মানবপাচারেও বৈষম্য এবং দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ by আহমদ রফিক

মানবপাচার, সমুদ্র্রে ভাসমান মানুষ, একুশ শতকে দাস ব্যবসা, একাধিক দেশের জঙ্গলে বন্দিশিবির, নির্যাতন ইত্যাদি ঘটনা সংবাদপত্র ও পাঠক মহলে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে সুউচ্চ ঢেউ তুলেছিল এই তো কিছুদিন আগের কথা। ইতোমধ্যে যথারীতি ঢেউ নেমে গেছে ‘সময়’ নামক ভাটার টানে। এখন সব শান্ত, চারদিক সুনসান। কিন্তু সমস্যা ঠিকই রয়ে গেছে। এখনো অনেক মানুষ উদ্ধারের অপেক্ষায়। পাচার করে আনা মানুষের ক্যাম্প তথা বন্দিশিবিরগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়নি, অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি বিধানও সম্ভব হয়নি। এর মধ্যেই নেমে এসেছে ব্যবস্থাহীন নিস্তব্ধতা। একুশ শতকে পৌঁছেও বিশ্বের মানবিকবোধ কি পর্যায়ে রয়েছে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলি তার প্রমাণ দিচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ কেন বিশ্বের উন্নতমান, অগ্রসর চেতনার দেশগুলোও এ মানবিক ট্র্যাজেডির বিরুদ্ধে ব্যবস্থাপনায় কেমন যেন উদাসীন।
আজকের একটি দৈনিকে (২৬ জুন) শিরোনাম ‘পাচারের শিকার হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয়!’ ঘটনায় প্রকাশ : ‘যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে ৮২ তরুণকে পাচার করেছে আন্তর্জাতিক পাচারকারী একটি চক্র। এ জন্য জনপ্রতিনিধি ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা করে প্রায় ২৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। এর সঙ্গে জড়িত ঢাকা বিমানবন্দরের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীও। এ ঘটনার রয়েছে একাধিক পার্শ্বমুখ। যেমন দেশে বিরাজমান বেকারত্ব (যদিও অর্থনৈতিক স্বচ্ছকে অগ্রগতির দাবি রয়েছে আমাদের), স্বপ্নের দেশে যাত্রার আকাক্সক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধে ব্যাপক ধস ও দুর্নীতির মহামারী, সর্বোপরি অন্যায়-অপরাধ অনৈতিকতার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অভাব। এ পরিস্থিতিতে অনাচার, অন্যায়, অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে এমনটাই স্বাভাবিক।
পার্শ্ব প্রসঙ্গ হিসেবে আমাদের উদ্ভট মননশীলতা ও মানবিকতা সম্বন্ধে দু’চার ছত্র বলা দরকার। যে মেধাবী সাংবাদিক এ পত্র সে পত্র করে শেষ পর্যন্ত স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র জোগাড় করে, মার্কিন ভূমিতে বিচিত্র কাজ করে (যেমন ওসিডিসি) জীবিকা নির্বাহ করতে তার সাংস্কৃতিক মর্যাদায় বাঁধবেন না তার যত অসুবিধা স্বদেশে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে। কেন এ আত্মমর্যাদাহীন উদ্ভট মানসিকতা? এ ছাড়া মেধার বহির্গমন তো বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী হয়তো বলবেন, সামাজিক পরিবেশ অর্থনৈতিক বৈষম্য ইত্যাদি এজন্য দায়ী। সমাজে বাস্তবিকই রয়েছে একরাশ বৈষম্য এবং সুস্থ ও স্বচ্ছ জীবনযাপনের অনুপযোগী পরিবেশ। এ মূল্যায়নের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না করেও বলি, নিজ দেশে থেকে জীবনযাত্রার লড়াই চালানোটাই কি নাগরিক মর্যাদার উপযোগী নয়? অবশ্য বিশ্বায়নের যুগে ভিন্নমতই স্বাভাবিক। তবে বিশ্বায়ন করে বা কাদের সুবিধার জন্য সেটাও বিবেচনার বিষয়।
দুই
মানবপাচারেও বৈষম্য এবং দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশআবার মূল প্রসঙ্গ, পাচার প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নর-নারী পাচারের আরেকটি বড় সূত্র ও আনুষঙ্গিক কারণ পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের ওপর উদ্দেশ্যমূলক, সম্প্রদায়বাদী রাজনৈতিক অত্যাচার, পীড়ন পরিশেষে বিতাড়ন। মিয়ানমার সরকার ও রাখাইন সমাজ এ অপরাধে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এমনই এক পর্যায়ে যে মুসলমান রোহিঙ্গা বৌদ্ধ রাখাইনদের তাড়নায় বাস্তুগম করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের উপযুক্ত কাজই করছে মিয়ানমারের রাখাইন সমাজ!
