এবার পাঠ্যবই বিদেশে ছাপা হচ্ছে না! by শরিফুজ্জামান
প্রাথমিকের
পাঠ্যবই ছাপতে বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার অংশগ্রহণ ঠেকাতে জোট বেঁধেছেন
দেশের ২২ মুদ্রাকর ও প্রকাশক। তাঁরা ৩২ থেকে ৪১ শতাংশ কম দরে দরপত্র জমা
দিয়ে বই ছাপার কাজ পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই অবিশ্বাস্য কম দামে বই ছাপার কাজ দেওয়া হলে নির্দিষ্ট শর্ত ও মান রক্ষা করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ, মানসম্পন্ন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো কঠিন হবে।
২০১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সাদা কাগজে প্রাথমিকের চার রঙের বই ছাপা হচ্ছে। তখন থেকে ভারত, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি ছাপাখানা দরপত্রে অংশ নেওয়া শুরু করে। যদিও পরে শুধু ভারতের কয়েকটি ছাপাখানা অংশ নিয়ে আসছিল। শুরু থেকেই দেশীয় প্রকাশকেরা বিদেশি ছাপাখানায় বই ছাপতে দেওয়ার বিরোধিতা করে আসছিলেন। অন্যদিকে সরকারের যুক্তি ছিল, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কাজ হলে পাঠ্যবইয়ের মান বাড়বে।
তখন থেকে বই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষ সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার বেক্সিমকোর মালিকানাধীন তিনটি ছাপাখানাকে সিংহভাগ কাজ দিয়ে বিপাকে পড়ে। তখন এ নিয়ে বেশ হইচই হয়। এরপর আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এলে আবারও প্রকাশকদের হাতে জিম্মি হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এত দিন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এলেও এবার নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, গত বছরের দরপত্র এবং এখনকার বাজারদর পর্যালোচনা করে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড শুধু প্রাথমিক স্তরের বইয়ের জন্য ৩৩০ কোটি টাকা খরচের বিষয়টি প্রাক্কলন করে। কিন্তু ২২ জন মুদ্রাকর ও প্রকাশক জোটবদ্ধ হয়ে ২২১ কোটি টাকায় কাজ করার দরপত্র জমা দেন। সরকার যে টাকায় কাজ করাতে চায়, মুদ্রাকর ও প্রকাশকেরা তার চেয়ে ১০৯ কোটি টাকা কমে কাজ করতে আগ্রহী।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার অংশগ্রহণ ঠেকাতে দেশীয় প্রকাশক ও মুদ্রাকরেরা অস্বাভাবিক এই কম দাম দিয়েছেন। লট ভিত্তিতে তাঁরা দর দেওয়ায় সরকারি ক্রয়বিধির লঙ্ঘন না হলেও বাজারমূল্য অনুযায়ী এই দামে মানসম্পন্ন বই দেওয়া সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে সরকার প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী দুলাল সরকার জোটবদ্ধ হয়ে কম দর দেওয়ার কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলো এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু সরকার আমাদের চাপে রাখতে ভারতসহ কয়েকটি দেশকে ছাপার কাজ দিচ্ছে। আমরা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, আমরাই এটা করতে পারি।’
দুলাল সরকার নিজের মালিকানাধীন একাধিক ছাপাখানার নামে প্রায় ২০ শতাংশ কাজ পেতে যাচ্ছেন। নিজের মালিকানাধীন একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে বেশি কাজ পাওয়া অন্য দুই প্রকাশক হলেন এস এম মোহসীন ও রাব্বানী জব্বার।
এক প্রশ্নের জবাবে দুলাল সরকার বলেন, ‘ব্যাংকঋণ নিয়ে, ছাপাখানা বসিয়ে, লোকজন নিয়োগ করে আমরা সারা বছর পাঠ্যবই ছাপার কাজের জন্য বসে থাকি। সেই কাজ যাতে অন্যরা না পায়, সে জন্য আমরা জোটবদ্ধ হয়েছি।’ এই দরে কাজ করা কঠিন—এ কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা কম লাভ করব বা হয়তো লাভ করব না। কিন্তু সম্মিলিতভাবে আমরাই কাজ করতে চাই।’
