মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রা by শহিদুল ইসলাম
সামাজিক
প্রয়োজন ও তা সম্পাদনের লক্ষ্য শিক্ষা। মানুষের ধারাবাহিক অস্তিত্ব রক্ষার
জন্য শিক্ষা অপরিহার্য। সে শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিক হতে পারে কিংবা
অপ্রাতিষ্ঠানিক হতে পারে। শিক্ষার মূল প্রেরণা হলো অভিজ্ঞতা। তবে
অভিজ্ঞতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। সচেতন ও অসচেতন অভিজ্ঞতা। সচেতন অভিজ্ঞতা
ও অসচেতন অভিজ্ঞতার মধ্যে পার্থক্য হলো, সচেতন অভিজ্ঞতা প্রগতিশীল। আর
অসচেতন অভিজ্ঞতা কোনো এক বিন্দুতে এসে স্থবির হয়ে পড়ে। এখানেই
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষাবিহীন অভিজ্ঞতার পার্থক্য রচিত হয়।
অভিজ্ঞতার নতুন নতুন ব্যাখ্যার মাধ্যমেই মানব সভ্যতা এগিয়ে চলে। সেই
ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়।
যারা সেই ক্ষমতা অর্জন করে তারাই শিক্ষিত-তারাই শিক্ষক-তারাই মানুষকে
জ্ঞানদানের অধিকারী। এরা অভিজ্ঞতাকে নতুন নতুন ব্যাখ্যা দান করতে পারেন।
তারাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-ধারা গড়ে তোলেন। ভারতের নালন্দা, তক্ষশিলা,
বাংলাদেশের ময়নামতি, মহাস্থানগড় প্রাচীনতম শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। ইউরোপের
সোফিস্টরাই হলো প্রথম পেশাজীবী শিক্ষক। শিক্ষা পরিকল্পিতভাবে প্রগতিশীল।
সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সম্মতিতে গড়ে ওঠে সে শিক্ষা কিন্তু যারা
পুরনো প্রতিষ্ঠিত সমাজ-কাঠামো, আচার-আচরণ বহাল রাখার পক্ষে, শিক্ষার
প্রগতিশীল দর্শন অবশ্যই তাদের বিরোধিতা করে। শিক্ষার সঙ্গে স্বাধীনতার
সম্পর্ক অতি নিবিড়। তাই প্রগতিশীল শিক্ষার জন্য তখন এমন একটা সমাজ-কাঠামো
প্রয়োজন হয় যাকে সাধারণত গণতান্ত্রিক সমাজ বলা যায়। কারণ সে সমাজে-মানুষ
স্বাধীনভাবে তার মত প্রকাশ করতে পারেন। সে সমাজে উচ্চতর শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণে
পুরনো অভ্যাস, পুরনো চিন্তা স্থান করে নিতে পারে না। নতুনের ধাক্কায় পুরনো
অভ্যাসগুলো ভেসে যায়। এটা শিক্ষার দার্শনিকদের দর্শনের কথা। বাস্তবে আজ
সে সমাজের অস্তিত্ত্ব দেখা যায় না। পৃথিবীতে বড় বড় বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সময়
এ রকম সমাজের সন্ধান পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে লেবাননের কবি কাহ্লিল জিবরানের
‘দি প্রফেট’ কবিতার একটি পঙ্ক্তির কথা মনে পড়ে। ‘জীবন কখনও পিছনের দিকে
যায় না কিংবা জীবন আলকাতরা লেপা গতকালও নয়।’ তাই শিশুদের শিক্ষা সম্পর্কে
উক্ত কবিতায় তিনি বলেন, শিশুদের ‘আত্মা আগামীকালের মাঝে বাস করে, যা তোমরা
কখনও পরিভ্রমণ করতে পার না, তোমাদের স্বপ্নেও নয়।’
গণতান্ত্রিক সমাজও অপরিবর্তনীয় কোনো সমাজ-কাঠামো নয়। আজকের গণতান্ত্রিক সমাজ এক সময় তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারায়। তেমনি আজকের প্রগতিশীল শিক্ষাও এক সময় তার প্রগতিশীল চরিত্র হারায়। তখন শিক্ষা অতীতের পৌনঃপুনিকতায় পর্যবসিত হয। পুরনো দর্শন, পুরনো আচার-আচরণ আঁকড়ে ধরে। শিক্ষা তখন নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে অক্ষম হয়ে পড়ে। শিক্ষিত শ্রেণী অর্থাৎ শিক্ষক শ্রেণীও তার প্রগতিশীল চরিত্র হারিয়ে গতানুগতিকায় গা ছেড়ে দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা পলায়ন করে। পুরনো চিন্তার ভারে ন্যুব্জ শিক্ষক নতুন জ্ঞানের আবির্ভাবকে যেন ভয় করে। মেলবন্ধন ঘটে যায় পরিবর্তনবিরোধী শাসক শ্রেণীর সঙ্গে শিক্ষকদের। এ প্রসঙ্গে পাওলো ফ্রেইরির পেডাগগি অব দি অপপ্রেসড্ (Pedagogy of the Oppressed) বইটি পড়তে বলব। প্লেটো (৪২৮-২৭ খ্রিঃ পূঃ-৩৪৭ খ্রিঃপূঃ) থেকে পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষার দর্শনের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে সমাজ বদলের ইতিহাসের সঙ্গে শিক্ষা বদলের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। শিক্ষার জন্য যেমন একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজন তেমনি একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলায় শিক্ষারও একটি বিশেষ ভূমিকা আছে।
মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রাদুই, শিক্ষার এ প্রগতিশীল ভূমিকার জন্য অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের এক অবিচ্ছিন্ন ধারা গড়ে তোলা জরুরি। তার ফলে ব্যক্তির ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে তার বিষয়ে তিনি ক্রমেই পারদর্শী হয়ে ওঠেন। মানুষে মানুষে বিভেদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার অভাব মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার জন্য প্রধান বাধাই নয় শুধু এই বিভেদ ও স্বাধীনতাহীনতা একদিন হয়তো মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। বৈজ্ঞানিক-প্রাযুক্তিক বিপ্লব যে দ্রুতগতিতে সমাজের রূপান্তর ঘটাচ্ছে এবং মানুষের দীর্র্ঘদিনের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, চিন্তাচেতনাকে দ্রুততর গতিতে পরিবর্তিত করছে, তা যেমন একদিকে সম্ভাবনাময়, একই সঙ্গে তা ভয়ঙ্করও বটে। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে যখন মানুষে মানুষে বৈষম্যের পাহাড় ক্রমবৃদ্ধিমান, শ্রেণী মেরুকরণ আকাশচুম্বী এবং কথা বলা ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা সাংঘাতিকভাবে খর্বিত তখন সচেতন মানুষ মানব সভ্যতার ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বিশ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক বিপ্লবের সুফল যদি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া যেত, তাহলে মানুষে মানুষে বৈষম্যের দেয়ালটা ভেঙ্গে পড়ত, দু’বেলা দুমুঠো খাবারের জন্য কাউকে ভিক্ষাবৃত্তি করতে হতো না, কিংবা মেয়েদের দেহব্যবসায় নামতে হতো না, প্রতিটি মানুষের জন্য একটি করে ছোট বাড়ির ব্যবস্থা করা যেত; প্রতিটি বিদ্যালয়গামী শিশুকে স্কুলে পাঠানো সম্ভব হতো; প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঠিক খবরটি দ্রুততম সময়ে প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যেত। কিন্তু ঘটেছে ঠিক এর উল্টোটি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়ন শ্রেণীবিভাজনকে আকাশচুম্বী করে তুলেছে এবং শাসক শ্রেণী উন্নত যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করে ফেলেছে। অবাধ যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর তাদের কড়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে গণতন্ত্র আজ ভেঙে পড়েছে, অর্থনৈতিকভাবে গণতন্ত্র আজ মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করার ক্ষমতা হারিয়েছে; ফলে গণতন্ত্র আজ তার ‘গণ’ চরিত্র হারিয়েছে। পৃথিবীর তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ‘সংসদ ভবন’ আজ শাসক শ্রেণীর ডিবেটিং ক্লাবে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু পৃথিবীর সকল মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি চায়; উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে মানুষ তা জানতে চায়; মানুষ আজ প্রতিটি শিশুকে স্কুলে পাঠাতে চায়; প্রতিটি মানুষের মাথার ওপর একটি ছাদের ব্যবস্থা করতে চায়; প্রতিটি মানুষ ঘরে ঘরে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা পৌঁছে দিতে চায়; প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তি তার বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা দাবি করে ; উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগুলোতে মানুষ স্বাধীনভাবে পাঠগ্রহণ ও পাঠদান এবং গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করতে