বিএনপির ভবিষ্যৎ by মোহাম্মদ শাহজাহান
মোহাম্মদ শাহজাহান, যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি ও সাবেক হুইপ |
অসুস্থতার ৩
থেকে ১৬ জুন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এই ক’দিন রাজনীতি থেকে অনেকটা
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। হাসপাতালের বেডে অসহনীয় যন্ত্রণায় খবরের কাগজও
খুব ভালোভাবে পড়তে পারছিলাম না। যারা আমাকে দেখতে এসেছিলেন, তাদের মাধ্যমে
রাজনৈতিক বিষয়ে প্রচ্ছন্ন ধারণা পেয়েছি। এই সময়কালে দেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ
ঘটনা ঘটেছে। ৬-৭ জুন আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ও বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক
দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি বাংলাদেশ সফর করেন। বিএনপি
চেয়ারপার্সনের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার চার্জশিট দেয়া হয়।
ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শারীরিক অবস্থার মারাত্মক
অবনতির পরও তাকে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির
সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চেয়ারপার্সনের
উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু ও গাজীপুরের মেয়র অধ্যাপক আবদুল মান্নান ও
যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীসহ সারা দেশে হাজার হাজার
নেতাকর্মীকে জামিন না দিয়ে মানবেতর অবস্থায় কারাবাসে বাধ্য করা হয়েছে।
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখিও হয় এই সময়ে। কয়েকজন বিএনপি নেতার ফোনালাপ বিভিন্ন পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। যেমন : ‘এই বিএনপি দিয়ে হবে না’, ‘বেগম জিয়াকে দিয়ে হবে না’, ‘উনি (বেগম খালেদা জিয়া) আর উঠে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না’। এসব ফোনালাপ নিশ্চয়ই সাংবাদিক বন্ধুরা আড়িপেতে শোনেননি বা রেকর্ডও করেননি। রাজনৈতিক নেতাদের ফোনে আড়িপাতা ও কথোপকথন রেকর্ড করা যেসব সরকারি সংস্থার দায়িত্ব, সরকারি নির্দেশে এই কাজে হয়তো তারাই সাহায্য করেছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, নেতাদের এই কথাগুলো প্রকাশ করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের হতাশ করা; মাঠপর্যায়ে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে নেতাদের বিতর্কিত করা। দলের জন্য নিবেদিত এবং সার্বণিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত অনেক উঁচু স্তরের নেতাও ব্যক্তিগত কথোপকথনে হতাশা প্রকাশ করতে পারেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা অস্বাভাবিক নয়। তাই এটাকে বিএনপির দল ভাঙার বা ফ্যাসিবাদের সাথে আপসরফার অংশ হিসেবে দেখা বা বিবেচনা করা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সমীচীন হবে না। অতীতেও অনেক দেশবরেণ্য নেতা ব্যক্তিগত কথোপকথনে এমন হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এমনকি কোনো কোনো বড় নেতা নিজের দলকে ‘চাটার দল’ বলেছেন।
২৮ মে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৪তম শাহাদতবার্ষিকীর আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে প্রায় ৫৪ মিনিট শহীদ জিয়ার ওপর বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যের মূল সুর ছিল, বর্তমান বিএনপি জিয়ার আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তাই বিএনপিকে আত্ম-অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভুলত্রুটি সংশোধনপূর্বক ওই আদর্শের ভিত্তিতে দলকে পুনর্গঠিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, তিনি বর্তমান বিএনপিকে নিয়ে আরো কঠিন এবং তির্যক সমালোচনা করেছেন। তার বক্তব্যে বিএনপির সমালোচনার ধার যত তীব্র ছিল বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ততটুকু তীব্র ছিল না। সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলেন। মনোযোগসহ আলোচকদের আলোচনা শুনেছেন। সৌভাগ্যক্রমে আমি তার পাশের আসনে উপবিষ্ট ছিলাম। সমালোচনামুখর বক্তব্য শুনে বেগম জিয়া একটিবারও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। এমনকি তার মুখাবয়বেও কোনো বিরক্তিরেখা ফুটে ওঠেনি। তিনি বক্তব্যের নির্যাস অনুসন্ধানে মগ্ন ছিলেন। তার অব্যক্ত ভাষার মধ্যে একটি ভাষা ছিল ‘যিনি আমার আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি তার কথায় বা বক্তব্যে আমার মনে কষ্ট পাওয়ার কোনো অবকাশ নেই।’
এখানে তিনি (বেগম খালেদা জিয়া) ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক নেত্রী এবং জাতীয়তাবাদী শক্তির মূর্তপ্রতীক হিসেবে স্বীয় নেতৃত্বের বিশালতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। তা হবেনই না বা কেন? তিনি তো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সব গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান। আশা করি, তার এই মনোভাবের প্রতি সবাই সম্মান প্রদর্শন করবেন।
এসব মন্তব্য ও বক্তব্য থেকে অনেকেই মনে করেন বিএনপি ভেঙে যাবে, আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না, দলটির ভবিষ্যৎ অন্ধকার! রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তারা এমনটি ভাবতেই পারেন। কারণ, তাদের ভাবনার মূল ভিত্তি হলো, সরকার রাষ্ট্রের সব অঙ্গকে দলীয় প্রভাবে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, সব সংস্থা যেন সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে নেমেছে। তারা জনমতের তোয়াক্কা না করে সরকারি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দলীয় কাজে ব্যবহার করে দীর্ঘকাল মতায় থাকবে। যে নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে, এই সরকার নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই নির্বাচনব্যবস্থাকে একেবারে ধূলিসাৎ করে দিয়ে নিজেদের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীদের যোগসাজশে নির্বাচনের নামে যা চাইবে তাই বাস্তবায়ন করবে। এর প্রমাণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন এবং সাম্প্রতিককালে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর, দক ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন; যা শুধু এ দেশের মানুষের কছে নয়, বহির্বিশ্বেও ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এমনকি মত প্রকাশ না করলেও এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংশয় কাজ করছে। তাই বাংলাদেশ সফরকালে জাতীয় সংসদের অধিবেশন থাকা অবস্থায়ও তিনি সংসদে বক্তব্য রাখেননি। অথচ বাংলাদেশ সফরের আগে তিনি নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কাসহ যেসব দেশ সফর করেছেন, সেসব দেশের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে বক্তব্য রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট মহল এ বিষয়টি যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই নিজেদের, দেশের এবং গণতন্ত্রের জন্য তা মঙ্গলজনক। না হয় আজ হোক কাল হোক সময়ের পরিক্রমায় এই অন্যায় কাজের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে যেন সাক্ষাৎ না হয়, এ বিষয়ে সরকার যারপরনাই চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রাক্কালে বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার সাথে মোদির সাক্ষাতের কোনো যুক্তিই তিনি দেখেন না। তার এই বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকর দিল্লিতে ঘোষণা করেছেন, ‘বাংলাদেশে সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করবেন।’ সে মোতাবেক ৭ জুন হোটেল সোনারগাঁওয়ে বেগম খালেদা জিয়া দলের কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রায় ৩০ মিনিট প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনা শেষে মোদি এবং বেগম জিয়া আরো ১৫ মিনিট একান্ত রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠকের বিষয়বস্তু প্রকাশ করা থেকে উভয় নেতা বিরত ছিলেন। তবে বৈঠক থেকে বের হওয়ার সময় বেগম খালেদা জিয়াকে যেভাবে প্রফুল্ল দেখা গেছে, তাতে মনে হয়েছে বৈঠকটি ছিল খুবই আন্তরিক, অর্থবহ ও সন্তোষজনক।
এই একান্ত বৈঠক নিয়ে আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা নানা ধরনের খবর পরিবেশন করেছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধ উপেক্ষা করে মোদি যে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং একান্ত সাক্ষাতে যে গুরুত্ব দিয়েছেন, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমি মনে করি, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, নির্বাচনের নামে যে প্রহসন বাংলাদেশে চলছে তা চিরস্থায়ী হবে না, একদিন-না-একদিন এখানে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এবং সেই নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলের নিরঙ্কুশ জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এ অঞ্চলের শান্তি-স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক অবকাঠামোসহ উন্নয়নে বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সরকার রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে দীর্ঘকাল দলীয় কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ, ইতোমধ্যে সংস্থাগুলোর কার্যক্রম দেশে এবং বাইরে ভাবমূর্তির সঙ্কটে পড়েছে। গুম-খুন, ভয়ভীতি দেখানো গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হতে পারে না। জনগণ একসময় দুঃশাসন, দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেই। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির নয়া রাজনৈতিক মেরুকরণ হবে। সেই মেরুকরণে দলগুলোর পার্থক্য ও বিরোধ থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষে আন্দোলনে সব রাজনৈতিক শক্তির এক সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে উঠবে। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপির সাহসী, ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাকর্মীরা নেতৃত্বের সামনের কাতারে চলে আসবেন। ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ নয়, তৃণমূল কর্মীদের মতামতই হবে নেতা নির্বাচনের মাপকাঠি। দুর্বলচিত্তের ভীরু নেতারা নেতৃত্ব থেকে দূরে সরে যাবেন, নিষ্ক্রিয় হবেন। অনেকেই হয়তো ক্ষমতাসীনদের সাথে হাত মেলাতে পারেন। তাতেও তেমন ক্ষতি হবে না। বিএনপির এই কঠিন সময় থাকবে না। প্রয়োজন শুধু সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতাকর্মীদের পাহাড়ের মতো অবিচল থাকা। দল এবং দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি নেতাকর্মীদের রয়েছে অবিচল আস্থা এবং জনগণের ব্যাপক সমর্থন। প্রয়োজন শুধু সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা।
লেখক: যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি ও সাবেক হুইপ
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখিও হয় এই সময়ে। কয়েকজন বিএনপি নেতার ফোনালাপ বিভিন্ন পত্রিকার শিরোনাম হয়েছে। যেমন : ‘এই বিএনপি দিয়ে হবে না’, ‘বেগম জিয়াকে দিয়ে হবে না’, ‘উনি (বেগম খালেদা জিয়া) আর উঠে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না’। এসব ফোনালাপ নিশ্চয়ই সাংবাদিক বন্ধুরা আড়িপেতে শোনেননি বা রেকর্ডও করেননি। রাজনৈতিক নেতাদের ফোনে আড়িপাতা ও কথোপকথন রেকর্ড করা যেসব সরকারি সংস্থার দায়িত্ব, সরকারি নির্দেশে এই কাজে হয়তো তারাই সাহায্য করেছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, নেতাদের এই কথাগুলো প্রকাশ করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের হতাশ করা; মাঠপর্যায়ে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে নেতাদের বিতর্কিত করা। দলের জন্য নিবেদিত এবং সার্বণিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত অনেক উঁচু স্তরের নেতাও ব্যক্তিগত কথোপকথনে হতাশা প্রকাশ করতে পারেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটা অস্বাভাবিক নয়। তাই এটাকে বিএনপির দল ভাঙার বা ফ্যাসিবাদের সাথে আপসরফার অংশ হিসেবে দেখা বা বিবেচনা করা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সমীচীন হবে না। অতীতেও অনেক দেশবরেণ্য নেতা ব্যক্তিগত কথোপকথনে এমন হতাশা ব্যক্ত করেছেন। এমনকি কোনো কোনো বড় নেতা নিজের দলকে ‘চাটার দল’ বলেছেন।
২৮ মে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৩৪তম শাহাদতবার্ষিকীর আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী প্রধান অতিথি হিসেবে প্রায় ৫৪ মিনিট শহীদ জিয়ার ওপর বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যের মূল সুর ছিল, বর্তমান বিএনপি জিয়ার আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তাই বিএনপিকে আত্ম-অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভুলত্রুটি সংশোধনপূর্বক ওই আদর্শের ভিত্তিতে দলকে পুনর্গঠিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, তিনি বর্তমান বিএনপিকে নিয়ে আরো কঠিন এবং তির্যক সমালোচনা করেছেন। তার বক্তব্যে বিএনপির সমালোচনার ধার যত তীব্র ছিল বাংলাদেশের ওপর চেপে বসা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ততটুকু তীব্র ছিল না। সভায় বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দর্শক সারিতে উপস্থিত ছিলেন। মনোযোগসহ আলোচকদের আলোচনা শুনেছেন। সৌভাগ্যক্রমে আমি তার পাশের আসনে উপবিষ্ট ছিলাম। সমালোচনামুখর বক্তব্য শুনে বেগম জিয়া একটিবারও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। এমনকি তার মুখাবয়বেও কোনো বিরক্তিরেখা ফুটে ওঠেনি। তিনি বক্তব্যের নির্যাস অনুসন্ধানে মগ্ন ছিলেন। তার অব্যক্ত ভাষার মধ্যে একটি ভাষা ছিল ‘যিনি আমার আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি তার কথায় বা বক্তব্যে আমার মনে কষ্ট পাওয়ার কোনো অবকাশ নেই।’
এখানে তিনি (বেগম খালেদা জিয়া) ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক নেত্রী এবং জাতীয়তাবাদী শক্তির মূর্তপ্রতীক হিসেবে স্বীয় নেতৃত্বের বিশালতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। তা হবেনই না বা কেন? তিনি তো ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সব গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে চান। আশা করি, তার এই মনোভাবের প্রতি সবাই সম্মান প্রদর্শন করবেন।
এসব মন্তব্য ও বক্তব্য থেকে অনেকেই মনে করেন বিএনপি ভেঙে যাবে, আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না, দলটির ভবিষ্যৎ অন্ধকার! রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তারা এমনটি ভাবতেই পারেন। কারণ, তাদের ভাবনার মূল ভিত্তি হলো, সরকার রাষ্ট্রের সব অঙ্গকে দলীয় প্রভাবে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, সব সংস্থা যেন সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী বিশেষ করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধে নেমেছে। তারা জনমতের তোয়াক্কা না করে সরকারি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দলীয় কাজে ব্যবহার করে দীর্ঘকাল মতায় থাকবে। যে নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হবে, এই সরকার নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সেই