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে এবার ৭৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৩৫ কোটি বই ছেপে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ২৯২ কোটি, প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে ৩৮ কোটি এবং মাধ্যমিকে ৪৪৩ কোটি টাকা দর প্রাক্কলন করে এনসিটিবি দরপত্র আহ্বান করে। এই তিনটি স্তরেই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দর পড়েছে বলে বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আলোচনার সূত্র ধরে গতকাল রোববার এনসিটিবিতে গিয়ে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মুখে মুখে এ বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। তাঁদের আশঙ্কা, এই দরে মানসম্মত বই দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র পাল এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী বোর্ড কাজ বুঝে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। বোর্ড বেশি দর প্রাক্কলন করেছে কি না, জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, দর প্রাক্কলন ঠিকই আছে। তবে দরদাতারা অনেক কম দাম দিয়েছেন। বিষয়টি সরকারি ক্রয়বিধির লঙ্ঘন নয় বলে জানান তিনি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে কেন্দ্রীয় ক্রয় কারিগরি ইউনিটের সাবেক মহাপরিচালক অমূল্য দেবনাথ এ বিষয়ে প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, পণ্যের ক্ষেত্রে প্রাক্কলিত দরের কতটা কম বা বেশি দর দেওয়া যাবে, সরকারি ক্রয়বিধিতে তা বলা নেই। তবে এটি বলা উচিত ছিল। এখন করণীয় হচ্ছে সতর্কতার সঙ্গে ও কঠোরভাবে পণ্য বুঝে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
এনসিটিবির একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ২৫ জুন প্রাথমিকের দরপত্র উন্মুক্ত করে কম দর দেওয়ার এই বিস্ময়কর তথ্য দেখতে পান কমিটির সদস্যরা। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ কোটি বই ছাপার জন্য এনসিটিবি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে এ বছরের ২৯ এপ্রিল। কিন্তু ২০টি প্যাকেজে অংশ নেওয়া ২২টি ছাপাখানার সবাই জোট বেঁধে ৩১ দশমিক ৯৪ শতাংশ কম দর দেয়। প্রাথমিকে ২৯২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত দরের বিপরীতে তারা ১৯৮ কোটি টাকায় কাজ করতে আগ্রহ দেখায়।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছর প্রতি ফর্মায় প্রাক্কলিত দর ছিল আড়াই টাকা। এবার তা ধরা হয় ২ টাকা ৩ পয়সা। এ ছাড়া গত বছর ফর্মাপ্রতি উদ্ধৃত দর ছিল ১ টাকা ৬৯ পয়সা, এবার তা ১ টাকা ৩৭ পয়সা।
এই প্রক্রিয়ায় বিদেশি ছাপাখানা ছাড়াও দেশের গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট বড় দুটি ছাপাখানা বাদ পড়ে যায়। দেশীয় ছাপাখানা দুটি এ অবস্থায় প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৪১ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম দর দাখিল করে প্রাক্-প্রাথমিকের দুটি লটের কাজ নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে। প্রাক্-প্রাথমিকে মোট প্রাক্কলিত দর ছিল ৩৮ কোটি ২২ লাখ টাকা, দেশীয় দুটি ছাপাখানা তা ২২ কোটি ৪৩ লাখ টাকায় নিতে চায়।
প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের দরপত্র বিশ্লেষণ করা হলেও গতকাল রোববার পর্যন্ত মাধ্যমিকের দরপত্র পর্যালোচনা করা শেষ হয়নি। ছোট ছোট লটে বিভক্ত হওয়ায় মাধ্যমিকের দরপত্রে প্রাক্কলিত দরের কত কম দেওয়া হয়েছে, তা নিশ্চিত করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি উভয়সংকট তৈরি করেছে। ছাপাখানাগুলো রক্ষার স্বার্থে কাজ পাওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু এটা করতে গিয়ে হয়তো পাঠ্যবইয়ের মানের সঙ্গে আপস করতে হবে। কারণ, মুদ্রাকর বা প্রকাশকেরা তো আর পকেট থেকে টাকা দেবেন না।
