কোন পথে যাব- কার হাত ধরব? by মোকাম্মেল হোসেন
পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছি। পারছি
না। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের নগর-শহরে ফুটপাতের উপর দিয়ে আবেগ-কাতর নর-নারী
হাত ধরাধরি করে হাঁটলে অন্য পথচারীদের সমস্যা হয় না। ঢাকা শহরে হয়। ঢাকা
শহরের ফুটপাত হচ্ছে দুগ্ধবতী গাভী। মাস্তান, রাজনৈতিক পোষ্য ও রাষ্ট্রের
পুলিশ বাহিনী প্রতিদিন দুবেলা এ গাভী দোহন করে বছরে যে পরিমাণ দুধ সংগ্রহ
করে- টাকার অংকে তার পরিমাণ অন্তত ৬০০ কোটি। যে শহরের ফুটপাত প্রতিবছর
অন্যূন ৬০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজির সুযোগ করে দিচ্ছে, তার উপর দিয়ে হাঁটার
সময় পথচারীদের পিঁপড়ারীতি অনুসরণ করা উচিত। বঙ্গীয় রোমিও-জুলিয়েট এ রীতি
অনুসরণ করছে না। তারা হাঁটছে হাত ধরাধরি করে, পরস্পরের মুগ্ধতা বিনিময় করতে
করতে। গলা খাঁকারি দিলাম- কাজ হল না। এক্সকিউজ মি বললাম- শুনল না।
মুগ্ধতার নোনাজলে আকণ্ঠ ডুবে থাকা এ জুটির কারবার দেখে বাসের ঘটনা মনে পড়ল।
বাড্ডা নতুন বাজার পর্যন্ত জাবালে নূর নামে একটা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। আজকাল এ বাসেই অফিসে আসা-যাওয়া করি। কয়েকদিন আগে বাসে উঠে বসতে না বসতেই অস্পষ্ট নারী কণ্ঠস্বর কানে এলো-
: আহ! ছাড়ো...
হায় আল্লাহ তুমি সোবাহান- ইজ্জতের মালিক। জোশের বশে ভুল করে ধরে ফেললাম না তো! হাতজোড়ার দিকে তাকালাম। নাহ! হাতের জায়গায় হাত আছে। কোনো গড়বড় হয়নি। তাহলে? প্রশ্রয়মাখা, আবেশ জড়ানো বাক্যের উৎস অনুসন্ধানে ডানে-বামে চোখ ঘোরাতেই দেখলাম- আমার পেছনের সিটে একজোড়া তরুণ-তরুণী বসে আছে। অফিসে যাওয়া-আসার পথে বাসে সহযাত্রী হিসেবে যাদের পাই- অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। বোঝা যায়, এরা নতুনবাজার-নর্দা-বসুন্ধরা এলাকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ক্লাসরুমের বাইরেও শিক্ষার্থীদের অনেক কিছু শেখার আছে। দেখার আছে। এ দুই শিক্ষার্থীর শেখার ও দেখার অধিকার মেনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছি, বাস কন্ডাক্টরের গলা বেজে উঠল-
: বাচ্চার কি সিট নিবেন?
আরে! এরমধ্যে বাচ্চাও হয়ে গেছে! এটা কীভাবে সম্ভব? চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল অসম্ভবকে সম্ভব করার দায়িত্ব পালন করছে। এ তরুণ কি তবে অনন্ত জলিলের খালাত ভাই জলন্ত খলিল? জলন্ত বারুদের ক্ষমতা ছাড়া এত দ্রুত পৃথিবীতে নতুন আদম সন্তানের আগমন ঘটানো সম্ভব নয়! বারুদের ক্ষমতার ফসল দেখার আশায় সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াব কিনা ভাবছি, জলন্ত খলিলের কণ্ঠ শোনা গেল-
: অই মিয়া, বাচ্চা পাইলা কই?
