সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশৃঙ্খলা by আলী ইমাম মজুমদার
বিভিন্ন
রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও আমাদের ১৬ কোটি মানুষের দেশটির অর্জন অনেক।
স্বাধীনতা যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে, তা যথার্থভাবে কাজে লাগানো গেলে সেটা আরও
বেশি হতো, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে আমাদের
সাফল্য অন্যদের জন্যও অনুকরণীয়। তবে সেই অর্জনকে ক্রমান্বয়ে জোরদার করতে
শুধু নয়, ধরে রাখতেও প্রয়োজন দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা।
দুঃখজনক হলেও বলতে হয়, এ ক্ষেত্রে আমরা বিপরীত চিত্রটাই দেখতে পাচ্ছি।
দেশের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দলগুলোর দৈন্য আর রাষ্ট্রীয় ও
অরাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যথার্থ ভূমিকা রাখতে অক্ষমতা সেই
চিত্রটিকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে
উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মানের ক্রমহ্রাসমান পরিস্থিতি। শিক্ষার বিকল্প
নেই। আর সেই শিক্ষা মানসম্মতও হতে হবে। উচ্চশিক্ষা তো বটেই। আমাদের এখন
উচ্চশিক্ষারত শিক্ষার্থীদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের
আওতায় বিভিন্ন কলেজে পড়েন। অবশিষ্টদের একটি অংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ
দুই শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুটি কয়েক ব্যতিক্রম থাকলেও সিংহভাগই
মানসম্মত শিক্ষা দিচ্ছে না। নেই যথোপযুক্ত তদারকি।
ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভরসাস্থল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তুলনামূলকভাবে অধিক মেধাবীরা ভর্তি হন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে উচ্চশিক্ষারত মোট শিক্ষার্থীর খুব কম অংশই এগুলোতে শিক্ষার সুযোগ পান। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হচ্ছে না। এর কারণ বিচিত্র। এগুলোতে কথায় কথায় শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকেরা ক্লাস বর্জন করেন। আর তা ক্ষেত্রবিশেষে মাসের পর মাস। উপাচার্য নিয়োগ এবং সেই পদ থেকে অপসারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সুস্পষ্ট বিধান আছে। আছে যথাযথ কর্তৃপক্ষ। অথচ তাদের ধার না ধেরেই শিক্ষক বা কখনো শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে অচল করে দেন বিশ্ববিদ্যালয়। কী দাবি আর পাল্টা দাবি, তা আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এখন এরূপ আন্দোলন চলছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘকাল এ আন্দোলন চলেছিল জাহাঙ্গীরনগরে। সরকার পিছু হটেছে সেখানে।
তেমনি কোনো না কোনো কারণে শিক্ষকদের আন্দোলনে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন কুমিল্লা, রংপুরের বেগম রোকেয়া, রাজশাহী, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। কিছু শিক্ষার্থীর টার্ম পরীক্ষা পেছানোর সহিংস আন্দোলনে বন্ধ হয়ে গেছে বুয়েট।
