বিএনপির কৌশলী অবস্থান by কাফি কামাল
সিটি
করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে কৌশলী অবস্থানে বিএনপি। নির্বাচনের মাঠেও থাকবে
আবার রাজপথের আন্দোলনেও থাকবে দলটি। সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের খালি মাঠে গোল
দিতে না দেয়া এবং পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে সরে যাওয়ার সুযোগ রেখে এমন
নীতিতে এগোচ্ছে তারা। তফসিল ঘোষণার ৭ দিন পেরিয়ে গেলেও আনুষ্ঠানিকভাবে
নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি বিএনপি। সিনিয়র নেতারা দফায় দফায় ইতিবাচক
ইঙ্গিত দিলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণে করা হচ্ছে সময়ক্ষেপণ। তবে দল ও জোটের
তরফে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও বসে নেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা। ইতিমধ্যেই
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল
আউয়াল মিন্টু, ঢাকা দক্ষিণে দলের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সালাম ও
সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক নাসিরউদ্দিন আহম্মেদ পিন্টু এবং চট্টগ্রামে
চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এম মনজুর আলম মঞ্জুর পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করা
হয়েছে। বিএনপির সমর্থন প্রত্যাশী সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীরাও তুলেছেন
মনোনয়নপত্র। সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির স্বার্থে নির্বাচন কমিশনে
গিয়ে নিজেদের ৬ দফা পরামর্শ ও সময় বাড়ানোর অনুরোধ জানিয়েছে বিএনপিপন্থি
বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন ‘শত নাগরিক’। ঢাকায় কোন সামাজিক বা নাগরিক সংগঠনের
পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোন প্রার্থীকে সমর্থন দেয়া না হলেও চট্টগ্রামে
মনজুর আলমকে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সমর্থন দিয়েছেন ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন
আন্দোলন’। এটিও বিএনপিপন্থি বিশিষ্ট নাগরিকদের চট্টগ্রামভিত্তিক একটি
সংগঠন। বুধবার পর্যন্ত বিষয়টি ‘শত নাগরিক’ এবং ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন
আন্দোলন’-এর সীমাবদ্ধ থাকলে গতকাল নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি। বুধবার শত নাগরিক জাতীয় কমিটি প্রধান নির্বাচন
কমিশনারের কাছ থেকে তাদের পরামর্শ ও অনুরোধের ইতিবাচক সাড়া পাননি। বিএনপি
নেতা ও শত নাগরিকদের তরফে প্রধান দাবি ছিল নির্বাচনের সময় বিরোধী দলের
নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও পুলিশি হয়রানি না করা। কিন্তু শত নাগরিকদের সঙ্গে
বৈঠকের পর সিইসি কাজী রকীবউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, মামলা বা
গ্রেপ্তার সংক্রান্ত বিষয়টি তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এমন পরিস্থিতিতে
বুধবার সন্ধ্যার পর ২০ দলীয় জোটের তরফে দেয়া এক বিবৃতিতে সিটি নির্বাচনকে
‘দেশবাসীর ইচ্ছার সঙ্গে তামাশা’ এবং নির্বাচন কমিশনকে ‘আজ্ঞাবহ’ ও ‘ঠুঁঁটো
জগন্নাথ’ বলে আখ্যায়িত করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লাহ বুলু। অভিযোগ
করা হয়, ‘কমিশন তথা সরকার স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় আরেকটি নির্বাচনী নাটক
মঞ্চস্থ করতে যাচ্ছে। ২০ দলীয় জোট যখন আন্দোলনে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে
উপনীত, ঠিক তখনই মহাচক্রান্তের অংশ হিসেবে সরকার আন্দোলনের গতিধারাকে
ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে।’ ২০ দলের তরফে এমন বিবৃতির মধ্যেই নির্বাচন
বর্জনের ইঙ্গিত পান অনেকেই। তবে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন
নির্বাচনে মেয়র পদে বর্তমান মেয়র মনজুর আলমকে সমর্থন দিয়েছে চট্টগ্রাম
মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপি। ওদিকে বিএনপি নেতা এবং শত নাগরিকদের
পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির স্বার্থে বিরোধী নেতাকর্মীদের
