গতায়ু দিন দিন
তখন ভেবেছিলাম আর কখনো গ্রামে যেতে হবে না। কৈশোর এবং যৌবনের অনেকগুলো দিন কেটেছে সেখানকার সহজতায়। জলাশয়ে মাছ ধরতে নেমে বহুবার কাদামাখা হয়েছি। পেরিয়ে গেছি খরতাপ, বৃষ্টিভেজা সময়ও গেল অনেক। বিকেল কেটেছে সঙ্গীসাথিদের ছায়ায়। অতীতের ওই সব দৃশ্য কখনো-সখনো চোখের সামনে ভেসে উঠুক, তেমন আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল না। দূরান্তে যেতে হবে রাত জেগে যাত্রা দেখতে, বাড়ির পাশ দিয়ে সারি সারি লোক যাচ্ছে মাছ ধরার উৎসবে, স্কুলের মাঠে খেলা আছে—সেই সব আহ্বানও কেউ জানাতে আসার নয়। পেছনে তাকানোর সময় কোথায়!
প্রাচুর্যের কোল কেমন নেশা জাগায় তা আমি নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারছি। ঢাকা শহরে চারখানা বাড়ি। দুই ছেলেকে পড়াচ্ছি বিদেশে রেখে। দামি গাড়ি সার্বক্ষণিক সঙ্গী। ব্যাংকেও গচ্ছিত আছে অঢেল। অভাব নামক শব্দটা আমার অভিধান থেকে মুছে দিয়েছি কবেই। এমন একটা বলয়ে বাস করি যে, ওসব আমাকে স্পর্শ করার কোনো ফাঁকফোকর পায় না। প্রতিদিন যখন প্রাচুর্যের গালিচায় ছাওয়া পথ ধরে ঘুরি, তখন আরও সম্পদের নেশা আমাকে মাতাল বানিয়েও নিস্তার দেয় না। দুচোখে শিকারি পশুর লোভ আরও তীক্ষ্ণ হয়। কেটলির ফুটন্ত জলের ক্ষোভ যেন। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরার নরম বিছানায় গা ছেড়ে দিয়েও হা-হুতাশ। অদৃশ্য এসে যেন ঘুম কেড়ে নেয়। স্ত্রী ভৎর্সনা করে। তার দিকে তাকিয়ে আমার দুই ঠোঁটের প্রান্তে নিরুপায় হাসি খেলে যায়। যে যা-ই বলুক কিংবা ভাবুক, আরও সম্পদ চাই আমার। অতএব সময় কোথায় যে, কাজ ফেলে স্বগ্রামে যাব, কিছুদিন কাটিয়ে আসব সেখানটায়। বেড়ে ওঠা গ্রামে যাওয়া উচিত ভাবলেও শেষাবধি একটা উপেক্ষার স্রোতই ঠেলে দিয়েছি।
বুঝি, এসব মনের খেলা। তা-ও প্রশ্ন জাগে, আমার কি কোনো অভিমান ছিল, যা হৃদয়ের অদৃশ্য কোলে স্থায়ী রূপ নিয়েছে! শুরুতে সেই অভিমান জাগ্রত হলে কেঁদেছি ভাড়া নেওয়া ছোট্ট একটা কামরার চৌকিতে নিঃসঙ্গ শুয়ে। দৌড়ঝাঁপ করেও চাকরি জোটাতে পারিনি। ভাগ্য ফিরতে লাগল একটা জুট মিলে কিছু পার্টস সরবরাহ করার ঠিকাদারি দিয়ে। ক্রমে ক্রমে ব্যবসার অন্ধিসন্ধি আয়ত্ত করার ভেতর দিয়ে বাড়ি-গাড়ি হলো, ব্যাংকেও জমল টাকা। এগারো বছর আগে ভাগ্যান্বেষণে ঢাকা শহরে এসেছিলাম। তখন যৌবন। বিত্তবৈভবের খেয়াল সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরত। তবে জানতাম না, অতীতের আমার আমির মৃত্যু হবে ওই সম্পদের কারণে। আর এ-ও জানা ছিল না, শহরে এসে কাউকে বন্ধু করে নেওয়ার সময় এবং মন দুই-ই খুইয়ে ফেলব। গ্রামে থাকতে সঙ্গীসাথিদের পাশাপাশি হয়ে কত প্রান্তর ঘোরা হতো। অকৃত্রিম অক্সিজেনের সেসব দিনে সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শুনিয়েছি হৃদয়ের বিচিত্র বারতা। কিন্তু শহরে এসে হাওয়া হয়ে গেল অনেক কিছুই। অর্থমোহের অতলেই বোধকরি সব ঢাকা পড়ল আমার। আমি যে ডুবতে শুরু করেছি। আমাকে ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন মা। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় ছেলেকে ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে মুখ গুঁজলেন তিনি। দেখাসাক্ষাৎ রুদ্ধ হলো এভাবেই। অবশ্য নিভৃতে শূন্যতাটুকু হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠত, এখনো ওঠে। খবর এসেছে, মা শয্যা নিয়েছেন। তাঁকে শহরে এনে চিকিৎসা দেওয়ার প্রসঙ্গ তুললেও সম্মতি মেলেনি। শেষ বয়সে স্বামীগৃহের বাইরে পা রাখবেন না তিনি। চিকিৎসা যা, ওখানেই চলবে। ছেলের অবৈধ উপার্জন বন্ধ করতে মা এমন অটল ও বিমুখ। মধুর কোনো স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন—কোনো কিছুই আমার ঘুমে দৃশ্যমান নয়। আজকাল ঘুমে, কী জাগরণে রোগভোগে শয্যাশায়ী মায়ের মুখখানি মনের আয়নায় বারবার ভেসে ওঠে, স্পষ্ট হয়।
আমার জন্মের দুই বছরের মাথায় বিধবা হলেন মা। ছেলেকে ঘিরে অনেক আশার কথা রচনা করেছেন তিনি। কিন্তু আমার লেখন বিপরীতই দাঁড়াল। সৎ-উপার্জন আর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিজমার আয় দিয়ে স্ত্রী, সন্তানের ভরণপোষণ চালিয়ে নিতে পারতাম হয়তো। তবে কিনা জন্মের পর জ্ঞাত হয়েছিলাম, পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী আদম এবং বিবি হাওয়া থেকে যুগে যুগে জন্ম নেওয়া মানুষেরই একজন আমি। তাঁদের জীবনেও মস্ত পাপ ছিল, আমি আরকি! খোদার নিষেধ ডিঙিয়ে শয়তানের প্ররোচনায় দুজনেই গন্ধম খেয়েছিলেন। সেই পাপে সৃষ্টিকর্তা তাঁদের নিক্ষেপ করেছিলেন পৃথিবীতে। আদিম মানব-মানবীর ভুলই আজ নানা আঙ্গিকে মানুষে মানুষে পল্লবিত। আগে মায়ের চিঠি পেতাম। দোয়া জানান অন্তে পরসমাচারের প্রথমেই তিনি আমাকে সৎপথে চলার নির্দেশ দিতেন। তাঁর বউমা এবং দুই নাতিকে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার ডাকও থাকত সেই চিঠিতে। জবাবে লিখেছি, তিনি যেন আগে ঢাকায় আসেন। এখানে এলে সুচিকিৎসা হবে। মা এসেছিলেন অবশেষে। এক রাত থেকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাকে ধরে বসেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, চল, আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবি তুই। যাওয়া হয়নি। আজ সেই কথা স্মরণ হলে শোকের গলিতে সেঁধিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে। বিবেকের