এসব কিছুর পেছনে কী কাজ করছে—এমন প্রশ্ন যেকোনো সচেতন নাগরিক করতে পারেন। কারও কারও মতে, অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্র ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগে দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পায়। আর এ বিবেচনায় স্থান পাওয়া ছাত্র-শিক্ষকদের স্বাভাবিক শৃঙ্খলাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করাই স্বাভাবিক। তাঁরা দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা জোরদার করতে সচেষ্ট থাকেন। নিজদের প্রকৃত ভিতকে করে চলেছেন অবজ্ঞা। একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একজন প্রবীণ সদস্য অধ্যাপক মোহাব্বত খান মন্তব্য করেছেন, ‘শিক্ষকেরা নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে ব্যস্ত থাকেন কনসালট্যান্সি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিতে। আর শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি তো নিয়মে পরিণত হয়েছে।’ এই প্রবীণ শিক্ষাবিদের বক্তব্যটি অপ্রিয় হতে পারে, তবে অনেকটা সত্য। লেখাপড়ার মান সম্পর্কে অনেকেই বলেন, উচ্চশিক্ষা মুখস্থবিদ্যানির্ভর হয়ে পড়েছে। গবেষণার কোনো বালাই নেই সেখানে।
অথচ গবেষণাহীন উচ্চশিক্ষাকে অপূর্ণই বলতে হবে। আরও নির্মম সত্য যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল। এখানে সরকারের কার্পণ্য অগ্রহণযোগ্য। নামমাত্র ছাত্র বেতন। আবাসিক হলের সিটভাড়া নগণ্য। সর্বত্রই সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য এখানে প্রয়োজনীয় টাকা কেন দেওয়া হবে না, তা বোধগম্য নয়। অবশ্য গবেষণার জন্য অর্থ একমাত্র অন্তরায় নয় বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন। পাঠাগারে থাকা বইপত্র, সাময়িকীতে বেশ কিছু শিক্ষক হাতও দেন না—এমন দুর্ভাগ্যজনক অভিযোগও জানা যায়।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় দেশে পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ছয়টি। এর দুটি প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। অবশিষ্ট চারটিতে একটি গণতান্ত্রিক ধারা চালু করতে স্বাধীনতার পরপর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু দিনে দিনে এর ফল বিকৃতি ঘটে। এখন অবশ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭টি। এর অনেকগুলোতেই এ আইন প্রয়োগ করা হয়নি। তবু ভূমিকা ও আচরণে প্রায় একরূপ হয়ে গেছে। শিক্ষাবিদদের অনেকেই এগুলোর সার্বিক নিম্নমুখিতা নিয়ে চিন্তিত। সরব এগুলোর অব্যবস্থা নিয়ে। অন্যদিকে রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতাধন্য শিক্ষার্থীরা যখন-তখন শৃঙ্খলাবিরোধী আচরণে লিপ্ত হচ্ছেন। রাজশাহী ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন ছাত্রনেতাদের চাকরি না দেওয়ার কারণে আক্রান্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা। জানা যায়, রাজশাহীতে সেই আক্রমণাত্মক ভূমিকায় শুধু ছাত্ররাই ছিলেন না, ছিলেন রাজনৈতিক নেতারাও। অন্যদিকে কোথাও কোথাও শিক্ষকদের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ তাঁদের যুগবাহিত মর্যাদাকে আজ প্রশ্নের মুখে নিয়ে এসেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত ভবনের দখল নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের একটি আন্দোলন সবাইকে বিস্মিত করেছে। গ্রীষ্ম আর রোজার ছুটি দিয়ে প্রশাসন পরিস্থিতি সাময়িক সামাল দিয়েছে। নিকট ভবিষ্যৎ অজানা।
জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ হিসেবে ছাত্রসংগঠন থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রধান দলগুলোর সব কটিরই তা আছে, একেবারেই প্রকাশ্যে। শিক্ষকদের সংগঠন সে রূপে না হলেও বিভিন্ন রঙের নামে মাঝেমধ্যে সামনে আসে। অন্য সময়ে তা প্রকাশ্যে না থাকলেও আছে সক্রিয়। এ সম্পর্ক শুধু আদর্শগত, এমনটা বলা যাবে না। বেশ কিছু ক্ষেত্রে বৈষয়িক বিষয়াদি রয়েছে। তাদের সমর্থিত দল ক্ষমতায় এলে মেলে বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বাইরের আকর্ষণীয় পদ-পদবি। আর