স্বাধীনতা ও ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
১৯৪৭
সালে শেষ পর্যন্ত যা পাওয়া গেল সেটাকে স্বাধীনতা বলার উপায় নেই, সেটা ছিল
ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত অবস্থায় ১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইনের
প্রয়োজনীয় সংশোধনের মধ্য দিয়ে প্রদত্ত ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস লাভ, যার অর্থ
দাঁড়ায় ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রাপ্তি। ব্রিটিশ শাসকরা স্বাধীনতা দেবে না
এটাই ছিল স্বাভাবিক, না দেওয়ার জন্য যা যা দরকার তারা সেগুলোর কোনোটা করা
থেকেই বিরত থাকেনি। তাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ ছিল সাম্প্রদায়িক
বিভাজনকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের ব্যবস্থা করে দেওয়া। দৃশ্যত কাজটা কংগ্রেস
ও মুসলিম লীগই করেছে, কিন্তু ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ঔপনিবেশিক শাসকরা যে
ছিল সেটা মোটেই মিথ্যা নয়। কংগ্রেস ও লীগের কলহ এবং সংঘর্ষের দরুনই দেশ ভাগ
হয়েছিল এবং স্বাধীনতার বদলে দেশবাসীর ঘাড়ে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন চেপে
বসেছিল, এটা দৃশ্যমান সত্য; নেপথ্য দুর্বৃত্ত ছিল শাসকরা। কিন্তু এটাও তো
মানতেই হবে যে, ১৯৪৭ সালের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তটিতে কংগ্রেস ও লীগ উভয় দলই
ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছে, দেশকে ভাগ করে দেওয়ায়
মাউন্টব্যাটেনকে নানা মাত্রায় ধন্যবাদ জানিয়েছে এবং বাইরে যা-ই বলুক না কেন
সংঘর্ষে লিপ্ত দুই দলের কোনো দলই প্রকৃত স্বাধীনতা চায়নি। প্রয়োজনে
দেশবাসীকে তারা গৃহযুদ্ধের দিকে পরিচালিত করতেও প্রস্তুত ছিল। সেই
প্রয়োজনটা অন্য কিছুই নয়, নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া ছাড়া।
তাঁরা স্বাধীনতা চাননি, চেয়েছেন ক্ষমতার হস্তান্তর। তাই ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনে তাদের অসুবিধা হয়নি, বরঞ্চ সুবিধাই হয়েছে, কারণ ভারতশাসন আইনের মাধ্যমে আগে যারা দেশ শাসন করত তাদের ছেড়ে-দেওয়া ও সাজানো-গোছানো আসনগুলোতে নতুন শাসক হিসেবে এঁরা বসে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেছেন। দেশভাগও মেনে নিয়েছেন, কেননা দেশভাগ না ঘটলে দুই দলের ভেতর ক্ষমতা নিয়ে যে বিরোধ তার কোনো মীমাংসা হচ্ছিল না এবং ব্রিটিশ শাসকরা কিছুটা কৌতুকের সঙ্গেই তাগাদা দিচ্ছিল দ্রুত মীমাংসায় পৌঁছার জন্য। ভাবটা এই রকমের যে তারা তো উড়োজাহাজ তৈরি রেখেছে প্রস্থান করবে বলে, কিন্তু হানাহানি না থামলে ক্ষমতা যে দিয়ে যাবে সেটা কার হাতে। অতএব, মীমাংসা প্রয়োজন। দেশভাগ সেই মীমাংসারই নাম। তাতে নেতাদের সুবিধাই হয়েছে, দাম যা দেওয়ার দিতে হয়েছে হতভাগা দেশবাসীকেই, নাকের বদলে নরুন পাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা যদি ঘটে থাকে তবে তা ঘটেছে সাধারণ মানুষের জীবনেই।