গ্রেপ্তার ও হয়রানি না করার আহ্বান জানালেও এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি
নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের তরফে। বিষয়টিকে নিজেদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে
না মন্তব্যের পাশাপাশি পরিষ্কার করে বলেছেন, আমি তো এ ব্যাপারে আশ্বস্ত
করতে পারি না। এছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি)
যুগ্ম কমিশনার ও ডিএমপির মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম গতকাল ডিএমপির মিডিয়া
সেন্টারে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, মামলা থাকা ব্যক্তিদের
মধ্যে কেউ জামিন না নিয়ে আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হলে
বা প্রচারে অংশ নিলে, তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে পুলিশ। এদিকে
জোটের তরফে দেয়া বিবৃতিতে সিটি নির্বাচনকে তামাশা মন্তব্য করা হলেও নেতারা
বিএনপি সমর্থকদের অংশগ্রহনের বিষয়টি উড়িয়ে দেননি। গতকাল স্বাধীনতা দিবস
উপলক্ষে দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা
জানাতে গিয়ে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল
(অব.) মাহবুবুর রহমান বলেছেন, আন্দোলন ও নির্বাচন একে অন্যের পরিপূরক।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও সিটি নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
কিন্তু অনেক প্রার্থী কারাগারে, অনেকে আত্মগোপনে। নির্বাচনী পরিবেশ ফিরে
এলে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হলে আন্দোলনের অংশ হিসেবে সিটি করপোরেশন
নির্বাচনে যাবে বিএনপি। তিনি বলেন, বিএনপি বিশ্বাস করে দেশের যে বড় সংকট
সেক্ষেত্রে স্থানীয় নিবার্চন নয়, জাতীয় নিবার্চন হওয়া উচিত। বিএনপির একাধিক
নেতা জানান, বিএনপিকে আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনতেই সিটি নির্বাচন দিয়েছে
সরকার। এ জন্য নির্বাচন কমিশন তড়িঘড়ি করে এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের পরামর্শকে
সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তফসিল ঘোষণা করেছে কমিশন। আবার বিএনপিকে সক্রিয়ভাবে
নির্বাচনের মাঠে থাকতে দিতে চায় না সরকার। তাই বিএনপিসহ অন্যান্য দলকে
অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হলেও নির্বাচনে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের
পরিবেশ সৃষ্টির কোন উদ্যোগ বা লক্ষণ নেই। বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের আইনগত
হয়রানির ব্যাপারেও কঠোর অবস্থান থেকে সরছে না সরকার ও প্রশাসন। বিএনপির
একাধিক নেতা ও দলীয় সূত্র জানায়, সিটি নির্বাচন নিয়ে কৌশলী অবস্থানে থাকবে
বিএনপি। স্থানীয় সরকার নির্বাচন হিসেবে সরাসরি নির্বাচনে না গিয়ে বিভিন্ন
প্ল্যাটফর্ম ও মঞ্চের ব্যানারে নির্বাচনী মাঠে থাকবে বিএনপি সমর্থক
সম্ভাব্য প্রার্থীর। চট্টগ্রামের মতো ঢাকায়ও শত নাগরিক বা কোন মঞ্চের পক্ষ
থেকে প্রার্থীদের সমর্থন দেয়া হতে পারে। বিরোধী নেতা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো
জানায়, সব প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা জেনেও কৌশলী অবস্থানে থেকে নির্বাচনে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। কারণ চলমান আন্দোলনের
কার্যকারিতা দিন দিন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলন থেকে
সরে আসা ও গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের একটি উপলক্ষ প্রয়োজন ছিল। পাবলিক পরীক্ষার
মতো গুরুত্বপূর্ণ সুযোগকে বিবেচনায় করা না হলেও এবার নির্বাচনকে সে উপলক্ষ
হিসেবে নেয়া হয়েছে। তাই মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে এ কৌশলী অবস্থান
নিয়েছে বিএনপি। পরিস্থিতি বিবেচনা করে যাতে নির্বাচনের প্রাক্কালে সরে আসা
যায়। আবার শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকলেও প্রার্থীরা জিতে এলে ভাল, না হলে
যাতে সেটাকে করা যায় আন্দোলনের গতি জোরদারের উপায়। সূত্র আরও জানায়,
কৌশলগত এ অবস্থানের কারণেই গতকাল জোটের তরফে দেয়া হয়নি কোন বিবৃতিতে।
No comments