ফ্রন্ট লাইনে কামরান by ওয়েছ খছরু
দুর্দিনে
অনেকটা মুষড়ে পড়েছিলেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। চিরচেনা নগর ভবন হয়েছে
হাতছাড়া। ফ্ল্যাগ, পুলিশ এস্কর্ট সবই হারিয়েছেন। নিজ দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়
থাকলেও তাকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। নির্বাচনের সময় সুবিধাভোগী সব মওসুমি
পাখিরা দূর আকাশে উড়ে গিয়েছিল। আস্থাভাজন নিকটজন করেছিলেন বিশ্বাসঘাতকতা।
নিজ দলের অনেকেই করেছিলেন বিদ্রোহ। ঝড় এসেছিল হেফাজতের। সেই ঝড়ে স্বপ্ন
ভেঙে খান খান। এরপর অনেকটা নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। আগের মতো কোলাহল নেই
জীবনযাপনে। নেই তদবিরের ভিড়। আগের মতো জমে ওঠে না ড্রইংরুমের আড্ডা। সরকারি
কাজে ডাক পড়ে না তার। এতে করে ঘরমুখো হয়েছিলেন তিনি। এরই মধ্যে রমজানে
করেছেন ‘এতেকাফ’। ধর্মের প্রতি হয়েছেন অনুরক্ত। আগের ভুল শুধরে নিজে হয়েছেন
‘ক্ষমতাহীন কামরান’। কিন্তু তাতে কি? কামরান তো দমার পাত্র নয়। আড়মোড়া
ভেঙে যে জেগে ওঠা যায় সেটির প্রমাণ দিতে শুরু করছেন এবার। নীরব কামরান ফের
হয়ে উঠেছেন সরব। চলে এসেছেন ফ্রন্টলাইনে। চিরচেনা নগরভবনের সিংহাসন হারালেও
দল ও সিলেটের প্রয়োজনে হয়ে উঠেছেন প্রয়োজনীয়। কামরান এখনও ফ্যাক্টর।
কামরান পারেন সব কিছুই। সেটি সিলেটের শহীদ মিনার উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে
প্রমাণ করলেন তিনি। এই মুহূর্তে অনেকটা অন্তরালে সিলেট সিটি করপোরেশনের
বিএনপি দলীয় মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএসএম কিবরিয়া
হত্যা মামলার চার্জশিটে আসামি হওয়ার পর অনেকটা নিভৃতে রয়েছেন তিনি। ক্ষমতা,
শক্তি সব থাকলেও মেয়র আরিফ সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে নির্মিত শহীদ মিনারের
জমকালো উদ্বোধনে নায়ক সাজতে পারলেন না। এই ফাঁকে সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন
আহমদ কামরান নজর কাড়লেন সবার। ২০১৩ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি সিলেট কেন্দ্রীয়
শহীদ মিনার তৌহিদি জনতার মিছিল থেকে ভাঙচুর করা হয়। সেই সময় নতুনভাবে শহীদ
মিনার নির্মাণের দাবি উঠেছিল। বুধবার রাতে শহীদ মিনারে সুধী সমাবেশে
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজেই বলেছেন, শহীদ মিনারের
পুনর্নির্মাণের দাবিটি বাস্তব রূপ দেয়ার সুবিধা করে দিয়েছিলেন কামরান।
কারণ, তখন কামরান ছিলেন নগর পিতা। এ কারণে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগেই শহীদ
মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। পরবর্তীকালে নির্বাচনে হেরে গেলেও সিলেটের
মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী নির্মাণকাজ এগিয়ে নিতে সহায়তা করেন বলে অর্থমন্ত্রী
নিজেই জানিয়েছেন। শহীদ মিনারের কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরিফুল হক চৌধুরী
উপস্থিত ছিলেন। কাজ চলার সময়ও অর্থমন্ত্রী যখন শহীদ মিনার পরিদর্শন করেন
তখনও সেখানে ছিলেন। কিন্তু উদ্বোধনে থাকতে পারলেন না। তার হয়ে সিটি
করপোরেশনের সব কাজ করেছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনামুল হাবিব। আর শহীদ
মিনারের উদ্বোধনসহ সব কাজের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয় সাবেক মেয়র বদর
উদ্দিন আহমদ কামরানকে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতই তার হাতে সে
দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন
কামরান। এ কারণে অনুষ্ঠানের শেষের দিকে কামরান জানিয়েছিলেন, তাকে যে
দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সেটি তিনি পালনের চেষ্টা করেছেন। জ্ঞাতসারে কারও মনে
কোন দুঃখ দিতে চাননি। এখানেই শেষ নয়, নিজের ক্ষমতায় কামরান এবার
সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলীকে সিলেটের অনুষ্ঠানে উপস্থিত করেছেন। গত
৯ই আগস্ট সিলেটের একটি অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী
সাংবাদিকদের খবিশসহ নানা ভাষায় গালিগালাজ করেছিলেন। এতে সিলেটের সাংবাদিকরা
তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এরপর থেকে সৈয়দ মহসিন আলী সিলেটে আসছেন না। আর
সাংবাদিকরা তার নিউজ কাভার করা থেকে বিরত ছিলেন। এবার শহীদ মিনার উদ্বোধনের
বর্ণাঢ্য আয়োজনে সৈয়দ মহসিন আলীর উপস্থিতি অনুভব করেন আয়োজকরা। খোদ আওয়ামী
লীগের সিনিয়র নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে মহসিন আলীর দূরত্ব কমাতে,
মান-অভিমান ভাঙাতে কামরানের কাঁধেই দায়িত্ব তুলে দেন। কামরানও এ নিয়ে সরব
হয়ে ওঠেন। তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে সিলেট জেলা প্রেস ক্লাব ও সিলেট প্রেস
ক্লাবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের সঙ্গে প্রথমে নিজেই বোঝাপড়া
করে মঙ্গলবার রাতে সৈয়দ মহসিন আলীকে নিয়ে প্রথমে জেলা প্রেস ক্লাবে আসেন।
সেখানে মতবিনিময় করার পর সিলেট প্রেস ক্লাবেও মতবিনিময় করেন। আর এ সভাগুলোয়
সৈয়দ মহসিন আলী বেফাঁস মন্তব্যের জন্য নিজেই ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যদিও
এই ক্ষমা চাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেকটা সমালোচিত হয়েছেন কামরান। এর
পরও বুধবার সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার উদ্বোধনের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে তিনি
সৈয়দ মহসিন আলীকে উপস্থিত রাখতে পেরেছেন। মহসিন আলী ক্ষমা চাওয়ার পর আর
বাধা হয়ে দাঁড়ালেন না সাংবাদিকরা। সাংবাদিকদের সঙ্গে কামরানের অন্তরঙ্গ
সম্পর্ক থাকার কারণে চার মাসের ক্ষোভ একদিনেই প্রশমিত হয়েছে বলে মনে করেন
সাংবাদিকরা। আর এতে কামরানকে সহায়তা করেছেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ
সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী। সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে
সম্বয়কের দায়িত্বে থাকা কামরান শুধু অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন না, ভাষা
আন্দোলনের একটি গান গেয়েও তিনি দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। আর তার এই গান শুনে
পরবর্তী বক্তা সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর নিজেই বলেছেন, এত সুরের
গানের পর আর বক্তৃতা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ওই অনুষ্ঠান কামরান শুরু করার
পর সমাজকল্যাণমন্ত্রীও গান গেয়ে সবাইকে বিমোহিত করেন। এ কারণে অনুষ্ঠানে
শেষে অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করলেন, সাড়ে তিন ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানে শুধু
বক্তৃতাই ছিল না, ছিল গান, আবৃত্তিও। এ কারণে বসে থাকতে খারাপ লাগেনি।
ব্যাকফুটে যাওয়া কামরান আবার ফ্রন্টফুটে। তিনি সরব হয়ে উঠেছেন। কেবল
যাচ্ছেন না নগর ভবনে। কিন্তু আগের মতোই প্রতি দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত
থাকছে ব্যস্ততা। প্রতিদিন ২ থেকে ৩টি অনুষ্ঠানে তাকে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে।
আর আরিফুল হক চৌধুরীর অনুপস্থিতিতে তিনিই এখন একাই সামলাচ্ছেন সামাজিক
কর্মকাণ্ড।
No comments