স্বাধীনতার প্রশ্নে অত্যন্ত পরিষ্কার ও দৃঢ় অবস্থান গান্ধী বা জিন্নাহ কারোই ছিল না, বরঞ্চ ছিল পরবর্তী প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং জওহরলাল নেহেরুর। অপরদিকে জিন্নাহ আগাগোড়াই ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা ভেবেছেন, নতুন রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল হতে আপত্তি করবেন কি অন্যদের ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ না দিয়ে নিজের সঙ্গে নিজের গোপন পরামর্শ সভা বসিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন যে ওই পদটিতে তাঁকেই কেবল মানাবে। লাহোর প্রস্তাবে independent states-এর কথা ছিল; কিন্তু সেই independence বলতে যে প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা বোঝানো হয়েছে তা নয়, কি বোঝানো হয়েছে সেটা টের পাওয়া যায় ইংরেজরা চলে গেলে মুসলমানদের (অর্থাৎ জিন্নাহর নিজের) ভাগে কতটা পড়বে তা নিয়ে তাঁর ব্যস্ত থাকা দেখে। পরে independent states-এর বদলে যে তিনি একটি state-এর কথা বলা শুরু করেছিলেন তার পেছনে মনোভাবটা ছিল এই রকমের যে, ওই অখণ্ড রাষ্ট্রে ইংরেজরা থাকবে না ঠিকই, কিন্তু তাদের তৈরি করা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটা থাকবে। ইংরেজরা জিন্নাহকে কখনো কখনো বিরক্তিকর ব্যক্তি বলে হয়তো মনে করেছে, কিন্তু কখনোই শত্রু ভাবেনি, বরঞ্চ কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ হিসেবে জিন্নাহকে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। কংগ্রেসের নেতারা বারবার কারাবন্দী হয়েছেন, কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকরা গান্ধীর পরেই যে নেতার নাম শোনা যেত সেই জিন্নাহকে এমনকি একদিনের জন্য বন্দী করাটাও আবশ্যক মনে করেনি।
সুভাষ বসু যে সরকারি চাকরির মোহ ত্যাগ করে রাজনীতিতে এসেছিলেন তার পেছনে অনুপ্রেরণা ছিল একটিই, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা। দেশে ফিরে সুভাষ স্বাধীনতার কথাই ভাবতেন, ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের নয়। তাঁর নিজের ওপর গান্ধীর তুলনায় চিত্তরঞ্জনের প্রভাবই বরঞ্চ অধিক পরিমাণে পড়েছিল এবং চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে তিনি এ-বিষয়ে একমত ছিলেন যে, একটি পরাধীন দেশে যে-সমস্যার কথাই ভাবা যাক না কেন, চূড়ান্ত বিচারে সেটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা হতে বাধ্য। স্বাধীনতার যে কোনো বিকল্প নেই এটি তাঁর কাছে অল্প সময়েই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল এবং স্বাধীনতা না-পেলে যে ভারতের মুক্তি নেই এটি তাঁর জানা হয়ে গিয়েছিল, তবে অরবিন্দের মতো তিনি আধ্যাত্মিকতার পথ ধরেননি, গান্ধীর অহিংসার পথকেও কার্যকর বলে মনে করেননি। উভয় পন্থার বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ধারাবাহিক গণআন্দোলনে।
স্বাধীনতার প্রশ্নে জওহরলাল নেহেরুর অবস্থানও সুভাষ বসুর মতোই স্পষ্ট ছিল। তাত্তি্বক ও দার্শনিকভাবে নেহেরুর সঙ্গে তুলনীয় নেতা ভারতবর্ষে সেকালে কমই ছিলেন; কিছুটা কাছাকাছি ছিলেন এম এন রায়, কিন্তু রায় ভারতবর্ষকে তেমনভাবে জানেননি, বুঝতেও পারেননি, নেহেরু যে-ভাবে জেনেছেন ও বুঝেছেন। ১৯৩৪-৩৬-এ লেখা তাঁর আত্মজীবনীতে নেহেরু স্বাধীনতা বলতে কি বোঝেন সেটা সুন্দরভাবে বলেছেন। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল না, ছিল সমাজব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন। ইংরেজ চলে যাবে, তার জায়গায় স্থানীয়রা ক্ষমতা পাবে, অথচ সমাজ ও রাষ্ট্র আগের মতোই রয়ে যাবে, ওই ব্যবস্থাকে তিনি স্বাধীনতা বলে মানতে আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। জমিদারি ও মহাজনী শোষণ অক্ষুণ্ন রেখে স্বাধীনতার লাভ যে অসম্ভব তা তিনি প্রত্যক্ষ জ্ঞান থেকে বুঝেছেন।
