ফাঁসির দুই আসামিকে দেশে ফেরানোর গতি নেই
বুদ্ধিজীবী
হত্যা মামলায় আলবদর নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের ফাঁসির
আদেশ হয়েছে ১ বছরেরও বেশি সময় আগে। কিন্তু পলাতক এই দুই আসামিকে দেশে
ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এদের একজন যুক্তরাজ্যে
এবং অপরজন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে আছেন। যদিও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন,
‘তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কাজ চলছে। তবে জনস্বার্থে এর চেয়ে
বিস্তারিত কিছুই বলা যাবে না।’ এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়
দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী
আহসান মুজাহিদের বিরুদ্ধেও বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
দু’জনকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এ
রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করেছেন। বর্তমানে তাদের আপিল বিচারাধীন।
একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে এখন পর্যন্ত মোট চারজনের ফাঁসির আদেশ
হয়েছে। জানতে চাওয়া হলে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম বলেন,
‘বুদ্ধিজীবী হত্যায় কেন্দ্রীয়ভাবে নেতৃত্বদানকারী অধিকাংশের বিচার আপাতত
শেষ হয়েছে। তবে ঢাকার বাইরে রংপুর, রাজশাহী, খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে
বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলো তদন্তাধীন রয়েছে। এগুলো এখন বিচারের
আওতায় আসবে।’
একাত্তরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা চালায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। স্বাধীনতার উষালগ্নে বেছে বেছে এ দেশের মেধাবীদের হত্যা করা হয়েছিল। যেসব বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক নানাভাবে এ দেশের স্বাধীনতায় অবদান রেখে চলেছিলেন তাদের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যোদয় দেখার সুযোগ দেয়া হয়নি। ৪৩ বছর পর পাকিস্তানি নরঘাতদের সেই দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যদের বিচার শুরু হয়েছে। বিচারে ইতিমধ্যে চারজন দণ্ডিত হলেও তাদের সাজা কার্যকরের জন্য জাতিকে আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা কেউ বলতে পারছেন না।
দেশ স্বাধীনের পর ’৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইন প্রণয়ন করা হয়। একই বছরের ১৭ মার্চ এই ট্রাইব্যুনালে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত এবং প্রথম বিচার দাবি করা হয়। পরে ২২ মাসে এ আইনের আওতায় ৭০ হাজার মামলা হয়েছিল।
বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারের জন্যে ওই সময় ৪২টি মামলা হয়। ’৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সরকারি প্রেস নোটের মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয় এবং একই সঙ্গে দালাল আইনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যা করার পর আশির দশকের শুরুতে দালাল আইন বাতিল হয়। এসব মামলায় বিচারাধীন আসামিসহ সাজাপ্রাপ্তদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়।
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বুদ্ধিজীবী গিয়াস উদ্দিনের বোন অধ্যাপিকা ফরিদা বানু ফৌজদারি আইনের বিভিন্ন ধারায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মঈন উদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ’৯৭ সালে মামলা করেন। ২০০২ সালে মামলাটির চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে পুলিশ। এরপর ২০১০ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে এ দুজনের বিরুদ্ধে সরাসরি বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মামলা হয়। তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার ১১টি অভিযোগ আনা হয়।
বিচার শেষে গত বছরের ৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল ১১টি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়া হয়। রায়ে বলা হয়, ‘জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আলবদর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার যে নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে, তা গোটা জাতির বুকে ক্ষত হয়ে আজও রক্ত ঝরাচ্ছে। গত চার দশকে মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাকারীদের বিচার না করতে পারায় জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত, এ লজ্জা আমাদের ক্ষতকে দিন দিন বাড়িয়ে তুলছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতিকে চিরদিন নিদারুণ যন্ত্রণাই দিয়ে যাবে।’
