কেন মুসলিম তরুণরা চরমপন্হার দিকে ঝুঁকছে? by মীর সালমান শামিল

প্রথমেই আমার অবস্থান পরিষ্কার করে নেই। আমি মনে করি আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্ব পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসবাদী এবং সন্ত্রাস এর জন্মদাতা। তারা ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে সারা দুনিয়া থেকে ইহুদিদের আমদানি করে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইজরাইলের জন্ম দিয়েছে। যারা গত ৬৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনের মানুষের উপর গণহত্যা চালাচ্ছে। পারমানবিক অস্ত্র আছে এই নির্জলা মিথ্যাকে বার বার প্রচার করে তারা ইরাক হামলা করে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। সম্পূর্ণ মিথ্যা অজুহাতে আফগানিস্তান হামলা করে দেশটাকে ধংস করে দিয়েছে। এদেরকে ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার করা উচিত। 
এবার আমার মূল আলোচনায় আসি।
কেন মুসলিম তরুণদের একটি অংশ চরমপন্হার দিকে ঝুঁকছে?
পূর্বে একটি থিওরি দেওয়া হত যে যারা চরমপন্হার দিকে ঝুঁকছে তারা নির্যাতনের শিকার। তাদের মধ্যে রয়েছে চরম দারিদ্রতা। কর্মসংস্থান নেই। নেই শিক্ষা। এজন্য তারা চরমপন্হার দিকে ঝুঁকছে। কথাটি অবশ্যই সত্য। এটা দিয়ে জেএমবি, হুজি, ভারতের গুজরাট বা কাশ্মীর এর ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করা যায়। কিন্তু ISIL বা হিজবুত তাহরির এর মত সংগঠন এর ব্যাপারে কি ঘটছে। আমাদের দেশে হিজবুত তাহরির যে সকল সদস্য ধরা পড়েছে তাদের মধ্যে উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তানও রয়েছে। ISIL এ ৯০ টিরও বেশি দেশের সদস্য রয়েছে যারা সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। এদের মধ্যে রয়েছে ইউরোপ-অ্যামেরিকার উচ্চশিক্ষিত এবং ধনী তরুণেরাও।
একটি লক্ষ্য করার মত বিষয় বলতে গেলে সউদি আরব, মিশর বা আমাদের বাংলাদেশেরও সকল ইসলামি বিশেষজ্ঞ চরমপন্হার বিপক্ষে। তারা বলছেন ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামের নানা দিক নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। এগুলো বর্ণনা করে বইও লিখেছেন প্রচুর। এছাড়া মূল ধারার সব ইসলামি দলই চরমপন্থার বিপক্ষে। তারপরও এদের বাদ দিয়ে কেন তরুণ সমাজের একটা অংশ ইসলাম সম্পর্কে ওসামা বিন লাদেনের ব্যাখ্যাকেই বেশি গ্রহণ করছেন। যিনি কিনা পেশায় একজন চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ড ছিলেন।
আমাদের বেশির ভাগ ইসলামি বিশেষজ্ঞগণই তাদের বিপথগামী, তাকফিরি, খারেজী নানা সর্বনামে ডেকেই নিজেদের কাজ শেষ মনে করে বেশ আত্মতুষ্ট মনে হয়। ইসলামি দলগুলো পশ্চিমা কন্সপিরাসি থিওরি দিয়েই খালাস। পশ্চিমারা তাদের দমিয়ে রাখতেই এসব দলের জন্ম দিচ্ছে, এটা তাদের খুব সুন্দর একটি বিশ্লেষণ। আর সরকারগুলো এদের নিয়ে কঠিন ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। গোয়েন্দাদের দিন রাত গলদঘর্ম হতে হচ্ছে এদের ধরতে। তাদের ধরে চরম শাস্তিও দেওয়া হচ্ছে। এত কিছুর পরও সমস্যার কোন সমাধান হচ্ছে না। ইসলামি বিশেষজ্ঞগনদের নানাঅভিধা, ইসলামি দল গুলোর পশ্চিমা কন্সপিরাসি থিওরি, বা সরকারগুলোর জেল এর ভয় সবকিছুকে কাঁচ কলা দেখিয়ে একের পর এক নতুন নতুন চরমপন্থি দলের জন্ম হচ্ছে। এতে মুসলিম তরুণরাও যোগ দিচ্ছে।
কিন্তু কেন?
