গণকর্মচারীর স্বেচ্ছা-অবসর এবং বাধ্যতামূলক অবসরের প্রয়োগ ও অপ্রয়োগ by মোঃ ফিরোজ মিয়া
আইনের বিধান অনুসরণে কোনো কর্মচারীকে
চাকরি থেকে অবসর দেয়া বা কোনো কর্মচারী কর্তৃক নিজে অবসর নেয়া দোষের কিছু
নয়। কিন্তু যখনই দেখা যায় এই অবসর দেয়া ও নেয়ার ক্ষেত্রে আইনের বিধানকে
যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না বা আইনের অপপ্রয়োগ হয়, তখনই এসব অবসর নিয়ে
জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয় এবং তা বিভ্রান্তি ও বিতর্কের সৃষ্টি করে। এছাড়া
শৃংখলা ও আপিল বিধিতে দণ্ড হিসেবে কোনো কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার
উল্লেখ থাকলেও অবসর আইনে বাধ্যতামূলক অবসরের কোনো উল্লেখ না থাকা সত্ত্বেও এ
আইনের অধীনে সরকার কোনো কর্মচারীকে অবসর প্রদান করলে তাকে বাধ্যতামূলক
অবসর বলা হয় কেন, এ বিষয়টিও সবার কাছে স্পষ্ট নয়।
গণকর্মচারী অবসর আইনের বিধানমতে, মোট চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যে কোনো সময় যে কোনো কর্মচারী চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করতে পারেন। এ ধরনের অবসরকে স্বেচ্ছা-অবসর বলে। স্বেচ্ছা-অবসরের অন্যতম শর্ত হল অভিপ্রায়কৃত অবসরের দিনটির কমপক্ষে ত্রিশদিন আগে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বরাবরে সরাসরি অবসর গ্রহণের বা অবসর-উত্তর ছুটিতে যাওয়ার তারিখ উল্লেখ করে নোটিশ প্রদান এবং নোটিশে ছুটির মেয়াদ উল্লেখ করাসহ ছুটির প্রাপ্যতার সনদ সংযুক্ত করা। আইনের বিধান অনুসরণ করে ৩০ দিনের নোটিশ প্রদানপূর্বক স্বেচ্ছা-অবসরের আবেদন করা হলে কর্মচারীর স্বেচ্ছা-অবসরের প্রতিবন্ধকতাবিহীন অধিকার সৃষ্টি হয়, যা কর্মচারী প্রত্যাহার করতে পারেন না, এমনকি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষও তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। কিন্তু আইনের বিধান অনুসরণ না করে অর্থাৎ আইনের বিধানমতে ৩০ দিনের নোটিশ না দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে স্বেচ্ছা-অবসরের আবেদন করা হলে তা স্বেচ্ছা-অবসরের নোটিশ হিসেবে গণ্য করে অবসরের আদেশ জারি আইনের বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়া আইনের বিধান অনুসরণ না করে তাৎক্ষণিকভাবে অবসরের আবেদন করা আচরণবিধির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। স্বেচ্ছা-অবসরের আবেদনে অবসর-উত্তর ছুটি ভোগের ইচ্ছা ব্যক্ত না করা হলে অবসর-উত্তর ছুটি মঞ্জুরেরও আইনগত কোনো সুযোগ থাকে না। উল্লেখ্য, কোনো কর্মচারী ছুটিতে থাকা অবস্থায়ও স্বেচ্ছা-অবসরের নোটিশ প্রদান করতে পারেন। এমনকি কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান অবস্থায়ও স্বেচ্ছা-অবসরের নোটিশ প্রদান করা যায়। তবে এক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বেচ্ছা-অবসরের আবেদনের ওপর কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যায় না। মামলা নিষ্পত্তির পর মামলার ফলাফলের ভিত্তিতে আবেদনটি নিষ্পত্তিযোগ্য হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে স্বেচ্ছা-অবসরের আবেদনে যে তারিখ হতে অবসর গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়, ওই তারিখ হতে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে না। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, আইনের বিধান অনুসারে ৩০ দিনের নোটিশ প্রদান না করা সত্ত্বেও তাৎক্ষণিক আবেদনের ভিত্তিতে স্বেচ্ছা-অবসরের আদেশ জারি করা হয়, যা আইন সমর্থন করে না।