রায়ে আরও বলা হয়, চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান আলবদর বাহিনীর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। জামায়াতের নীল নকশা অনুযায়ী সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকা অবস্থায় পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আগ মুহূর্তে কমপক্ষে ১০০ বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। যাদের হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১০ জন শিক্ষক, বিবিসির সাংবাদিকসহ পাঁচজন সাংবাদিক, দুজন সাহিত্যিক ও ২৬ জন চিকিৎসককে হত্যা করে বলে বিভিন্ন দলিল থেকে জানা যায়।
রায়ে উল্লেখ করা হয়, দৈনিক পূর্বদেশে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘জল্লাদের ডায়েরি : বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল্যবান দলিল।’ বাংলার সোনার সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নৃশংসতার খণ্ড খণ্ড চিত্র ওই ডায়েরিতে ছিল। ওই ডায়েরির মালিক ছিলেন জল্লাদ আশরাফুজ্জামান খান। এই ডায়েরিতেই উল্লেখ রয়েছে, জল্লাদ বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মঈনুদ্দীনের নাম। এ ছাড়া আলবদর কমান্ডার শওকত ইমরান, সিটি বদরবাহিনী প্রধান সামসুল হকের নামও উল্লেখ ছিল।
রায়ে বলা হয়, এটা প্রমাণিত যে বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেয়ার যে ‘মাস্টার প্ল্যান’ ছিল ফ্যাসিস্ট জামায়াতের সেই পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে আলবদর বাহিনীকে নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের কাজ ছিল এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা। আলবদর বাহিনী জামায়াতের নীল নকশা সম্পন্ন করতে ‘কিলিং স্কোয়াড’ হিসেবে কাজ করেছিল। রায়ে বলা হয়, প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর জাতি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। একটা নতুন জাতি গঠনে এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা নিঃস্বার্থভাবে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়।
রায়ের অভিমতে আরও বলা হয়, সবগুলো অভিযোগই ছিল এ দেশের ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ধরনের অপরাধকে গুরুতর মানবাধিকার লংঘন হিসেবে বিবেচনা করার দাবি রাখে। ন্যায়বিচারের জন্য দুষ্কৃতকারীরা যে জঘন্য অপরাধ করেছে তার পরিণাম ভোগ করতে হবে। অপরাধের গভীরতা বিবেচনা করে তাদের মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো সাজা দেয়ার উপায় নেই। তাদের একমাত্র এবং একমাত্র সাজা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
যে ১৮ বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য এই দুই আলবদর নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সেই বুদ্ধিজীবীরা হলেন- দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, পিপিআইয়ের তৎকালীন চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার তৎকালীন চিফ রিপোর্টার আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির তৎকালীন সংবাদদাতা ও পিপিআইয়ের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার নিজাম উদ্দিন আহমদ, শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদক সেলিনা পারভীন, সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, বিশিষ্ট চক্ষুচিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরী, ঢাকা মেডিকেল কলেজের কার্ডিওলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ফয়জুল মহিউদ্দিন, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরী এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ মর্তুজা। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি পলাতক থাকায় এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলও দায়ের হয়নি।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে প্রথম ফাঁসি দেয়া হয় আলবদর নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে। গত বছরের ১৭ জুলাই তার রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ ছিল। রায়ে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে ৬ নম্বর অভিযোগটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার নেতৃত্বদানের। এছাড়া এক নম্বর অভিযোগ ছিল দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন হত্যার। ট্রাইব্যুনাল এ দুটি অভিযোগকে বুদ্ধিজীবী হত্যা হিসেবে গণ্য করে তাকে ফাঁসির আদেশ দেন।
সর্বশেষ ২৯ অক্টোবর জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধেও বুদ্ধিজীবী হত্যায় নেতৃত্বদানের অভিযোগ রয়েছে। তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনী নিজামীর অধীন ছিল। ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসেবে নিজামী আলবদর বাহিনীকে মানসিকভাবে সমর্থন জুগিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী শুধু পাকিস্তানকে সহায়তা করেনি, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে এই আলবদর বাহিনী গঠন করে। তাই বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় নিজামী এড়াতে পারেন না।