শব্দ-নৈরাজ্যের মিছিলে যোগদানকারী জাবালে নূর চিৎকার করতে করতে দৌঁড়াচ্ছে। জাবালে নূর-এর আরবী উচ্চারণ জাবাল-আল-নূর। আরবী জাবাল মানে পাহাড় আর নূর হচ্ছে আলো। জাবাল-আল-নূর-এর বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায় আলোর পাহাড়। এ পাহাড়ের হেরা নামক গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আখেরী নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর নবুয়ত প্রাপ্তি ঘটে। নবীজির (সাঃ) মাধ্যমে আল্লাহপাক কোরআনের যে আলো বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার সূচনা ঘটে এ পাহাড় থেকেই। সেজন্য একে জাবাল-আল-নূর বা আলোর পাহাড় নামে অভিহিত করা হয়। পাহাড়ের পক্ষে নড়াচড়া করা অসম্ভব। পবিত্র নগরী মক্কার জাবাল-আল-নূর অনড় থাকলেও বাংলার জাবালে নূর দৌঁড়াচ্ছে। দিয়াশলাই বাক্স আকৃতির বাংলার আলোর পাহাড় শুধু দৌঁড়াচ্ছেই না, চলমান এ পাহাড়ের কোলে আরব্য রজনীর গল্পের স্টাইলে প্রেম-রোমান্স সবই চলছে। চাকা ফিট করে আলোর পাহাড়কে সচলকারীরা ক্বলবে পবিত্রতার জোশ অনুভব করলেও নামের পবিত্রতা যে রক্ষা হচ্ছে না- কন্ডাক্টরের কথায় তা স্পষ্ট হল। সে বলল-
: বাচ্চা না হইলে কোলে লইয়া বইসা রইছেন কী জন্য?
যৌবনপ্রাপ্ত নর-নারীর একে অপরের সান্নিধ্যে আসা, কোলে ওঠা বা ঠোঁটে ঠোঁট রাখা জাগতিক নিয়মের চিরন্তন রূপ। পশু-পাখিরাও এ নিয়মের অধীন। তবে সবার উপস্থাপনা এক রকম নয়। গোপনীয়তার মোড়কে আবৃত থাকে বলেই চুম্বনের স্মৃতি এত মধুর। বাঙালি যদি প্রকাশ্যে চকাস-চকাস চুম্বনচর্চায় লিপ্ত হতো, তাহলে চুম্বন তাদের স্মৃতির মন্দিরে জায়গা করে নিতো না। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা মন্দিরের বেদি থেকে চুম্বনকে রাজপথে টেনে নামানোর আন্দোলন শুরু করেছে। দাদাদের সবকিছুই আমাদের অতি প্রিয়। পাখি-ঢেউয়ের মতো চুম্বন-ঢেউ এদেশে আছড়ে পড়ার আতংকে আতংকিত হয়ে ওইদিনই একটা ডিভিডি প্লেয়ার কিনে বাসায় হাজির হলাম। বগলে বাক্স দেখে অবাক হয়ে লবণ বেগম জিজ্ঞেস করল-
: বাক্সের মধ্যে কী?
- লেখা আছে।
: কী লেখা আছে?
- কানিবুড়ি হইছ? কী লেখা আছে, দেখতেছ না?
: দেখলাম। এইটা কই পাইলা?
- কই পাইলাম মানে! এইসব কি রাস্তায় কুড়াইয়া পাওয়ার জিনিস? কিইন্যা আনলাম।
: কেন?
ব্যাগ থেকে কতগুলো ডিভিডি ডিস্ক বের করে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললাম-
: আইজ থেইক্যা বাসার ডিশ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। বাচ্চাদের জন্য কার্টুন ছবি আর তোমার জন্য ক্লাসিক ম্যুভি ও গানের ডিস্ক আনছি। এখন থেইক্যা বিনোদন জগতে তোমরা এইসব লইয়া বিচরণ করবা। আমি টাইম টু টাইম ডিস্ক সাপ্লাই দিব।
লবণ বেগম ডিভিডি ডিস্কগুলো খুঁটিয়ে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-
: তাসিনের আব্বু! তোমারে নির্বোধ বলার মধ্যে আমার সুখ নাই; গৌরবও নাই। তারপরও আমি বলতে বাধ্য হইতেছি- তুমি একটা চরম নির্বোধ।
নারীজাতির মূল্যায়ন রিপোর্টে নির্বোধ চিহ্নিত হওয়া বড়ই লজ্জার বিষয়। কোনো পুরুষের পক্ষে এটা হজম করা মুশকিল। হজম করতে না পেরে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললাম। আগের কথার সূত্র ধরে লবণ বেগম বলল-
: টেলিভিশনের সম্প্রচার নীতিমালা সামাজিক অনুশাসন, বিধিবিধান ও আইনের কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু ডিভিডি ডিস্কের তো কোনো বাপ-মা নাই। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে বাচ্চারা যদি অশ্লীল ছবির ডিস্ক জোগাড় কইরা দেখা শুরু করে- কী করবা? ডিশের লাইন বন্ধ করতে চাও- ভালা কথা। ইন্টারনেট? এইটা বন্ধ করবা কীভাবে? মাই ডিয়ার তাসিনের আব্বু! কাচের ঘরে বাচ্চাদের আবদ্ধ কইরা চরিত্রবান বানানোর চেষ্টা না কইরা তারা যাতে সত্য, সুন্দর ও সঠিক পথের অনুসারী হয়-সেই শিক্ষা দেও। সঠিক শিক্ষা পাইলে কোন পথে হাঁটা যাবে, কার হাত ধরা যাবে- এইটা নির্ধারণ করতে তারা ভুল করবে না।
মাগনা জিনিসের কদর কম। লবণ বেগমের ফ্রি পরামর্শ এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিলাম। তবে কথাগুলো ফেরত এলো। কয়েকদিন পর লবণ বেগমের প্রতিটি কথা হাজার গুণ শক্তিশালী হয়ে আমার চেতনার জগতে আঘাত করল।
অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হচ্ছি, লবণ বেগম জানতে চাইল-
: এইবার শাফিনের জন্মদিনে কী করবা?