দুয়ারে দারুণ প্রশ্নরা আরও তীক্ষ্ণ হয়। ভাবি কি, ফন্দিফিকির দিয়ে যা গড়েছি, সব ফেলে স্বগ্রামে ফিরে যাই। আবার এ-ও বুঝি, লোভ সংবরণ সহজসাধন নয়। এই নেশা যাকে পেয়ে বসে, তা থেকে তার অব্যাহতি মেলে না। কী যেন সে হারিয়ে ফেলে প্রতিদিন অংশ অংশ করে, জানতেও পারে না। সম্ভবত সেটা ছুটির দিন ছিল। সে সময় আমার ঘরে প্রবেশ করেছিল ছেলেবেলার বন্ধু গজনফর আলী। তাকে পাশে বসার আমন্ত্রণ জানানোর পর রোগভোগে শয্যাশায়ী আমার মায়ের কথা শোনাল। প্রচণ্ড অসুখ। মরণশয্যায়। আমাকে যেতেই হবে, এই বোধটা সমস্ত সত্তাজুড়ে প্রখর হয়ে ওঠে। কিন্তু মায়ের মুখ দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম পরিণতি। শুধু যেন একটা অপেক্ষা ছিল। শেষে সেই প্রহর উত্তীর্ণ হলে গজনফর শিশুর মতো কেঁদে উঠেছে। আমি শুধু পশ্চিমের আকাশ দেখেছি, পকেটে রাখা সিগারেট হাতড়েছি, পাইনি শেষ পর্যন্ত। মাকে শুভ্র কাপড়ে আবৃত করা হয়েছে। চারপাশে অনেক মানুষের ভিড়। গজনফর একবার শুধু বলেছে, ক্ষমা চাইতে হলে মৃতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্ষমা চেয়ে নে। আমি তা পারিনি, বুকের ভেতরের একটা ভারী পাথরকে শুধু নামাতে চেয়েছি। কবরে একমুঠো মাটি ছড়িয়ে দিয়ে ঘরে এসে ফুরসত পেয়ে কেঁদেছিলাম। গজনফর আলী সান্ত্বনা দিয়েছে। একবার বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এ পর্যন্ত যা হারিয়ে ফেলেছি তা কি পুনরায় ফিরে পাব? কান্নার পর কি নিজেকে চিনতে আরম্ভ করেছিলাম?
দুদিন কেটে গেছে। এই দুদিন গজনফর আলীর সঙ্গে বসে অতীত স্মরণ করেছি। যাদের কথা ভুলে গিয়েছিলাম, যাদের ভালোবাসা আমার জন্য সংরক্ষিত ছিল, তারা সবাই আবার চৈতন্যে ফিরে আসতে থাকল। সেদিন তাকে বলেছিলাম, গজনফর, আমি আর ফিরে যাব না শহরে। সে অবাক হয়ে তাকিয়েছে আমার মুখের দিকে। পরদিন আমরা আনন্দ মাঝির নৌকায় চড়েছি। স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম একজন মানুষ কোন্দায় চড়ে বর্ষার জলে ছিপ ফেলেছে। গজনফর আমার পাশে বসে সেই লোকটির দিকে তাকাল। ধানখেতের ওপর দিয়ে বয়ে গেল বাতাসের হঠাৎ ঝটকা। স্টেশনে ঘণ্টা বাজছিল। অদূরে সিগন্যালের লাল বাতি। আমি চমকে উঠেছি। এই দৃশ্যের ভেতরে আমি ছিলাম, অতীতেও একবার এই স্টেশনে এসেছিলাম। আনন্দ মাঝিরই নৌকা ছিল পারাপারের জন্য। গজনফর সেদিনও এভাবেই বসা ছিল আমার পাশে। সেদিনও লোকটা ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিল। স্টেশনে ঘণ্টা বেজে ওঠা, কি ট্রেনের সিগন্যাল দেখতে পাওয়া—সবই হুবহু এ রকম। কিন্তু কবে ঠিক এই দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছিলাম, কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না। গজনফর