের এমপি হয়ে চিফ হুইপ হন। ১৯৭৫ সালে খোন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। ১৯৭৬ সালে নতুন রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেটিক লীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে গ্রেপ্তার হন এবং জেল থেকে বের হওয়ার পর পুনরায় ১৯৭৭ সালে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত জনদলের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং দলের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে জনদল জাতীয় পার্টিতে রূপান্তরিত হলে তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও প্রেসিডিয়ামের সদস্য নির্বাচিত হন। একই বৎসর তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৭ সালে তিনি জাতীয় পার্টির মহাসচিব নির্বাচিত হন। সে বছরই তিনি সরকারের উপ-প্রধান মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৮৮ সালে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের রংপুর পীরগঞ্জ থেকে উপ-নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে পদত্যাগ করে যোগ দেন বিএনপিতে। বর্তমানে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ এই নেতাও মামলার শিকার হয়েছেন দেড় ডজন। জীবনের পড়ন্ত বেলায় বিএনপিতেই থাকতে চান তিনি। দলটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে প্রবীণ এই রাজনীতিক বলেন, রাজনীতিতে উত্থান-পতন আছেই। আমি বিএনপিতে কোন ক্রাইসিস দেখি না। সরকারের এত অত্যাচার-নির্যাতনের পরও বিএনপি টিকে আছে। সরকারের উদ্দেশে সাবেক এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, এত উন্নয়ন করলে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেন। জনগণ যাকে ভোট দেবে সেই ক্ষমতায় যাবে। জেলহত্যা মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ৬২ জন নেতা সাক্ষ্য দিয়েছেন। কেউ আমার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি। আর্মিদের বন্দুকের নলের মুখে আমি মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলাম। দেশের অনেক জনহিতকর কাজও করেছেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। ঢাকা-মাওয়া বিশ্বরোডের তিনিই উদ্যোক্তা এবং রূপকার। তার এলাকার ৬টি কলেজ ও বেশ কয়েকটি স্কুল, মসজিদ, মন্দির, মাদরাসা, স্টেডিয়াম, হেলিপ্যাড, অসংখ্য রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার এবং প্রতিষ্ঠা করেছেন। লেখালেখির জগতেও তার বিচরণ রয়েছে। জেল জীবনের প্রথম স্মৃতিকথা নিয়ে লেখেন ‘নিত্য কারাগার’। এছাড়া ‘বলেছি বলছি বলবো’, ‘ছাব্বিশ সেল’ ও ‘জেল হত্যা মামলা’, উপন্যাস ‘বিচলনে’ পাঠক মহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
No comments