- দোয়া করব।
: হুরু! তোমার খালি বাউলি কাটার স্বভাব। বাপ হইয়া সন্তানের জন্য দোয়া করবা- এইটা ঘোষণা দিয়া বলার দরকার নাই। ঘোষণা দিয়া কী করবা- সেইটা কও।
- নাথিং টু ডু। ফকিরচাঁনের পক্ষে দোয়া ছাড়া আর কিছু বিতরণ করা সম্ভব নয়।
: তাসিনের আব্বু! পিছলা মারবা না।
- পিছলা মারা না, যা সত্য- তাই বললাম। সন্তানের জন্য বাপ-মায়ের দোয়ার চাইতে মূল্যবান আর কিছু নাই...
সন্ধ্যার পর অফিস থেকে বাসায় ফিরে লবণ বেগমের খোঁজ করতেই রুমা বলল-
: আন্টি ট্যাবলেট কিনতে গেছে।
ততক্ষণাৎ লবণ বেগমকে ফোন করলাম। বললাম-
: কী হইছে তোমার?
- কিছু হয় নাই তো!
রুমা কি তবে ভুল তথ্য দিল? লবণ বেগমকে রুমার গাধামি সম্পর্কে বলতেই সে কুড়মুড় করে হাসল কিছুক্ষণ। তারপর বলল-
: রুমা ভুল বলে নাই। আমি ট্যাবলেট কিনতেই আসছি। তবে এইটা খাওয়ার ট্যাবলেট না, ব্যবহারের।
ব্যবহারের ট্যাবলেট! সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি একসময় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী হিসেবে বাজারে এক ধরনের ট্যাবলেট সরবরাহ করত। এর নাম ছিল জয় ফোম ট্যাবলেট। বিশেষ মুহূর্তে ব্যবহার উপযোগী জয় ফোম ট্যাবলেট পরবর্তীকালে বাজার থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়। পুনরায় এর সাপ্লাই শুরু হল নাকি? আমার ভাবনা শুনে লবণ বেগমের হাসি হেঁচকিতে গিয়ে ঠেকল। হেঁচকি তুলতে তুলতে কোনোমতে সে উচ্চারণ করল-
: লাইনে থাক- পানি খাইয়া লই।
পানিপান পর্ব শেষ করে লবণ বেগম বলল-
: তোমার মতো গাধা জগতে দুইটা নাই। তুমি কোন লাইনের গাড়ি কোন লাইনে তুইল্যা দিছ- হুঁশ আছে? ট্যাবলেট কিনতে আসছি শাফিনের জন্য।
- শাফিনের কী হইছে?
: আবার বলে কী হইছে? আরে গাধা! এই ট্যাবলেট হইল ল্যাপটপের মিনি সংস্করণ।
- ল্যাপটপের মিনি সংস্করণ দিয়া শাফিন কী করবে?
: এর উত্তর আমি দিতে পারব না। শাফিনের জন্মদিন উপলক্ষে তার লাইজু খালামনি তারে এইটা উপহার দিতেছে। তোমার যা জিজ্ঞাসা করার শাফিনের খালামনিরে জিজ্ঞাসা কর।
বাসায় ফেরার পর লবণ বেগমকে বললাম-
: পুইচ্চাদের হাতে ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট না দিয়া প্রাইজবন্ড কিইন্যা দিলেই হইত।
লবণ বেগম স্যুটের মাপ নেয়ার মতো সূক্ষ্মভাবে উপর-নিচে আমার মাপ সম্পন্ন করে বলল-
: জন্মদিন উপলক্ষে বাচ্চাদের একাধিকবার প্রাইজবন্ড উপহার দেওয়া হইছে। তার রেজাল্ট কী?
