মেমনের ফাঁসি কি মুম্বাই হিংসার ইতিহাসে পর্দা টেনে দেবে?
ইয়াকুব
মেমনের ফাঁসি মুম্বাইয়ে ১৯৯২-১৯৯৩’র হিংসা-দাঙ্গার ঘটনার ওপরে পর্দা টেনে
দেবে কি? প্রশ্ন উঠেছে কেন না ইয়াকুব মেমনের মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিতর্কের
সময়েও কার্যত উপেক্ষিতই থেকে গেছে মু্ম্বাই দাঙ্গার ইতিহাস। ১৯৯৩-র মার্চে
মুম্বাইয়ে পরপর ১২টি বিস্ফোরণে ২৫৭জনের মৃত্যু হয়, প্রায় ১৩০০ মানুষ আহত
হন। এই হিংসার ঘটনার তদন্তেই গ্রেপ্তার হয় মেমন ও অন্যরা। মুম্বাইয়ের টাডা
আদালতে ১০০ জন দোষী সাব্যস্ত হয় ও ১১ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়।
পরবর্তীকালে অন্য ১০ জনের প্রাণদণ্ড মকুব হলেও ইয়াকুবের হয়নি। আইনি লড়াই
শেষে বৃহস্পতিবার ভোরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। মুম্বাইয়ের ওই হিংসার
ঘটনাক্রম শুরু হয়েছিল মুম্বাই থেকে অনেক দূরে-অযোধ্যায়। ১৯৯২-র ৬ই
ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক
উত্তেজনা ও সংঘাত শুরু হয়। মুম্বাইয়েও তার রেশ পড়ে। ৭ ডিসেম্বর থেকে একদফা
এবং ফের ১৯৯৩-র জানুয়ারিতে আরেক দফায় ব্যাপক হিংসার ঘটনা ঘটে দেশের
বাণিজ্য-রাজধানীতে। দুই দফায় নিহত হয়েছিলেন প্রায় ৯০০ মানুষ, আহত ২০০০।
প্রায় একতরফা আক্রান্ত হয়েছিলে মুসলমানরা। ১৯৯৩-র ২৫শে জানুয়ারি বিচারপতি
বি এন শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে কমিশন গঠিত হয়। মহারাষ্ট্রে তখন কংগ্রেস সরকার।
১৯৯৩-৯৮ সময়পর্বে কমিশন ওই ঘটনাবলীর তদন্ত করে। সেই রিপোর্টে বিশদে
মুম্বাইয়ের ২৬টি থানা এলাকার হিংসার ঘটনার বিস্তৃত বিবরণ ছিলো। প্রচুর তথ্য
প্রমাণ নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু কমিশনের রিপোর্ট সেদিন থেকেই আজ পর্যন্ত
বাতিল কাগজের ঝুড়িতে ফেলে রাখা হয়েছে। কোনো সরকারই শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের
রিপোর্ট মোতাবেক তদন্ত করেনি, অভিযুক্তরা কেউ শাস্তিও পায়নি। শিবসেনা-বি জে
পি সরকার গঠিত হবার পরে ১৯৯৩-র মার্চ মাসে পরপর বিস্ফোরণের ঘটনাও কমিশনের
বিচার্য বিষয়ে যুক্ত হয়। শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের রিপোর্টে দেখানো হয়েছিল কীভাবে
শিবসেনা এবং মুম্বাইয়ের পুলিশ উন্মত্তের মতো সংখ্যালঘুদের হত্যা করেছিল। এই
দাঙ্গায় সংগঠিত সশস্ত্র শিবসেনা বাহিনী রাস্তায় নামে। কমিশন শিবসেনার
প্রয়াত সর্বাধিনায়ক বাল থ্যাকারে সম্পর্কে মন্তব্য করেছিল, ‘অভিজ্ঞ সেনা
জেনারেলের মতো তিনি দাঙ্গা পরিচালনা করেছিলেন।’ রিপোর্টে শিউড়ে ওঠার মতো
অজস্র ঘটনার বিবরণ ছিলো। ছিলো এখন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া হরি মসজিদের
ঘটনাও। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মসজিদে পুলিশ ঢুকে সমবেত নিরীহ মানুষদের ওপরে
নির্বিচারে গুলি চালায়। এক পুলিশকর্মী সেই ঘটনার প্রধান অপরাধী বলে
চিহ্নিতও হয়েছিল। সেই পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।
বস্তুত, মুম্বাই পুলিশের তদানীন্তন যুগ্ম কমিশনার আর ডি ত্যাগী ও ১৬জন
পুলিশকর্মীকে নির্দিষ্ট ভাবে হত্যাকাণ্ডে দায়ী করে কমিশন বলেছিল,
‘উন্মত্তের মতো আচরণ’ করেছিল পুলিশ। কমিশন বলেছিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আগে
থেকেই সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা ছড়ানো হয়েছিল। ডিসেম্বরে তা চূড়ান্ত আকার
নেয়। শিবসেনা রাস্তাজুড়ে ‘মহা-আরতি’ শুরু করে এবং নিষ্ক্রিয় প্রশাসনের
চোখের সামনে সংখ্যালঘু মহল্লায় অগ্নিসংযোগ, লুঠের ঘটনা ঘটতে থাকে। ১৯৯৩-র
৮ই জানুয়ারি থেকে শিবসেনা সংগঠিত ভাবে মুসলিমদের ও তাঁদের সম্পত্তির ওপরে
আক্রমণ শুরু করে। শাখা প্রমুখ থেকে বাল থ্যাকারে সেই আক্রমণে নেতৃত্ব দিতে
থাকেন। পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রে গুলি চালায় সংখ্যালঘুদের ওপরে। গ্রেপ্তারও
বেশি হয় তারাই। হিংসার বৃত্তে নিহত হন হিন্দুরাও, বিশেষ করে কয়েকটি বস্তি
এলাকায়। শ্রীকৃষ্ণ কমিশনের বিশ্লেষণ ছিলো, দু’মাস ধরে প্রশাসনের ভূমিকা
সংখ্যালঘুদের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি করেছিল তা ১৯৯৩-র মার্চের বিস্ফোরণে
অনুঘটকের কাজ করেছে। কমিশন ৯৬৫৫ পৃষ্ঠার রিপোর্টে ৫০২ জন সাক্ষীর বয়ান
লিপিবদ্ধ করেছিল, ২৯০০ নথি পেশ করেছিল। শিবসেনা-বিজেপি সরকার সেই রিপোর্টকে
খারিজ করে দেয়। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী মনোহর যোশী রিপোর্টকে
‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে আখ্যা দেন। মহারাষ্ট্রে এবং কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তন
হলেও কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। মুম্বাই
দাঙ্গার প্রথম দুই পর্বের জন্য শাস্তি পায়নি কেউ। ইয়াকুব মেমনের মৃত্যুদণ্ড
কার্যকর হবার পরে এই সূত্রেই সামনে আসছে ১৯৮৪-র শিখ-বিরোধী দাঙ্গার বিচার ও
শাস্তির কথা। ২০০২-র গুজরাট গণহত্যায় যেভাবে অভিযুক্তদের আড়াল করা, রেহাই
দেবার তৎপরতা চলছে তার ভিত্তিতে সন্দেহ জোরালো হয়েছে, শেষ পর্যন্ত কেউ কি
গুরুতর শাস্তি পাবে? মালেগাঁও থেকে সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণের ঘটনায়
দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা শিথিল করার জন্য মোদী সরকারের আমলে উদ্যোগ নেওয়া
হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এই মামলার সরকারি আইনজীবী স্বয়ং। - ওয়েবসাইট।
No comments