পাচারকারীদের থেকে মেয়েকে উদ্ধার করেও চাপে পরিবার by গোলাম মর্তুজা ও আহাদ হায়দার
পাত্র
দেখানোর নাম করে সদ্য এসএসসি উত্তীর্ণ একটি মেয়েকে বাগেরহাটের কচুয়া থেকে
ভারতে পাচার করেছিল তারই এক আত্মীয়। স্বজনেরা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আড়াই মাস
পরে মেয়েটিকে ভারতের উত্তরাখন্ড থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। কিন্তু এরপর
থেকেই পাচারকারীরা সমানে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি ও তার পরিবারকে।
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয়ে আসামিরা!
সাতজনের বিরুদ্ধে মেয়েটির বাবা মানব পাচারের মামলা করেছিলেন। তাদের ধরতেও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না পুলিশ। উল্টো মামলা তুলে নিতে চাপ দিয়ে যাচ্ছে আসামিরা। ভুক্তভোগী মেয়েটির পরিবার এ নিয়ে কচুয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছে।
পরিবারের অভিযোগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা আসামিদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তার কারণেই আড়াই মাসেও আসামিদের ধরতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ। পুলিশ বলছে, বাগেরহাটের আওয়ামী লীগের এক নেতার পক্ষের দুই ব্যক্তি ওই মেয়েটির বাড়িতে এসেছিল বলে তদন্তে জানা গেছে। তবে আসামি ধরা বা না-ধরার বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই।
মামলার বিবরণ ও মেয়েটির স্বজনদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট জেলা শহরে নিয়ে পাত্র দেখানোর নাম করে মেয়েটিকে বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যায় তারই চাচাতো বোনের স্বামী আল আমিন ফকির। এরপর থেকেই মেয়েটি নিখোঁজ। এ ঘটনায় ৮ মার্চ কচুয়া থানায় একটি ‘নিখোঁজে’র জিডি করে মেয়েটির পরিবার। বাড়ি থেকে যাওয়ার এক মাস পর ১ এপ্রিল মেয়েটি তার মাকে ভারতের একটি নম্বর থেকে ফোন করে জানায়, সে বেঁচে আছে, ভালো আছে। ওই মুঠোফোনের সূত্র ধরেই তার সন্ধানে নামেন মামা রিয়াজ উদ্দীন। স্বজনেরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, মেয়েটিকে ভারতে পাচার করা হয়েছে। এরপর মেয়েটির বাবা বাদী হয়ে আল আমিন ফকিরসহ সাতজনকে আসামি করে কচুয়া থানায় মানব পাচার আইনে একটি মামলা করেন। মামলার অন্য আসামিরা হলো নাজমা বেগম, মেহেদি হাসান, পারুল বেগম, আল আমিনের স্ত্রী দুলালি বেগম এবং তার দুই ভাই আকু ফকির ও জুমা ফকির।
উদ্ধারপর্ব: মেয়েটির মামা রিয়াজ উদ্দীন বলেন, তিনি দুই দফা ভারতে গিয়ে সেখানে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও মানবাধিকার সংগঠন স্টপের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত উত্তরাখন্ড রাজ্যের নেপাল সীমান্তবর্তী জেলা রুদ্রপুর থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করেছেন। তিনি বলেন, ১ এপ্রিল প্রথম যেই নম্বরটি থেকে মেয়েটি ফোন করেছিল সেই নম্বরে বাংলাদেশ থেকে যখন বলা হয় তখন সীমা পরিচয় দিয়ে এক নারী বলেছিলেন, তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রামে অবস্থান করছেন। সীমা পরিচয় দেওয়া ওই নারী দাবি করেন, মেয়েটিকে তিনি বাসের ভেতর পেয়েছেন। মেয়েটির অভিভাবক ভারতে গেলে তিনি তাকে অভিভাবকের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু রিয়াজ উদ্দীন ভারতে গিয়ে ওই নম্বরটি বন্ধ পান। এরপর বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহযোগিতায় পুলিশের শরণাপন্ন হন রিয়াজ। পুলিশ মুঠোফোন নম্বরটি প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ করে দেখে ঝাড়খন্ড থেকে সিমকার্ডটি কেনা, সেটি দিল্লিতে ব্যবহৃত হচ্ছিল। নম্বর বন্ধ থাকায় পুলিশ কিছু করতে পারেনি।