সেরনিয়াবাত মনে করেন, এত কম দর দিয়ে যে ২২টি প্রতিষ্ঠান কাজ নিচ্ছে, সেগুলোর তিন-চারটি ছাড়া বাকিগুলো লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কাই বেশি।
এনসিটিবির একাধিক সূত্র জানায়, অস্বাভাবিক কম দরে কাজ নেওয়া ছাপাখানাগুলোকে অনিয়মের আশ্রয় নিতেই হবে। কারণ, এই টাকায় ৮০ গ্রাম সাদা কাগজ, নির্দিষ্ট উজ্জ্বলতা ও পুরুত্ব এবং চার রঙে মানসম্মত ছাপার সুযোগ থাকবে না।
ওই সূত্র জানায়, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মান নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন আছে।
এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ছাপাখানাগুলো বিশেষ কৌশলের অংশ হিসেবে বছরের শেষ ভাগে গিয়ে তড়িঘড়ি করে বই সরবরাহ শুরু করে, যখন বইয়ের মানের চেয়ে শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছানোটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ওই কর্মকর্তার মতে, এই দরে সাদা কাগজ দূরে থাক, নিউজপ্রিন্টেও বই দেওয়া সম্ভব নয়।
তবে একাধিক ক্ষুব্ধ প্রকাশক বলেন, ভারত বা অন্যান্য দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে এ দেশের বই ছাপার জন্য কর দিতে হয় না। বরং বিনিয়োগকৃত টাকা লাভসহ তারা প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স) হিসেবে দেশে নিতে পারে। কিন্তু দেশীয় প্রকাশকদের ৬ শতাংশের মতো কর দিতে হয়।
এ অবস্থায় কী করণীয় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থাকলে ভালো হতো—এটাও যেমন সত্য, তেমনি দেশীয় প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ চাই। এ পরিস্থিতিতে আমার বিশ্বাস, দেশীয় প্রকাশকেরা এমন কিছু করবেন না, যা চূড়ান্তভাবে ছেলেমেয়েদের ক্ষতি করে।’
বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এই নির্বাহী পরিচালকের মতে, মন্ত্রণালয় ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের উচিত কঠোর নজরদারির মাধ্যমে মানসম্মত কাজ আদায় করে নিতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিষয়টি পর্যালোচনা করার পর মন্তব্য করবেন বলে প্রথম আলোকে জানান।
তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই অবিশ্বাস্য কম দামে বই ছাপার কাজ দেওয়া হলে নির্দিষ্ট শর্ত ও মান রক্ষা করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ, মানসম্পন্ন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো কঠিন হবে।
২০১১ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে সাদা কাগজে প্রাথমিকের চার রঙের বই ছাপা হচ্ছে। তখন থেকে ভারত, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়ার কয়েকটি ছাপাখানা দরপত্রে অংশ নেওয়া শুরু করে। যদিও পরে শুধু ভারতের কয়েকটি ছাপাখানা অংশ নিয়ে আসছিল। শুরু থেকেই দেশীয় প্রকাশকেরা বিদেশি ছাপাখানায় বই ছাপতে দেওয়ার বিরোধিতা করে আসছিলেন। অন্যদিকে সরকারের যুক্তি ছিল, প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে কাজ হলে পাঠ্যবইয়ের মান বাড়বে।
তখন থেকে বই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে তেমন সমস্যা হয়নি। এর আগে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শেষ সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার বেক্সিমকোর মালিকানাধীন তিনটি ছাপাখানাকে সিংহভাগ কাজ দিয়ে বিপাকে পড়ে। তখন এ নিয়ে বেশ হইচই হয়। এরপর আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এলে আবারও প্রকাশকদের হাতে জিম্মি হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এত দিন পরিস্থিতি সামাল দিয়ে এলেও এবার নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, গত বছরের দরপত্র এবং এখনকার বাজারদর পর্যালোচনা করে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড শুধু প্রাথমিক স্তরের বইয়ের জন্য ৩৩০ কোটি টাকা খরচের বিষয়টি প্রাক্কলন করে। কিন্তু ২২ জন মুদ্রাকর ও প্রকাশক জোটবদ্ধ হয়ে ২২১ কোটি টাকায় কাজ করার দরপত্র জমা দেন। সরকার যে টাকায় কাজ করাতে চায়, মুদ্রাকর ও প্রকাশকেরা তার চেয়ে ১০৯ কোটি টাকা কমে কাজ করতে আগ্রহী।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার অংশগ্রহণ ঠেকাতে দেশীয় প্রকাশক ও মুদ্রাকরেরা অস্বাভাবিক এই কম দাম দিয়েছেন। লট ভিত্তিতে তাঁরা দর দেওয়ায় সরকারি ক্রয়বিধির লঙ্ঘন না হলেও বাজারমূল্য অনুযায়ী এই দামে মানসম্পন্ন বই দেওয়া সম্ভব নয়।