বলল, ঠিক সময়েই এসেছি। আরেকটু দেরি হলে ট্রেন পেতে না। চমকে উঠি। গজনফর সেদিনও এই কথাটাই শুনিয়েছিল আমাকে। ট্রেনে বসে মনে করতে চেয়েছি দিন-সাল—কবে ঠিক এই ঘটনা ঘটেছিল। সম্ভবত চাকরির খোঁজে প্রথম যখন শহরে আসি আনন্দ মাঝির নৌকায় চড়ে, সেদিন। প্রথমবার আমি জেনে আসতে পারিনি, কী হারিয়ে এসেছি, দ্বিতীয়বার জেনেছি আসল সত্য।
প্রাচুর্যের কোল কেমন নেশা জাগায় তা আমি নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারছি। ঢাকা শহরে চারখানা বাড়ি। দুই ছেলেকে পড়াচ্ছি বিদেশে রেখে। দামি গাড়ি সার্বক্ষণিক সঙ্গী। ব্যাংকেও গচ্ছিত আছে অঢেল। অভাব নামক শব্দটা আমার অভিধান থেকে মুছে দিয়েছি কবেই। এমন একটা বলয়ে বাস করি যে, ওসব আমাকে স্পর্শ করার কোনো ফাঁকফোকর পায় না। প্রতিদিন যখন প্রাচুর্যের গালিচায় ছাওয়া পথ ধরে ঘুরি, তখন আরও সম্পদের নেশা আমাকে মাতাল বানিয়েও নিস্তার দেয় না। দুচোখে শিকারি পশুর লোভ আরও তীক্ষ্ণ হয়। কেটলির ফুটন্ত জলের ক্ষোভ যেন। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরার নরম বিছানায় গা ছেড়ে দিয়েও হা-হুতাশ। অদৃশ্য এসে যেন ঘুম কেড়ে নেয়। স্ত্রী ভৎর্সনা করে। তার দিকে তাকিয়ে আমার দুই ঠোঁটের প্রান্তে নিরুপায় হাসি খেলে যায়। যে যা-ই বলুক কিংবা ভাবুক, আরও সম্পদ চাই আমার। অতএব সময় কোথায় যে, কাজ ফেলে স্বগ্রামে যাব, কিছুদিন কাটিয়ে আসব সেখানটায়। বেড়ে ওঠা গ্রামে যাওয়া উচিত ভাবলেও শেষাবধি একটা উপেক্ষার স্রোতই ঠেলে দিয়েছি।
বুঝি, এসব মনের খেলা। তা-ও প্রশ্ন জাগে, আমার কি কোনো অভিমান ছিল, যা হৃদয়ের অদৃশ্য কোলে স্থায়ী রূপ নিয়েছে! শুরুতে সেই অভিমান জাগ্রত হলে কেঁদেছি ভাড়া নেওয়া ছোট্ট একটা কামরার চৌকিতে নিঃসঙ্গ শুয়ে। দৌড়ঝাঁপ করেও চাকরি জোটাতে পারিনি। ভাগ্য ফিরতে লাগল একটা জুট মিলে কিছু পার্টস সরবরাহ করার ঠিকাদারি দিয়ে। ক্রমে ক্রমে ব্যবসার অন্ধিসন্ধি আয়ত্ত করার ভেতর দিয়ে বাড়ি-গাড়ি হলো, ব্যাংকেও জমল টাকা। এগারো বছর আগে ভাগ্যান্বেষণে ঢাকা শহরে এসেছিলাম। তখন যৌবন। বিত্তবৈভবের খেয়াল সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরত। তবে জানতাম না, অতীতের আমার আমির মৃত্যু হবে ওই সম্পদের কারণে। আর এ-ও জানা ছিল না, শহরে এসে কাউকে বন্ধু করে নেওয়ার সময় এবং মন দুই-ই খুইয়ে ফেলব। গ্রামে থাকতে সঙ্গীসাথিদের পাশাপাশি হয়ে কত প্রান্তর ঘোরা হতো। অকৃত্রিম অক্সিজেনের সেসব দিনে সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে নিজেকে শুনিয়েছি হৃদয়ের বিচিত্র বারতা। কিন্তু শহরে এসে হাওয়া হয়ে গেল অনেক