ট্রাইব্যুনাল যে তিনটি রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে চারজনকে ফাঁসি দিয়েছেন, তার সবগুলোতেই জামায়াতকে এই হত্যাকাণ্ডের নীল নকশাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর ‘আলবদর বাহিনী’ এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, আলবদর বাহিনী ছিল একটি সশস্ত্র প্যারা মিলিটারি ফোর্স। পাকিস্তান সরকারের ব্যবস্থাপনায় এই বাহিনীকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর ‘ডেথ স্কোয়াড’ ছিল আলবদর। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত এই বদর বাহিনী।
একাত্তরে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার অপচেষ্টা চালায় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। স্বাধীনতার উষালগ্নে বেছে বেছে এ দেশের মেধাবীদের হত্যা করা হয়েছিল। যেসব বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক নানাভাবে এ দেশের স্বাধীনতায় অবদান রেখে চলেছিলেন তাদের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যোদয় দেখার সুযোগ দেয়া হয়নি। ৪৩ বছর পর পাকিস্তানি নরঘাতদের সেই দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যদের বিচার শুরু হয়েছে। বিচারে ইতিমধ্যে চারজন দণ্ডিত হলেও তাদের সাজা কার্যকরের জন্য জাতিকে আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা কেউ বলতে পারছেন না।
দেশ স্বাধীনের পর ’৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আইন প্রণয়ন করা হয়। একই বছরের ১৭ মার্চ এই ট্রাইব্যুনালে শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত এবং প্রথম বিচার দাবি করা হয়। পরে ২২ মাসে এ আইনের আওতায় ৭০ হাজার মামলা হয়েছিল।
বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারের জন্যে ওই সময় ৪২টি মামলা হয়। ’৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সরকারি প্রেস নোটের মাধ্যমে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয় এবং একই সঙ্গে দালাল আইনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারের হত্যা করার পর আশির দশকের শুরুতে দালাল আইন বাতিল হয়। এসব মামলায় বিচারাধীন আসামিসহ সাজাপ্রাপ্তদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়।
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বুদ্ধিজীবী গিয়াস উদ্দিনের বোন অধ্যাপিকা ফরিদা বানু ফৌজদারি আইনের বিভিন্ন ধারায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অন্যতম প্রধান আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মঈন উদ্দিন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ’৯৭ সালে মামলা করেন। ২০০২ সালে মামলাটির চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে পুলিশ। এরপর ২০১০ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে এ দুজনের বিরুদ্ধে সরাসরি বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মামলা হয়। তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার ১১টি অভিযোগ আনা হয়।
বিচার শেষে গত বছরের ৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল ১১টি অভিযোগই প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করে রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেয়া হয়। রায়ে বলা হয়, ‘জামায়াতে ইসলামীর মস্তিষ্কপ্রসূত ঘাতক বাহিনী আলবদর একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার যে নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে, তা গোটা জাতির বুকে ক্ষত হয়ে আজও রক্ত ঝরাচ্ছে। গত চার দশকে মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যাকারীদের বিচার না করতে পারায় জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত, এ লজ্জা আমাদের ক্ষতকে দিন দিন বাড়িয়ে তুলছে। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড বাঙালি জাতিকে চিরদিন নিদারুণ যন্ত্রণাই দিয়ে যাবে।’
রায়ে আরও বলা হয়, চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান আলবদর বাহিনীর শীর্ষ নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। জামায়াতের নীল নকশা অনুযায়ী সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকা অবস্থায় পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আগ মুহূর্তে কমপক্ষে ১০০ বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। যাদের হত্যা করেছে, তাদের মধ্যে কমপক্ষে ১০ জন শিক্ষক, বিবিসির সাংবাদিকসহ পাঁচজন সাংবাদিক, দুজন সাহিত্যিক ও ২৬ জন চিকিৎসককে হত্যা করে বলে বিভিন্ন দলিল থেকে জানা যায়।
রায়ে উল্লেখ করা হয়, দৈনিক পূর্বদেশে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘জল্লাদের ডায়েরি : বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল্যবান দলিল।’ বাংলার সোনার সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নৃশংসতার খণ্ড খণ্ড চিত্র ওই ডায়েরিতে ছিল। ওই ডায়েরির মালিক ছিলেন জল্লাদ আশরাফুজ্জামান খান। এই ডায়েরিতেই উল্লেখ রয়েছে, জল্লাদ বাহিনীর অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মঈনুদ্দীনের নাম। এ ছাড়া আলবদর কমান্ডার শওকত ইমরান, সিটি বদরবাহিনী প্রধান সামসুল হকের নামও উল্লেখ ছিল।