জানতে চাইলে সরকার প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী দুলাল সরকার জোটবদ্ধ হয়ে কম দর দেওয়ার কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলো এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু সরকার আমাদের চাপে রাখতে ভারতসহ কয়েকটি দেশকে ছাপার কাজ দিচ্ছে। আমরা সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, আমরাই এটা করতে পারি।’
দুলাল সরকার নিজের মালিকানাধীন একাধিক ছাপাখানার নামে প্রায় ২০ শতাংশ কাজ পেতে যাচ্ছেন। নিজের মালিকানাধীন একাধিক প্রতিষ্ঠানের নামে বেশি কাজ পাওয়া অন্য দুই প্রকাশক হলেন এস এম মোহসীন ও রাব্বানী জব্বার।
এক প্রশ্নের জবাবে দুলাল সরকার বলেন, ‘ব্যাংকঋণ নিয়ে, ছাপাখানা বসিয়ে, লোকজন নিয়োগ করে আমরা সারা বছর পাঠ্যবই ছাপার কাজের জন্য বসে থাকি। সেই কাজ যাতে অন্যরা না পায়, সে জন্য আমরা জোটবদ্ধ হয়েছি।’ এই দরে কাজ করা কঠিন—এ কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা কম লাভ করব বা হয়তো লাভ করব না। কিন্তু সম্মিলিতভাবে আমরাই কাজ করতে চাই।’
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে এবার ৭৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৩৫ কোটি বই ছেপে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে বিতরণ করার প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ২৯২ কোটি, প্রাক্-প্রাথমিক স্তরে ৩৮ কোটি এবং মাধ্যমিকে ৪৪৩ কোটি টাকা দর প্রাক্কলন করে এনসিটিবি দরপত্র আহ্বান করে। এই তিনটি স্তরেই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে কম দর পড়েছে বলে বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আলোচনার সূত্র ধরে গতকাল রোববার এনসিটিবিতে গিয়ে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মুখে মুখে এ বিষয়টি আলোচনা হচ্ছে। তাঁদের আশঙ্কা, এই দরে মানসম্মত বই দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান নারায়ণ চন্দ্র পাল এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী বোর্ড কাজ বুঝে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। বোর্ড বেশি দর প্রাক্কলন করেছে কি না, জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, দর প্রাক্কলন ঠিকই আছে। তবে দরদাতারা অনেক কম দাম দিয়েছেন। বিষয়টি সরকারি ক্রয়বিধির লঙ্ঘন নয় বলে জানান তিনি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে কেন্দ্রীয় ক্রয় কারিগরি ইউনিটের সাবেক মহাপরিচালক অমূল্য দেবনাথ এ বিষয়ে প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, পণ্যের ক্ষেত্রে প্রাক্কলিত দরের কতটা কম বা বেশি দর দেওয়া যাবে, সরকারি ক্রয়বিধিতে তা বলা নেই। তবে এটি বলা উচিত ছিল। এখন করণীয় হচ্ছে সতর্কতার সঙ্গে ও কঠোরভাবে পণ্য বুঝে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