কিছুই। অর্থমোহের অতলেই বোধকরি সব ঢাকা পড়ল আমার। আমি যে ডুবতে শুরু করেছি। আমাকে ফেরানোর চেষ্টা করেছিলেন মা। কিন্তু ব্যর্থ হওয়ায় ছেলেকে ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে মুখ গুঁজলেন তিনি। দেখাসাক্ষাৎ রুদ্ধ হলো এভাবেই। অবশ্য নিভৃতে শূন্যতাটুকু হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠত, এখনো ওঠে। খবর এসেছে, মা শয্যা নিয়েছেন। তাঁকে শহরে এনে চিকিৎসা দেওয়ার প্রসঙ্গ তুললেও সম্মতি মেলেনি। শেষ বয়সে স্বামীগৃহের বাইরে পা রাখবেন না তিনি। চিকিৎসা যা, ওখানেই চলবে। ছেলের অবৈধ উপার্জন বন্ধ করতে মা এমন অটল ও বিমুখ। মধুর কোনো স্বপ্ন অথবা দুঃস্বপ্ন—কোনো কিছুই আমার ঘুমে দৃশ্যমান নয়। আজকাল ঘুমে, কী জাগরণে রোগভোগে শয্যাশায়ী মায়ের মুখখানি মনের আয়নায় বারবার ভেসে ওঠে, স্পষ্ট হয়।
আমার জন্মের দুই বছরের মাথায় বিধবা হলেন মা। ছেলেকে ঘিরে অনেক আশার কথা রচনা করেছেন তিনি। কিন্তু আমার লেখন বিপরীতই দাঁড়াল। সৎ-উপার্জন আর পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিজমার আয় দিয়ে স্ত্রী, সন্তানের ভরণপোষণ চালিয়ে নিতে পারতাম হয়তো। তবে কিনা জন্মের পর জ্ঞাত হয়েছিলাম, পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী আদম এবং বিবি হাওয়া থেকে যুগে যুগে জন্ম নেওয়া মানুষেরই একজন আমি। তাঁদের জীবনেও মস্ত পাপ ছিল, আমি আরকি! খোদার নিষেধ ডিঙিয়ে শয়তানের প্ররোচনায় দুজনেই গন্ধম খেয়েছিলেন। সেই পাপে সৃষ্টিকর্তা তাঁদের নিক্ষেপ করেছিলেন পৃথিবীতে। আদিম মানব-মানবীর ভুলই আজ নানা আঙ্গিকে মানুষে মানুষে পল্লবিত। আগে মায়ের চিঠি পেতাম। দোয়া জানান অন্তে পরসমাচারের প্রথমেই তিনি আমাকে সৎপথে চলার নির্দেশ দিতেন। তাঁর বউমা এবং দুই নাতিকে নিয়ে গ্রামে যাওয়ার ডাকও থাকত সেই চিঠিতে। জবাবে লিখেছি, তিনি যেন আগে ঢাকায় আসেন। এখানে এলে সুচিকিৎসা হবে। মা এসেছিলেন অবশেষে। এক রাত থেকে সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাকে ধরে বসেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, চল, আমাকে বাড়িতে দিয়ে আসবি তুই। যাওয়া হয়নি। আজ সেই কথা স্মরণ হলে শোকের গলিতে সেঁধিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা জাগে। বিবেকের দুয়ারে দারুণ প্রশ্নরা আরও তীক্ষ্ণ হয়। ভাবি কি, ফন্দিফিকির দিয়ে যা গড়েছি, সব ফেলে স্বগ্রামে ফিরে যাই। আবার এ-ও বুঝি, লোভ সংবরণ সহজসাধন নয়। এই নেশা যাকে পেয়ে বসে, তা থেকে তার অব্যাহতি মেলে না। কী যেন সে হারিয়ে ফেলে প্রতিদিন অংশ অংশ করে, জানতেও পারে না। সম্ভবত সেটা ছুটির দিন ছিল। সে সময় আমার ঘরে প্রবেশ করেছিল ছেলেবেলার বন্ধু গজনফর আলী। তাকে পাশে বসার আমন্ত্রণ জানানোর পর রোগভোগে শয্যাশায়ী আমার মায়ের কথা শোনাল। প্রচণ্ড অসুখ। মরণশয্যায়। আমাকে যেতেই হবে, এই বোধটা সমস্ত সত্তাজুড়ে প্রখর হয়ে ওঠে। কিন্তু মায়ের মুখ দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম পরিণতি। শুধু যেন একটা অপেক্ষা ছিল। শেষে সেই প্রহর উত্তীর্ণ হলে গজনফর শিশুর মতো কেঁদে উঠেছে। আমি শুধু পশ্চিমের আকাশ দেখেছি, পকেটে রাখা সিগারেট হাতড়েছি, পাইনি শেষ পর্যন্ত। মাকে শুভ্র কাপড়ে আবৃত করা হয়েছে। চারপাশে অনেক মানুষের ভিড়। গজনফর একবার শুধু বলেছে, ক্ষমা চাইতে হলে মৃতার কানের কাছে মুখ নিয়ে ক্ষমা চেয়ে নে। আমি তা পারিনি, বুকের ভেতরের একটা ভারী পাথরকে শুধু নামাতে চেয়েছি। কবরে একমুঠো মাটি ছড়িয়ে দিয়ে ঘরে এসে ফুরসত পেয়ে কেঁদেছিলাম। গজনফর আলী সান্ত্বনা দিয়েছে। একবার বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে প্রশ্ন জেগেছিল, এ পর্যন্ত যা হারিয়ে ফেলেছি তা কি পুনরায় ফিরে পাব? কান্নার পর কি নিজেকে চিনতে আরম্ভ করেছিলাম?
দুদিন কেটে গেছে। এই দুদিন গজনফর আলীর সঙ্গে বসে অতীত স্মরণ করেছি। যাদের কথা ভুলে গিয়েছিলাম, যাদের ভালোবাসা আমার জন্য সংরক্ষিত ছিল, তারা সবাই আবার চৈতন্যে ফিরে আসতে থাকল। সেদিন তাকে বলেছিলাম, গজনফর, আমি আর ফিরে যাব না শহরে। সে অবাক হয়ে তাকিয়েছে আমার মুখের দিকে। পরদিন আমরা আনন্দ মাঝির নৌকায় চড়েছি। স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম একজন মানুষ কোন্দায় চড়ে বর্ষার জলে ছিপ ফেলেছে। গজনফর আমার পাশে বসে সেই লোকটির দিকে তাকাল। ধানখেতের ওপর দিয়ে বয়ে গেল বাতাসের হঠাৎ ঝটকা। স্টেশনে ঘণ্টা বাজছিল। অদূরে সিগন্যালের লাল বাতি। আমি চমকে উঠেছি। এই দৃশ্যের ভেতরে আমি ছিলাম, অতীতেও একবার এই স্টেশনে এসেছিলাম। আনন্দ মাঝিরই নৌকা ছিল পারাপারের জন্য। গজনফর সেদিনও এভাবেই বসা ছিল আমার পাশে। সেদিনও লোকটা ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিল। স্টেশনে ঘণ্টা বেজে ওঠা, কি ট্রেনের সিগন্যাল দেখতে পাওয়া—সবই হুবহু এ রকম। কিন্তু কবে ঠিক এই দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছিলাম, কিছুতেই ভেবে পাচ্ছিলাম না। গজনফর বলল, ঠিক সময়েই এসেছি। আরেকটু দেরি হলে ট্রেন পেতে না। চমকে উঠি। গজনফর সেদিনও এই কথাটাই শুনিয়েছিল আমাকে। ট্রেনে বসে মনে করতে চেয়েছি দিন-সাল—কবে ঠিক এই ঘটনা ঘটেছিল। সম্ভবত চাকরির খোঁজে প্রথম যখন শহরে আসি আনন্দ মাঝির নৌকায় চড়ে, সেদিন। প্রথমবার আমি জেনে আসতে পারিনি, কী হারিয়ে এসেছি, দ্বিতীয়বার জেনেছি আসল সত্য।
No comments