পাকিস্তানের সামরিক গণতন্ত্র by এম সাখাওয়াত হোসেন
পাকিস্তানের গণতন্ত্র পুনরায় একটি
চৌরাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। ইমরান খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান তেহরিক-ই–ইনসাফ
(পিটিআই) এবং প্রবাসী ধর্মীয়-রাজনৈতিক নেতা তাহির-উল কাদরির সমর্থকেরা
এখনো সুরক্ষিত রাজধানী ইসলামাবাদের রেড জোন দখল করে রেখেছে। ইমরান-কাদরি
জুটি হয়তো মিসরের তাহরির স্কয়ারই বানাতে চেয়েছেন ইসলামাবাদের রেড জোনকে।
তাঁদের দাবি, ২০১৩ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে অধিষ্ঠিত
প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে পদত্যাগ করে নতুন নির্বাচন দিতে হবে। যদিও
ইমরান খানের দল খাইবার পাখতুনখাওয়াতে প্রাদেশিক সরকার গঠন করে প্রায় এক বছর
ক্ষমতায় রয়েছে, তথাপি ইমরান খান ভোটে কারচুপির দাবি থেকে পিছে সরে আসছেন
না। অবশ্য ২০১৩ সালের নির্বাচন বিশ্বে প্রশংসিত হলেও ওই সময়েও মি. খান দাবি
তুলেছিলেন ভোট পুনর্গণনার, কিন্তু সে দাবি দাবিই থেকে যায়। তাঁর
ভাষ্যমতে, তিনি তাঁর অভিযোগের বিষয়টি বিভিন্ন সংস্থায় উত্থাপিত করলেও
কোনো জায়গা, এমনকি কোর্ট থেকে ইতিবাচক সাড়া না পাওয়ায় রাস্তায় নেমেছেন।
কাদরিও সমর্থকদের নিয়ে ইমরান খানের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একাত্মতা
ঘোষণা করেছেন।
ইমরান খানের একধরনের অভ্যুত্থানের চেষ্টায় কতখানি রাজনৈতিক সমর্থন রয়েছে, তা নিরূপণ করতেই পাকিস্তান পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ বিশেষ অধিবেশনে বসেছিল। সেখানে বিভিন্ন দল, পাকিস্তান পিপলস পার্টিসমেত (পিপিপি) নওয়াজ শরিফের নির্বাচিত সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী থেেক শুরু করে বেশির ভাগ পত্রপত্রিকা ওই দেশে একটি নির্বাচিত সরকারকে সংসদে তৃতীয় স্থানে থাকা একটি দল দিয়ে উৎখাতের চেষ্টাকে সমর্থন করেনি। তাদের সমর্থনের কারণ নওয়াজপ্রীতি নয়, বরং অন্য আশঙ্কা। আশঙ্কাটা পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর পুনরায় ক্ষমতা দখল করার আশঙ্কা নিয়ে। যদিও এখন পর্যন্ত সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে সে ধরনের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি, তথাপি এমন আশঙ্কা জনমন থেকে তিরোহিত হচ্ছে না।
প্রশ্ন উঠেছে যে একদার চৌকস ক্রিকেটার, ফাস্ট বোলার, রাজনীতির মাঠে এই সময় আউট সুইঙ্গার কেন মারলেন? এর পেছনে অনেক কারণের মধ্যে তাঁর ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। অন্যদিকে দ্বিতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পারিবারিক এবং দলের সদস্যদের দুর্নীতি, শাসনগত অব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, বেকারত্ব এবং ওয়াজিরিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব ইত্যাদি কারণে তাঁর নিজের দলের জনসমর্থন কমেছে। নওয়াজ শরিফের দল পরিচালনা নিয়েও হতাশ তাঁরই সহযোগীরা।
পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দলেই গণতন্ত্র নেই। অতীতেও ছিল না। দলগুলো চলছে একনায়কতন্ত্রে। এমনকি নওয়াজ শরিফের দলের নাম মুসলিম লীগ হলেও তার সঙ্গে যুক্ত নওয়াজ শরিফের নামের আদি অক্ষর ‘এন’ (পিএমএল-এন)। পিটিআই অথবা এমকিউএম অথবা পাকিস্তান পিপলস পার্টিরও একই অবস্থা। এর উদাহরণ পিটিআইয়ের প্রেসিডেন্ট বর্ষীয়ান নেতা জাভেদ হাশমির একাধিকবার প্রচারিত সাক্ষাৎকার এবং সংসদে তাঁর বক্তব্য। তিনি অভিযোগ করেন যে দলের নীতিনির্ধারকদের দ্বিমত সত্ত্বেও ইমরান খানের একক সিদ্ধান্তে পাকিস্তান টেলিভিশন স্টেশন দখল এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে হামলা হয়েছে, যা পিটিআইয়ের আন্দোলনকে শুধু দুর্বলই করেনি, জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ারও জন্ম