পদদলিত হয়ে ১০ পুণ্যার্থীর মৃত্যু- ‘ভগবতীরে তুই কই গেলি...’
নিমিষেই
পুণ্য স্নানের উৎসব পরিণত হয় শোকের মাতমে। পুণ্যের আশায় ছুটে আসা লোকজনের
ভিড়ে পদদলিত হয়ে মারা যান ১০ জন। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। অতিরিক্ত ভিড় ও
গুজব ছড়ানোর কারণে মর্মান্তিক এ ঘটনা বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। ভোর
থেকেই বাড়তে থাকে জন সমাগম। একপর্যায়ে তিল ধারণের ঠাঁই পাওয়া দুষ্কর হয়ে
যায় সেখানে। এর মধ্যেই ঘাটের কাছের সড়কের বেইলি ব্রিজ ভেঙে পড়ার গুজব ছড়িয়ে
পড়ে। ওই গুজব থেকেই ঘাটমুখী রাস্তায় অতিরিক্ত মানুষের হুড়োহুড়ি শুরু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুণ্যস্নানের জন্য ১৮টি ঘাট থাকলে বরাবরের মতোই বেশি পুণ্যের প্রত্যাশায় রাজঘাটে ছিল উপচেপড়া ভিড়। রাজঘাটের ৫০ গজের মতো দূরে রয়েছে একটি বেইলি ব্রিজ। ঘাট ও ব্রিজের মধ্যবর্তী স্থানে তিন রাস্তার মোড়। সেখানে সকাল পৌনে ৮টার দিকে ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ পূজা নামে ১০ বছরের এক শিশু নিচে পড়ে যায়। স্বজনরা তাকে উদ্ধার করতে গেলে তাদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে অন্যরা। এতে পূজা আহত হয়। তবে তার স্বজনদের মধ্যে মালতি দাস ও তার ছেলে নিত্য গোপাল দাস ঘটনাস্থলে মারা যায়। ওই সময়ে ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়লে তিনদিকে পুণ্যার্থীদের ছোটাছুটি ও ধাক্কায় ওই এলাকায় অর্ধশত লোক মাটিতে পড়ে যান। এতেই পদদলিত আরও আট জনের মৃত্যু ঘটে। ঘটনার পরপর সরজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। নিহতের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে লাঙ্গলবন্দ তীর্থস্থান। স্বজন হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন অনেকে। তাদেরই একজন লক্ষ্মী রাণী সাহা। সত্তর বছর বয়সী তার বৃদ্ধা মা সূচিত্রা রাণী সাহা প্রায় প্রতিবারই পুণ্যস্নানের জন্য লাঙ্গলবন্দ যান। এবারও পটুয়াখালীর বাউফল থানার লোহালিয়া থেকে ছুটে এসেছিলেন মা ও মেয়ে। পুণ্যস্নানও করেছিলেন রাজঘাটে। ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে রাজঘাট থেকে বের হওয়ার পরেই ঘটে দুর্ঘটনা। লক্ষ্মী রাণী জানান, ভিড়ের মধ্যে হাত ধরে মাকে নিয়ে বেইলি ব্রিজের কাছাকাছি গিয়েছিলেন তিনি। ঠিক ওই সময়ে মানুষের ধাক্কায় মায়ের হাত থেকে ছুটে যায় তার হাত। মুহূর্তের মধ্যেই নিচে পড়ে যান তিনি। এ সময় তার ওপরে লুটিয়ে পড়েছিল আরও অনেকে। তারপর জ্ঞান হারান লক্ষ্মী রাণী। জ্ঞান ফেরার পর ‘মা মা’ বলে চিৎকার করছিলেন তিনি। এসব বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। লক্ষ্মী রাণী বলেন, পুণ্যস্নানে এসে মাকে হারালাম। আমি কেন বেঁচে থাকলাম। ভগবান মায়ের সঙ্গে আমারে কেন নিলেন না।
একইভাবে ভগবতী রাণী দাস ও তার কন্যা রাখী রাণী দাসের লাশ দেখে আর্তনাদ করছিলেন তাদের স্বজন মিনু দাস ও গুরুচরণ দাস। গুরুচরণ জানান, ভারতীয় দূতাবাসের কর্মচারী ভগবতী পুণ্যস্নানের জন্য মেয়ে ও মেয়েজামাইকে নিয়ে লাঙ্গলবন্দ তীর্থস্থানে যান। গোসল শেষে ফেরার পথেই পদদলিত হয়ে মারা যান তারা। ভগবতীরে তুই কই গেলি, তুই কই গেলি তুই...। বলে কাঁদছিলেন গুরুচরণ।
এভাবেই নিহতদের স্বজনদের সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না কেউ। এ ঘটনার পর ত্রিমুখী সড়কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য মানুষের পায়ের জুতা ও পোশাক। ভোর ৫টা ২৮ মিনিট থেকে লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যস্নান শুরু হয়। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ পুণ্যার্থী সমবেত হয় সেখানে। সকাল সাড়ে ৭টার পর ভিড় বাড়তে থাকে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ত্রিমুখী মোড়ের অলক রেস্টুরেন্টের মালিক অপু মালাকার জানান, পৌনে ৮টার দিকে স্নান শেষে ভেজা কাপড় নিয়ে যখন পুণ্যার্থীরা ফিরছিলেন। তখন ভিড়ে ও ব্রিজ ভাঙার গুজবে এক জনের উপর আরেকজন পড়তে থাকে। এরমধ্যে প্রায় ১০-১২ জন শিশু ছিল। আপ্রাণ চেষ্টা করে আশপাশের লোকজন ওই শিশুদের উদ্ধার করেছেন। অপু নিজেও ছয় শিশুকে উদ্ধার করেছেন বলে জানান। এই হতাহতের ঘটনার পরপর চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে কমতে থাকে পুণ্যার্থীর সংখ্যা। স্না না করেই ফিরে যেতে দেখা গেছে অনেককে। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পুণ্যার্থীদের অনেকে। নারায়াণগঞ্জের চাষাড়া এলাকার বাসিন্দা অর্চনা রাণী বিশ্বাস বলেন, শৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। যে যেভাবে পারছে সরু সড়ক দিয়ে ঢুকছে-বের হচ্ছে। এতেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর ছিল না।
রাজঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের এই ঘাটের দুটি ফটক রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদে রয়েছে কচুরিপানা। রাজঘাটে আছে মন্দির ও নারীদের পোশাক পরিবর্তনের স্থান। ঘাটে শৃঙ্খলার দায়িত্বে রয়েছেন চার জন পুলিশ ও ছয় জন আনসার সদস্য। কিন্তু শৃঙ্খলা বলতে কিছুই নেই সেখানে। দুটি ফটক দিয়েই ইচ্ছামতো পুণ্যার্থীরা বের হচ্ছেন ও প্রবেশ করছেন। যদিও কর্তব্যরত আনসার সদস্য সেলিম জানিয়েছেন, একটি ফটক দিয়ে পুণ্যার্থীরা বের হন এবং অন্যটি দিয়ে প্রবেশ করেন।
লাঙ্গলবন্দের স্নানের ইতিহাসে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা এটিই প্রথম বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ দুর্ঘটনার জন্য র্দুঘটনার জন্য অবৈধ দখলদারকে দায়ী করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান এমপি সেলিম ওসমান, জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিঞা, পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন প্রমুখ। এ সময় সেলিম ওসমান সাংবাকিদের কাছে এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, দখলদারদের কারণে ব্রহ্মপুত্র তীরের সড়ক দখল হয়ে রাস্তা সরু হয়ে গেছে। রাস্তা প্রশস্ত থাকলে হয়তো এ দুর্ঘটনা ঘটতো না।
নিহতদের পরিচয়: পদদলিত হয়ে মর্মান্তিকভাবে নিহতরা হলেন, মানিকগঞ্জের জাবরা এলাকার বলাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী মালতি দাস (৬০) ও তার ছেলে নিতাই (নিত্য) গোপল দাস (৩০), গোপালগঞ্জ জেলার গোষালকান্দি গ্রামের নকুল চন্দ্র বিশ্বাস (৫৫), কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামের কালিপদ নন্দীর ছেলে রঞ্জিত চন্দ্র নন্দী (৫৫), কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির নারায়ণ সাহার স্ত্রী কানন সাহা (৫০), কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের পরিমল সাহার স্ত্রী তুলশি দেবনাথ (৫২), ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার নিতাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী ভগবতি দাস (৪৮) ও তার কন্যা রাখী দাস (২২), নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার কবিরহাটের অনিল চন্দ্র নাগের স্ত্রী ভানুমতি নাগ (৫০) ও পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার মৃত বিজেন্দ্র লাল সাহার স্ত্রী সুচিত্রা রাণী সাহা (৭০), নিহতদের মধ্যে নকুল চন্দ্র বিশ্বাস মাদারীপুরের চরমুগরিয়া কলেজের অধ্যাপক। নিহতের পরিবারের লোকজনের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই জেলা প্রশাসকের অনুমতিতে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান, নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিনারা নাজমীন। এ বিষয়ে তিনি আরও জানান, নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
১০ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি: ব্রহ্মপুত্র নদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী স্নান উৎসবে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। আগামী পাঁচদিনের মধ্যে এ কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় এ কমিটি গঠন করা হয় বলে জানান জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা। ডিসি জানান, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ইসরাত হোসেন খানকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন-নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাহমুদুর রহমান হাবিব ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মিজানুর রহমান।