রিয়াজ উদ্দীন বলেন, বাগেরহাটে ফিরে তিনি একপর্যায়ে প্রধান আসামি আল আমিন ফকিরের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে দিল্লির একটি ঠিকানা পান। এর মধ্যেই ৪ মে মেয়েটি ফোন করে জানায় যে, সে পাচারকারীদের খপ্পর থেকে পালিয়ে দিল্লির গ্রিন পার্ক এলাকায় প্রিয়া নামে এক নারীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। পরদিনই রিয়াজ রওনা দিয়ে ৬ মে কলকাতা পৌঁছান। সেখান থেকে প্রিয়া নামে ওই নারীকে ফোন করলে তিনি বলেন, তিনি এখন বেঙ্গালুরুতে রয়েছেন। তিনি মেয়েটির স্বজনদের দুই মাস পরে গিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে আসার জন্য বলে ফোন কেটে দেন।
রিয়াজ বলেন, তবুও ১১ মে দিল্লি যান তিনি। সেখানে গিয়ে প্রিয়ার ওই নম্বরটি বন্ধ পান। পরে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্টপ নামের একটি এনজিওর সাহায্য চাওয়া হয়। এর মধ্যেই পাচার হওয়া মেয়েটির বিষয়ে জানতে ভারতের একটি নম্বর থেকে গ্রামের বাড়িতে যোগাযোগ করেন এক নারী। পরে সেই নম্বরটি সংগ্রহ করে দিল্লি থেকে ফোন করেন রিয়াজ। জানতে পারেন, নিতু রায় ও অমিত নামে দুই যুবকের তত্ত্বাবধানে রয়েছে মেয়েটি। মূলত প্রিয়া নামের ওই নারীও পাচারকারী চক্রের সদস্য ছিলেন। তাঁর বাড়ির গৃহকর্মী ছিল অমিত। অমিতের কাছে সাহায্য চাইলে অমিত মেয়েটিকে নিয়ে উত্তরাখন্ডের রুদ্রপুরে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে ১৩ মে মেয়েটিকে পুলিশ ও এনজিও স্টপের সহায়তায় উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধার হওয়ার পরে মেয়েটি জানায়, তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল আল আমিন। এরপর কয়েক হাত বদল হয়ে দিল্লি যায়। তাকে অনৈতিক কাজে বাধ্য করার জন্য নানা রকম নির্যাতনও করা হয়। এর মধ্যে মেয়েটি মার্কেটে কাপড় কিনতে যাওয়ার কথা বলে পাচারকারীদের কবল থেকে পালাতে সক্ষম হয়। কিন্তু গিয়ে পড়ে আরেক পাচারকারী প্রিয়ার খপ্পরে। ২৪ মে মেয়েটি বাগেরহাটে মা-বাবার কাছে ফেরে।
হুমকি ও চাপ: মেয়েটি ফেরার পর থেকে গত দেড় মাসে পাঁচবার তাদের বাড়িতে মোটরসাইকেল আরোহী যুবকেরা গিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে এসেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে মামলা তুলে নেওয়ার চাপও দেওয়া হচ্ছে। পরিবারটি রয়েছে চরম আতঙ্কে।
গত বুধবার মঘিয়া গ্রামে গিয়ে ওই মেয়েটির বাবার নাম বলে তাদের বাড়িতে যাওয়ার পথ জানতে চাইলে লোকজন কেউই সাহায্য করেনি। উল্টো বিভিন্নজন নানা রকম প্রশ্ন শুরু করে। পরে মেয়েটির বাড়ি খুঁজে পাওয়ার পর তার ভাই জানান, হুমকিদাতা সন্দেহে গ্রামবাসী এ রকম আচরণ করেছিলেন। মেয়েটির পরিবার কৃষক, বেড়ার ওপরে টিন দিয়ে তাদের বাড়ি। পরিবারের সদস্যরা জানান, এখন পর্যন্ত পাঁচবার মোটরসাইকেলে তাদের বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে গেছে অচেনা যুবকেরা। এর মধ্যে একই লোকেরা এসেছে তিনবার। তারা নিজেদের বাগেরহাট সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনা হাসিবুল হাসান ওরফে শিপন মিনার লোক বলে পরিচয়ও দিয়েছে। আর বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মামলা তুলে নিয়ে ‘মীমাংসা’ করার চাপও আসছে। অব্যাহত হুমকি ও চাপের মুখে ২৩ জুন মেয়েটির ভাই কচুয়া থানায় একটি জিডি করেন।