রেজাল্ট ফাটা বেলুন। অভাবের সংসারে প্রয়োজন যখন অনিবার্য হয়ে সামনে দাঁড়ায়, তখন সবার আগে রেডিমেড সঞ্চয়ের উপর হাত পড়ে। এ প্রক্রিয়ায় প্রাইজবন্ড ক্যাশে রূপান্তরিত হয়ে হজম হতে দেরি হয়নি। প্রাইজবন্ড বুমেরাং হয়ে আমাকেই আঘাত করবে বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে ভদ্রলোকের মতো চুপচাপ থাকতাম।
ট্যাবলেট হাতে পেয়েই শাফিন বলল-
: আব্বু, আমারে একটা সিম কিইন্যা দিবা?
- শিমের কারবার তো আমি করি না। রুমা করে। তুমি তার কাছে চাও।
: আব্বু! কথা ঘোরাবা না। আমি কোন সিমের বলতেছি, এইটা তুমি ঠিকই বুঝতে পারছ।
- সিম দিয়া কী করবা?
: ট্যাবে লাগাব।
- ট্যাবে লাগাইলে কী হবে?
: ইন্টারনেট ইউজ কইরা নতুন নতুন গেইম ডাউনলোড করা যাবে।
ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন শুধু গেইম ডাউনলোডেই সহায়তা করে না। এ লেখার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডাল্ট ফিল্মের অপশন নিয়ে হাজির হয়। ফেসবুকে ঢোকার জন্য এফ লিখতেই ফাক উঁকি মারে। অপরিপক্ক ছেলেমেয়েদের চোখের সামনে ফাকের পর্দা একবার উন্মোচিত হলে তার পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য। জ্ঞানচর্চার নামে, স্মার্ট হওয়ার দোহাই দিয়ে আধুনিক প্রজন্ম ই-মেইল, ফেসবুক চর্চা করছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের ইন্টারনেট পরিসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তুমুল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কেউ কেউ রাত ১২টার পর থেকে ভোরের আলো ফোটার আগ পর্যন্ত পাঁচভাগের এক ভাগ মূল্যে সেবা নেয়ার লোভ দেখাচ্ছে। বিদ্যাসাগর রাতে রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টে বসতেন। তার হাতে থাকত বই। আমাদের সন্তানরা এখন স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটার সামনে নিয়ে রাত জাগে। এসব উপকরণ সামনে নিয়ে কোন জ্ঞান আহরণ করছে তারা? দেশের মন্ত্রী-মিনিস্টার, এমপি-স্পীকার, আমলা-গামলারা এ প্রজন্মকে চরিত্রবান হওয়ার তাগিদ দিয়ে ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ সমাজ গঠনের কারিগর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে হর-হাশেমাই বক্তৃতা-বিবৃতি দেন। অথচ ১৫ পার্সেন্ট ভ্যাট পাওয়ার মায়া ত্যাগ করে তারা উচ্চারণ করতে পারেন না- মাছের সামনে টোপ রাখার মতো ছেলেমেয়েদের সামনে গভীর রাতের টোপ ফেলা চলবে না।
পেশাগত প্রয়োজনে আমাকে প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটের জগতে বিচরণ করতে হয়। কাজের উৎকর্ষ সাধনে ইন্টারনেটের কোনো জুড়ি নেই। এ জ্ঞান-সমুদ্রে সাঁতার কাটার সময় আমি ডলফিন আর হাঙরের পার্থক্য বুঝতে সক্ষম। আমার অল্পবয়েসী ছেলে কি তা বুঝতে সক্ষম? রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকের সুরক্ষা কবজ হিসেবে ভূমিকা পালন করে না, তখন যার যার ঘর তাকেই সামলাতে হয়। ছেলেকে সামলানোর একটা অস্ত্রই হাতে আছে আমার। আমি সেটা প্রয়োগ করে তাকে বললাম-
: নেভার অ্যান্ড এভার। কিছুতেই না। কখনই না। যে দোকান থেইক্যা ট্যাবলেট কেনা হইছে, তোমার আম্মুরে লইয়া সেখানে যাবা- তারা নতুন গেইমস ভইরা দিবে।
আজ শাফিনের জন্মদিন। কেক কাটা হবে সন্ধ্যায়। লবণ বেগম দুপুরে মুরগি-পোলাউয়ের আয়োজন করেছে। আমার তিনছেলে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নাকে-মুখে মুরগি-পোলাউ খেয়ে ট্যাব নিয়ে বসে পড়ল। ডি ড্রাইভে সংরক্ষিত গেইমসের মজুদ শেষ হওয়ার পর শাফিন তার সীমাবদ্ধতার কথা জানাতেই ওর এক বন্ধুকে বলতে শুনলাম-
: আরে! এইটা কোনো ব্যাপারই না। আমি ওয়াই-ফাই দিয়া পাঁচ মিনিটের মধ্যে নতুন গেইম ডাউনলোড কইরা দিতেছি...