গণকর্মচারী অবসর আইনের বিধানমতে মোট চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সরকার যে কোনো সময়, জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে, কোনোরূপ কারণ দর্শানো ব্যতীত যে কোনো গণকর্মচারীকে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করতে পারে। তবে এ ক্ষমতা সরকার ছাড়া অন্য কোনো অধঃস্তন নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ প্রয়োগ করতে পারে না। যে ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সরকার ব্যতীত অধঃস্তন কোনো কর্তৃপক্ষ অথবা বিধিবদ্ধ সংস্থা বা এর কোনো কর্মকর্তা, সেক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা যদি মনে করে যে, তদকর্তৃক নিযুক্ত কোনো গণকর্মচারীর আইনের বিধানমতে ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর তাকে জনস্বার্থে অবসরগ্রহণ করানো উচিত, তাহলে ওই কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এতদসংক্রান্ত প্রস্তাব প্রেরণ করবে এবং এরূপ প্রস্তাব পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্মচারীদের অবসরগ্রহণ সংক্রান্ত প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে তার সদয় আদেশের জন্য পেশ করবে। এরূপ বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান শৃংখলা ও আপিলবিধির আওতাধীন শাস্তিমূলক বাধ্যতামূলক অবসর না হওয়ায় বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী অবসর-উত্তর ছুটি এবং ছুটি নগদায়নসহ সব ধরনের অবসর সুবিধাদি পাবেন।
সরকার কর্তৃক এরূপ অবসর প্রদান প্রকৃতপক্ষে জনস্বার্থে অবসর প্রদান। অবসর আইনে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের উল্লেখ না থাকলেও একে বাধ্যতামূলক অবসর বলা হয়। কারণ উচ্চতর আদালতের অনেক রায়ে সরকার কর্তৃক জনস্বার্থে এরূপ অবসর প্রদানকে বাধ্যতামূলক অবসর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
একজন গণকর্মচারীর স্বাভাবিকভাবে অবসর গ্রহণের বয়সে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত চাকরি করার অধিকার থাকলেও অবসর আইনের অধীনে একজন গণকর্মচারীকে সরকার কোনোরূপ কারণ দর্শানোর সুযোগ প্রদান না করে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করতে পারে। উচ্চতর আদালতের কোনো কোনো রায়ে সরকার কর্তৃক বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানকে সংবিধানের কতিপয় অনুচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় মর্মে উল্লেখ করা হলেও আইনের এ বিধানকে বাতিল হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে উচ্চতর আদালতের প্রায় সব রায়েই জনস্বার্থের বিষয়টির ওপর অধিক গুরুত্বারূপ করা হয়েছে। ডক্টর নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলার রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, অবসর আইনের অধীনে সরকারকে অবসর দানের প্রতিবন্ধকতাবিহীন অধিকার দেয়া হলেও আইনে বা বিধিতে অবসর দানের কোনোরূপ নির্দেশাবলী বর্ণিত নেই। আইনে বা এর অধীনে প্রণীত বিধিতে কোনোরূপ নির্দেশনাবলী ছাড়া সরকারকে বাধ্যতামূলক অবসর দানের প্রতিবন্ধকতাবিহীন অধিকার দেয়া সংবিধানের সমতার নীতির লংঘন। এছাড়া প্রয়োগের নির্দেশনাবলী ছাড়া আইনে প্রতিবন্ধকতাবিহীন স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রদান বৈষম্যমূলক এবং এইরূপ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সমতা নীতির নিশ্চয়তার প্রতিকার পাওয়ার অধিকারী। এ সম্পর্কে ডক্টর আবু আহমেদ চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলার রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার অবসর দানের প্রয়োজনীয়তা এবং জনস্বার্থ বিবেচনা করলেও চাকরির ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে এমন সমপর্যায়ের সব কর্মকর্তার মধ্য থেকে এককভাবে কোনো একজনকে বাধ্যতামূলক অবসরদান বৈষম্যমূলক।