স্মরণীয় যে এসব নেতার অনেকেই ছিলেন আইনজীবী। স্বাধীনতা এঁদের জন্য ছিল ব্যক্তিগত লাভের প্রতিশ্রুতি। নেহেরুর আত্মজীবনীর প্রামাণ্য বাংলা অনুবাদ করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার; স্বাধীনতার বিষয়ে উদারপন্থিদের মনোভাব সম্পর্কে নেহেরুর মন্তব্যকে বাংলায় উপস্থাপিত করতে গিয়ে তিনি যোগ করে দিয়েছেন 'রামের বদলে শ্যামে'র উপমা। অর্থাৎ উদারপন্থিরা চেয়েছে রামের বদলে শ্যামকে; এর বেশি কিছু নয়। এই বাংলা উপমা মূল বইতে নেই। দেশবাসীর অভিজ্ঞতা অবশ্য বলছে কিছুটা ভিন্ন কথা। সেটা এই যে, রাষ্ট্রীয় গদিতে রামের জায়গায় শ্যাম বসে পড়বে এমন সম্ভাবনা দেখে রহিমও এসে হাজির হয়েছে, সেও বলছে ওই আসনে তার জায়গা চাই। আর ওই যে রাম অর্থাৎ ইংরেজ, সে তখন করতালি দিয়ে রহিমকে বলেছে, হ্যাঁ, তাই তো, রহিম কেন বঞ্চিত হবে; আমি রাম তো তৈরি আছি ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাব বলে, তোমরা শ্যাম ও রহিম নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নাও কে কোন অংশ নেবে। শেষ পর্যন্ত ভাগাভাগিটা অবশ্য ইংরেজই করে দিয়েছে, ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর কলমের দাগ দিয়ে র্যাডক্লিফের যে সীমানা কেটে দেওয়া সেও তো এক ইংরেজ ব্যারিস্টারেরই ঔপনিবেশিক কর্তব্যপালন।
সুভাষ ও নেহেরু উভয়েই আন্তর্জাতিকতাবাদী ছিলেন, গান্ধী যা ছিলেন না; গান্ধী সারা বিশ্বে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু বিশ্বে, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে, কি ঘটছে সে-বিষয়ে মোটেই অবহিত ছিলেন না। অপরদিকে সুভাষ ও নেহেরু উভয়েই ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন না-করতে পারলে স্বাধীনতা যে কেবল কথার কথাই রয়ে যাবে, তার চেয়ে গভীর কিছু হবে না, এ বিষয়ে নেহেরু স্পষ্ট জানতেন। মার্কসের লেখা এবং লেনিনের কাজ সম্পর্কে তিনি কেবল অবহিত নন, তাঁদের দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছিলেন। লেনিনকে তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ নেতা বলে মনে করতেন। এসব বক্তব্য তাঁর আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়। সমাজতন্ত্রে আস্থা সুভাষেরও ছিল।
অনেক ব্যাপারেই সুভাষকে গান্ধীর বিপরীত অবস্থানে দাঁড়াতে হয়েছিল, তবু গান্ধী যেমন স্বাধীনতাকে একটি ভারতীয় রূপ দিতে চেয়েছেন, সুভাষও তেমনি বলতেন যে সমাজতন্ত্রকেও ভারতীয় রূপ দেওয়া আবশ্যক হবে। কমিউনিজম সম্পর্কে সুভাষের আপত্তি ছিল দুটি। একটি হলো এই মতবাদ নাস্তিক্যবাদের প্রশ্রয় দেয়, অপরটি হলো কমিউনিজম জাতীয়তাবাদবিরোধী। উভয় আপত্তিই অবশ্য ছিল অপ্রাসঙ্গিক। ধর্মনিরপেক্ষ ও ইহজাগতিক নেহেরু কমিউনিজমের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক আছে, নাকি বিরোধ রয়েছে এ নিয়ে মোটেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন না; যদিও ভারতীয় কমিউনিস্টরা ভারতকে ঠিক বোঝেননি এমন অভিযোগ তাঁর সব সময়েই ছিল।