দেশের অভিভাবক রাজনৈতিক নেতারা দল–মতনির্বিশেষে এটাকে প্রশ্রয় দিয়েই চলেছেন। এতে জ্ঞানানুসন্ধান করে নিজেকে আরও যোগ্য করে তোলার ভাবনা কেন সবার মধ্যে আসবে? এটা অসত্য নয় যে এর মধ্যেও বেশ কিছু তা করে চলেছেন। আর তা করছেন স্রোতের প্রতিকূলে। নিজকে আলোকিত করা আর সেই আলো ছড়ানোর নেশাতেই। চরম অব্যবস্থার মধ্যেও বেশ কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থী জ্ঞানের অন্বেষণে রয়েছেন সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে। নামকরা বিদেশি বৃত্তিও কেউ কেউ লাভ করছেন। কিন্তু এতে তো বিষয়টা মিটছে না। সার্বিক সমস্যা দিনে দিনে বাড়ছে বৈ কমছে না। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই গুণগত অবক্ষয় ঘটে চলেছে। আর সেটা জেনে নীরব থাকলে তো চলবে না। অগ্রণী হতে হবে তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই।
প্রতিকূল স্রোতে সঠিক পথে চলতে চাইলেও যে চলা যায়, তার প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ)। ওই ছোঁয়াচে রোগ এখনো এই অঙ্গনটিকে গ্রাস করতে পারেনি। তবে অনেকটা গ্রাস করে ফেলেছে দেশের আরেক গর্বের প্রতিষ্ঠান বুয়েটকে। কথায় কথায় সেখানে ধর্মঘট, ক্লাস বর্জন, ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগও হয়। সেশনজট ক্ষেত্রবিশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও হার মানিয়েছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনা করতে চাইলে সে দেশের দূতাবাস অগ্রাধিকার দিয়ে তা বিবেচনা করে। এ অবস্থান ও মর্যাদাটা হয়তো বা আমরা ঝুঁকিতে ফেলছি।
যে ক্ষেত্রে দেশে যত অগ্রগতি হোক, মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে তা না হলে সেটা সুষম হবে না। জনগণ ঈপ্সিত ফল ভোগ করতে পারবে না। কেবল সুশিক্ষিত জ্ঞানী লোকেরাই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে এলে তা হতে পারে। তাঁদের সেখানে আনতে উচ্চশিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির জোগান দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। আর আমরা যেহেতু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় পুরো ব্যয়টিই বহন করছি, তা তাদের কাছে প্রত্যাশা করাই স্বাভাবিক। এই পরিবেশ সৃষ্টি করতে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি সমাজের সব মহলকে একাগ্র হয়ে জোর দিতে হবে। এখনকার মতো এগুলো চলতে থাকলে ব্যাহত হতে পারে আমাদের অনেক অর্জন। নিয়তির ওপর সব ছেড়ে না দিয়ে হাল ধরতে হবে নিজেদেরই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ভরসাস্থল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তুলনামূলকভাবে অধিক মেধাবীরা ভর্তি হন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে উচ্চশিক্ষারত মোট শিক্ষার্থীর খুব কম অংশই এগুলোতে শিক্ষার সুযোগ পান। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেক ক্ষেত্রেই তাদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম হচ্ছে না। এর কারণ বিচিত্র। এগুলোতে কথায় কথায় শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষকেরা ক্লাস বর্জন করেন। আর তা ক্ষেত্রবিশেষে মাসের পর মাস। উপাচার্য নিয়োগ এবং সেই পদ থেকে অপসারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সুস্পষ্ট বিধান আছে। আছে যথাযথ কর্তৃপক্ষ। অথচ তাদের ধার না ধেরেই শিক্ষক বা কখনো শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে অচল করে দেন বিশ্ববিদ্যালয়। কী দাবি আর পাল্টা দাবি, তা আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এখন এরূপ আন্দোলন চলছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘকাল এ আন্দোলন চলেছিল জাহাঙ্গীরনগরে। সরকার পিছু হটেছে সেখানে।
