শাবি’র তিনটি হল ছিল ছাত্রলীগের অস্ত্রাগার
শাহজালাল
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি হলই অস্ত্রাগার হিসেবে গড়ে
তুলেছিল বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। আগ্নেয়াস্ত্রসহ দেশীয় অস্ত্রের নিরাপদ
স্থান হিসেবে তারা ব্যবহার করতো ওই তিনটি হল। এ কারণে তুচ্ছ ঘটনায় ঘটে
প্রাণহানি, হয় রক্তপাত। আর হল দখলে রাখতো ছাত্রলীগের দুর্ধর্ষ চিহ্নিত
ক্যাডাররা। ওদিকে, নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের জের ধরে ছাত্রলীগ নেতা সুমন
খুন হওয়ার প্রায় দুই মাস অতিবাহিত হওয়ার পর অভিযান চালিয়ে শাবি’র তিনটি হল
থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার
ঠিক আগের দিন শনিবার টানা ৫ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে এসব অস্ত্র উদ্ধার করে।
গতকাল থেকে খুলেছে শাবি ক্যাম্পাস। খোলার আগের দিন ক্যাম্পাসকে অস্ত্রমুক্ত
করতে অভিযান চালায় পুলিশ। শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হল, বঙ্গবন্ধু
হল ও মুজতবা আলী হল থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৫৫টি রামদা, ৮১টি
পাইপ, ১২৪টি রড, ছুরি ১০টি ও চায়নিজ কুড়াল একটি। গত ২০শে নভেম্বর
ছাত্রলীগের দুই পক্ষের বন্দুকযুদ্ধে ছাত্রলীগ নেতা সুমন নিহত হয়। এ ঘটনায়
আহত হন অর্ধশতাধিক। ঘটনার পর থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় সিলেটের সর্বোচ্চ
বিদ্যাপীঠ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সংঘর্ষের সময়
ছাত্রলীগের বিবদমান দুটি গ্রুপের নেতারা বিপুল পরিমাণ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র
ব্যবহার করে। বিরামহীন গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। গুলিবিনিময়ের ঘটনাকালে
ক্যাম্পাসে পুলিশও নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ঘটনার পর পুলিশ
পাঠানটুলার ছাত্রলীগ কর্মী শিপলুর বাসা থেকে একটি রিভলবার ছাড়া আর কোন
আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা গতকাল জানিয়েছেন,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি হলই হচ্ছে ছাত্রলীগের
অস্ত্রাগার। চারদলীয় জোট সরকারের সময় ছাত্রদল ও শিবিরকর্মীরা হলগুলোকে
অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তবে ওই সময় আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। কিন্তু
ছাত্রলীগের বহিরাগত চিহ্নিতরা তিনটি হলেই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র মজুত রাখতো।
সর্বশেষ সুমন খুনের ঘটনার পর পুলিশ অ্যাকশনে নামলে ছাত্রলীগ কর্মীরা হলে
থাকা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র সরিয়ে ফেলে। সিলেট নগরীর শামীমাবাদ আবাসিক এলাকার
মনিকা সিনেমা হলের সামনে, বাগবাড়ী এলাকা, মদিনা মার্কেট এলাকা, কালিবাড়ী
এলাকা, পাঠানটুলা এলাকায় এসব অস্ত্র সরিয়ে আনে। এর ফলে পুলিশ অভিযান
চালালেও হলের ভেতরে কোন আগ্নেয়াস্ত্র পায়নি। ওই সময় পুলিশ সম্ভাব্য স্থানে
অভিযান চালালেও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি। ওদিকে, শাবি’র হলে
নিয়মিত ছাত্রদের বাস খুব একটা ছিল না। বলা হচ্ছে, শাবি’র হলে বসবাসকারী ৮০
ভাগই বহিরাগত। তারা ছাত্রলীগের হয়ে হল দখলে রাখতো। এ বহিরাগতদের মধ্যে
বেশির ভাগই ছিল সিলেট ইন্টারন্যাশনায় ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি উপ-গ্রুপের
সদস্য। এদিকে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও এখনও
সুমন খুনের কোন কিনারা হয়নি। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল পর্যন্ত
রিপোর্ট জমা দেয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষকালে
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও ভবনের বাইরে থাকা সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে
দেয়া হয়েছিল। এর ফলে সিসি ক্যামেরায় অস্ত্রবাজদের ছবি ধারণ করা হয়নি। কারা এ
সিসি ক্যামেরা বন্ধ করে দিয়েছিল সে ব্যাপারেও কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, ছাত্রলীগের ওই সংঘর্ষের ঘটনার আগে
শাবি’র তিনটি ছাত্রহলে যত ‘ছাত্র’ থাকতেন, তাদের ৮০ ভাগই ছিলেন অবৈধ। তারা
হলে থাকার জন্য কোন ধরনের ফি দিতেন না। তিনটি হলই ছাত্রলীগ নেতাদের
নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে জানা যায়। আর ছাত্রলীগ নেতাদের ধরেই বিভিন্নজন
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বসবাস করতেন। শাবি’র তিনটি হল তথা বঙ্গবন্ধু হল,
শাহপরান হল ও সৈয়দ মুজতবা হলে আসন সংখ্যা হচ্ছে যথাক্রমে ৫০৮, ৪৪৭ ও ৬৪টি।
তন্মধ্যে বঙ্গবন্ধু হলের মাত্র ৫৮টি আসনে বৈধ ছাত্র ছিলেন। একই অবস্থা
শাহপরান হলেও। হলটিতে মাত্র ৭০ জন বৈধ ছাত্র থাকতেন। আর সৈয়দ মুজতবা হলে
সবগুলো আসনেই ছিলেন অবৈধরা। তবে এ অবস্থা আগেও ছিল। যখন বিএনপি নেতৃত্বাধীন
চারদলীয় জোট ক্ষমতায় ছিল, তখন শাবি’র হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ করতো
ছাত্রদল-ছাত্রশিবির। তারও আগে, আওয়ামী লীগ শাসনামলে ছিল ছাত্রলীগের দাপট।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, হলে বহিরাগত থাকার সত্যতা প্রশাসনের হাতে
রয়েছে। বহিরাগতদের কারণে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা বসবাস করতেন বাইরে। এবার থেকে
এ বিষয়টি মনিটরিং করা হবে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। তিনি
সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ছাত্রদের জন্যই বরাদ্দ থাকবে হল। অন্য কারও জন্য
নয়। গতকাল থেকে খুলেছে শাবি। শাবি খুলে দিলেও ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধি
করা হয়েছে। এ অবস্থার সমালোচনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোর
নেতারা। শাবি ছাত্রলীগ সহসভাপতি অঞ্জন রায়, শাবি ছাত্রদলের আহ্বায়ক এস এম
জাহাঙ্গীর, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট শাবি শাখার সভাপতি অনিক ধর, ছাত্র
ইউনিয়নের শাবি সভাপতি শ্রীকান্ত শর্মা প্রমুখ নেতারা প্রশাসনের এ ধরনের
সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক বলে জানিয়েছেন। তারা জানান, ছাত্রলীগের ওই
সংঘর্ষের ঘটনায় এক কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনার প্রতিশোধ নিতে আবারও বিশৃঙ্খল
হয়ে উঠতে পারে শাবি।
No comments