পরিবারের কয়েকজন সদস্য জানান, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা আসামিদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এ কারণে তাদের ধরছে না পুলিশ।
কচুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ শমসের আলী বলেন, আসামিদের না ধরার বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। প্রধান আসামি আল আমিনসহ দুজন এখন ভারতে পালিয়ে রয়েছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। বাকিদের ধরার জন্য তিনিসহ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একাধিকবার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছেন। এর মধ্যে ২২ জুন রাতে ২ নম্বর আসামি আল আমিন ফকিরের স্ত্রীকে (পাচার হওয়া মেয়েটির চাচাতো বোন) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, কারা হুমকি দিতে এসেছিল সেটা জানাতে পারেনি বাদীপক্ষ। তবে পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে, বাগেরহাটের সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনা হাসিবুল হাসানের দুজন লোক ওই মেয়েটির বাড়িতে গিয়েছিল। পুলিশ জেনেছে, বাদীপক্ষেরই কোনো আত্মীয় শিপন মিনার কাছে গিয়ে বলেছেন যে মামলাটি ভুয়া। তারপরে শিপন মিনা ঘটনাটি খতিয়ে দেখার জন্য দুজনকে মঘিয়া গ্রামে পাঠান। তারা বাদী ও আশপাশের বিভিন্নজনের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। এ বিষয়ে পরে পুলিশ শিপন মিনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি।
যোগাযোগ করা হলে মিনা হাসিবুল হাসান লোক পাঠানোর অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো তাদের চিনিই না। আমি কেন লোক পাঠাব। আমার লোক ৩৫ জন। তাঁরা কোথাও যান না। আর যদি এ রকম লোক গিয়ে থাকে তাহলে পুলিশকে বলেন পুলিশ আটকায় রাখুক।’
আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের প্রশ্রয়ে আসামিরা!
সাতজনের বিরুদ্ধে মেয়েটির বাবা মানব পাচারের মামলা করেছিলেন। তাদের ধরতেও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না পুলিশ। উল্টো মামলা তুলে নিতে চাপ দিয়ে যাচ্ছে আসামিরা। ভুক্তভোগী মেয়েটির পরিবার এ নিয়ে কচুয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছে।
পরিবারের অভিযোগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা আসামিদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। তার কারণেই আড়াই মাসেও আসামিদের ধরতে কোনো উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ। পুলিশ বলছে, বাগেরহাটের আওয়ামী লীগের এক নেতার পক্ষের দুই ব্যক্তি ওই মেয়েটির বাড়িতে এসেছিল বলে তদন্তে জানা গেছে। তবে আসামি ধরা বা না-ধরার বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই।
মামলার বিবরণ ও মেয়েটির স্বজনদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাট জেলা শহরে নিয়ে পাত্র দেখানোর নাম করে মেয়েটিকে বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যায় তারই চাচাতো বোনের স্বামী আল আমিন ফকির। এরপর থেকেই মেয়েটি নিখোঁজ। এ ঘটনায় ৮ মার্চ কচুয়া থানায় একটি ‘নিখোঁজে’র জিডি করে মেয়েটির পরিবার। বাড়ি থেকে যাওয়ার এক মাস পর ১ এপ্রিল মেয়েটি তার মাকে ভারতের একটি নম্বর থেকে ফোন করে জানায়, সে বেঁচে আছে, ভালো আছে। ওই মুঠোফোনের সূত্র ধরেই তার সন্ধানে নামেন মামা রিয়াজ উদ্দীন। স্বজনেরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, মেয়েটিকে ভারতে পাচার করা হয়েছে। এরপর মেয়েটির বাবা বাদী হয়ে আল আমিন ফকিরসহ সাতজনকে আসামি করে কচুয়া থানায় মানব পাচার আইনে একটি মামলা করেন। মামলার অন্য আসামিরা হলো নাজমা বেগম, মেহেদি হাসান, পারুল বেগম, আল আমিনের স্ত্রী দুলালি বেগম এবং তার দুই ভাই আকু ফকির ও জুমা ফকির।
উদ্ধারপর্ব: মেয়েটির মামা রিয়াজ উদ্দীন বলেন, তিনি দুই দফা ভারতে গিয়ে সেখানে বাংলাদেশ হাইকমিশন ও মানবাধিকার সংগঠন স্টপের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত উত্তরাখন্ড রাজ্যের নেপাল সীমান্তবর্তী জেলা রুদ্রপুর থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করেছেন। তিনি বলেন, ১ এপ্রিল প্রথম যেই নম্বরটি থেকে মেয়েটি ফোন করেছিল সেই নম্বরে বাংলাদেশ থেকে যখন বলা হয় তখন সীমা পরিচয় দিয়ে এক নারী বলেছিলেন, তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রামে অবস্থান করছেন। সীমা পরিচয় দেওয়া ওই নারী দাবি করেন, মেয়েটিকে তিনি বাসের ভেতর পেয়েছেন। মেয়েটির অভিভাবক ভারতে গেলে তিনি তাকে অভিভাবকের হাতে তুলে দেবেন। কিন্তু রিয়াজ উদ্দীন ভারতে গিয়ে ওই নম্বরটি বন্ধ পান। এরপর বাংলাদেশ হাইকমিশনের সহযোগিতায় পুলিশের শরণাপন্ন হন রিয়াজ। পুলিশ মুঠোফোন নম্বরটি প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ করে দেখে ঝাড়খন্ড থেকে সিমকার্ডটি কেনা, সেটি দিল্লিতে ব্যবহৃত হচ্ছিল। নম্বর বন্ধ থাকায় পুলিশ কিছু করতে পারেনি।
রিয়াজ উদ্দীন বলেন, বাগেরহাটে ফিরে তিনি একপর্যায়ে প্রধান আসামি আল আমিন ফকিরের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে দিল্লির একটি ঠিকানা পান। এর মধ্যেই ৪ মে মেয়েটি ফোন করে জানায় যে, সে পাচারকারীদের খপ্পর থেকে পালিয়ে দিল্লির গ্রিন পার্ক এলাকায় প্রিয়া নামে এক নারীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে। পরদিনই রিয়াজ রওনা দিয়ে ৬ মে কলকাতা পৌঁছান। সেখান থেকে প্রিয়া নামে ওই নারীকে ফোন করলে তিনি বলেন, তিনি এখন বেঙ্গালুরুতে রয়েছেন। তিনি মেয়েটির স্বজনদের দুই মাস পরে গিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে আসার জন্য বলে ফোন কেটে দেন।
রিয়াজ বলেন, তবুও ১১ মে দিল্লি যান তিনি। সেখানে গিয়ে প্রিয়ার ওই নম্বরটি বন্ধ পান। পরে দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে স্টপ নামের একটি এনজিওর সাহায্য চাওয়া হয়। এর মধ্যেই পাচার হওয়া মেয়েটির বিষয়ে জানতে ভারতের একটি নম্বর থেকে গ্রামের বাড়িতে যোগাযোগ করেন এক নারী। পরে সেই নম্বরটি সংগ্রহ করে দিল্লি থেকে ফোন করেন রিয়াজ। জানতে পারেন, নিতু রায় ও অমিত নামে দুই যুবকের তত্ত্বাবধানে রয়েছে মেয়েটি। মূলত প্রিয়া নামের ওই নারীও পাচারকারী চক্রের সদস্য ছিলেন। তাঁর বাড়ির গৃহকর্মী ছিল অমিত। অমিতের কাছে সাহায্য চাইলে অমিত মেয়েটিকে নিয়ে উত্তরাখন্ডের রুদ্রপুরে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে ১৩ মে মেয়েটিকে পুলিশ ও এনজিও স্টপের সহায়তায় উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধার হওয়ার পরে মেয়েটি জানায়, তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল আল আমিন। এরপর কয়েক হাত বদল হয়ে দিল্লি যায়। তাকে অনৈতিক কাজে বাধ্য করার জন্য নানা রকম নির্যাতনও করা হয়। এর মধ্যে মেয়েটি মার্কেটে কাপড় কিনতে যাওয়ার কথা বলে পাচারকারীদের কবল থেকে পালাতে সক্ষম হয়। কিন্তু গিয়ে পড়ে আরেক পাচারকারী প্রিয়ার খপ্পরে। ২৪ মে মেয়েটি বাগেরহাটে মা-বাবার কাছে ফেরে।