তেমনি কোনো না কোনো কারণে শিক্ষকদের আন্দোলনে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন কুমিল্লা, রংপুরের বেগম রোকেয়া, রাজশাহী, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। কিছু শিক্ষার্থীর টার্ম পরীক্ষা পেছানোর সহিংস আন্দোলনে বন্ধ হয়ে গেছে বুয়েট।
এসব কিছুর পেছনে কী কাজ করছে—এমন প্রশ্ন যেকোনো সচেতন নাগরিক করতে পারেন। কারও কারও মতে, অনেক ক্ষেত্রেই ছাত্র ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগে দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পায়। আর এ বিবেচনায় স্থান পাওয়া ছাত্র-শিক্ষকদের স্বাভাবিক শৃঙ্খলাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করাই স্বাভাবিক। তাঁরা দলীয় পৃষ্ঠপোষকতা জোরদার করতে সচেষ্ট থাকেন। নিজদের প্রকৃত ভিতকে করে চলেছেন অবজ্ঞা। একটি দৈনিকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একজন প্রবীণ সদস্য অধ্যাপক মোহাব্বত খান মন্তব্য করেছেন, ‘শিক্ষকেরা নিজ বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে ব্যস্ত থাকেন কনসালট্যান্সি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নিতে। আর শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি তো নিয়মে পরিণত হয়েছে।’ এই প্রবীণ শিক্ষাবিদের বক্তব্যটি অপ্রিয় হতে পারে, তবে অনেকটা সত্য। লেখাপড়ার মান সম্পর্কে অনেকেই বলেন, উচ্চশিক্ষা মুখস্থবিদ্যানির্ভর হয়ে পড়েছে। গবেষণার কোনো বালাই নেই সেখানে।
অথচ গবেষণাহীন উচ্চশিক্ষাকে অপূর্ণই বলতে হবে। আরও নির্মম সত্য যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল। এখানে সরকারের কার্পণ্য অগ্রহণযোগ্য। নামমাত্র ছাত্র বেতন। আবাসিক হলের সিটভাড়া নগণ্য। সর্বত্রই সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য এখানে প্রয়োজনীয় টাকা কেন দেওয়া হবে না, তা বোধগম্য নয়। অবশ্য গবেষণার জন্য অর্থ একমাত্র অন্তরায় নয় বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন। পাঠাগারে থাকা বইপত্র, সাময়িকীতে বেশ কিছু শিক্ষক হাতও দেন না—এমন দুর্ভাগ্যজনক অভিযোগও জানা যায়।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের সময় দেশে পাবলিক বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ছয়টি। এর দুটি প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। অবশিষ্ট চারটিতে একটি গণতান্ত্রিক ধারা চালু করতে স্বাধীনতার পরপর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু দিনে দিনে এর ফল বিকৃতি ঘটে। এখন অবশ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭টি। এর অনেকগুলোতেই এ আইন প্রয়োগ করা হয়নি। তবু ভূমিকা ও আচরণে প্রায় একরূপ হয়ে গেছে। শিক্ষাবিদদের অনেকেই এগুলোর সার্বিক নিম্নমুখিতা নিয়ে চিন্তিত। সরব এগুলোর অব্যবস্থা নিয়ে। অন্যদিকে রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতাধন্য শিক্ষার্থীরা যখন-তখন শৃঙ্খলাবিরোধী আচরণে লিপ্ত হচ্ছেন। রাজশাহী ও কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন ছাত্রনেতাদের চাকরি না দেওয়ার কারণে আক্রান্ত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকেরা। জানা যায়, রাজশাহীতে সেই আক্রমণাত্মক ভূমিকায় শুধু ছাত্ররাই ছিলেন না, ছিলেন রাজনৈতিক নেতারাও। অন্যদিকে কোথাও কোথাও শিক্ষকদের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ তাঁদের যুগবাহিত মর্যাদাকে আজ প্রশ্নের মুখে নিয়ে এসেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত ভবনের দখল নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের একটি আন্দোলন সবাইকে বিস্মিত করেছে। গ্রীষ্ম আর রোজার ছুটি দিয়ে প্রশাসন পরিস্থিতি সাময়িক সামাল দিয়েছে। নিকট ভবিষ্যৎ অজানা।
জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গ হিসেবে ছাত্রসংগঠন থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রধান দলগুলোর সব কটিরই তা আছে, একেবারেই প্রকাশ্যে। শিক্ষকদের সংগঠন সে রূপে না হলেও বিভিন্ন রঙের নামে মাঝেমধ্যে সামনে আসে। অন্য সময়ে তা প্রকাশ্যে না থাকলেও আছে সক্রিয়। এ সম্পর্ক শুধু আদর্শগত, এমনটা বলা যাবে না। বেশ কিছু ক্ষেত্রে বৈষয়িক বিষয়াদি রয়েছে। তাদের সমর্থিত দল ক্ষমতায় এলে মেলে বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বাইরের আকর্ষণীয় পদ-পদবি। আর দেশের অভিভাবক রাজনৈতিক নেতারা দল–মতনির্বিশেষে এটাকে প্রশ্রয় দিয়েই চলেছেন। এতে জ্ঞানানুসন্ধান করে নিজেকে আরও যোগ্য করে তোলার ভাবনা কেন সবার মধ্যে আসবে? এটা অসত্য নয় যে এর মধ্যেও বেশ কিছু তা করে চলেছেন। আর তা করছেন স্রোতের প্রতিকূলে। নিজকে আলোকিত করা আর সেই আলো ছড়ানোর নেশাতেই। চরম অব্যবস্থার মধ্যেও বেশ কিছু শিক্ষক-শিক্ষার্থী জ্ঞানের অন্বেষণে রয়েছেন সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে। নামকরা বিদেশি বৃত্তিও কেউ কেউ লাভ করছেন। কিন্তু এতে তো বিষয়টা মিটছে না। সার্বিক সমস্যা দিনে দিনে বাড়ছে বৈ কমছে না। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই গুণগত অবক্ষয় ঘটে চলেছে। আর সেটা জেনে নীরব থাকলে তো চলবে না। অগ্রণী হতে হবে তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই।
প্রতিকূল স্রোতে সঠিক পথে চলতে চাইলেও যে চলা যায়, তার প্রমাণ ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ)। ওই ছোঁয়াচে রোগ এখনো এই অঙ্গনটিকে গ্রাস করতে পারেনি। তবে অনেকটা গ্রাস করে ফেলেছে দেশের আরেক গর্বের প্রতিষ্ঠান বুয়েটকে। কথায় কথায় সেখানে ধর্মঘট, ক্লাস বর্জন, ভাঙচুর আর অগ্নিসংযোগও হয়। সেশনজট ক্ষেত্রবিশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেও হার মানিয়েছে। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রিধারী শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়াশোনা করতে চাইলে সে দেশের দূতাবাস অগ্রাধিকার দিয়ে তা বিবেচনা করে। এ অবস্থান ও মর্যাদাটা হয়তো বা আমরা ঝুঁকিতে ফেলছি।
যে ক্ষেত্রে দেশে যত অগ্রগতি হোক, মানসম্মত শিক্ষার ক্ষেত্রে তা না হলে সেটা সুষম হবে না। জনগণ ঈপ্সিত ফল ভোগ করতে পারবে না। কেবল সুশিক্ষিত জ্ঞানী লোকেরাই দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে এলে তা হতে পারে। তাঁদের সেখানে আনতে উচ্চশিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির জোগান দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। আর আমরা যেহেতু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রায় পুরো ব্যয়টিই বহন করছি, তা তাদের কাছে প্রত্যাশা করাই স্বাভাবিক। এই পরিবেশ সৃষ্টি করতে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের পাশাপাশি সমাজের সব মহলকে একাগ্র হয়ে জোর দিতে হবে। এখনকার মতো এগুলো চলতে থাকলে ব্যাহত হতে পারে আমাদের অনেক অর্জন। নিয়তির ওপর সব ছেড়ে না দিয়ে হাল ধরতে হবে নিজেদেরই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments