জয় বাংলা ধ্বনি দিয়েই নিভে গেল বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবন প্রদীপ by এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান
একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেকের তাড়নায় ও
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দায়বদ্ধতা থেকে একজন শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনের
শেষ স্মৃতিগুলো দেশবাসী, সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারকে জানানোটা
নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। এই শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম মজিবর রহমান
মুন্সি, পিতা- মরহুম আঃ খালেক মুন্সি, গ্রাম- কাগ্দী, থানা- কাশিয়ানী,
জেলা- গোপালগঞ্জ (ফরিদপুর)। সহযোদ্ধা শহীদ মজিবর রহমান মুন্সির সঙ্গে আমার
প্রথম পরিচয় হয় ভারতের পশ্চিম বাংলার কল্যাণী রেস্ট ক্যাম্পে। মজিবরের
উচ্চতর প্রশিক্ষণ হয় চাকুলিয়াতে আর আমার বীরভূমে। কল্যাণী থেকে আমরা একই
কোম্পানি ও একই প্লাটুনে অন্তর্ভুক্ত হই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে
তাদের ছাউনিতে আমরা বাগদা ভারতীয় সীমানায় (যশোরের বর্ডারে) ক্যাম্প স্থাপন
করি। তখন মজিবর আমার পাশের সিটে থাকতেন।
মজিবর ছিল সদা হাস্যোজ্জ্বল, সদালাপী ও বন্ধুবৎসল। বয়সে আমার চেয়ে প্রায় ২ বছরের বড় হলেও শরীরের গঠনে ও আকৃতিতে একটু ছোট ছিল। বয়স ও গ্রামের বাড়ি কাছাকাছি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী হিসেবে একসঙ্গে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করার কারণে আমার সঙ্গে মজিবরের এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যে কোনো অপারেশন কিংবা রণপাহারায় আমি না গেলে সে যেত না, তেমনি সে না গেলে আমিও কোনো অজুহাতে ঝরপশ জবঢ়ড়ৎঃ করতাম। একদিন সন্ধ্যার পর আমরা পাকিস্তানি আর্মির অ্যাম্বুশে পড়লে সম্মুখযুদ্ধ চলাকালে আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) কোনো রকম সিগন্যাল/বার্তা না দিয়েই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের ফেলে তাদের ক্যাম্পে চলে যায়। ওই যুদ্ধে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ভাগ্যক্রমে আমরা বেঁচে যাই।
প্রায় প্রতিটি অপারেশনেই আমাদের সামনে রাখা হতো, তাতে পাক আর্মি ও ভারতীয় আর্মি উভয় পক্ষের গুলিতে আমাদের জীবননাশের আশংকা ছিল। ২৬ দিন আমাদের এক কোম্পানি (মুক্তিযোদ্ধা) ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে অঙ্গীভূত করে রাখা হয়। একদিন ভারতীয় কর্নেলসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন অফিসার ও জয় বাংলার মেজর জলিল আমাদের সীমান্তবর্তী ক্যাম্পে দেখতে এলে শহীদ মজিবর এবং আমি একযোগে আমাদের দেশে গিয়ে যুদ্ধ করার অনুমতি প্রার্থনা করি। ফলে আমরা ওইদিনই দেশে আসার অনুমতি পাই। আমাদের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন মেজর হুদা এবং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন আমিনুর রহমান তালুকদার। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী হিসেবে কর্মকালীন আমরা বিনামূল্যে ২ প্যাকেট চার্মিনার সিগারেট পেতাম। ধূমপায়ী সহযোদ্ধারা আমাদের সিগারেট নিয়ে নিত। একদিন দেখলাম শহীদ মজিবর বেশ কিছু সিগারেট জমিয়ে রেখেছে। কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলল, দেশ স্বাধীন হলে মুক্ত বাতাসে এই সিগারেট ফুঁকব। নরঘাতক বর্বর পাক হায়েনার দল তাকে মুক্ত স্বাধীন দেশের নতুন সূর্যোদয় দেখার সুযোগ দিল না।
বাগদা বর্ডারস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছাউনি থেকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামে অস্ত্র, গুলি, এক্সপ্লোসিভ, গ্রেনেড ইস্যু করে ২ মাসের খরচের টাকাসহ প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দিয়ে দুজন গাইডসহ বিদায় দিলে অপরাহ্নে আমরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই যশোর জেলার ভেতর দিয়ে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার উদ্দেশে হেঁটে রওনা হই। দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরার এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করলেও বুকের ভেতর এক অজানা শংকা কাজ করে। দেশের অভ্যন্তরে মা-বাবা, ভাই-বোন বেঁচে আছে কিনা; ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে কিনা; গিয়ে কী দেখব তা আল্লাহই জানেন। হাঁটতে হাঁটতে মজিবর অদম্য সাহসে আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, তুই চিন্তা করিস না, ওরা আমাদের একজন মানুষ হত্যা করলে আমরা ১০০ জন পাক আর্মিকে গুলি করে মারব। এখন আমাদের ট্রেনিং আছে, অস্ত্র আছে, ভয় কিসের!