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ব্যাপারে নেহেরুর ভূমিকার তুলনায় সুভাষের ভূমিকা অবশ্যই বড় ও আপোসহীন, আজাদ হিন্দ ফৌজের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তিনি যে মাপের একটি ধাক্কা দিয়েছিলেন, নেহেরু তেমনটি দিতে পারেননি। তদুপরি গান্ধীর সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও নেহেরু যেভাবে গান্ধীর নেতৃত্ব মেনে নিয়ে আপোস করে ফেলেছিলেন, সুভাষ তেমনটি করেননি; এতে সুভাষ অনেক বেশি স্বাধীনচেতা ছিলেন। কিন্তু মতাদর্শগত দার্শনিক প্রশ্নে সুভাষ নেহেরুর তুলনায় যে পিছিয়ে ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই দুই নায়ক যদি একত্রে কাজ করতে পারতেন তাহলে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং দেশভাগের পরিবর্তে হয়তো এক প্রকারের স্বাধীনতাই পাওয়া যেত; কিন্তু তাঁদের পক্ষে কাছাকাছি এসেও একযোগে কাজ করা সম্ভব হয়নি, যার জন্য ক্ষতি হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের এবং পরবর্তী ইতিহাসের। গান্ধী ধর্মীয় ভারত, নৈতিক ভারত, আধ্যাত্মিক ভারত, সনাতন ভারত ইত্যাদির কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁর কালে মূল সত্য ছিল রাজনৈতিক ভারতই, যেখানে লড়াইটা চলছিল স্বাধীনতার জন্য, এবং যাতে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা স্বয়ং গান্ধীরই। কিন্তু রাজনীতি থেকে গান্ধী মাঝে মধ্যেই সরে যেতেন, কাজ নিতেন সমাজ সংস্কারের। তবে সমস্যাটা তো রয়েই যায় যে, সমাজে মৌলিক সংস্কার আসবে কি করে রাষ্ট্র যদি সমাজকে শাসন করতে থাকে, এবং সমাজের যত দুর্বলতা সেগুলোর রক্ষক ও পরিপালক হয়ে দাঁড়ায়? এ ধরনের প্রশ্নের জবাব গান্ধীর লেখায় তো পাওয়া যায়ইনি, তাঁর কাজের মধ্যেও সন্ধান মেলেনি। স্বাধীনতাকে তিনি একটি ভারতীয় চেহারা দিতে চেয়েছেন, যেমনভাবে পরবর্তীতে পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে ক্ষমতা জবরদখলকারী স্বৈরশাসকদের সবাই গণতন্ত্রকে 'দেশীয়' সাজে, অর্থাৎ নিজেদের সুবিধামতো রূপে সজ্জিত করতে চেয়েছেন। স্বাধীনতাকে ভারতীয় রূপ দানের প্রসঙ্গে গান্ধী রামরাজ্যের কথা বলতেন। তাঁর মতে রামরাজ্যই হলো ভারতীয় গণতন্ত্র, যে রাজ্যে জনগণের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিটা রাজনৈতিক নয়, নৈতিক বটে (moral authorit)। গান্ধী রামের ভক্ত ছিলেন; আমরা স্মরণ করি যে, অাঁততায়ীর আঘাতে প্রাণ হারানোর চরম মুহূর্তে তিনি রাম নামই উচ্চারণ করেছিলেন, অন্য কিছু নয়।
তাঁরা স্বাধীনতা চাননি, চেয়েছেন ক্ষমতার হস্তান্তর। তাই ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনে তাদের অসুবিধা হয়নি, বরঞ্চ সুবিধাই হয়েছে, কারণ ভারতশাসন আইনের মাধ্যমে আগে যারা দেশ শাসন করত তাদের ছেড়ে-দেওয়া ও সাজানো-গোছানো আসনগুলোতে নতুন শাসক হিসেবে এঁরা বসে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেছেন। দেশভাগও মেনে নিয়েছেন, কেননা দেশভাগ না ঘটলে দুই দলের ভেতর ক্ষমতা নিয়ে যে বিরোধ তার কোনো মীমাংসা হচ্ছিল না এবং ব্রিটিশ শাসকরা কিছুটা কৌতুকের সঙ্গেই তাগাদা দিচ্ছিল দ্রুত মীমাংসায় পৌঁছার জন্য। ভাবটা এই রকমের যে তারা তো উড়োজাহাজ তৈরি রেখেছে প্রস্থান করবে বলে, কিন্তু হানাহানি না থামলে ক্ষমতা যে দিয়ে যাবে সেটা কার হাতে। অতএব, মীমাংসা প্রয়োজন। দেশভাগ সেই মীমাংসারই নাম। তাতে নেতাদের সুবিধাই হয়েছে, দাম যা দেওয়ার দিতে হয়েছে হতভাগা দেশবাসীকেই, নাকের বদলে নরুন পাওয়ার মর্মান্তিক ঘটনা যদি ঘটে থাকে তবে তা ঘটেছে সাধারণ মানুষের জীবনেই।