এই প্রশ্ন নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে যা বুঝলাম আমাদের মধ্যে যারা এর বিরোধী তাদের মতামত মোটামুটি একই। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা আফ্রিকা। বেশির ভাগই ইসলামি বিশেষজ্ঞগণদের, ইসলামি দল গুলোর সুরে বলেছেন। কেউ বলেছন তাদের মধ্যে হতাশা আছে, তারা ইসলাম সম্পর্কে পরিষ্কারভাবেকিছু জানে না। তবে কয়েকজন একটু ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেন UK এর একজন বলেছেন তাদের সহজেইমিস গাইড করা সম্ভব হয়েছে। USA এর একজন বলেছেন তারা সহজেই বিখ্যাত হতে চায় তাই একটু রোমানটিসাইজ হয়ে এগুলো করছে। কোনটা কতটা ঠিক আল্লাহই ভালো জানেন।
তবে ইসলামি বিশেষজ্ঞগণদের মত এবং ইসলামি দল গুলোর মন্তব্য আমার কাছে নিজের অযোগ্যতা ঢাকার একটি চমৎকার চেষ্টা বলেই মনে হয়।
ড. তারিক রামাদান এর বিশ্লেষণ সবচেয়ে যৌক্তিক মনে হয়। তার বিশ্লেষণকে সামনে রেখে আমি ব্যাপারটার এমনভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারি। কতটা সঠিক আল্লাহই ভালো জানেন।
মুসলিম তরুণদের চরমপন্থার দিকে ঝোঁকার কারন গুলো হল
মুসলিম দেশগুলোর রাজনৈতিক অস্থিরতা
বেশির ভাগ মুসলিমদেশই সামরিক শাসন, রাজতন্ত্রবা পোশাকি গনতন্ত্র চলছে। দেশগুলোতে স্বাধীনতা নেই। নেই মত প্রকাশের সুযোগ। সরকারগুলোইসলামের বিরোধী অনেক কাজ করছে। ইসলামপন্থীরা তোপের মুখে (মধ্য প্রাচ্যের অধিকাংশদেশেই এই সমস্যায় জর্জরিত)। অনেক ক্ষেত্রে সরকার ইসলামবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
সন্ত্রাসবাদী ইজরাইল
ফিলিস্তিনের মুসলিমদের উচ্ছেদ করে ইজরাইলপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মুসলিমরা গত ৬০-৭০ বছর ধরে তাদের প্রথম কিবলা মসজিদুল আকসারকরুন অবস্থা দেখছে। প্রতি বছর যায়নবাদী ইজরাইল ফিলিস্তিনে গনহত্যা চালায় কিন্তুকোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। না মুসলিম দেশগুলো না জাতিসংঘ। কেউ কোন ব্যবস্থানিচ্ছে না।
নির্যাতন
সারাবিশ্বেই মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতন এর স্বীকার।কাশ্মীর, গুজরাট, আরাকান, আফগান, ইরাক, চেচনিয়া, চীন সহ সারাবিশ্বেই মুসলিমদের উপর অন্যায় অত্যাচার চলছে।
ইসলামি বিশেষজ্ঞগণ
আমার মনে হয় মুসলিম তরুণদের চরমপন্থার দিকে ঝোঁকার কারন গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারন বর্তমান আলেমদের অবস্থান। তারা একদিকেবলেন ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামে অত্যাচার নির্যাতন নিষিদ্ধ। সত্য কথা বলতে হবে।অথচ তারা উপরের বর্ণিত তিনটি ব্যাপারে বলতে গেলে একদম নিরব। মাঝে মাঝে একটু বিবৃতিদিয়েই নিজেদের হেফাজত করছেন। তারা এই সব সামরিক শাসক এবং রাজতন্ত্র এর ব্যাপারে নিরব।তাদের কোন সমালোচনা তো করেনই না উল্টো একটা বড় অংশ তাদের তোষামোদে বাস্ত।জাজিরাতুল আরব(সইদি আরব) বা মিশরের বিখ্যাত বিখ্যাত ইসলামি বিশেষজ্ঞগন এর প্রমান।তাই এদের প্রতি তরুণ সমাজের একটা বড় অংশের শ্রদ্ধা নেই। তারা ইসলামকে জানতে অন্যকাউকে খুঁজেছ এবং পেয়ে যাচ্ছে একজন ওসামা বিন লাদেন বা আয়মান আল জাওয়াহিরিকে যারামুসলিমদের উপর হওয়া সব অবিচার এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন বলে দাবি করেন। এবং এমনবৈপ্লবিক মতবাদ পেয়ে তারা সহজেই চরমপন্থার দিকে যাচ্ছে।
ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর দৈন্যদশা
এটি দ্বিতীয় প্রধান কারন। উপমহাদেশবা পূর্ব এশিয়ায় এটি বড় কারন। এই অঞ্চলের ইসলামি দলগুলো ইসলাম এর নাম নিয়ে রাজনীতিশুরু করলেই শেষ পর্যন্ত ইসলামে না থেকে প্রচলিত ক্ষমতার রাজনিতির পথেই হাঁটছেন। অনেক ক্ষেত্রে ইসলামকে নিজের ইচ্ছামত ব্যাখ্যা বা ব্যবহার করছেন ক্ষমতার রাজনিতির জন্য।তাই এদের পরিত্যাগ করে চরমপন্থার দিকে যাচ্ছে তরুণদের একটা অংশ। কিছুদিন আগে সময়টিভিতে একটি প্রতিবেদনে দেখানো হয় বর্তমান এ বাংলাদেশে বিভিন্ন জঙ্গিদল এর যারাধরা পড়েছে তারা একসময় জামাত-শিবির বা অন্য ইসলামি রাজনৈতিক দল এর সদস্য ছিল। একইঅবস্থা ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানে। যে সকল দেশে ইসলামি  রাজনৈতিক দলগুলো সঠিক অবস্তান ধরে রেখেছে সে সবদেশে ইসলামি জঙ্গি দল কম বা নেই বললেই চলে। যেমন মিশর, তুরুস্ক, ইরান এবংতিউনেশিয়া। এসব দেশে ইসলামি দলগুলো শত প্রতিকূলতার পরও ইসলামি চরিএ ধরে রেখেছে। তিউনেশিয়াথেকে অনেকে ISIL এযোগ দিয়েছে তবে তার কারন বাশার আল আসাদ এর অপশাসন, ইজরাইল এবং ইরাক হামলা।
সর্বশেষ কন্সপিরাসি থিওরি এবং ISIL
যদিওআমি কন্সপিরাসি থিওরি দিতে পছন্দকরি না। নিজের অযোগ্যতা ঢাকার কৌশল মনে হয়। তারপরও ISIL এর নাটকীয় উত্থান। অত্যাধুনিকঅস্ত্রের ব্যবহার। তেল এর খনি দখল এবং সেই তেল কালো বাজারে বিক্রি। এমনকি অতি দ্রুতমুদ্রা প্রচলন দেখে আমার কাছে মনে হচ্ছে অবশ্যই কিছু আছে। আরও একটি মজার ব্যাপার প্রথমে অ্যামেরিকার জনগণ নতুন যুদ্ধে জরানোর পক্ষে ছিল না। ওবামা সাহেব সমর্থন পাচ্ছিলেন নাISIL এর উপর বিমান হামলা করার। ঠিক তখনই  ISIL মুণ্ড কাঁটা শুরু করলো এবং অ্যামেরিকার জনমত ঘুরে গেল যুদ্ধের পক্ষে। (সর্প হইয়া দংশন কর, ওঝা হইয়া ঝার)
ড. রামাদান এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন,বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের পাশাপাশি ভারত এবং চীনও যাচ্ছে তেল ব্যবসায়। তাদের আগমন ঠেকানো অ্যামেরিকার জন্য একটি বড় ইস্যু। অর্থাৎ এভাবে বলা যায় চীন ও ভারতের আগমন বন্ধকরা, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সেনা এর অব্যস্থানকে জায়েজ করে আরব রাজ রাজা এবং ইজারাইলএর নিরাপওা নিশ্চিত করতে এই  ISIL এর জন্ম।
লেখক- শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.