শোক প্রকাশ: এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। পৃথক শোকবাণীতে তারা নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। সেইসঙ্গে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পুণ্যস্নানের জন্য ১৮টি ঘাট থাকলে বরাবরের মতোই বেশি পুণ্যের প্রত্যাশায় রাজঘাটে ছিল উপচেপড়া ভিড়। রাজঘাটের ৫০ গজের মতো দূরে রয়েছে একটি বেইলি ব্রিজ। ঘাট ও ব্রিজের মধ্যবর্তী স্থানে তিন রাস্তার মোড়। সেখানে সকাল পৌনে ৮টার দিকে ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ পূজা নামে ১০ বছরের এক শিশু নিচে পড়ে যায়। স্বজনরা তাকে উদ্ধার করতে গেলে তাদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে অন্যরা। এতে পূজা আহত হয়। তবে তার স্বজনদের মধ্যে মালতি দাস ও তার ছেলে নিত্য গোপাল দাস ঘটনাস্থলে মারা যায়। ওই সময়ে ব্রিজ ভেঙে যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়লে তিনদিকে পুণ্যার্থীদের ছোটাছুটি ও ধাক্কায় ওই এলাকায় অর্ধশত লোক মাটিতে পড়ে যান। এতেই পদদলিত আরও আট জনের মৃত্যু ঘটে। ঘটনার পরপর সরজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে হৃদয়বিদারক দৃশ্য। নিহতের স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে লাঙ্গলবন্দ তীর্থস্থান। স্বজন হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন অনেকে। তাদেরই একজন লক্ষ্মী রাণী সাহা। সত্তর বছর বয়সী তার বৃদ্ধা মা সূচিত্রা রাণী সাহা প্রায় প্রতিবারই পুণ্যস্নানের জন্য লাঙ্গলবন্দ যান। এবারও পটুয়াখালীর বাউফল থানার লোহালিয়া থেকে ছুটে এসেছিলেন মা ও মেয়ে। পুণ্যস্নানও করেছিলেন রাজঘাটে। ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে রাজঘাট থেকে বের হওয়ার পরেই ঘটে দুর্ঘটনা। লক্ষ্মী রাণী জানান, ভিড়ের মধ্যে হাত ধরে মাকে নিয়ে বেইলি ব্রিজের কাছাকাছি গিয়েছিলেন তিনি। ঠিক ওই সময়ে মানুষের ধাক্কায় মায়ের হাত থেকে ছুটে যায় তার হাত। মুহূর্তের মধ্যেই নিচে পড়ে যান তিনি। এ সময় তার ওপরে লুটিয়ে পড়েছিল আরও অনেকে। তারপর জ্ঞান হারান লক্ষ্মী রাণী। জ্ঞান ফেরার পর ‘মা মা’ বলে চিৎকার করছিলেন তিনি। এসব বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। লক্ষ্মী রাণী বলেন, পুণ্যস্নানে এসে মাকে হারালাম। আমি কেন বেঁচে থাকলাম। ভগবান মায়ের সঙ্গে আমারে কেন নিলেন না।
একইভাবে ভগবতী রাণী দাস ও তার কন্যা রাখী রাণী দাসের লাশ দেখে আর্তনাদ করছিলেন তাদের স্বজন মিনু দাস ও গুরুচরণ দাস। গুরুচরণ জানান, ভারতীয় দূতাবাসের কর্মচারী ভগবতী পুণ্যস্নানের জন্য মেয়ে ও মেয়েজামাইকে নিয়ে লাঙ্গলবন্দ তীর্থস্থানে যান। গোসল শেষে ফেরার পথেই পদদলিত হয়ে মারা যান তারা। ভগবতীরে তুই কই গেলি, তুই কই গেলি তুই...। বলে কাঁদছিলেন গুরুচরণ।
এভাবেই নিহতদের স্বজনদের সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না কেউ। এ ঘটনার পর ত্রিমুখী সড়কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য মানুষের পায়ের জুতা ও পোশাক। ভোর ৫টা ২৮ মিনিট থেকে লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে পুণ্যস্নান শুরু হয়। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ পুণ্যার্থী সমবেত হয় সেখানে। সকাল সাড়ে ৭টার পর ভিড় বাড়তে থাকে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ত্রিমুখী মোড়ের অলক রেস্টুরেন্টের মালিক অপু মালাকার জানান, পৌনে ৮টার দিকে স্নান শেষে ভেজা কাপড় নিয়ে যখন পুণ্যার্থীরা ফিরছিলেন। তখন ভিড়ে ও ব্রিজ ভাঙার গুজবে এক জনের উপর আরেকজন পড়তে থাকে। এরমধ্যে প্রায় ১০-১২ জন শিশু ছিল। আপ্রাণ চেষ্টা করে আশপাশের লোকজন ওই শিশুদের উদ্ধার করেছেন। অপু নিজেও ছয় শিশুকে উদ্ধার করেছেন বলে জানান। এই হতাহতের ঘটনার পরপর চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে কমতে থাকে পুণ্যার্থীর সংখ্যা। স্না না করেই ফিরে যেতে দেখা গেছে অনেককে। এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পুণ্যার্থীদের অনেকে। নারায়াণগঞ্জের চাষাড়া এলাকার বাসিন্দা অর্চনা রাণী বিশ্বাস বলেন, শৃঙ্খলা বলতে কিছু ছিল না। যে যেভাবে পারছে সরু সড়ক দিয়ে ঢুকছে-বের হচ্ছে। এতেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুর্ঘটনার আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তৎপর ছিল না।
রাজঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের এই ঘাটের দুটি ফটক রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদে রয়েছে কচুরিপানা। রাজঘাটে আছে মন্দির ও নারীদের পোশাক পরিবর্তনের স্থান। ঘাটে শৃঙ্খলার দায়িত্বে রয়েছেন চার জন পুলিশ ও ছয় জন আনসার সদস্য। কিন্তু শৃঙ্খলা বলতে কিছুই নেই সেখানে। দুটি ফটক দিয়েই ইচ্ছামতো পুণ্যার্থীরা বের হচ্ছেন ও প্রবেশ করছেন। যদিও কর্তব্যরত আনসার সদস্য সেলিম জানিয়েছেন, একটি ফটক দিয়ে পুণ্যার্থীরা বের হন এবং অন্যটি দিয়ে প্রবেশ করেন।
লাঙ্গলবন্দের স্নানের ইতিহাসে পদদলিত হয়ে মৃত্যুর ঘটনা এটিই প্রথম বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এ দুর্ঘটনার জন্য র্দুঘটনার জন্য অবৈধ দখলদারকে দায়ী করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান এমপি সেলিম ওসমান, জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিঞা, পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন প্রমুখ। এ সময় সেলিম ওসমান সাংবাকিদের কাছে এই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, দখলদারদের কারণে ব্রহ্মপুত্র তীরের সড়ক দখল হয়ে রাস্তা সরু হয়ে গেছে। রাস্তা প্রশস্ত থাকলে হয়তো এ দুর্ঘটনা ঘটতো না।
নিহতদের পরিচয়: পদদলিত হয়ে মর্মান্তিকভাবে নিহতরা হলেন, মানিকগঞ্জের জাবরা এলাকার বলাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী মালতি দাস (৬০) ও তার ছেলে নিতাই (নিত্য) গোপল দাস (৩০), গোপালগঞ্জ জেলার গোষালকান্দি গ্রামের নকুল চন্দ্র বিশ্বাস (৫৫), কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থানার রামচন্দ্রপুর গ্রামের কালিপদ নন্দীর ছেলে রঞ্জিত চন্দ্র নন্দী (৫৫), কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির নারায়ণ সাহার স্ত্রী কানন সাহা (৫০), কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের পরিমল সাহার স্ত্রী তুলশি দেবনাথ (৫২), ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার নিতাই চন্দ্র দাসের স্ত্রী ভগবতি দাস (৪৮) ও তার কন্যা রাখী দাস (২২), নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার কবিরহাটের অনিল চন্দ্র নাগের স্ত্রী ভানুমতি নাগ (৫০) ও পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার মৃত বিজেন্দ্র লাল সাহার স্ত্রী সুচিত্রা রাণী সাহা (৭০), নিহতদের মধ্যে নকুল চন্দ্র বিশ্বাস মাদারীপুরের চরমুগরিয়া কলেজের অধ্যাপক। নিহতের পরিবারের লোকজনের আবেদনের প্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই জেলা প্রশাসকের অনুমতিতে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানান, নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিনারা নাজমীন। এ বিষয়ে তিনি আরও জানান, নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের এমপি সেলিম ওসমান।
১০ জনের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত কমিটি: ব্রহ্মপুত্র নদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অষ্টমী স্নান উৎসবে ১০ জনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। আগামী পাঁচদিনের মধ্যে এ কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় এ কমিটি গঠন করা হয় বলে জানান জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান মিঞা। ডিসি জানান, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ইসরাত হোসেন খানকে প্রধান করে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন-নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাহমুদুর রহমান হাবিব ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মিজানুর রহমান।
শোক প্রকাশ: এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। পৃথক শোকবাণীতে তারা নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করেন। সেইসঙ্গে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।
No comments