নির্বাচনব্যবস্থাকে একেবারে ধূলিসাৎ করে দিয়ে নিজেদের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীদের যোগসাজশে নির্বাচনের নামে যা চাইবে তাই বাস্তবায়ন করবে। এর প্রমাণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন এবং সাম্প্রতিককালে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর, দক ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন; যা শুধু এ দেশের মানুষের কছে নয়, বহির্বিশ্বেও ন্যূনতম গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এমনকি মত প্রকাশ না করলেও এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যেও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও সংশয় কাজ করছে। তাই বাংলাদেশ সফরকালে জাতীয় সংসদের অধিবেশন থাকা অবস্থায়ও তিনি সংসদে বক্তব্য রাখেননি। অথচ বাংলাদেশ সফরের আগে তিনি নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কাসহ যেসব দেশ সফর করেছেন, সেসব দেশের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে বক্তব্য রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট মহল এ বিষয়টি যত দ্রুত উপলব্ধি করবেন, ততই নিজেদের, দেশের এবং গণতন্ত্রের জন্য তা মঙ্গলজনক। না হয় আজ হোক কাল হোক সময়ের পরিক্রমায় এই অন্যায় কাজের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে যেন সাক্ষাৎ না হয়, এ বিষয়ে সরকার যারপরনাই চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রাক্কালে বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার সাথে মোদির সাক্ষাতের কোনো যুক্তিই তিনি দেখেন না। তার এই বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকর দিল্লিতে ঘোষণা করেছেন, ‘বাংলাদেশে সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করবেন।’ সে মোতাবেক ৭ জুন হোটেল সোনারগাঁওয়ে বেগম খালেদা জিয়া দলের কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রায় ৩০ মিনিট প্রতিনিধিদলের সাথে আলোচনা শেষে মোদি এবং বেগম জিয়া আরো ১৫ মিনিট একান্ত রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। বৈঠকের বিষয়বস্তু প্রকাশ করা থেকে উভয় নেতা বিরত ছিলেন। তবে বৈঠক থেকে বের হওয়ার সময় বেগম খালেদা জিয়াকে যেভাবে প্রফুল্ল দেখা গেছে, তাতে মনে হয়েছে বৈঠকটি ছিল খুবই আন্তরিক, অর্থবহ ও সন্তোষজনক।
এই একান্ত বৈঠক নিয়ে আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা নানা ধরনের খবর পরিবেশন করেছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধ উপেক্ষা করে মোদি যে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন এবং একান্ত সাক্ষাতে যে গুরুত্ব দিয়েছেন, তার রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমি মনে করি, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মনে করেন, নির্বাচনের নামে যে প্রহসন বাংলাদেশে চলছে তা চিরস্থায়ী হবে না, একদিন-না-একদিন এখানে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে এবং সেই নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া ও তার দলের নিরঙ্কুশ জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এ অঞ্চলের শান্তি-স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক অবকাঠামোসহ উন্নয়নে বেগম খালেদা জিয়ার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সরকার রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে দীর্ঘকাল দলীয় কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। কারণ, ইতোমধ্যে সংস্থাগুলোর কার্যক্রম দেশে এবং বাইরে ভাবমূর্তির সঙ্কটে পড়েছে। গুম-খুন, ভয়ভীতি দেখানো গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনের হাতিয়ার হতে পারে না। জনগণ একসময় দুঃশাসন, দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেই। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক শক্তির নয়া রাজনৈতিক মেরুকরণ হবে। সেই মেরুকরণে দলগুলোর পার্থক্য ও বিরোধ থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষে আন্দোলনে সব রাজনৈতিক শক্তির এক সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে উঠবে। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিএনপির সাহসী, ত্যাগী ও আদর্শবান নেতাকর্মীরা নেতৃত্বের সামনের কাতারে চলে আসবেন। ব্যক্তিবিশেষের পছন্দ নয়, তৃণমূল কর্মীদের মতামতই হবে নেতা নির্বাচনের মাপকাঠি। দুর্বলচিত্তের ভীরু নেতারা নেতৃত্ব থেকে দূরে সরে যাবেন, নিষ্ক্রিয় হবেন। অনেকেই হয়তো ক্ষমতাসীনদের সাথে হাত মেলাতে পারেন। তাতেও তেমন ক্ষতি হবে না। বিএনপির এই কঠিন সময় থাকবে না। প্রয়োজন শুধু সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতাকর্মীদের পাহাড়ের মতো অবিচল থাকা। দল এবং দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি নেতাকর্মীদের রয়েছে অবিচল আস্থা এবং জনগণের ব্যাপক সমর্থন। প্রয়োজন শুধু সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করা।
লেখক: যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি ও সাবেক হুইপ
No comments