এনসিটিবির একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত ২৫ জুন প্রাথমিকের দরপত্র উন্মুক্ত করে কম দর দেওয়ার এই বিস্ময়কর তথ্য দেখতে পান কমিটির সদস্যরা। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ কোটি বই ছাপার জন্য এনসিটিবি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে এ বছরের ২৯ এপ্রিল। কিন্তু ২০টি প্যাকেজে অংশ নেওয়া ২২টি ছাপাখানার সবাই জোট বেঁধে ৩১ দশমিক ৯৪ শতাংশ কম দর দেয়। প্রাথমিকে ২৯২ কোটি টাকা প্রাক্কলিত দরের বিপরীতে তারা ১৯৮ কোটি টাকায় কাজ করতে আগ্রহ দেখায়।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছর প্রতি ফর্মায় প্রাক্কলিত দর ছিল আড়াই টাকা। এবার তা ধরা হয় ২ টাকা ৩ পয়সা। এ ছাড়া গত বছর ফর্মাপ্রতি উদ্ধৃত দর ছিল ১ টাকা ৬৯ পয়সা, এবার তা ১ টাকা ৩৭ পয়সা।
এই প্রক্রিয়ায় বিদেশি ছাপাখানা ছাড়াও দেশের গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট বড় দুটি ছাপাখানা বাদ পড়ে যায়। দেশীয় ছাপাখানা দুটি এ অবস্থায় প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ৪১ দশমিক ৪৩ শতাংশ কম দর দাখিল করে প্রাক্-প্রাথমিকের দুটি লটের কাজ নেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে। প্রাক্-প্রাথমিকে মোট প্রাক্কলিত দর ছিল ৩৮ কোটি ২২ লাখ টাকা, দেশীয় দুটি ছাপাখানা তা ২২ কোটি ৪৩ লাখ টাকায় নিতে চায়।
প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের দরপত্র বিশ্লেষণ করা হলেও গতকাল রোববার পর্যন্ত মাধ্যমিকের দরপত্র পর্যালোচনা করা শেষ হয়নি। ছোট ছোট লটে বিভক্ত হওয়ায় মাধ্যমিকের দরপত্রে প্রাক্কলিত দরের কত কম দেওয়া হয়েছে, তা নিশ্চিত করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি উভয়সংকট তৈরি করেছে। ছাপাখানাগুলো রক্ষার স্বার্থে কাজ পাওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু এটা করতে গিয়ে হয়তো পাঠ্যবইয়ের মানের সঙ্গে আপস করতে হবে। কারণ, মুদ্রাকর বা প্রকাশকেরা তো আর পকেট থেকে টাকা দেবেন না।
সেরনিয়াবাত মনে করেন, এত কম দর দিয়ে যে ২২টি প্রতিষ্ঠান কাজ নিচ্ছে, সেগুলোর তিন-চারটি ছাড়া বাকিগুলো লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কাই বেশি।
এনসিটিবির একাধিক সূত্র জানায়, অস্বাভাবিক কম দরে কাজ নেওয়া ছাপাখানাগুলোকে অনিয়মের আশ্রয় নিতেই হবে। কারণ, এই টাকায় ৮০ গ্রাম সাদা কাগজ, নির্দিষ্ট উজ্জ্বলতা ও পুরুত্ব এবং চার রঙে মানসম্মত ছাপার সুযোগ থাকবে না।
ওই সূত্র জানায়, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে মান নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে আগে থেকেই প্রশ্ন আছে।
এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ছাপাখানাগুলো বিশেষ কৌশলের অংশ হিসেবে বছরের শেষ ভাগে গিয়ে তড়িঘড়ি করে বই সরবরাহ শুরু করে, যখন বইয়ের মানের চেয়ে শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছানোটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। ওই কর্মকর্তার মতে, এই দরে সাদা কাগজ দূরে থাক, নিউজপ্রিন্টেও বই দেওয়া সম্ভব নয়।
তবে একাধিক ক্ষুব্ধ প্রকাশক বলেন, ভারত বা অন্যান্য দেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলোকে এ দেশের বই ছাপার জন্য কর দিতে হয় না। বরং বিনিয়োগকৃত টাকা লাভসহ তারা প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স) হিসেবে দেশে নিতে পারে। কিন্তু দেশীয় প্রকাশকদের ৬ শতাংশের মতো কর দিতে হয়।
এ অবস্থায় কী করণীয় জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থাকলে ভালো হতো—এটাও যেমন সত্য, তেমনি দেশীয় প্রকাশনা শিল্পের বিকাশ চাই। এ পরিস্থিতিতে আমার বিশ্বাস, দেশীয় প্রকাশকেরা এমন কিছু করবেন না, যা চূড়ান্তভাবে ছেলেমেয়েদের ক্ষতি করে।’
বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এই নির্বাহী পরিচালকের মতে, মন্ত্রণালয় ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের উচিত কঠোর নজরদারির মাধ্যমে মানসম্মত কাজ আদায় করে নিতে সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিষয়টি পর্যালোচনা করার পর মন্তব্য করবেন বলে প্রথম আলোকে জানান।
No comments