স্বাধীনতার প্রশ্নে অত্যন্ত পরিষ্কার ও দৃঢ় অবস্থান গান্ধী বা জিন্নাহ কারোই ছিল না, বরঞ্চ ছিল পরবর্তী প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং জওহরলাল নেহেরুর। অপরদিকে জিন্নাহ আগাগোড়াই ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা ভেবেছেন, নতুন রাষ্ট্রের গভর্নর জেনারেল হতে আপত্তি করবেন কি অন্যদের ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ না দিয়ে নিজের সঙ্গে নিজের গোপন পরামর্শ সভা বসিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন যে ওই পদটিতে তাঁকেই কেবল মানাবে। লাহোর প্রস্তাবে independent states-এর কথা ছিল; কিন্তু সেই independence বলতে যে প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা বোঝানো হয়েছে তা নয়, কি বোঝানো হয়েছে সেটা টের পাওয়া যায় ইংরেজরা চলে গেলে মুসলমানদের (অর্থাৎ জিন্নাহর নিজের) ভাগে কতটা পড়বে তা নিয়ে তাঁর ব্যস্ত থাকা দেখে। পরে independent states-এর বদলে যে তিনি একটি state-এর কথা বলা শুরু করেছিলেন তার পেছনে মনোভাবটা ছিল এই রকমের যে, ওই অখণ্ড রাষ্ট্রে ইংরেজরা থাকবে না ঠিকই, কিন্তু তাদের তৈরি করা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাটা থাকবে। ইংরেজরা জিন্নাহকে কখনো কখনো বিরক্তিকর ব্যক্তি বলে হয়তো মনে করেছে, কিন্তু কখনোই শত্রু ভাবেনি, বরঞ্চ কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ হিসেবে জিন্নাহকে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। কংগ্রেসের নেতারা বারবার কারাবন্দী হয়েছেন, কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকরা গান্ধীর পরেই যে নেতার নাম শোনা যেত সেই জিন্নাহকে এমনকি একদিনের জন্য বন্দী করাটাও আবশ্যক মনে করেনি।
সুভাষ বসু যে সরকারি চাকরির মোহ ত্যাগ করে রাজনীতিতে এসেছিলেন তার পেছনে অনুপ্রেরণা ছিল একটিই, ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা। দেশে ফিরে সুভাষ স্বাধীনতার কথাই ভাবতেন, ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের নয়। তাঁর নিজের ওপর গান্ধীর তুলনায় চিত্তরঞ্জনের প্রভাবই বরঞ্চ অধিক পরিমাণে পড়েছিল এবং চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে তিনি এ-বিষয়ে একমত ছিলেন যে, একটি পরাধীন দেশে যে-সমস্যার কথাই ভাবা যাক না কেন, চূড়ান্ত বিচারে সেটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা হতে বাধ্য। স্বাধীনতার যে কোনো বিকল্প নেই এটি তাঁর কাছে অল্প সময়েই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল এবং স্বাধীনতা না-পেলে যে ভারতের মুক্তি নেই এটি তাঁর জানা হয়ে গিয়েছিল, তবে অরবিন্দের মতো তিনি আধ্যাত্মিকতার পথ ধরেননি, গান্ধীর অহিংসার পথকেও কার্যকর বলে মনে করেননি। উভয় পন্থার বিরুদ্ধে তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ধারাবাহিক গণআন্দোলনে।
