৫০ লাখ প্রবাসীর হাতে পুরোনো পাসপোর্ট by কামরুল হাসান
আগামী ২৪ নভেম্বরের পর থেকে পৃথিবীর কোথাও হাতে লেখা পাসপোর্ট চলবে না
পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতায় যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) নিয়ে ভয়াবহ সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ, এখনো অন্তত ৫০ লাখ প্রবাসীর হাতে এমআরপি পৌঁছাতে পারেনি সরকার। এদিকে আগামী ২৪ নভেম্বরের পর থেকে পৃথিবীর কোথাও হাতে লেখা পাসপোর্ট চলবে না।
বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এমআরপি প্রকল্প চালুর পর পাঁচ বছরে প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১ হাজার ১০০ প্রবাসীর হাতে এই পাসপোর্ট পৌঁছেছে। অর্থাৎ প্রকল্প চালুর পর ২০ লাখ প্রবাসী এমআরপি পেয়েছেন। এই সময়ে আরও ২০ লাখ প্রবাসী দেশেই এমআরপি পেয়েছেন। সরকারের হিসাবে প্রবাসীর সংখ্যা ৯০ লাখ। এই হিসাবে এখনো ৫০ লাখ প্রবাসী এমআরপি পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু এখন পাসপোর্ট দেওয়ার যে ধীরগতি, তা অব্যাহত থাকলে অবশিষ্ট সাড়ে তিন মাসে এত মানুষকে এমআরপি দেওয়া সম্ভব হবে না।
এমআরপি দেওয়ার কাজ পেয়েছে মালয়েশীয় প্রতিষ্ঠান আইরিস করপোরেশন। সাবেক প্রবাসীকল্যাণ-মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, পররাষ্ট্রসচিবসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা এই প্রতিষ্ঠানের কাজের ব্যাপারে বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সরকার কেন ব্যবস্থা নেয়নি, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে কী হয়েছে, সেটা বড় কথা না। সামনে যে সময়টা আছে, সেই সময়ের মধ্যে কাজটা শেষ করতে চাই এবং সেটা পারব।’
বিভিন্ন সরকারি নথি ও দূতাবাস থেকে পাঠানো কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অতীতে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগ ছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমআরপি সমস্যা সমাধানে তাঁর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স এবং সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে প্রধান করে উপদেষ্টা কমিটি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুই কমিটি বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও কাজে গতি আনেনি আইরিস।
সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী এবং বর্তমান এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে আমি বারবার তাগাদা দিয়েছি, চাপ দিয়েছি। কিন্তু আমি তো এখন নেই। আমি তো আর অনধিকার চর্চা করতে পারি না। তবে যা শুনছি, তাতে এমআরপি নিয়ে ভয়াবহ সংকট তৈরি হবে।’
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে আইরিসকে সৌদি আরবে প্রতিদিন নয় হাজার এবং আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় প্রতিদিন পাঁচ হাজার করে এমআরপি দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা এখনো সৌদি আরবে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৯০০, আরব আমিরাতে ১২৫ এবং মালয়েশিয়ায় মাত্র ৭০টি এমআরপি দিতে পারছে। সর্বশেষ গত ৯ এপ্রিল কাজে গতি আনতে তাদের এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু কাজে গতি আসেনি।
এমন পরিস্থিতিতে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব প্রবাসী এমআরপি পাবেন না। এর ফলে বিদেশে হয়রানির শিকার হবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এমআরপি না থাকায় বৈধ আকামা বা কাজের অনুমতিও পাসপোর্টে লাগাতে পারবেন না তাঁরা। এতে তাঁদের অবৈধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এন এম জিয়াউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সবাই তো আর একসঙ্গে ভ্রমণ করবেন না যে তাঁদের একসঙ্গে এমআরপি লাগবে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাসপোর্ট শ্রমিকদের হাতে থাকে না, এটা থাকে তাঁদের নিয়োগকারীদের কাছে। তিনি আশা করছেন, পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (আইসিএও) বাংলাদেশকে এমআরপি চালুর নির্দেশনা দিয়েছিল ১৬ বছর আগে। কিন্তু বাংলাদেশ যথাযথ উদ্যোগ নিতে না পারায় এখন সংকট তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমআরপি প্রকল্প চালু হওয়ার পর প্রায় পাঁচ বছরে ৯২ লাখ ৯১ হাজার বাংলাদেশি এমআরপি পেয়েছেন। ৩০ জুলাই ৯০ লাখ প্রবাসীর মধ্যে মাত্র ১৯ লাখ ৭৩ হাজার এমআরপি পেয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের ভুল সিদ্ধান্ত এবং এমআরপি প্রকল্পের কর্মকর্তাদের ঢিলেমির কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ কাজটি দ্রুত করার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ (আউটসোর্সিং) দিয়েছিল সরকার। তাতে এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো জটিলতা তৈরি হয়। সবচেয়ে বেশি জটিলতা তৈরি হয় সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নবনিযুক্ত প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম ‘এ সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য একটা বড় উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এটা হলে আমার মনে হয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ কী ধরনের বড় উদ্যোগ জানতে চাইলে, তা তিনি বলতে পারেননি।