অনেক আগেই বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছিল। নেহাতই মানবিক বিবেচনায়। সেই সঙ্গে যে কাজটি করা উচিত ছিল তাহলো এ বিষয়ে অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের তাদের স্বদেশে নিরাপদ পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে দৃঢ় কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করা। মিয়ানমার তা না চাইলে এ বিষয়ে ফয়সালা করতে জাতিসংঘের সাহায্য নেয়া এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হওয়া। বাংলাদেশ দৃঢ়তার সঙ্গে এ কাজটি করেনি। এমন কি ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে ভিন্ন ধারার শরণার্থী সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়নি। বরং বিষয়টি নিয়ে হেলাফেলার পরিচয় দিয়েছে। ইতোমধ্যে এনজিওসহ নানা সূত্রে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে মৌলবাদী, জঙ্গিবাদী ও সম্প্রদায়বাদী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তের সূচনা তার নিরসনেও কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সমস্যাটিকে জিইয়ে রেখে বাড়তে দেয়া হয়েছে। এ সূত্রে শুরু হয়েছে রাখাইন রাজ্যের অনাচারী তৎপরতার কারণে বাংলাদেশে আরো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, আরো সামাজিক সমস্যা। মনে রাখা দরকার যে, মানবপাচারের ঘটনাও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য ও দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ বই কিছু নয়।
সংবাদপত্র পাঠকের মনে থাকার কথা যে, মানবপাচারের ঘটনাবলি সংবাদপত্রে প্রকাশের সময় দেখা গেছে পাচার হওয়া দুর্গত মানুষের একটি বড় অংশ বাংলাদেশি নাগরিক এবং রোহিঙ্গা। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দূরবস্থা সামাজিক অসহায়তা মানুষগুলোকে পাচারকারীদের চক্রান্তের শিকার করে তুলেছে। আমরা আগেই বলেছি, এসব ঘটনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণœ হয়েছে। এতদসত্ত্বেও মানবপাচারের বিষয়টি নিয়ে কোনো পক্ষের মাথাব্যথা দেখা যাচ্ছে না। আমরা আগেও বলেছি, রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে বাংলাদেশ সরকারের অধিকতর গুরুত্বে গ্রহণ করে এর চূড়ান্ত ফয়সালার পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ সামাজিক ইস্যু রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হতে চলেছে। দরকার এ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলকে সচেতন করে তোলা।
সম্প্রতি এ বিষয়ে আইসিআরসির টনক নড়েছে বলে মনে হয়। একটি ভারতীয় পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উল্লিখিত সংস্থার সভাপতি মন্তব্য করেছেন যে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান দরকার। তার মতে সমাজ আজ সংঘাতময়। অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য বাড়ছে বলে সহিংসতাও বাড়ছে। তিনি উল্লেখ করেছেন মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সহিংসতার কথা, রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হওয়ার কথা। এ সমস্যা রাজনৈতিক। কাজেই এর সমাধান রাজনৈতিকভাবেই হওয়া দরকার। কিন্তু এ বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি মোটেই সমঝোতার নয়। কাজেই এ সমস্যার আশু সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের অবিলম্বে লাগাতার উদ্যোগ নেয়া উচিত। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ মানবপাচারের দুই মাত্রার দিকে নজর দেয়া। দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূর করা, বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়া ইত্যাদি। সে সঙ্গে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা হলো মানবপাচারকারী চক্রের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অভিযান চালিয়ে তাদের নির্মূল করার ব্যবস্থা নেয়া। এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। তবে পাচারকারী চক্রের নেটওয়ার্ক যথেষ্ট বড় এবং শক্ত। তাই কাজটা কঠিন হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এ কাজটি শক্ত হাতে মোকাবিলা করার দরকার। তা না হলে এ অবস্থা ক্রমে বিপজ্জনক সামাজিক সমস্যায় পরিণত হবে।
লেখক : ভাষা সংগ্রামী, রবীন্দ্র গবেষক, কবি, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.