জাফলংয়ে ইউএনও’র গাড়িতে হামলা, রাস্তা অবরোধ, বিক্ষোভ
‘আপনারা লিখিত দিন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্টোন ক্রাশার সরিয়ে নেবেন। আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালাবো না। ফিরে যাবো।’ গোয়াইনঘাটের এসি (ল্যান্ড) এসএম ফেরদৌসের সে প্রস্তাবে ব্যবসায়ীরা রাজি হননি। তাদের দাবি, ‘আরও সময় দিতে হবে। এই স্বল্প সময়ে ক্রাশার মিল সরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।’ এভাবে ঘণ্টাখানেক বৈঠক হলেও সিলেটের জাফলংয়ে অবৈধ স্টোন ক্রাশার অভিযান নিয়ে কোন সুরাহা হয়নি। শেষে হাইকোর্টের নির্দেশনা পালন করতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করা হলে চালানো হয় হামলা। শতাধিক শ্রমিক ও মালিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে অভিযান পরিচালনাকারী দলের ওপর হামলার পাশাপাশি গুঁড়িয়ে দেয়া হয় প্রশাসনের গাড়ি। এ সময় হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। গতকাল সকালে সিলেটের গোয়াইনঘাটে জাফলংয়ে এ নিয়ে দিনভর ছিল উত্তপ্ত পরিস্থিতি। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিকালে রাস্তা অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছে। তারা হামলা চালিয়ে অভিযান পরিচালনাকারীদের গাড়ি ভাঙচুরসহ পুলিশ ও সরকারি কর্মকর্তাদের মারধর করে। এতে অন্তত ২০ জন আহত হন। স্টোন ক্রাশার উচ্ছেদে সিলেটে পদে পদে তোপের মুখে পড়ছেন প্রশাসনের কর্তারা। হাইকোর্টের নির্দেশমতো পরিবেশ বিধ্বংসী সহস্রাধিক স্টোন ক্রাশারের মালিক ও শ্রমিকদের হামলার শিকার হচ্ছেন তারা। বিক্ষুব্ধ মালিক ও শ্রমিকরা জানিয়েছেন, সময়সীমা না দিয়েই উচ্ছেদ অভিযানে নামার কারণে এমনটি হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, সিলেটের জাফলং পাথর কোয়ারিকেন্দ্রিক প্রায় ২০০ স্টোন ক্রাশার মিল রয়েছে। এর মধ্যে পাথর কোয়ারি লাগোয়া এলাকা বল্লাঘাট, মামার দোকান, জাফলং বাজার, গুচ্ছগ্রাম, মোহাম্মদপুর, নলজুড়ি, তামাবিল সহ কয়েকটি এলাকায় এসব স্টোন ক্রাশার মিল গড়ে তোলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে সরকারি নির্দেশ মেনে মাত্র ৪টি স্টোন ক্রাশার ব্যবসা পরিচালনা করছে। অন্যদের অনুমোদনপ্রাপ্তি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এদিকে, অবৈধ স্টোন ক্রাশার মিল উচ্ছেদে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা জারির কারণে গতকাল সকাল ১০টায় জাফলংয়ে উচ্ছেদ অভিযানে নামে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুল ইসলাম চৌধুরী, এসি (ল্যান্ড) এসএম ফেরদৌস, পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজ, সওজ-এর এসও খালেদ আহমদের নেতৃত্বে শতাধিক বিজিবি ও পুলিশ দল প্রথমে নলজুড়ি এলাকা থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। ফেলুডার মেশিন দিয়ে তারা চারটি স্টোন ক্রাশার মিলের যন্ত্র গুঁড়িয়ে দেয়। এতে প্রশাসন ও ব্যবসায়ীরা মুখোমুখি অবস্থানে নেয়। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, কোন সময় না দিয়েই অভিযান পরিচালনা করায় তারা ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। ফলে স্টোন ক্রাশার মিল ও পাথর ব্যবসায়ীরা এক হয়ে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান। এর ফলে ইউএনও আজিজুল ইসলামের নির্দেশে এসি (ল্যান্ড) এসএম ফেরদৌস পাথর ব্যবসায়ী সমিতির কার্যালয়ের স্টোন ক্রাশার মিল ও পাথর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বৈঠকে স্টোন ক্রাশার মিল সমিতির সভাপতি বাবুল বখত, সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস উদ্দিন, পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মুতলিব খান ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাফিজ সহ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পক্ষে এসি (ল্যান্ড) ব্যবসায়ীদের জানান, আপনাদের ২৪ ঘণ্টা সময় দেয়া হলো। এই সময়ের মধ্যে আপনারা স্টোন ক্রাশার মিল সরিয়ে নিন। আর বিষয়টি লিখিত আকারে মেনে নিলেই তিনি সরে যাবেন বলে জানান। কিন্তু ব্যবসায়ীরা লিখিত না দিয়েই টালবাহানা শুরু করেন বলে জানান প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এ কারণে দুপুর ১২টার দিকে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ফের অভিযান শুরু করে কয়েকটি টমটম মেশিন ভেঙে দিলে ব্যবসায়ীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। স্টোন ক্রাশার মালিক ও শ্রমিকদের একটি বড় অংশ তাৎক্ষণিক জড়ো হয়ে অভিযান পরিচালনাকারী দলের ওপর হামলা চালায়। তাদের হামলায় ইউএনও’র পাজেরো জিপ সহ বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করলে ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। এতে পুলিশের এসআই সহ অন্তত ২০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে রয়েছে শ্রমিক জিয়া, রাসেল, ইউসুফ সহ বেশ কয়েকজন। তাদেরকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এদিকে, হামলার পরপরই ব্যবসায়ীরা অভিযান বন্ধের দাবিতে সিলেট-তামাবিল সড়কের মামার দোকান ও গুচ্ছগ্রামের রাজস্ব আদায় কেন্দ্রে সড়ক অবরোধ করে। প্রায় দেড় ঘণ্টা তারা সড়ক অবরোধ করে দফায় দফায় বিক্ষোভ করতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সিলেট থেকে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি নেয়া হয় এলাকায়। বেলা একটা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত প্রায় আড়াই ঘণ্টা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা। এ সময় জাফলং পর্যটন এলাকায় শ’ শ’ যানবাহন আটকা পড়ে। বিকাল ৪টার দিকে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়। পাথর ব্যবসায়ী ও স্টোন ক্রাশার মিলের মালিকরা জানিয়েছেন, প্রশাসন জোরপূর্বক উচ্ছেদ অভিযান চালানোর কারণে শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়েছে। আর এসি (ল্যান্ড) জানিয়েছেন, তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালানো হয়েছে। এতে গাড়ি ভাঙচুর সহ শ্রমিকরাও আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় সন্ধ্যায় জাফলং ও মামার দোকান এলাকায় আরও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
No comments