স্বাধীনতার প্রশ্নে জওহরলাল নেহেরুর অবস্থানও সুভাষ বসুর মতোই স্পষ্ট ছিল। তাত্তি্বক ও দার্শনিকভাবে নেহেরুর সঙ্গে তুলনীয় নেতা ভারতবর্ষে সেকালে কমই ছিলেন; কিছুটা কাছাকাছি ছিলেন এম এন রায়, কিন্তু রায় ভারতবর্ষকে তেমনভাবে জানেননি, বুঝতেও পারেননি, নেহেরু যে-ভাবে জেনেছেন ও বুঝেছেন। ১৯৩৪-৩৬-এ লেখা তাঁর আত্মজীবনীতে নেহেরু স্বাধীনতা বলতে কি বোঝেন সেটা সুন্দরভাবে বলেছেন। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল না, ছিল সমাজব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন। ইংরেজ চলে যাবে, তার জায়গায় স্থানীয়রা ক্ষমতা পাবে, অথচ সমাজ ও রাষ্ট্র আগের মতোই রয়ে যাবে, ওই ব্যবস্থাকে তিনি স্বাধীনতা বলে মানতে আদৌ প্রস্তুত ছিলেন না। জমিদারি ও মহাজনী শোষণ অক্ষুণ্ন রেখে স্বাধীনতার লাভ যে অসম্ভব তা তিনি প্রত্যক্ষ জ্ঞান থেকে বুঝেছেন।
স্মরণীয় যে এসব নেতার অনেকেই ছিলেন আইনজীবী। স্বাধীনতা এঁদের জন্য ছিল ব্যক্তিগত লাভের প্রতিশ্রুতি। নেহেরুর আত্মজীবনীর প্রামাণ্য বাংলা অনুবাদ করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার; স্বাধীনতার বিষয়ে উদারপন্থিদের মনোভাব সম্পর্কে নেহেরুর মন্তব্যকে বাংলায় উপস্থাপিত করতে গিয়ে তিনি যোগ করে দিয়েছেন 'রামের বদলে শ্যামে'র উপমা। অর্থাৎ উদারপন্থিরা চেয়েছে রামের বদলে শ্যামকে; এর বেশি কিছু নয়। এই বাংলা উপমা মূল বইতে নেই। দেশবাসীর অভিজ্ঞতা অবশ্য বলছে কিছুটা ভিন্ন কথা। সেটা এই যে, রাষ্ট্রীয় গদিতে রামের জায়গায় শ্যাম বসে পড়বে এমন সম্ভাবনা দেখে রহিমও এসে হাজির হয়েছে, সেও বলছে ওই আসনে তার জায়গা চাই। আর ওই যে রাম অর্থাৎ ইংরেজ, সে তখন করতালি দিয়ে রহিমকে বলেছে, হ্যাঁ, তাই তো, রহিম কেন বঞ্চিত হবে; আমি রাম তো তৈরি আছি ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাব বলে, তোমরা শ্যাম ও রহিম নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নাও কে কোন অংশ নেবে। শেষ পর্যন্ত ভাগাভাগিটা অবশ্য ইংরেজই করে দিয়েছে, ভারতবর্ষের মানচিত্রের ওপর কলমের দাগ দিয়ে র্যাডক্লিফের যে সীমানা কেটে দেওয়া সেও তো এক ইংরেজ ব্যারিস্টারেরই ঔপনিবেশিক কর্তব্যপালন।
সুভাষ ও নেহেরু উভয়েই আন্তর্জাতিকতাবাদী ছিলেন, গান্ধী যা ছিলেন না; গান্ধী সারা বিশ্বে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু বিশ্বে, বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে, কি ঘটছে সে-বিষয়ে মোটেই অবহিত ছিলেন না। অপরদিকে সুভাষ ও নেহেরু উভয়েই ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন না-করতে পারলে স্বাধীনতা যে কেবল কথার কথাই রয়ে যাবে, তার চেয়ে গভীর কিছু হবে না, এ বিষয়ে নেহেরু স্পষ্ট জানতেন। মার্কসের লেখা এবং লেনিনের কাজ সম্পর্কে তিনি কেবল অবহিত নন, তাঁদের দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছিলেন। লেনিনকে তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ নেতা বলে মনে করতেন। এসব বক্তব্য তাঁর আত্মজীবনীতে পাওয়া যায়। সমাজতন্ত্রে আস্থা সুভাষেরও ছিল।