চায়। মানুষ একদিকে যেমন সন্ত্রাসবাদ, ধর্মান্ধতা ও স্বৈরতন্ত্র, বর্ণবাদ, চণ্ডবাদ (fascism) ঘৃণা করে অপর পক্ষে তারা একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ কাঠামো ও বুদ্ধির স্বাধীনতা দাবি করে। বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা অর্থ মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মানব সমাজের অগ্রযাত্রার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত। এর অর্থ মত পোষণ ও তা প্রকাশ করা, তথ্য পাওয়া এবং তা প্রচার করা, মুক্ত চিন্তার অবাধ চলাচল; নির্ভয়ে তর্কে লিপ্ত হওয়া এবং সরকারি ও আমলাতান্ত্রিক বাধা-বিপত্তির বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা নির্ভয়ে সত্যের সন্ধান করতে পারবেন এবং সে সত্য নির্ভয়ে প্রচার করতে পারবেন, তার গ্যারান্টি চায়। স্বাধীনতাই কেবল রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিসহ জীবন ও সমাজের যাবতীয় বিষয়ে মানুষকে উপযুক্ত করে তোলে। চিন্তার স্বাধীনতাই কেবল একজন ভালো রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, চিত্র ও সংগীত পরিচালক, সাংবাদিক, আইনজীবীর জন্ম দিতে পারে। চিন্তা যখন বিভিন্ন ধর্মের কারাগারে বন্দি ছিল, তখন কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব হয়নি। চিন্তার অবাধ স্বাধীনতা প্রথম যুগে গ্রিক-রোমান সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। বর্তমানে পশ্চিমা সভ্যতার জন্মের শুরু ইতালির রেনেসাঁ থেকে। ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন ও শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানে ধর্মীয় কারাগারের প্রাচীর ভেঙে পড়ে এবং চিন্তার স্বাধীনতা পুনর্প্রতিষ্ঠা পায়। চিন্তা ও আলোচনা-সমালোচনার অবাধ স্বাধীনতা পশ্চিমা সভ্যতার উত্থানের একটি প্রধান শর্ত ছিল।
কিন্তু ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবিদার উন্নত দেশগুলোতেও চিন্তার স্বাধীনতা আজ হুমকির সম্মুখে পড়েছে। সতেরো ও আঠারো শতকের ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ প্রতিক্রিয়ার দুর্গে পরিণত হয়েছে। গবেষণাগারগুলোতে বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষা-গবেষণায় আজ স্বাধীনতা নেই। সমাজ ও মানুষ সংক্রান্ত গবেষণা তো বটেই, প্রকৃতির গবেষণাও আজ শাসক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রিত। গবেষণায় আজ রাষ্ট্রের তেমন ভূমিকা নেই।
তাই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে শিক্ষা ও গবেষণায় সামান্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। তার দায়িত্ব আজ কতিপয় বড় কর্পোরেট ও বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। প্রথমত, শাসক শ্রেণী; দ্বিতীয়, মুক্ত চিন্তার শত্রু; কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ধর্মান্ধ গণমানুষের সাংস্কৃতিক চেতনা; তৃতীয়, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে উদাসীন আত্মকেন্দ্রিক ভাবাদর্শ এবং একটি ক্ষুদ্র আমলাতান্ত্রিক বন্ধনে আবদ্ধ জীবাশ্মভূত কুসংস্কার এবং ভাবাদর্শিক সেন্সরশিপ, যা আমলাতন্ত্রের শক্তিশালী হাতিয়ার। এরাই আজ মানবজাতির মিত্র নয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক
গণতান্ত্রিক সমাজও অপরিবর্তনীয় কোনো সমাজ-কাঠামো নয়। আজকের গণতান্ত্রিক সমাজ এক সময় তার গণতান্ত্রিক চরিত্র হারায়। তেমনি আজকের প্রগতিশীল শিক্ষাও এক সময় তার প্রগতিশীল চরিত্র হারায়। তখন শিক্ষা অতীতের পৌনঃপুনিকতায় পর্যবসিত হয। পুরনো দর্শন, পুরনো আচার-আচরণ আঁকড়ে ধরে। শিক্ষা তখন নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে অক্ষম হয়ে পড়ে। শিক্ষিত শ্রেণী অর্থাৎ শিক্ষক শ্রেণীও তার প্রগতিশীল চরিত্র হারিয়ে গতানুগতিকায় গা ছেড়ে দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা পলায়ন করে। পুরনো চিন্তার ভারে ন্যুব্জ শিক্ষক নতুন জ্ঞানের আবির্ভাবকে যেন ভয় করে। মেলবন্ধন ঘটে যায় পরিবর্তনবিরোধী শাসক শ্রেণীর সঙ্গে শিক্ষকদের। এ প্রসঙ্গে পাওলো ফ্রেইরির পেডাগগি অব দি অপপ্রেসড্ (Pedagogy of the Oppressed) বইটি পড়তে বলব। প্লেটো (৪২৮-২৭ খ্রিঃ পূঃ-৩৪৭ খ্রিঃপূঃ) থেকে পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষার দর্শনের ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে সমাজ বদলের ইতিহাসের সঙ্গে শিক্ষা বদলের ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। শিক্ষার জন্য যেমন একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজন তেমনি একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলায় শিক্ষারও একটি বিশেষ ভূমিকা আছে।
মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রাদুই, শিক্ষার এ প্রগতিশীল ভূমিকার জন্য অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের এক অবিচ্ছিন্ন ধারা গড়ে তোলা জরুরি। তার ফলে ব্যক্তির ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করে তার বিষয়ে তিনি ক্রমেই পারদর্শী হয়ে ওঠেন। মানুষে মানুষে বিভেদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার অভাব মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার জন্য প্রধান বাধাই নয় শুধু এই বিভেদ ও স্বাধীনতাহীনতা একদিন হয়তো মানবজাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। বৈজ্ঞানিক-প্রাযুক্তিক বিপ্লব যে দ্রুতগতিতে সমাজের রূপান্তর ঘটাচ্ছে এবং মানুষের দীর্র্ঘদিনের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, চিন্তাচেতনাকে দ্রুততর গতিতে পরিবর্তিত করছে, তা যেমন একদিকে সম্ভাবনাময়, একই সঙ্গে তা ভয়ঙ্করও বটে। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে যখন মানুষে মানুষে বৈষম্যের পাহাড় ক্রমবৃদ্ধিমান, শ্রেণী মেরুকরণ আকাশচুম্বী এবং কথা বলা ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা সাংঘাতিকভাবে খর্বিত তখন সচেতন মানুষ মানব সভ্যতার ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বিশ শতকের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিক বিপ্লবের সুফল যদি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া যেত, তাহলে মানুষে মানুষে বৈষম্যের দেয়ালটা ভেঙ্গে পড়ত, দু’বেলা দুমুঠো খাবারের জন্য কাউকে ভিক্ষাবৃত্তি করতে হতো না, কিংবা মেয়েদের দেহব্যবসায় নামতে হতো না, প্রতিটি মানুষের জন্য একটি করে ছোট বাড়ির ব্যবস্থা করা যেত; প্রতিটি বিদ্যালয়গামী শিশুকে স্কুলে পাঠানো সম্ভব হতো; প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঠিক খবরটি দ্রুততম সময়ে প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া যেত। কিন্তু ঘটেছে ঠিক এর উল্টোটি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়ন শ্রেণীবিভাজনকে আকাশচুম্বী করে তুলেছে এবং শাসক শ্রেণী উন্নত যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে নিজেদের করায়ত্ত করে ফেলেছে। অবাধ যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর তাদের কড়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। ফলে রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে গণতন্ত্র আজ ভেঙে পড়েছে, অর্থনৈতিকভাবে গণতন্ত্র আজ মানুষের মুক্তি নিশ্চিত করার ক্ষমতা হারিয়েছে; ফলে গণতন্ত্র আজ তার ‘গণ’ চরিত্র হারিয়েছে। পৃথিবীর তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ‘সংসদ ভবন’ আজ শাসক শ্রেণীর ডিবেটিং ক্লাবে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু পৃথিবীর সকল মানুষ দারিদ্র্য থেকে মুক্তি চায়; উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে মানুষ তা জানতে চায়; মানুষ আজ প্রতিটি শিশুকে স্কুলে পাঠাতে চায়; প্রতিটি মানুষের মাথার ওপর একটি ছাদের ব্যবস্থা করতে চায়; প্রতিটি মানুষ ঘরে ঘরে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা পৌঁছে দিতে চায়; প্রতিটি শিক্ষিত ব্যক্তি তার বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা দাবি করে ; উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গবেষণাগুলোতে মানুষ স্বাধীনভাবে পাঠগ্রহণ ও পাঠদান এবং গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করতে চায়। মানুষ একদিকে যেমন সন্ত্রাসবাদ, ধর্মান্ধতা ও স্বৈরতন্ত্র, বর্ণবাদ, চণ্ডবাদ (fascism) ঘৃণা করে অপর পক্ষে তারা একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ কাঠামো ও বুদ্ধির স্বাধীনতা দাবি করে। বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা অর্থ মত প্রকাশের স্বাধীনতা। মানব সমাজের অগ্রযাত্রার জন্য একটি অপরিহার্য শর্ত। এর অর্থ মত পোষণ ও তা প্রকাশ করা, তথ্য পাওয়া এবং তা প্রচার করা, মুক্ত চিন্তার অবাধ চলাচল; নির্ভয়ে তর্কে লিপ্ত হওয়া এবং সরকারি ও আমলাতান্ত্রিক বাধা-বিপত্তির বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরা নির্ভয়ে সত্যের সন্ধান করতে পারবেন এবং সে সত্য নির্ভয়ে প্রচার করতে পারবেন, তার গ্যারান্টি চায়। স্বাধীনতাই কেবল রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিসহ জীবন ও সমাজের যাবতীয় বিষয়ে মানুষকে উপযুক্ত করে তোলে। চিন্তার স্বাধীনতাই কেবল একজন ভালো রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, চিত্র ও সংগীত পরিচালক, সাংবাদিক, আইনজীবীর জন্ম দিতে পারে। চিন্তা যখন বিভিন্ন ধর্মের কারাগারে বন্দি ছিল, তখন কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব হয়নি। চিন্তার অবাধ স্বাধীনতা প্রথম যুগে গ্রিক-রোমান সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। বর্তমানে পশ্চিমা সভ্যতার জন্মের শুরু ইতালির রেনেসাঁ থেকে। ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন ও শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানে ধর্মীয় কারাগারের প্রাচীর ভেঙে পড়ে এবং চিন্তার স্বাধীনতা পুনর্প্রতিষ্ঠা পায়। চিন্তা ও আলোচনা-সমালোচনার অবাধ স্বাধীনতা পশ্চিমা সভ্যতার উত্থানের একটি প্রধান শর্ত ছিল।
কিন্তু ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবিদার উন্নত দেশগুলোতেও চিন্তার স্বাধীনতা আজ হুমকির সম্মুখে পড়েছে। সতেরো ও আঠারো শতকের ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পৃথিবীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ প্রতিক্রিয়ার দুর্গে পরিণত হয়েছে। গবেষণাগারগুলোতে বিশেষ উদ্দেশ্য সামনে রেখে গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। শিক্ষা-গবেষণায় আজ স্বাধীনতা নেই। সমাজ ও মানুষ সংক্রান্ত গবেষণা তো বটেই, প্রকৃতির গবেষণাও আজ শাসক শ্রেণীর নিয়ন্ত্রিত। গবেষণায় আজ রাষ্ট্রের তেমন ভূমিকা নেই।
তাই রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে শিক্ষা ও গবেষণায় সামান্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। তার দায়িত্ব আজ কতিপয় বড় কর্পোরেট ও বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। প্রথমত, শাসক শ্রেণী; দ্বিতীয়, মুক্ত চিন্তার শত্রু; কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ধর্মান্ধ গণমানুষের সাংস্কৃতিক চেতনা; তৃতীয়, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে উদাসীন আত্মকেন্দ্রিক ভাবাদর্শ এবং একটি ক্ষুদ্র আমলাতান্ত্রিক বন্ধনে আবদ্ধ জীবাশ্মভূত কুসংস্কার এবং ভাবাদর্শিক সেন্সরশিপ, যা আমলাতন্ত্রের শক্তিশালী হাতিয়ার। এরাই আজ মানবজাতির মিত্র নয়।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক
No comments