সুন্দরবনের নদীতে তেলবাহী জাহাজডুবি- দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়ায় তেল ছড়িয়েছে
(‘মহাদুর্যোগে
সুন্দরবন: জরুরি করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা। প্রথম আলোর
উদ্যোগে রোববার বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের কার্যালয়ে এ আলোচনা
অনুষ্ঠিত হয়। ছবি: জাহিদুল করিম) সুন্দরবনের
শ্যালা নদীতে তেলবাহী জাহাজডুবির পর তেলের বিস্তৃতি রোধ করতে দ্রুত
ব্যবস্থা না নেওয়ায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে। এ দুর্ঘটনায় সুন্দরবনের
জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হবে, তা পুষিয়ে উঠতে বেশ কয়েক বছর লেগে যাবে।
এমন দুর্ঘটনা রোধে বন্ধ করতে হবে সুন্দরবনের ভেতরে নৌযান চলাচল। গোলটেবিল
আলোচনায় বক্তারা এভাবেই প্রকাশ করলেন তাঁদের হতাশা আর শঙ্কা। একই সঙ্গে এ
মহাদুর্যোগ থেকে উত্তরণে তাঁরা কিছু পথও বাতলে দিয়েছেন। জাহাজডুবির পর
ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর এর প্রভাব নিয়ে
আজ রোববার বিকেলে এক গোলটেবিল বৈঠক হয়। কারওয়ান বাজার কার্যালয়ে
‘মহাদুর্যোগে সুন্দরবন: জরুরি করণীয়’ শীর্ষক এ গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন
করে প্রথম আলো। গোলটেবিল বৈঠকে সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
আব্দুল কাইয়ুম। আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস
অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, দুর্ঘটনার পর ‘বুম’ ব্যবহার করে এ তেল সহজেই
অপসারণ করা যেত। ফাঁপা প্লাস্টিকের পাইপের সঙ্গে দুই-তিন ফুট জাল দিয়ে এটি
সহজেই বুম তৈরি করা যায়। এর মাধ্যমে তেল এক জায়গায় সংকুচিত করে পরে তা
তুলে নেওয়া যেত। কিন্তু ব্যাপারটির গুরুত্ব বুঝতে না পারায় সেটি করা
হয়নি। সংবিধানের ১৮-এর (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ
সরকারের দায়িত্ব এমনটা উল্লেখ করে আইনুন নিশাত বলেন, এ সংকট মোকাবিলায়
সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীকে ব্যবহার করার দরকার ছিল। তেলের এ বিস্তৃতিতে
ডলফিনসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও তিনি জানান।
সুন্দরবনের মধ্য নৌযান চলাচল বন্ধের দাবি জানিয়ে আইনুন নিশাত বলেন, ঘটনার
পর শুধু তদন্ত কমিটি গঠন না করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মোকাবিলা
করতে হবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজের
নির্বাহী পরিচালক আতিক রহমান মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে কেন বুম থাকবে
না, তা জানতে চান। কচুরিপানা দিয়ে তেলের বিস্তৃতি রোধ করা যেত বলেও মনে
করেন তিনি। শুধু মানুষের জীবিকায় নয় বরং এ দুর্ঘটনায় বিশ্ববাসীর সামনে
বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে দাবি করে আতিক রহমান আরও বলেন, এই
মুহূর্তেই এ নৌপথটি বন্ধ করে দিতে হবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বাশার বলেন, এ দুর্ঘটনা সুন্দরবনের জিন
সম্পদের (জেনেটিক রিসোর্সেস) ক্ষতি করবে। এমন দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে
সরকার কতটুকু প্রস্তুত রয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। আলোচনায় অংশ
নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, ঘটনার পর
দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়ায় জোয়ার-ভাটায় তেল ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু
ঘটনার পরপরই ভাসমান বাঁধ (ফ্লোটিং বেরিয়ার) দিয়ে তেলের বিস্তৃতি রোধ করা
যেত। তেল অপসারণের স্বীকৃত আটটি পদ্ধতির মধ্যে কেবল ‘ভ্যাকুয়ামিং’ এবং
‘ম্যানুয়াল’ পদ্ধতি বাকি আছে এমনটা দাবি করে তানজিম উদ্দিন খান বলেন,
মানুষ দিয়ে এ তেল অপসারণ করতে হবে। এ জন্য তেল অপসারণকারীদের জন্য হাতের
দস্তানাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বিশ্বব্যাংকের
পরিবেশবিষয়ক পরামর্শক ও সুন্দরবন গবেষক ইশতিয়াক সোবহান বলেন, গাছের
শ্বাসমূলে এ তেল আটকে যাওয়ায় গাছ মরে যাবে। দীর্ঘ সময় ধরে এর প্রভাব
পড়বে। সরকার সুন্দরবনের মতো একটি বিশ্ব ঐতিহ্যের কাছে রামপালের মতো
বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে সরকারের দ্বৈত অবস্থান ফুটে ওঠে।
প্রধান বন সংরক্ষক ইউনুস আলী দাবি করেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে
বুম ছিল কিন্তু ঘটনাস্থলে বুম পৌঁছতে দুই দিন সময় লাগত বলে তা আনা হয়নি।
নদীতে জোয়ার-ভাটা না হলে এ দুর্ঘটনায় আরও ক্ষতি হতো, এমন শঙ্কা প্রকাশ
করে ইউনুস আলী বলেন, ছড়িয়ে পড়া তেলের আস্তরণে পানি দূষিত হয়েছে। ধীরে
চলাচলকারী জলজ প্রাণীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রাথমিকভাবে কিছু জলজ প্রাণী
মারা যাবে। তবে এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে ১০ বছরের মতো লাগতে পারে। শ্যালা নদীর
নৌরুট পর্যায়ক্রমে বন্ধ করা হবে এমনটা দাবি করে ইউনুস আলী আরও জানান,
নৌযান চলাচলের জন্য পশুর চ্যানেলটি পুরোপুরি উন্মুক্ত করা হবে।
No comments