আউটসোর্সিং ডুবিয়েছে: পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫০ লাখের বেশি প্রবাসী রয়েছেন। এ কারণেই সেখানে এমআরপির তথ্যসংগ্রহ, ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ ও ডিজিটাল স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজটি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার জন্য ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দরপত্র ডাকা হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজটি পায় ডেটাএজ-আইপিপল কনসোর্টিয়াম। কিন্তু তারা কাজটি শুরুর পর মাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার এমআরপি তৈরি করতে শুরু করে। কিন্তু আইরিস সেই কাজটি নেওয়ার পর এখন মাসে দুই হাজার এমআরপিও দিতে পারছে না।
ডেটাএজ-এর চেয়ারম্যান আহসান হাবিব অভিযোগ করেন, এমআরপি বই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইরিস চাপের মুখে তাঁদের কাজ নিয়ে নেয়। তবে আইরিস নিজের নামে না নিয়ে ‘বিতারা আবাদি’ নামে আরেকটি কোম্পানি খুলে মালয়েশিয়ায়। আবার বিতারা কাজটি দীপন ইনফো টেক নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেয়। কিছুদিন আগে তারাও মালয়েশিয়ায় এমআরপির কাজ প্রায় বন্ধ করে দেয়।
এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ডাটাএজ ও আইরিসের দ্বন্দ্বে মালয়েশিয়ায় আউটসোর্সিং প্রায় বন্ধ। তাদের দ্বন্দ্ব না মেটায় এখন দূতাবাসের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার মতোই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে আমিরাতে। সেখানে অবশ্য দরপত্রের মাধ্যমেই কাজ পেয়েছিল আইরিস করপোরেশন। কিন্তু নিজেরা কাজ না করে সেখানেও তারা দীপন ইনফো টেককে কাজ দেয়। ওই প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত ফির বদলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে এবং প্রবাসী শ্রমিকদের হয়রানি করছে বলে বারবার অভিযোগ ওঠে।
৯ এপ্রিলের এমআরপি-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির কার্যপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হাইকমিশন যেখানে প্রতিদিন সাড়ে সাত শ এমআরপি দিচ্ছে, সেখানে আইরিস দিচ্ছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি। সমস্যা সমাধানে আইরিসকে সেখানে ১০০ ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র (মোবাইল ইউনিট) খোলার কথা বলা হয়। কিন্তু তারা সেই কাজটিও করতে পারেনি।
একই ঘটনা ঘটছে সৌদি আরবে। সেখানে আইরিস এক বছরে মাত্র ৪৪ হাজার ৬০০ পাসপোর্ট বিতরণ করে, তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। সেখানে আইরিসের স্থানীয় অংশীদার কোয়াদ টেলিকম, যাদের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। সমস্যা সমাধানে সেখানে ১২০টি ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র ও দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল দিতে বলা হয় আইরিসকে। এ ক্ষেত্রেও তাদের অগ্রগতি নেই।
এর আগে মালয়েশিয়া থেকে আইরিসের ভিন্ন নামে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান বিতারা আবাদি এবং দীপনের বিরুদ্ধে এমআরপি দেওয়ার নামে লোকজনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহসহ নানা অভিযোগ ওঠে। মালয়েশিয়া থেকে এ ব্যাপারে চিঠিও দেওয়া হয় ঢাকায়। কিন্তু কখনোই আইরিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে আইরিসের স্থানীয় এজেন্ট আসিফ হাসান বলেন, ‘আমি আইরিশের কেউ নই। তবে তাদের আমি চিনি। আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।’ এর আগে আসিফ হাসানকে আইরিসের পক্ষে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে দেখা গেছে। সরকারি নথিপত্রেও তাঁর নাম আছে। আইরিশের বক্তব্য জানতে তাদের মালয়েশিয়ার দপ্তরে ই-মেইল পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবদুল মাবুদের বিরুদ্ধে আইরিসকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে। কেন আইরিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে এমআরপি প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং বারবার সতর্ক করা হয়েছে।
পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতায় যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) নিয়ে ভয়াবহ সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কারণ, এখনো অন্তত ৫০ লাখ প্রবাসীর হাতে এমআরপি পৌঁছাতে পারেনি সরকার। এদিকে আগামী ২৪ নভেম্বরের পর থেকে পৃথিবীর কোথাও হাতে লেখা পাসপোর্ট চলবে না।
বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, এমআরপি প্রকল্প চালুর পর পাঁচ বছরে প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১ হাজার ১০০ প্রবাসীর হাতে এই পাসপোর্ট পৌঁছেছে। অর্থাৎ প্রকল্প চালুর পর ২০ লাখ প্রবাসী এমআরপি পেয়েছেন। এই সময়ে আরও ২০ লাখ প্রবাসী দেশেই এমআরপি পেয়েছেন। সরকারের হিসাবে প্রবাসীর সংখ্যা ৯০ লাখ। এই হিসাবে এখনো ৫০ লাখ প্রবাসী এমআরপি পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু এখন পাসপোর্ট দেওয়ার যে ধীরগতি, তা অব্যাহত থাকলে অবশিষ্ট সাড়ে তিন মাসে এত মানুষকে এমআরপি দেওয়া সম্ভব হবে না।
এমআরপি দেওয়ার কাজ পেয়েছে মালয়েশীয় প্রতিষ্ঠান আইরিস করপোরেশন। সাবেক প্রবাসীকল্যাণ-মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, পররাষ্ট্রসচিবসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা এই প্রতিষ্ঠানের কাজের ব্যাপারে বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
সরকার কেন ব্যবস্থা নেয়নি, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে কী হয়েছে, সেটা বড় কথা না। সামনে যে সময়টা আছে, সেই সময়ের মধ্যে কাজটা শেষ করতে চাই এবং সেটা পারব।’
বিভিন্ন সরকারি নথি ও দূতাবাস থেকে পাঠানো কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অতীতে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের নানা অভিযোগ ছিল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমআরপি সমস্যা সমাধানে তাঁর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স এবং সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে প্রধান করে উপদেষ্টা কমিটি করে দিয়েছিলেন। কিন্তু দুই কমিটি বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও কাজে গতি আনেনি আইরিস।
সাবেক প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী এবং বর্তমান এলজিআরডি মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে আমি বারবার তাগাদা দিয়েছি, চাপ দিয়েছি। কিন্তু আমি তো এখন নেই। আমি তো আর অনধিকার চর্চা করতে পারি না। তবে যা শুনছি, তাতে এমআরপি নিয়ে ভয়াবহ সংকট তৈরি হবে।’
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পরিস্থিতি বিবেচনা করে আইরিসকে সৌদি আরবে প্রতিদিন নয় হাজার এবং আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় প্রতিদিন পাঁচ হাজার করে এমআরপি দেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা এখনো সৌদি আরবে প্রতিদিন ৬০০ থেকে ৯০০, আরব আমিরাতে ১২৫ এবং মালয়েশিয়ায় মাত্র ৭০টি এমআরপি দিতে পারছে। সর্বশেষ গত ৯ এপ্রিল কাজে গতি আনতে তাদের এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু কাজে গতি আসেনি।
এমন পরিস্থিতিতে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও স্বীকার করছেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব প্রবাসী এমআরপি পাবেন না। এর ফলে বিদেশে হয়রানির শিকার হবেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এমআরপি না থাকায় বৈধ আকামা বা কাজের অনুমতিও পাসপোর্টে লাগাতে পারবেন না তাঁরা। এতে তাঁদের অবৈধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এন এম জিয়াউল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সবাই তো আর একসঙ্গে ভ্রমণ করবেন না যে তাঁদের একসঙ্গে এমআরপি লাগবে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পাসপোর্ট শ্রমিকদের হাতে থাকে না, এটা থাকে তাঁদের নিয়োগকারীদের কাছে। তিনি আশা করছেন, পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (আইসিএও) বাংলাদেশকে এমআরপি চালুর নির্দেশনা দিয়েছিল ১৬ বছর আগে। কিন্তু বাংলাদেশ যথাযথ উদ্যোগ নিতে না পারায় এখন সংকট তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমআরপি প্রকল্প চালু হওয়ার পর প্রায় পাঁচ বছরে ৯২ লাখ ৯১ হাজার বাংলাদেশি এমআরপি পেয়েছেন। ৩০ জুলাই ৯০ লাখ প্রবাসীর মধ্যে মাত্র ১৯ লাখ ৭৩ হাজার এমআরপি পেয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের ভুল সিদ্ধান্ত এবং এমআরপি প্রকল্পের কর্মকর্তাদের ঢিলেমির কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ কাজটি দ্রুত করার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ (আউটসোর্সিং) দিয়েছিল সরকার। তাতে এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, উল্টো জটিলতা তৈরি হয়। সবচেয়ে বেশি জটিলতা তৈরি হয় সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নবনিযুক্ত প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী নুরুল ইসলাম ‘এ সমস্যা থেকে বের হওয়ার জন্য একটা বড় উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এটা হলে আমার মনে হয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ কী ধরনের বড় উদ্যোগ জানতে চাইলে, তা তিনি বলতে পারেননি।