বুঝতে পারলাম- পৃথিবী যে গতিধারায় অগ্রসর হচ্ছে, কাঁচের ঘর তৈরি করে ওদের আড়াল করার চেষ্টা করা বৃথা। বরং তারা যাতে ভুল পথে পা না রাখে, ভুল মানুষের হাত না ধরে- সে চেষ্টা করা উচিত। ভুল পথে পা রাখলে, ভুল মানুষের হাত ধরলে তার মূল্য এক জীবনে শোধ করা যায় না। পৃথিবী নামের এই গ্রহে বাবার ভূমিকা পালন করে আমি আমার সন্তানদের একটা জীবন উপহার দিয়েছি। দ্বিতীয়বারের মতো তাদের জীবন দেয়ার ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়নি।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
বাড্ডা নতুন বাজার পর্যন্ত জাবালে নূর নামে একটা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। আজকাল এ বাসেই অফিসে আসা-যাওয়া করি। কয়েকদিন আগে বাসে উঠে বসতে না বসতেই অস্পষ্ট নারী কণ্ঠস্বর কানে এলো-
: আহ! ছাড়ো...
হায় আল্লাহ তুমি সোবাহান- ইজ্জতের মালিক। জোশের বশে ভুল করে ধরে ফেললাম না তো! হাতজোড়ার দিকে তাকালাম। নাহ! হাতের জায়গায় হাত আছে। কোনো গড়বড় হয়নি। তাহলে? প্রশ্রয়মাখা, আবেশ জড়ানো বাক্যের উৎস অনুসন্ধানে ডানে-বামে চোখ ঘোরাতেই দেখলাম- আমার পেছনের সিটে একজোড়া তরুণ-তরুণী বসে আছে। অফিসে যাওয়া-আসার পথে বাসে সহযাত্রী হিসেবে যাদের পাই- অধিকাংশই তরুণ-তরুণী। বোঝা যায়, এরা নতুনবাজার-নর্দা-বসুন্ধরা এলাকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ক্লাসরুমের বাইরেও শিক্ষার্থীদের অনেক কিছু শেখার আছে। দেখার আছে। এ দুই শিক্ষার্থীর শেখার ও দেখার অধিকার মেনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছি, বাস কন্ডাক্টরের গলা বেজে উঠল-
: বাচ্চার কি সিট নিবেন?
আরে! এরমধ্যে বাচ্চাও হয়ে গেছে! এটা কীভাবে সম্ভব? চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল অসম্ভবকে সম্ভব করার দায়িত্ব পালন করছে। এ তরুণ কি তবে অনন্ত জলিলের খালাত ভাই জলন্ত খলিল? জলন্ত বারুদের ক্ষমতা ছাড়া এত দ্রুত পৃথিবীতে নতুন আদম সন্তানের আগমন ঘটানো সম্ভব নয়! বারুদের ক্ষমতার ফসল দেখার আশায় সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াব কিনা ভাবছি, জলন্ত খলিলের কণ্ঠ শোনা গেল-
: অই মিয়া, বাচ্চা পাইলা কই?
শব্দ-নৈরাজ্যের মিছিলে যোগদানকারী জাবালে নূর চিৎকার করতে করতে দৌঁড়াচ্ছে। জাবালে নূর-এর আরবী উচ্চারণ জাবাল-আল-নূর। আরবী জাবাল মানে পাহাড় আর নূর হচ্ছে আলো। জাবাল-আল-নূর-এর বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায় আলোর পাহাড়। এ পাহাড়ের হেরা নামক গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় আখেরী নবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ)-এর নবুয়ত প্রাপ্তি ঘটে। নবীজির (সাঃ) মাধ্যমে আল্লাহপাক কোরআনের যে আলো বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন, তার সূচনা ঘটে এ পাহাড় থেকেই। সেজন্য একে জাবাল-আল-নূর বা আলোর পাহাড় নামে অভিহিত করা হয়। পাহাড়ের পক্ষে নড়াচড়া করা অসম্ভব। পবিত্র নগরী মক্কার জাবাল-আল-নূর অনড় থাকলেও বাংলার জাবালে নূর দৌঁড়াচ্ছে। দিয়াশলাই বাক্স আকৃতির বাংলার আলোর পাহাড় শুধু দৌঁড়াচ্ছেই না, চলমান এ পাহাড়ের কোলে আরব্য রজনীর গল্পের স্টাইলে প্রেম-রোমান্স সবই চলছে। চাকা ফিট করে আলোর পাহাড়কে সচলকারীরা ক্বলবে পবিত্রতার জোশ অনুভব করলেও নামের পবিত্রতা যে রক্ষা হচ্ছে না- কন্ডাক্টরের কথায় তা স্পষ্ট হল। সে বলল-
: বাচ্চা না হইলে কোলে লইয়া বইসা রইছেন কী জন্য?