দিয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, পাকিস্তানের এই সমস্যা সৃষ্টির কারণ দৃশ্যত ইমরান-কাদরি জুটির মিসরের মতো অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা হলেও এর পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী পক্ষ। ধারণা করা হচ্ছিল যে ইমরান খানের পেছনে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পরোক্ষ সমর্থন ছিল বা এখনো কিছুটা রয়েছে। এমন ইঙ্গিত ইমরান খানের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মানও হয়েছে। নওয়াজ শরিফের ইসলামাবাদ থেকে লাহোরে অবস্থানও এ ধরনের ইঙ্গিত বহন করেছে। স্মরণযোগ্য যে এর আগেও একবার নওয়াজ শরিফকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষমতাচ্যুত করেছিল; যার জের এখনো চলছে।
নওয়াজ শরিফ প্রতিবারই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। প্রতিবারই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এবারও তিনি যদি ক্ষমতাচ্যুত না-ও হন, তবে সামরিক বাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকবেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যেসব বিষয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, সেখানে বেসামরিক সরকারের প্রবেশ নিষেধ। নওয়াজ শরিফ তাঁর প্রথম সরকারের সময়ও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মোশাররফ দ্বারা উৎখাত হয়েছিলেন। তিনি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন মোশাররফের পূর্বসূরিকে অবসর প্রদান নিয়ে, এমনকি খোদ মোশাররফের সঙ্গেও কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন। মোশাররফ ওই সময় কাশ্মীর ইস্যুতে নওয়াজ শরিফের অবস্থান সমর্থন করেননি। বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে নওয়াজ শরিফের অকার্যকারিতা সামরিক বাহিনীকে উৎসাহ জুগিয়েছে মধ্যস্থতা করার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং এমন পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনী নওয়াজ শরিফকে ব্ল্যাকমেল করতে সক্ষম হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তিনটি বিষয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এগুলো হলো, পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ, আফগান নীতি এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক। অতীতেও নওয়াজ শরিফের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর এসব প্রশ্নেই টানাপোড়েন ছিল। মোদির আমন্ত্রণে নওয়াজ শরিফের দিল্লি গমন সহজে হজম করেনি পিন্ডির সামরিক বাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টার (জিএইচকিউ)। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মীর প্রধান অন্তরায় হয়ে থাকবে, যার রাজনৈতিক সমাধানে সামরিক নীতিনির্ধারকেরা কিছুতেই সম্মত নন। নওয়াজ শরিফ প্রথমবার ক্ষমতায় থাকার সময়েই তাঁরই অজান্তে কার্গিল যুদ্ধ ঘটিয়েছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মোশাররফ, সে কথা কারও অজানা নয়। এবারও কাশ্মীর আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ঠিক ওই সময়ে, যখন পাকিস্তান রাজনৈতিক ডামাডোলে রয়েছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ।
আফগান নীতি সামরিক বাহিনী তার এখতিয়ারের মধ্যেই রাখবে। সে কারণেই ওয়াজিরিস্তানের সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজছিল। ইমরান খান এই আলোচনায় সমর্থন জানালেও নওয়াজ শরিফ বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। এখনো ওই অঞ্চলে সামরিক অভিযান চলছে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর। পাখতুনদের বিরাগভাজন হতে হচ্ছে তাদের। স্মরণযোগ্য যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম সদস্যসংখ্যা পাঠান ও বেলুচ। সমস্যা হচ্ছে, এই