আউটসোর্সিং ডুবিয়েছে: পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৫০ লাখের বেশি প্রবাসী রয়েছেন। এ কারণেই সেখানে এমআরপির তথ্যসংগ্রহ, ছবি তোলা, আঙুলের ছাপ ও ডিজিটাল স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজটি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে করার সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে মালয়েশিয়ার জন্য ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দরপত্র ডাকা হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজটি পায় ডেটাএজ-আইপিপল কনসোর্টিয়াম। কিন্তু তারা কাজটি শুরুর পর মাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার এমআরপি তৈরি করতে শুরু করে। কিন্তু আইরিস সেই কাজটি নেওয়ার পর এখন মাসে দুই হাজার এমআরপিও দিতে পারছে না।
ডেটাএজ-এর চেয়ারম্যান আহসান হাবিব অভিযোগ করেন, এমআরপি বই সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইরিস চাপের মুখে তাঁদের কাজ নিয়ে নেয়। তবে আইরিস নিজের নামে না নিয়ে ‘বিতারা আবাদি’ নামে আরেকটি কোম্পানি খুলে মালয়েশিয়ায়। আবার বিতারা কাজটি দীপন ইনফো টেক নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেয়। কিছুদিন আগে তারাও মালয়েশিয়ায় এমআরপির কাজ প্রায় বন্ধ করে দেয়।
এ বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ডাটাএজ ও আইরিসের দ্বন্দ্বে মালয়েশিয়ায় আউটসোর্সিং প্রায় বন্ধ। তাদের দ্বন্দ্ব না মেটায় এখন দূতাবাসের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার মতোই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে আমিরাতে। সেখানে অবশ্য দরপত্রের মাধ্যমেই কাজ পেয়েছিল আইরিস করপোরেশন। কিন্তু নিজেরা কাজ না করে সেখানেও তারা দীপন ইনফো টেককে কাজ দেয়। ওই প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত ফির বদলে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে এবং প্রবাসী শ্রমিকদের হয়রানি করছে বলে বারবার অভিযোগ ওঠে।
৯ এপ্রিলের এমআরপি-সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির কার্যপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হাইকমিশন যেখানে প্রতিদিন সাড়ে সাত শ এমআরপি দিচ্ছে, সেখানে আইরিস দিচ্ছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০টি। সমস্যা সমাধানে আইরিসকে সেখানে ১০০ ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র (মোবাইল ইউনিট) খোলার কথা বলা হয়। কিন্তু তারা সেই কাজটিও করতে পারেনি।
একই ঘটনা ঘটছে সৌদি আরবে। সেখানে আইরিস এক বছরে মাত্র ৪৪ হাজার ৬০০ পাসপোর্ট বিতরণ করে, তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। সেখানে আইরিসের স্থানীয় অংশীদার কোয়াদ টেলিকম, যাদের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। সমস্যা সমাধানে সেখানে ১২০টি ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র ও দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রয়োজনীয় জনবল দিতে বলা হয় আইরিসকে। এ ক্ষেত্রেও তাদের অগ্রগতি নেই।
এর আগে মালয়েশিয়া থেকে আইরিসের ভিন্ন নামে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান বিতারা আবাদি এবং দীপনের বিরুদ্ধে এমআরপি দেওয়ার নামে লোকজনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহসহ নানা অভিযোগ ওঠে। মালয়েশিয়া থেকে এ ব্যাপারে চিঠিও দেওয়া হয় ঢাকায়। কিন্তু কখনোই আইরিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে আইরিসের স্থানীয় এজেন্ট আসিফ হাসান বলেন, ‘আমি আইরিশের কেউ নই। তবে তাদের আমি চিনি। আমার পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়।’ এর আগে আসিফ হাসানকে আইরিসের পক্ষে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে দেখা গেছে। সরকারি নথিপত্রেও তাঁর নাম আছে। আইরিশের বক্তব্য জানতে তাদের মালয়েশিয়ার দপ্তরে ই-মেইল পাঠানো হলেও সাড়া মেলেনি।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবদুল মাবুদের বিরুদ্ধে আইরিসকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে। কেন আইরিসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে এমআরপি প্রকল্পের বর্তমান পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ রেজওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, তাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং বারবার সতর্ক করা হয়েছে।
No comments