যৌবনপ্রাপ্ত নর-নারীর একে অপরের সান্নিধ্যে আসা, কোলে ওঠা বা ঠোঁটে ঠোঁট রাখা জাগতিক নিয়মের চিরন্তন রূপ। পশু-পাখিরাও এ নিয়মের অধীন। তবে সবার উপস্থাপনা এক রকম নয়। গোপনীয়তার মোড়কে আবৃত থাকে বলেই চুম্বনের স্মৃতি এত মধুর। বাঙালি যদি প্রকাশ্যে চকাস-চকাস চুম্বনচর্চায় লিপ্ত হতো, তাহলে চুম্বন তাদের স্মৃতির মন্দিরে জায়গা করে নিতো না। কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা মন্দিরের বেদি থেকে চুম্বনকে রাজপথে টেনে নামানোর আন্দোলন শুরু করেছে। দাদাদের সবকিছুই আমাদের অতি প্রিয়। পাখি-ঢেউয়ের মতো চুম্বন-ঢেউ এদেশে আছড়ে পড়ার আতংকে আতংকিত হয়ে ওইদিনই একটা ডিভিডি প্লেয়ার কিনে বাসায় হাজির হলাম। বগলে বাক্স দেখে অবাক হয়ে লবণ বেগম জিজ্ঞেস করল-
: বাক্সের মধ্যে কী?
- লেখা আছে।
: কী লেখা আছে?
- কানিবুড়ি হইছ? কী লেখা আছে, দেখতেছ না?
: দেখলাম। এইটা কই পাইলা?
- কই পাইলাম মানে! এইসব কি রাস্তায় কুড়াইয়া পাওয়ার জিনিস? কিইন্যা আনলাম।
: কেন?
ব্যাগ থেকে কতগুলো ডিভিডি ডিস্ক বের করে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললাম-
: আইজ থেইক্যা বাসার ডিশ সংযোগ বিচ্ছিন্ন। বাচ্চাদের জন্য কার্টুন ছবি আর তোমার জন্য ক্লাসিক ম্যুভি ও গানের ডিস্ক আনছি। এখন থেইক্যা বিনোদন জগতে তোমরা এইসব লইয়া বিচরণ করবা। আমি টাইম টু টাইম ডিস্ক সাপ্লাই দিব।
লবণ বেগম ডিভিডি ডিস্কগুলো খুঁটিয়ে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-
: তাসিনের আব্বু! তোমারে নির্বোধ বলার মধ্যে আমার সুখ নাই; গৌরবও নাই। তারপরও আমি বলতে বাধ্য হইতেছি- তুমি একটা চরম নির্বোধ।
নারীজাতির মূল্যায়ন রিপোর্টে নির্বোধ চিহ্নিত হওয়া বড়ই লজ্জার বিষয়। কোনো পুরুষের পক্ষে এটা হজম করা মুশকিল। হজম করতে না পেরে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললাম। আগের কথার সূত্র ধরে লবণ বেগম বলল-
: টেলিভিশনের সম্প্রচার নীতিমালা সামাজিক অনুশাসন, বিধিবিধান ও আইনের কাঠামো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু ডিভিডি ডিস্কের তো কোনো বাপ-মা নাই। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে বাচ্চারা যদি অশ্লীল ছবির ডিস্ক জোগাড় কইরা দেখা শুরু করে- কী করবা? ডিশের লাইন বন্ধ করতে চাও- ভালা কথা। ইন্টারনেট? এইটা বন্ধ করবা কীভাবে? মাই ডিয়ার তাসিনের আব্বু! কাচের ঘরে বাচ্চাদের আবদ্ধ কইরা চরিত্রবান বানানোর চেষ্টা না কইরা তারা যাতে সত্য, সুন্দর ও সঠিক পথের অনুসারী হয়-সেই শিক্ষা দেও। সঠিক শিক্ষা পাইলে কোন পথে হাঁটা যাবে, কার হাত ধরা যাবে- এইটা নির্ধারণ করতে তারা ভুল করবে না।
মাগনা জিনিসের কদর কম। লবণ বেগমের ফ্রি পরামর্শ এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিলাম। তবে কথাগুলো ফেরত এলো। কয়েকদিন পর লবণ বেগমের প্রতিটি কথা হাজার গুণ শক্তিশালী হয়ে আমার চেতনার জগতে আঘাত করল।
অফিসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হচ্ছি, লবণ বেগম জানতে চাইল-
: এইবার শাফিনের জন্মদিনে কী করবা?