রায়ে বলা হয়, এটা প্রমাণিত যে বাঙালি জাতিকে পঙ্গু করে দেয়ার যে ‘মাস্টার প্ল্যান’ ছিল ফ্যাসিস্ট জামায়াতের সেই পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে আলবদর বাহিনীকে নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের কাজ ছিল এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা। আলবদর বাহিনী জামায়াতের নীল নকশা সম্পন্ন করতে ‘কিলিং স্কোয়াড’ হিসেবে কাজ করেছিল। রায়ে বলা হয়, প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর জাতি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। একটা নতুন জাতি গঠনে এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা নিঃস্বার্থভাবে অবদান রেখেছিলেন। কিন্তু চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি হয়।
রায়ের অভিমতে আরও বলা হয়, সবগুলো অভিযোগই ছিল এ দেশের ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ধরনের অপরাধকে গুরুতর মানবাধিকার লংঘন হিসেবে বিবেচনা করার দাবি রাখে। ন্যায়বিচারের জন্য দুষ্কৃতকারীরা যে জঘন্য অপরাধ করেছে তার পরিণাম ভোগ করতে হবে। অপরাধের গভীরতা বিবেচনা করে তাদের মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো সাজা দেয়ার উপায় নেই। তাদের একমাত্র এবং একমাত্র সাজা হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
যে ১৮ বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য এই দুই আলবদর নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। সেই বুদ্ধিজীবীরা হলেন- দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, পিপিআইয়ের তৎকালীন চিফ রিপোর্টার সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার তৎকালীন চিফ রিপোর্টার আ ন ম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির তৎকালীন সংবাদদাতা ও পিপিআইয়ের সাবেক জেনারেল ম্যানেজার নিজাম উদ্দিন আহমদ, শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদক সেলিনা পারভীন, সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, বিশিষ্ট চক্ষুচিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরী, ঢাকা মেডিকেল কলেজের কার্ডিওলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, ড. আবুল খায়ের, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ফয়জুল মহিউদ্দিন, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও মুনীর চৌধুরী এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ মর্তুজা। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি পলাতক থাকায় এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলও দায়ের হয়নি।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে প্রথম ফাঁসি দেয়া হয় আলবদর নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে। গত বছরের ১৭ জুলাই তার রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ ছিল। রায়ে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে ৬ নম্বর অভিযোগটি ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার নেতৃত্বদানের। এছাড়া এক নম্বর অভিযোগ ছিল দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সিরাজ উদ্দিন হোসেন হত্যার। ট্রাইব্যুনাল এ দুটি অভিযোগকে বুদ্ধিজীবী হত্যা হিসেবে গণ্য করে তাকে ফাঁসির আদেশ দেন।
সর্বশেষ ২৯ অক্টোবর জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামীকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধেও বুদ্ধিজীবী হত্যায় নেতৃত্বদানের অভিযোগ রয়েছে। তার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আলবদর বাহিনী নিজামীর অধীন ছিল। ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসেবে নিজামী আলবদর বাহিনীকে মানসিকভাবে সমর্থন জুগিয়েছেন। জামায়াতে ইসলামী শুধু পাকিস্তানকে সহায়তা করেনি, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে এই আলবদর বাহিনী গঠন করে। তাই বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় নিজামী এড়াতে পারেন না।
ট্রাইব্যুনাল যে তিনটি রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে চারজনকে ফাঁসি দিয়েছেন, তার সবগুলোতেই জামায়াতকে এই হত্যাকাণ্ডের নীল নকশাকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর ‘আলবদর বাহিনী’ এই হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছে। রায়ে বলা হয়েছে, আলবদর বাহিনী ছিল একটি সশস্ত্র প্যারা মিলিটারি ফোর্স। পাকিস্তান সরকারের ব্যবস্থাপনায় এই বাহিনীকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর ‘ডেথ স্কোয়াড’ ছিল আলবদর। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান এবং স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান বাহিনীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত এই বদর বাহিনী।
No comments