প্রায় ১৫ বছর বয়সে রাইফেলসহ এত ভারী সরঞ্জাম নিয়ে হেঁটে সাত-সাগর তেরো নদী পাড়ি দেয়ার মতো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে আসতে পেরে নিজেদের পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান বলে মনে হয়েছিল। আমাদের কমান্ডার আমিনুর রহমান তালুকদারের পরামর্শে ও কোম্পানি কমান্ডার মেজর হুদার নির্দেশে কাশিয়ানী থানার রাতইল গ্রামে মধুমতি নদীর পাড়ে ব্রিটিশ আমলের ডিএসপি সাবান মিয়ার বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করি। রাতইল গ্রাম থেকে পাক আর্মির ঐতিহাসিক ঘাঁটি ভাটিয়াপাড়ার দূরত্ব প্রায় ৩ মাইল। আমরা ঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে বিশ্রাম নিতাম। এখানেও মজিবরের বিছানা ছিল আমারই পাশে। রাতইল গ্রাম, রাতইল স্কুল, চাপ্তা স্কুল ও চাপ্তা গ্রামের অনেক বাড়িতেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্প স্থাপন করে ভাটিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের কাশিয়ানী থানা কমান্ডার মরহুম জগলুল কাদির সব দলের সদস্যদের ডিউটি বণ্টন করতেন। আমাদের গ্রামের কাওছার কাজী, ইদ্রিস মোল্লা ও আমাকে এক শিফটে এবং এক জায়গায় ডিউটি দেয়ার জন্য শহীদ মজিবর রহমান থানা কমান্ডারকে অনুরোধ করে। কারণ আমরা শপথ নিয়েছিলাম, যে কেউ মারা গেলে যত ঝুঁকিই থাকুক না কেন, লাশ যেন ফেলে না আসি। পাক আর্মিরা যেন আমাদের মৃত লাশ লাঞ্ছিত না করতে পারে, আর আমাদের কবরের চিহ্ন যেন থাকে।
সকাল-সন্ধ্যা ও সন্ধ্যা-সকাল এই দুই শিফটে আমরা ডিউটি করতাম। সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের নির্দেশে কাশিয়ানী, মুকসুদপুর, লোহাগড়া (নড়াইল), আলফাডাঙ্গা ও বোয়ালমারীর প্রায় সব মুক্তিফৌজ ও মুজিব বাহিনী একযোগে ভাটিয়াপাড়ার চতুর্দিকে অবস্থান নেয়। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ভাটিয়াপাড়ার পাক আর্মি, রাজাকার ও আলবদররা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাক আর্মির সব ধরনের মুভমেন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। ইতিমধ্যে যশোর ক্যান্টনমেন্ট মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলে ভাটিয়াপাড়ার পাক আর্মিদের মনোবল ভেঙে পড়ে। পাক আর্মিরা পাকা বাংকার থেকেই হালকা ও ভারী অস্ত্রের গুলিবর্ষণ করত। মাঝে মাঝে আমরা দেখতাম চারদিক থেকে হাজার হাজার গুলি ছুড়লেও পাক আর্মিরা গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার আশংকায় গুলিবর্ষণ থেকে বিরত থাকত।
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমাদের সকাল-সন্ধ্যা ডিউটি পড়ল ভাটিয়াপাড়া রেলস্টেশনের পূর্বদিকে। আমিন গ্রুপের আমি, শহীদ মজিবর, কাওছার, ইদ্রিস, মোদাচ্ছের, আবুলসহ আরও কয়েকজন (নাম মনে নেই) রেললাইন ঘেঁষে পজিশন নিলাম। উল্লেখ্য, রেললাইনের পর খাল এবং খালের পরই পাক আর্মিদের পাকা বাংকারসহ শক্তিশালী ঘাঁটি। আমাদের থেকে তাদের দূরত্ব খুবই কাছে হলেও রেললাইনটা আড় হিসেবে ব্যবহার করতাম। ওইদিন আমরা শত শত গুলি ছুড়লেও পাক হায়েনাদের দল সারাদিন একটি গুলিও ছুড়েনি। ওদের বাংকারে মেশিনগান HMG/MMG/LMG দেখা যায়, কিন্তু গুলি না করে কাওয়ালী গান গায়। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত আমরা, পড়ন্ত বিকাল বেলায় ভাবছি, একটু পরে আমাদের রিলিভার (অন্যদল) এলে ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে পেটপুরে খেয়ে গানের আসর বসাব। মজিবর বলছিল, আমাদের আজকের ডিউটি শেষ হতে চলল, একটা পাক আর্মি না মেরে ক্যাম্পে ফিরে যাব না। বাংকারের ছিদ্র পথে দেখতে পাওয়া পাক আর্মিদের গুলি করার উদ্দেশে হঠাৎ দেখলাম শহীদ মজিবর আমার পাশ থেকে রেললাইনে উঠে বসে বলল, শালাদের গুলি শেষ হয়ে গেছে। বলেই সে গুলি করার উদ্যোগ নিতেই একটা বুলেটে তার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে গেল। মজিবর গগনবিদারী জয় বাংলা ধ্বনিতে চিৎকার দিয়ে রেললাইনের ওপর লাফ দিয়ে পড়ে গেল। ফিনকি দিয়ে লাল রক্ত বের হতে লাগল। তখন পাক আর্মিরা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে লাগল। আমাদের সহযোদ্ধারা অনেকেই বুঝতে না পেরে পালাতে শুরু করল। মজিবরকে টেনে নিচে নামালাম, রাইফেলটা নিলাম। তখন তার গলার স্বর নিচু হয়ে গেছে, আস্তে আস্তে বলল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। বিড় বিড় করে তার মায়ের কথা, বাবার কথা, কবরের কথা কী যেন বলছিল, বোঝা যাচ্ছিল না। আমরা চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলার কারণে তার শেষ ইচ্ছা বা কথাগুলো ভালো করে শুনতে পারলাম না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নিভে গেল সম্ভাবনাময় সদাহাস্য দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মুন্সির জীবন প্রদীপ। বীর শহীদদের তালিকায় আরেকটি নাম অন্তর্ভুক্ত হল।
রাতেই মজিবরের লাশ কাঁধে করে আমরা সহযোদ্ধারা রেললাইন ধরে ৭/৮ কিমি. পায়ে হেঁটে কাগ্দি গ্রামে তার বাড়িতে পৌঁছলাম। অকস্মাৎ মজিবরের লাশ দেখে তার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের চিৎকার কান্নায় রাতের আঁধারে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। রাতেই বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে রেললাইন ঘেঁষে মজিবরকে সমাহিত করা হল। তার মা শুকুরন নেছার আহাজারি আজও আমার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে। মা শুকুরন নেছা ২০১২ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন। বাবা আবদুল খালেক মুন্সি ১৯৮৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বড় ভাই আজিজুর রহমান মুন্সিও আর বেঁচে নেই। ভাই তৈয়বুর রহমান মুন্সী কৃষি কাজ করে এবং অপর ভাই হাবিবুর রহমান (অব. সেনা সদস্য) ঢাকায় শ্যামলীতে কোনো এক প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। মজিবরের বড় বোন সালেহা বেগম বিধবা হয়ে বেঁচে আছেন। ছোট বোন হাসিনা বেগম পার্শ্ববর্তী ব্যাসপুর গ্রামে স্বামীর বাড়িতে বসবাস করছেন।
এখানে একটি কথা না বললে সত্য গোপন করা হবে। আমাদের দলের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবাই হয় ছুটি নিয়ে না হয় ডিউটির ফাঁকে রাতের অন্ধকারে বাড়িতে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। একমাত্র মজিবরই মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেনি। সে বলত, দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়ে জয় বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে বীরের বেশে একবারে বাড়িতে যাব। বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মুন্সির সেই অদম্য ইচ্ছা আর পূরণ হল না।
আজ স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মুন্সির নাম। নতুন প্রজন্মের কেউ তাকে চেনে না আর জানার কৌতূহলও নেই কারও। যাদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ, তাদের অসম্মান করলে জাতির গৌরবের পরিবর্তে দীনতা প্রকাশ পায়। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। দেরিতে হলেও পদকপ্রাপ্ত জাতীয় বীরদের তালিকায় এই শহীদদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্রীয় খেতাবসহ মর্যাদা দেয়া উচিত বলে মনে করি।
এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বিপিএম, পিপিএম : মুক্তিযোদ্ধা; ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জ, বাংলাদেশ পুলিশ, ঢাকা
মজিবর ছিল সদা হাস্যোজ্জ্বল, সদালাপী ও বন্ধুবৎসল। বয়সে আমার চেয়ে প্রায় ২ বছরের বড় হলেও শরীরের গঠনে ও আকৃতিতে একটু ছোট ছিল। বয়স ও গ্রামের বাড়ি কাছাকাছি এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী হিসেবে একসঙ্গে প্রায় প্রতিটি যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করার কারণে আমার সঙ্গে মজিবরের এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যে কোনো অপারেশন কিংবা রণপাহারায় আমি না গেলে সে যেত না, তেমনি সে না গেলে আমিও কোনো অজুহাতে ঝরপশ জবঢ়ড়ৎঃ করতাম। একদিন সন্ধ্যার পর আমরা পাকিস্তানি আর্মির অ্যাম্বুশে পড়লে সম্মুখযুদ্ধ চলাকালে আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) কোনো রকম সিগন্যাল/বার্তা না দিয়েই ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমাদের ফেলে তাদের ক্যাম্পে চলে যায়। ওই যুদ্ধে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই ভাগ্যক্রমে আমরা বেঁচে যাই।
প্রায় প্রতিটি অপারেশনেই আমাদের সামনে রাখা হতো, তাতে পাক আর্মি ও ভারতীয় আর্মি উভয় পক্ষের গুলিতে আমাদের জীবননাশের আশংকা ছিল। ২৬ দিন আমাদের এক কোম্পানি (মুক্তিযোদ্ধা) ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে অঙ্গীভূত করে রাখা হয়। একদিন ভারতীয় কর্নেলসহ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন অফিসার ও জয় বাংলার মেজর জলিল আমাদের সীমান্তবর্তী ক্যাম্পে দেখতে এলে শহীদ মজিবর এবং আমি একযোগে আমাদের দেশে গিয়ে যুদ্ধ করার অনুমতি প্রার্থনা করি। ফলে আমরা ওইদিনই দেশে আসার অনুমতি পাই। আমাদের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন মেজর হুদা এবং প্লাটুন কমান্ডার ছিলেন আমিনুর রহমান তালুকদার। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী হিসেবে কর্মকালীন আমরা বিনামূল্যে ২ প্যাকেট চার্মিনার সিগারেট পেতাম। ধূমপায়ী সহযোদ্ধারা আমাদের সিগারেট নিয়ে নিত। একদিন দেখলাম শহীদ মজিবর বেশ কিছু সিগারেট জমিয়ে রেখেছে। কারণ জিজ্ঞাসা করায় বলল, দেশ স্বাধীন হলে মুক্ত বাতাসে এই সিগারেট ফুঁকব। নরঘাতক বর্বর পাক হায়েনার দল তাকে মুক্ত স্বাধীন দেশের নতুন সূর্যোদয় দেখার সুযোগ দিল না।
বাগদা বর্ডারস্থিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছাউনি থেকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নামে অস্ত্র, গুলি, এক্সপ্লোসিভ, গ্রেনেড ইস্যু করে ২ মাসের খরচের টাকাসহ প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দিয়ে দুজন গাইডসহ বিদায় দিলে অপরাহ্নে আমরা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেই যশোর জেলার ভেতর দিয়ে তৎকালীন ফরিদপুর জেলার উদ্দেশে হেঁটে রওনা হই। দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরার এক অনাবিল আনন্দ অনুভব করলেও বুকের ভেতর এক অজানা শংকা কাজ করে। দেশের অভ্যন্তরে মা-বাবা, ভাই-বোন বেঁচে আছে কিনা; ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছে কিনা; গিয়ে কী দেখব তা আল্লাহই জানেন। হাঁটতে হাঁটতে মজিবর অদম্য সাহসে আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, তুই চিন্তা করিস না, ওরা আমাদের একজন মানুষ হত্যা করলে আমরা ১০০ জন পাক আর্মিকে গুলি করে মারব। এখন আমাদের ট্রেনিং আছে, অস্ত্র আছে, ভয় কিসের!
প্রায় ১৫ বছর বয়সে রাইফেলসহ এত ভারী সরঞ্জাম নিয়ে হেঁটে সাত-সাগর তেরো নদী পাড়ি দেয়ার মতো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে আসতে পেরে নিজেদের পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান বলে মনে হয়েছিল। আমাদের কমান্ডার আমিনুর রহমান তালুকদারের পরামর্শে ও কোম্পানি কমান্ডার মেজর হুদার নির্দেশে কাশিয়ানী থানার রাতইল গ্রামে মধুমতি নদীর পাড়ে ব্রিটিশ আমলের ডিএসপি সাবান মিয়ার বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করি। রাতইল গ্রাম থেকে পাক আর্মির ঐতিহাসিক ঘাঁটি ভাটিয়াপাড়ার দূরত্ব প্রায় ৩ মাইল। আমরা ঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে বিশ্রাম নিতাম। এখানেও মজিবরের বিছানা ছিল আমারই পাশে। রাতইল গ্রাম, রাতইল স্কুল, চাপ্তা স্কুল ও চাপ্তা গ্রামের অনেক বাড়িতেই মুক্তিযোদ্ধা ও মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্প স্থাপন করে ভাটিয়াপাড়াসহ বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের কাশিয়ানী থানা কমান্ডার মরহুম জগলুল কাদির সব দলের সদস্যদের ডিউটি বণ্টন করতেন। আমাদের গ্রামের কাওছার কাজী, ইদ্রিস মোল্লা ও আমাকে এক শিফটে এবং এক জায়গায় ডিউটি দেয়ার জন্য শহীদ মজিবর রহমান থানা কমান্ডারকে অনুরোধ করে। কারণ আমরা শপথ নিয়েছিলাম, যে কেউ মারা গেলে যত ঝুঁকিই থাকুক না কেন, লাশ যেন ফেলে না আসি। পাক আর্মিরা যেন আমাদের মৃত লাশ লাঞ্ছিত না করতে পারে, আর আমাদের কবরের চিহ্ন যেন থাকে।
সকাল-সন্ধ্যা ও সন্ধ্যা-সকাল এই দুই শিফটে আমরা ডিউটি করতাম। সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের নির্দেশে কাশিয়ানী, মুকসুদপুর, লোহাগড়া (নড়াইল), আলফাডাঙ্গা ও বোয়ালমারীর প্রায় সব মুক্তিফৌজ ও মুজিব বাহিনী একযোগে ভাটিয়াপাড়ার চতুর্দিকে অবস্থান নেয়। ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ভাটিয়াপাড়ার পাক আর্মি, রাজাকার ও আলবদররা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। পাক আর্মির সব ধরনের মুভমেন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়। ইতিমধ্যে যশোর ক্যান্টনমেন্ট মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এলে ভাটিয়াপাড়ার পাক আর্মিদের মনোবল ভেঙে পড়ে। পাক আর্মিরা পাকা বাংকার থেকেই হালকা ও ভারী অস্ত্রের গুলিবর্ষণ করত। মাঝে মাঝে আমরা দেখতাম চারদিক থেকে হাজার হাজার গুলি ছুড়লেও পাক আর্মিরা গুলি ফুরিয়ে যাওয়ার আশংকায় গুলিবর্ষণ থেকে বিরত থাকত।
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমাদের সকাল-সন্ধ্যা ডিউটি পড়ল ভাটিয়াপাড়া রেলস্টেশনের পূর্বদিকে। আমিন গ্রুপের আমি, শহীদ মজিবর, কাওছার, ইদ্রিস, মোদাচ্ছের, আবুলসহ আরও কয়েকজন (নাম মনে নেই) রেললাইন ঘেঁষে পজিশন নিলাম। উল্লেখ্য, রেললাইনের পর খাল এবং খালের পরই পাক আর্মিদের পাকা বাংকারসহ শক্তিশালী ঘাঁটি। আমাদের থেকে তাদের দূরত্ব খুবই কাছে হলেও রেললাইনটা আড় হিসেবে ব্যবহার করতাম। ওইদিন আমরা শত শত গুলি ছুড়লেও পাক হায়েনাদের দল সারাদিন একটি গুলিও ছুড়েনি। ওদের বাংকারে মেশিনগান HMG/MMG/LMG দেখা যায়, কিন্তু গুলি না করে কাওয়ালী গান গায়। প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত আমরা, পড়ন্ত বিকাল বেলায় ভাবছি, একটু পরে আমাদের রিলিভার (অন্যদল) এলে ক্যাম্পে ফিরে গিয়ে পেটপুরে খেয়ে গানের আসর বসাব। মজিবর বলছিল, আমাদের আজকের ডিউটি শেষ হতে চলল, একটা পাক আর্মি না মেরে ক্যাম্পে ফিরে যাব না। বাংকারের ছিদ্র পথে দেখতে পাওয়া পাক আর্মিদের গুলি করার উদ্দেশে হঠাৎ দেখলাম শহীদ মজিবর আমার পাশ থেকে রেললাইনে উঠে বসে বলল, শালাদের