- দোয়া করব।
: হুরু! তোমার খালি বাউলি কাটার স্বভাব। বাপ হইয়া সন্তানের জন্য দোয়া করবা- এইটা ঘোষণা দিয়া বলার দরকার নাই। ঘোষণা দিয়া কী করবা- সেইটা কও।
- নাথিং টু ডু। ফকিরচাঁনের পক্ষে দোয়া ছাড়া আর কিছু বিতরণ করা সম্ভব নয়।
: তাসিনের আব্বু! পিছলা মারবা না।
- পিছলা মারা না, যা সত্য- তাই বললাম। সন্তানের জন্য বাপ-মায়ের দোয়ার চাইতে মূল্যবান আর কিছু নাই...
সন্ধ্যার পর অফিস থেকে বাসায় ফিরে লবণ বেগমের খোঁজ করতেই রুমা বলল-
: আন্টি ট্যাবলেট কিনতে গেছে।
ততক্ষণাৎ লবণ বেগমকে ফোন করলাম। বললাম-
: কী হইছে তোমার?
- কিছু হয় নাই তো!
রুমা কি তবে ভুল তথ্য দিল? লবণ বেগমকে রুমার গাধামি সম্পর্কে বলতেই সে কুড়মুড় করে হাসল কিছুক্ষণ। তারপর বলল-
: রুমা ভুল বলে নাই। আমি ট্যাবলেট কিনতেই আসছি। তবে এইটা খাওয়ার ট্যাবলেট না, ব্যবহারের।
ব্যবহারের ট্যাবলেট! সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানি একসময় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী হিসেবে বাজারে এক ধরনের ট্যাবলেট সরবরাহ করত। এর নাম ছিল জয় ফোম ট্যাবলেট। বিশেষ মুহূর্তে ব্যবহার উপযোগী জয় ফোম ট্যাবলেট পরবর্তীকালে বাজার থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়। পুনরায় এর সাপ্লাই শুরু হল নাকি? আমার ভাবনা শুনে লবণ বেগমের হাসি হেঁচকিতে গিয়ে ঠেকল। হেঁচকি তুলতে তুলতে কোনোমতে সে উচ্চারণ করল-
: লাইনে থাক- পানি খাইয়া লই।
পানিপান পর্ব শেষ করে লবণ বেগম বলল-
: তোমার মতো গাধা জগতে দুইটা নাই। তুমি কোন লাইনের গাড়ি কোন লাইনে তুইল্যা দিছ- হুঁশ আছে? ট্যাবলেট কিনতে আসছি শাফিনের জন্য।
- শাফিনের কী হইছে?
: আবার বলে কী হইছে? আরে গাধা! এই ট্যাবলেট হইল ল্যাপটপের মিনি সংস্করণ।
- ল্যাপটপের মিনি সংস্করণ দিয়া শাফিন কী করবে?
: এর উত্তর আমি দিতে পারব না। শাফিনের জন্মদিন উপলক্ষে তার লাইজু খালামনি তারে এইটা উপহার দিতেছে। তোমার যা জিজ্ঞাসা করার শাফিনের খালামনিরে জিজ্ঞাসা কর।
বাসায় ফেরার পর লবণ বেগমকে বললাম-
: পুইচ্চাদের হাতে ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট না দিয়া প্রাইজবন্ড কিইন্যা দিলেই হইত।
লবণ বেগম স্যুটের মাপ নেয়ার মতো সূক্ষ্মভাবে উপর-নিচে আমার মাপ সম্পন্ন করে বলল-
: জন্মদিন উপলক্ষে বাচ্চাদের একাধিকবার প্রাইজবন্ড উপহার দেওয়া হইছে। তার রেজাল্ট কী?
রেজাল্ট ফাটা বেলুন। অভাবের সংসারে প্রয়োজন যখন অনিবার্য হয়ে সামনে দাঁড়ায়, তখন সবার আগে রেডিমেড সঞ্চয়ের উপর হাত পড়ে। এ প্রক্রিয়ায় প্রাইজবন্ড ক্যাশে রূপান্তরিত হয়ে হজম হতে দেরি হয়নি। প্রাইজবন্ড বুমেরাং হয়ে আমাকেই আঘাত করবে বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে ভদ্রলোকের মতো চুপচাপ থাকতাম।
ট্যাবলেট হাতে পেয়েই শাফিন বলল-
: আব্বু, আমারে একটা সিম কিইন্যা দিবা?
- শিমের কারবার তো আমি করি না। রুমা করে। তুমি তার কাছে চাও।
: আব্বু! কথা ঘোরাবা না। আমি কোন সিমের বলতেছি, এইটা তুমি ঠিকই বুঝতে পারছ।
- সিম দিয়া কী করবা?
: ট্যাবে লাগাব।
- ট্যাবে লাগাইলে কী হবে?
: ইন্টারনেট ইউজ কইরা নতুন নতুন গেইম ডাউনলোড করা যাবে।
ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন শুধু গেইম ডাউনলোডেই সহায়তা করে না। এ লেখার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডাল্ট ফিল্মের অপশন নিয়ে হাজির হয়। ফেসবুকে ঢোকার জন্য এফ লিখতেই ফাক উঁকি মারে। অপরিপক্ক ছেলেমেয়েদের চোখের সামনে ফাকের পর্দা একবার উন্মোচিত হলে তার পরিণতি মারাত্মক হতে বাধ্য। জ্ঞানচর্চার নামে, স্মার্ট হওয়ার দোহাই দিয়ে আধুনিক প্রজন্ম ই-মেইল, ফেসবুক চর্চা করছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশের ইন্টারনেট পরিসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তুমুল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কেউ কেউ রাত ১২টার পর থেকে ভোরের আলো ফোটার আগ পর্যন্ত পাঁচভাগের এক ভাগ মূল্যে সেবা নেয়ার লোভ দেখাচ্ছে। বিদ্যাসাগর রাতে রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টে বসতেন। তার হাতে থাকত বই। আমাদের সন্তানরা এখন স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটার সামনে নিয়ে রাত জাগে। এসব উপকরণ সামনে নিয়ে কোন জ্ঞান আহরণ করছে তারা? দেশের মন্ত্রী-মিনিস্টার, এমপি-স্পীকার, আমলা-গামলারা এ প্রজন্মকে চরিত্রবান হওয়ার তাগিদ দিয়ে ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ সমাজ গঠনের কারিগর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে হর-হাশেমাই বক্তৃতা-বিবৃতি দেন। অথচ ১৫ পার্সেন্ট ভ্যাট পাওয়ার মায়া ত্যাগ করে তারা উচ্চারণ করতে পারেন না- মাছের সামনে টোপ রাখার মতো ছেলেমেয়েদের সামনে গভীর রাতের টোপ ফেলা চলবে না।
পেশাগত প্রয়োজনে আমাকে প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটের জগতে বিচরণ করতে হয়। কাজের উৎকর্ষ সাধনে ইন্টারনেটের কোনো জুড়ি নেই। এ জ্ঞান-সমুদ্রে সাঁতার কাটার সময় আমি ডলফিন আর হাঙরের পার্থক্য বুঝতে সক্ষম। আমার অল্পবয়েসী ছেলে কি তা বুঝতে সক্ষম? রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকের সুরক্ষা কবজ হিসেবে ভূমিকা পালন করে না, তখন যার যার ঘর তাকেই সামলাতে হয়। ছেলেকে সামলানোর একটা অস্ত্রই হাতে আছে আমার। আমি সেটা প্রয়োগ করে তাকে বললাম-
: নেভার অ্যান্ড এভার। কিছুতেই না। কখনই না। যে দোকান থেইক্যা ট্যাবলেট কেনা হইছে, তোমার আম্মুরে লইয়া সেখানে যাবা- তারা নতুন গেইমস ভইরা দিবে।
আজ শাফিনের জন্মদিন। কেক কাটা হবে সন্ধ্যায়। লবণ বেগম দুপুরে মুরগি-পোলাউয়ের আয়োজন করেছে। আমার তিনছেলে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নাকে-মুখে মুরগি-পোলাউ খেয়ে ট্যাব নিয়ে বসে পড়ল। ডি ড্রাইভে সংরক্ষিত গেইমসের মজুদ শেষ হওয়ার পর শাফিন তার সীমাবদ্ধতার কথা জানাতেই ওর এক বন্ধুকে বলতে শুনলাম-
: আরে! এইটা কোনো ব্যাপারই না। আমি ওয়াই-ফাই দিয়া পাঁচ মিনিটের মধ্যে নতুন গেইম ডাউনলোড কইরা দিতেছি...
বুঝতে পারলাম- পৃথিবী যে গতিধারায় অগ্রসর হচ্ছে, কাঁচের ঘর তৈরি করে ওদের আড়াল করার চেষ্টা করা বৃথা। বরং তারা যাতে ভুল পথে পা না রাখে, ভুল মানুষের হাত না ধরে- সে চেষ্টা করা উচিত। ভুল পথে পা রাখলে, ভুল মানুষের হাত ধরলে তার মূল্য এক জীবনে শোধ করা যায় না। পৃথিবী নামের এই গ্রহে বাবার ভূমিকা পালন করে আমি আমার সন্তানদের একটা জীবন উপহার দিয়েছি। দ্বিতীয়বারের মতো তাদের জীবন দেয়ার ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়নি।
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
No comments