চাকরির ২৫ বছর পূর্তির পর যে কোনো সময় সরকার কর্তৃক কোনোরূপ কারণ দর্শানো ছাড়া বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের প্রধান ও অন্যতম শর্ত হল জনস্বার্থ এবং এই জনস্বার্থের বিষয়টি নির্ধারণের সম্পূর্ণ ক্ষমতা সরকারের বিধায় জনস্বার্থ প্রমাণের দায়িত্বও সরকারের। একজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে চাকরিবিধি লংঘনের বা আচরণবিধির পরিপন্থী কোনো কাজের অভিযোগ পাওয়া গেলে তার জন্য বিভাগীয় মামলা রুজু করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যায়। বিভাগীয় মামলায় কর্মচারীকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অনুসরণে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয় এবং কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু অবসর আইনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত বা জনশ্রুত অভিযোগের যথার্থতা বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় বিধায় আচরণবিধির পরিপন্থী কোনো অভিযোগের কারণে অবসর আইনের অধীনে অবসর দেয়া যায় না।
কিন্তু প্রায়ই কোনো গণকর্মচারীর বিরুদ্ধে আচরণবিধির পরিপন্থী কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে চাকরিবিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা গ্রহণ না করে অবসর আইনের অধীনে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের প্রবণতা দেখা যায়। যার কারণে জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয়। এছাড়া এসব মামলায় জনস্বার্থ প্রমাণ করা যায় না বিধায় আদালতে এরূপ অবসর প্রদানের আদেশ বাতিল বা রহিত হয়। অতীতে প্রদত্ত অধিকাংশ বাধ্যতামূলক অবসর আদেশই আদালতের আদেশে বাতিল বা রহিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা চাকরিতে ফিরে এসেছেন এবং অনেকে পরবর্তী পর্যায়ে উচ্চতর এক বা একাধিক পদে পদোন্নতি লাভ করেছেন। সেই সঙ্গে আর্থিক সুবিধাদিও পেয়েছেন।
চাকরিবিধি লংঘন বা আচরণবিধির পরিপন্থী কার্যকলাপের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারী আইনের বিধান অনুযায়ী যথাযথ পদ্ধতিতে দণ্ড ভোগ করুক এটা সবারই কাম্য এবং এতে করে চাকরির শৃংখলাও বজায় থাকে। কিন্তু আইনের অপপ্রয়োগ চাকরির শৃংখলা বিনষ্ট করে। যার জন্য অবসর আইনের বিধানসহ বিদ্যমান চাকরি সংক্রান্ত সব আইনের বিধান যথাযথ প্রয়োগ হোক এটাই সবার কাম্য।
মোঃ ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রন্থের লেখক
গণকর্মচারী অবসর আইনের বিধানমতে, মোট চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর যে কোনো সময় যে কোনো কর্মচারী চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করতে পারেন। এ ধরনের অবসরকে স্বেচ্ছা-অবসর বলে। স্বেচ্ছা-অবসরের অন্যতম শর্ত হল অভিপ্রায়কৃত অবসরের দিনটির কমপক্ষে ত্রিশদিন আগে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বরাবরে সরাসরি অবসর গ্রহণের বা অবসর-উত্তর ছুটিতে যাওয়ার তারিখ উল্লেখ করে নোটিশ প্রদান এবং নোটিশে ছুটির মেয়াদ উল্লেখ করাসহ ছুটির প্রাপ্যতার সনদ সংযুক্ত করা। আইনের বিধান অনুসরণ করে ৩০ দিনের নোটিশ প্রদানপূর্বক স্বেচ্ছা-অবসরের আবেদন করা হলে কর্মচারীর স্বেচ্ছা-অবসরের প্রতিবন্ধকতাবিহীন অধিকার সৃষ্টি হয়, যা কর্মচারী প্রত্যাহার করতে পারেন না, এমনকি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষও তা প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। কিন্তু আইনের বিধান অনুসরণ না করে অর্থাৎ আইনের বিধানমতে ৩০ দিনের নোটিশ না দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে স্বেচ্ছা-অবসরের আবেদন করা হলে তা স্বেচ্ছা-অবসরের নোটিশ হিসেবে গণ্য করে অবসরের আদেশ জারি আইনের বিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়া আইনের বিধান অনুসরণ না করে তাৎক্ষণিকভাবে অবসরের আবেদন করা আচরণবিধির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। স্বেচ্ছা-অবসরের আবেদনে অবসর-উত্তর ছুটি ভোগের ইচ্ছা ব্যক্ত না করা হলে অবসর-উত্তর ছুটি মঞ্জুরেরও আইনগত কোনো সুযোগ থাকে না। উল্লেখ্য, কোনো কর্মচারী ছুটিতে থাকা অবস্থায়ও স্বেচ্ছা-অবসরের নোটিশ প্রদান করতে পারেন। এমনকি কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলমান অবস্থায়ও স্বেচ্ছা-অবসরের নোটিশ প্রদান করা যায়। তবে এক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বেচ্ছা-অবসরের আবেদনের ওপর কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা যায় না। মামলা নিষ্পত্তির পর মামলার ফলাফলের ভিত্তিতে আবেদনটি নিষ্পত্তিযোগ্য হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে স্বেচ্ছা-অবসরের আবেদনে যে তারিখ হতে অবসর গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করা হয়, ওই তারিখ হতে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারে না। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, আইনের বিধান অনুসারে ৩০ দিনের নোটিশ প্রদান না করা সত্ত্বেও তাৎক্ষণিক আবেদনের ভিত্তিতে স্বেচ্ছা-অবসরের আদেশ জারি করা হয়, যা আইন সমর্থন করে না।
গণকর্মচারী অবসর আইনের বিধানমতে মোট চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর সরকার যে কোনো সময়, জনস্বার্থে প্রয়োজন মনে করলে, কোনোরূপ কারণ দর্শানো ব্যতীত যে কোনো গণকর্মচারীকে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করতে পারে। তবে এ ক্ষমতা সরকার ছাড়া অন্য কোনো অধঃস্তন নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ প্রয়োগ করতে পারে না। যে ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সরকার ব্যতীত অধঃস্তন কোনো কর্তৃপক্ষ অথবা বিধিবদ্ধ সংস্থা বা এর কোনো কর্মকর্তা, সেক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা যদি মনে করে যে, তদকর্তৃক নিযুক্ত কোনো গণকর্মচারীর আইনের বিধানমতে ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর তাকে জনস্বার্থে অবসরগ্রহণ করানো উচিত, তাহলে ওই কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এতদসংক্রান্ত প্রস্তাব প্রেরণ করবে এবং এরূপ প্রস্তাব পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কর্মচারীদের অবসরগ্রহণ সংক্রান্ত প্রস্তাব জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে তার সদয় আদেশের জন্য পেশ করবে। এরূপ বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান শৃংখলা ও আপিলবিধির আওতাধীন শাস্তিমূলক বাধ্যতামূলক অবসর না হওয়ায় বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী অবসর-উত্তর ছুটি এবং ছুটি নগদায়নসহ সব ধরনের অবসর সুবিধাদি পাবেন।
সরকার কর্তৃক এরূপ অবসর প্রদান প্রকৃতপক্ষে জনস্বার্থে অবসর প্রদান। অবসর আইনে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের উল্লেখ না থাকলেও একে বাধ্যতামূলক অবসর বলা হয়। কারণ উচ্চতর আদালতের অনেক রায়ে সরকার কর্তৃক জনস্বার্থে এরূপ অবসর প্রদানকে বাধ্যতামূলক অবসর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
একজন গণকর্মচারীর স্বাভাবিকভাবে অবসর গ্রহণের বয়সে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত চাকরি করার অধিকার থাকলেও অবসর আইনের অধীনে একজন গণকর্মচারীকে সরকার কোনোরূপ কারণ দর্শানোর সুযোগ প্রদান না করে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করতে পারে। উচ্চতর আদালতের কোনো কোনো রায়ে সরকার কর্তৃক বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানকে সংবিধানের কতিপয় অনুচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় মর্মে উল্লেখ করা হলেও আইনের এ বিধানকে বাতিল হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে উচ্চতর আদালতের প্রায় সব রায়েই জনস্বার্থের বিষয়টির ওপর অধিক গুরুত্বারূপ করা হয়েছে। ডক্টর নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলার রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, অবসর আইনের অধীনে সরকারকে অবসর দানের প্রতিবন্ধকতাবিহীন অধিকার দেয়া হলেও আইনে বা বিধিতে অবসর দানের কোনোরূপ নির্দেশাবলী বর্ণিত নেই। আইনে বা এর অধীনে প্রণীত বিধিতে কোনোরূপ নির্দেশনাবলী ছাড়া সরকারকে বাধ্যতামূলক অবসর দানের প্রতিবন্ধকতাবিহীন অধিকার দেয়া সংবিধানের সমতার নীতির লংঘন। এছাড়া প্রয়োগের নির্দেশনাবলী ছাড়া আইনে প্রতিবন্ধকতাবিহীন স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রদান বৈষম্যমূলক এবং এইরূপ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সমতা নীতির নিশ্চয়তার প্রতিকার পাওয়ার অধিকারী। এ সম্পর্কে ডক্টর আবু আহমেদ চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ সরকার মামলার রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার অবসর দানের প্রয়োজনীয়তা এবং জনস্বার্থ বিবেচনা করলেও চাকরির ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে এমন সমপর্যায়ের সব কর্মকর্তার মধ্য থেকে এককভাবে কোনো একজনকে বাধ্যতামূলক অবসরদান বৈষম্যমূলক।
চাকরির ২৫ বছর পূর্তির পর যে কোনো সময় সরকার কর্তৃক কোনোরূপ কারণ দর্শানো ছাড়া বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের প্রধান ও অন্যতম শর্ত হল জনস্বার্থ এবং এই জনস্বার্থের বিষয়টি নির্ধারণের সম্পূর্ণ ক্ষমতা সরকারের বিধায় জনস্বার্থ প্রমাণের দায়িত্বও সরকারের। একজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে চাকরিবিধি লংঘনের বা আচরণবিধির পরিপন্থী কোনো কাজের অভিযোগ পাওয়া গেলে তার জন্য বিভাগীয় মামলা রুজু করে অভিযোগ প্রমাণিত হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা যায়। বিভাগীয় মামলায় কর্মচারীকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার অনুসরণে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয় এবং কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু অবসর আইনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত বা জনশ্রুত অভিযোগের যথার্থতা বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় বিধায় আচরণবিধির পরিপন্থী কোনো অভিযোগের কারণে অবসর আইনের অধীনে অবসর দেয়া যায় না।
কিন্তু প্রায়ই কোনো গণকর্মচারীর বিরুদ্ধে আচরণবিধির পরিপন্থী কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে চাকরিবিধি অনুযায়ী বিভাগীয় মামলা গ্রহণ না করে অবসর আইনের অধীনে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের প্রবণতা দেখা যায়। যার কারণে জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয়। এছাড়া এসব মামলায় জনস্বার্থ প্রমাণ করা যায় না বিধায় আদালতে এরূপ অবসর প্রদানের আদেশ বাতিল বা রহিত হয়। অতীতে প্রদত্ত অধিকাংশ বাধ্যতামূলক অবসর আদেশই আদালতের আদেশে বাতিল বা রহিত হওয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা চাকরিতে ফিরে এসেছেন এবং অনেকে পরবর্তী পর্যায়ে উচ্চতর এক বা একাধিক পদে পদোন্নতি লাভ করেছেন। সেই সঙ্গে আর্থিক সুবিধাদিও পেয়েছেন।
চাকরিবিধি লংঘন বা আচরণবিধির পরিপন্থী কার্যকলাপের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারী আইনের বিধান অনুযায়ী যথাযথ পদ্ধতিতে দণ্ড ভোগ করুক এটা সবারই কাম্য এবং এতে করে চাকরির শৃংখলাও বজায় থাকে। কিন্তু আইনের অপপ্রয়োগ চাকরির শৃংখলা বিনষ্ট করে। যার জন্য অবসর আইনের বিধানসহ বিদ্যমান চাকরি সংক্রান্ত সব আইনের বিধান যথাযথ প্রয়োগ হোক এটাই সবার কাম্য।
মোঃ ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রন্থের লেখক
No comments