হুমকি ও চাপ: মেয়েটি ফেরার পর থেকে গত দেড় মাসে পাঁচবার তাদের বাড়িতে মোটরসাইকেল আরোহী যুবকেরা গিয়ে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিয়ে এসেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন জায়গা থেকে মামলা তুলে নেওয়ার চাপও দেওয়া হচ্ছে। পরিবারটি রয়েছে চরম আতঙ্কে।
গত বুধবার মঘিয়া গ্রামে গিয়ে ওই মেয়েটির বাবার নাম বলে তাদের বাড়িতে যাওয়ার পথ জানতে চাইলে লোকজন কেউই সাহায্য করেনি। উল্টো বিভিন্নজন নানা রকম প্রশ্ন শুরু করে। পরে মেয়েটির বাড়ি খুঁজে পাওয়ার পর তার ভাই জানান, হুমকিদাতা সন্দেহে গ্রামবাসী এ রকম আচরণ করেছিলেন। মেয়েটির পরিবার কৃষক, বেড়ার ওপরে টিন দিয়ে তাদের বাড়ি। পরিবারের সদস্যরা জানান, এখন পর্যন্ত পাঁচবার মোটরসাইকেলে তাদের বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে গেছে অচেনা যুবকেরা। এর মধ্যে একই লোকেরা এসেছে তিনবার। তারা নিজেদের বাগেরহাট সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনা হাসিবুল হাসান ওরফে শিপন মিনার লোক বলে পরিচয়ও দিয়েছে। আর বিভিন্ন মাধ্যম থেকে মামলা তুলে নিয়ে ‘মীমাংসা’ করার চাপও আসছে। অব্যাহত হুমকি ও চাপের মুখে ২৩ জুন মেয়েটির ভাই কচুয়া থানায় একটি জিডি করেন।
পরিবারের কয়েকজন সদস্য জানান, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা আসামিদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। এ কারণে তাদের ধরছে না পুলিশ।
কচুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ শমসের আলী বলেন, আসামিদের না ধরার বিষয়ে কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। প্রধান আসামি আল আমিনসহ দুজন এখন ভারতে পালিয়ে রয়েছে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। বাকিদের ধরার জন্য তিনিসহ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা একাধিকবার বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছেন। এর মধ্যে ২২ জুন রাতে ২ নম্বর আসামি আল আমিন ফকিরের স্ত্রীকে (পাচার হওয়া মেয়েটির চাচাতো বোন) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
হুমকির বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি বলেন, কারা হুমকি দিতে এসেছিল সেটা জানাতে পারেনি বাদীপক্ষ। তবে পুলিশ তদন্ত করে দেখেছে, বাগেরহাটের সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনা হাসিবুল হাসানের দুজন লোক ওই মেয়েটির বাড়িতে গিয়েছিল। পুলিশ জেনেছে, বাদীপক্ষেরই কোনো আত্মীয় শিপন মিনার কাছে গিয়ে বলেছেন যে মামলাটি ভুয়া। তারপরে শিপন মিনা ঘটনাটি খতিয়ে দেখার জন্য দুজনকে মঘিয়া গ্রামে পাঠান। তারা বাদী ও আশপাশের বিভিন্নজনের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। এ বিষয়ে পরে পুলিশ শিপন মিনার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি।
যোগাযোগ করা হলে মিনা হাসিবুল হাসান লোক পাঠানোর অভিযোগ অস্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তো তাদের চিনিই না। আমি কেন লোক পাঠাব। আমার লোক ৩৫ জন। তাঁরা কোথাও যান না। আর যদি এ রকম লোক গিয়ে থাকে তাহলে পুলিশকে বলেন পুলিশ আটকায় রাখুক।’
No comments