গুলি শেষ হয়ে গেছে। বলেই সে গুলি করার উদ্যোগ নিতেই একটা বুলেটে তার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে গেল। মজিবর গগনবিদারী জয় বাংলা ধ্বনিতে চিৎকার দিয়ে রেললাইনের ওপর লাফ দিয়ে পড়ে গেল। ফিনকি দিয়ে লাল রক্ত বের হতে লাগল। তখন পাক আর্মিরা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে লাগল। আমাদের সহযোদ্ধারা অনেকেই বুঝতে না পেরে পালাতে শুরু করল। মজিবরকে টেনে নিচে নামালাম, রাইফেলটা নিলাম। তখন তার গলার স্বর নিচু হয়ে গেছে, আস্তে আস্তে বলল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। বিড় বিড় করে তার মায়ের কথা, বাবার কথা, কবরের কথা কী যেন বলছিল, বোঝা যাচ্ছিল না। আমরা চিকিৎসার ব্যাপারে কথা বলার কারণে তার শেষ ইচ্ছা বা কথাগুলো ভালো করে শুনতে পারলাম না। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই নিভে গেল সম্ভাবনাময় সদাহাস্য দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মুন্সির জীবন প্রদীপ। বীর শহীদদের তালিকায় আরেকটি নাম অন্তর্ভুক্ত হল।
রাতেই মজিবরের লাশ কাঁধে করে আমরা সহযোদ্ধারা রেললাইন ধরে ৭/৮ কিমি. পায়ে হেঁটে কাগ্দি গ্রামে তার বাড়িতে পৌঁছলাম। অকস্মাৎ মজিবরের লাশ দেখে তার মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজনের চিৎকার কান্নায় রাতের আঁধারে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। রাতেই বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে রেললাইন ঘেঁষে মজিবরকে সমাহিত করা হল। তার মা শুকুরন নেছার আহাজারি আজও আমার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে। মা শুকুরন নেছা ২০১২ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন। বাবা আবদুল খালেক মুন্সি ১৯৮৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। বড় ভাই আজিজুর রহমান মুন্সিও আর বেঁচে নেই। ভাই তৈয়বুর রহমান মুন্সী কৃষি কাজ করে এবং অপর ভাই হাবিবুর রহমান (অব. সেনা সদস্য) ঢাকায় শ্যামলীতে কোনো এক প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে। মজিবরের বড় বোন সালেহা বেগম বিধবা হয়ে বেঁচে আছেন। ছোট বোন হাসিনা বেগম পার্শ্ববর্তী ব্যাসপুর গ্রামে স্বামীর বাড়িতে বসবাস করছেন।
এখানে একটি কথা না বললে সত্য গোপন করা হবে। আমাদের দলের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় সবাই হয় ছুটি নিয়ে না হয় ডিউটির ফাঁকে রাতের অন্ধকারে বাড়িতে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। একমাত্র মজিবরই মা-বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেনি। সে বলত, দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন দেশের পতাকা নিয়ে জয় বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে বীরের বেশে একবারে বাড়িতে যাব। বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মুন্সির সেই অদম্য ইচ্ছা আর পূরণ হল না।
আজ স্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবর রহমান মুন্সির নাম। নতুন প্রজন্মের কেউ তাকে চেনে না আর জানার কৌতূহলও নেই কারও। যাদের রক্তে মুক্ত স্বদেশ, তাদের অসম্মান করলে জাতির গৌরবের পরিবর্তে দীনতা প্রকাশ পায়। আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। দেরিতে হলেও পদকপ্রাপ্ত জাতীয় বীরদের তালিকায় এই শহীদদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে রাষ্ট্রীয় খেতাবসহ মর্যাদা দেয়া উচিত বলে মনে করি।
এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বিপিএম, পিপিএম : মুক্তিযোদ্ধা; ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জ, বাংলাদেশ পুলিশ, ঢাকা
No comments