অনেক ব্যাপারেই সুভাষকে গান্ধীর বিপরীত অবস্থানে দাঁড়াতে হয়েছিল, তবু গান্ধী যেমন স্বাধীনতাকে একটি ভারতীয় রূপ দিতে চেয়েছেন, সুভাষও তেমনি বলতেন যে সমাজতন্ত্রকেও ভারতীয় রূপ দেওয়া আবশ্যক হবে। কমিউনিজম সম্পর্কে সুভাষের আপত্তি ছিল দুটি। একটি হলো এই মতবাদ নাস্তিক্যবাদের প্রশ্রয় দেয়, অপরটি হলো কমিউনিজম জাতীয়তাবাদবিরোধী। উভয় আপত্তিই অবশ্য ছিল অপ্রাসঙ্গিক। ধর্মনিরপেক্ষ ও ইহজাগতিক নেহেরু কমিউনিজমের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক আছে, নাকি বিরোধ রয়েছে এ নিয়ে মোটেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন না; যদিও ভারতীয় কমিউনিস্টরা ভারতকে ঠিক বোঝেননি এমন অভিযোগ তাঁর সব সময়েই ছিল।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ব্যাপারে নেহেরুর ভূমিকার তুলনায় সুভাষের ভূমিকা অবশ্যই বড় ও আপোসহীন, আজাদ হিন্দ ফৌজের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে তিনি যে মাপের একটি ধাক্কা দিয়েছিলেন, নেহেরু তেমনটি দিতে পারেননি। তদুপরি গান্ধীর সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও নেহেরু যেভাবে গান্ধীর নেতৃত্ব মেনে নিয়ে আপোস করে ফেলেছিলেন, সুভাষ তেমনটি করেননি; এতে সুভাষ অনেক বেশি স্বাধীনচেতা ছিলেন। কিন্তু মতাদর্শগত দার্শনিক প্রশ্নে সুভাষ নেহেরুর তুলনায় যে পিছিয়ে ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই দুই নায়ক যদি একত্রে কাজ করতে পারতেন তাহলে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন এবং দেশভাগের পরিবর্তে হয়তো এক প্রকারের স্বাধীনতাই পাওয়া যেত; কিন্তু তাঁদের পক্ষে কাছাকাছি এসেও একযোগে কাজ করা সম্ভব হয়নি, যার জন্য ক্ষতি হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের এবং পরবর্তী ইতিহাসের। গান্ধী ধর্মীয় ভারত, নৈতিক ভারত, আধ্যাত্মিক ভারত, সনাতন ভারত ইত্যাদির কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁর কালে মূল সত্য ছিল রাজনৈতিক ভারতই, যেখানে লড়াইটা চলছিল স্বাধীনতার জন্য, এবং যাতে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা স্বয়ং গান্ধীরই। কিন্তু রাজনীতি থেকে গান্ধী মাঝে মধ্যেই সরে যেতেন, কাজ নিতেন সমাজ সংস্কারের। তবে সমস্যাটা তো রয়েই যায় যে, সমাজে মৌলিক সংস্কার আসবে কি করে রাষ্ট্র যদি সমাজকে শাসন করতে থাকে, এবং সমাজের যত দুর্বলতা সেগুলোর রক্ষক ও পরিপালক হয়ে দাঁড়ায়? এ ধরনের প্রশ্নের জবাব গান্ধীর লেখায় তো পাওয়া যায়ইনি, তাঁর কাজের মধ্যেও সন্ধান মেলেনি। স্বাধীনতাকে তিনি একটি ভারতীয় চেহারা দিতে চেয়েছেন, যেমনভাবে পরবর্তীতে পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে ক্ষমতা জবরদখলকারী স্বৈরশাসকদের সবাই গণতন্ত্রকে 'দেশীয়' সাজে, অর্থাৎ নিজেদের সুবিধামতো রূপে সজ্জিত করতে চেয়েছেন। স্বাধীনতাকে ভারতীয় রূপ দানের প্রসঙ্গে গান্ধী রামরাজ্যের কথা বলতেন। তাঁর মতে রামরাজ্যই হলো ভারতীয় গণতন্ত্র, যে রাজ্যে জনগণের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিটা রাজনৈতিক নয়, নৈতিক বটে (moral authorit)। গান্ধী রামের ভক্ত ছিলেন; আমরা স্মরণ করি যে, অাঁততায়ীর আঘাতে প্রাণ হারানোর চরম মুহূর্তে তিনি রাম নামই উচ্চারণ করেছিলেন, অন্য কিছু নয়।
No comments