দুই সম্প্রদায়ের সৈনিকদের ওয়াজিরিস্তানে নিয়োগ নিয়ে; এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে জেনারেলদের মধ্যে। অন্যদিকে আফগানিস্তানে ভারত-পাকিস্তানের টানাপোড়েন একরকম উন্মুক্ত। পাকিস্তানের সামরিক প্রভাবিত নীতিনির্ধারকেরা কাবুলে পশতুন শাসক ছাড়া অন্যদের গ্রহণ করবেন না। অনেকে মনে করেন, হালে আফগানিস্তানের নির্বাচনে যে ফলাফল হয়েছে, তার মাধ্যমে পাকিস্তানের আফগান নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অন্যদিকে তালেবানদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগের পেছনেও পাকিস্তানের ‘অদৃশ্য সরকারের’, আইএসআইয়ের প্রভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও পাকিস্তানের অবস্থান অগ্রাহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না।
২০১৩ সালের আগের জারদারি সরকারকেও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়েই পাঁচ বছর কাটাতে হয়েছে। অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেন হত্যার খবর এবং পরিকল্পনা পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা, আইএসআই জানলেও জারদারিকে আগে জানানো হয়নি। জারদারিও ছিলেন একধরনের চাপের মধ্যে। জারদারি সরকার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ফর্মুলার বাইরে যেতে পারেনি।
ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বেসামরিক রাজনৈতিক সরকার অধিকতর সহযোগিতার পথ যতবার খুঁজেছে, প্রতিবারই ওই পথ কাশ্মীর ইস্যুতে আটকে গিয়েছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর শক্তি হচ্ছে ভারতবিরোধিতা, বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যু। তিন-তিনবার পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কাশ্মীরে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ঘোষিত যুদ্ধের বাইরেও থেমে থাকেনি সংঘর্ষ। পাকিস্তানের ৬৭ বছরের ইতিহাসে সামরিক বা বেসামরিক এমন কোনো সরকার ছিল না, যারা কাশ্মীর বিষয়ে নমনীয় অথবা সমস্যা সমাধানের রাস্তায় হাঁটতে পেরেছে।
নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অসন্তোষের শেষ কারণ হিসেবে অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফের বিচার। মোশাররফকে নিয়ে এ ধরনের টানাহেঁচড়া তাঁর অনুসারীরা সহজে নিয়েছে বলে মনে হয় না। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ জেনারেল পারভেজ মোশাররফের অনুরক্ত বলেই পরিচিত। মোশাররফ জেনারেল শরিফকে প্রমোশন দিয়ে লাহোরে ডিভিশন কমান্ডে রেখেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে লক্ষণীয় হবে, নওয়াজ সরকার মোশাররফের বিচারিক কর্মকাণ্ডকে কীভাবে সামাল দেয়।
যা হোক, পাকিস্তানে রাজনৈতিক নতৃত্ব এবং দলের দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও প্রায় সব দল এখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, যদিও ইমরান খান ও তাহির-উল কাদরি ছিটকে পড়েছেন। তবে সামরিক বাহিনীর অংশীদারত্ব ছাড়া পাকিস্তানের তথাকথিত গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার মতো বেসামরিক নেতৃত্ব অতীতেও ছিল না এবং নিকট ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে ইমরান খান একটি নির্বাচিত দলের প্রধান হয়ে ব্যবহৃত হচ্ছেন বলে মনে করা অযৌক্তিক নয়। পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক ডামাডোলে লাভবান হয়েছে পাকিস্তান সামরিক চক্র। ওই দেশে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ হয়তো আপাতত হবে না, কিন্তু অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে বেসামরিক সরকারকে সামরিক বাহিনীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এবং যে দেশে গণন্ত্রের মূলধারার চর্চা না থাকে, সেসব দেশে সামরিক বাহিনীর প্রভাব বাড়তে থাকে। সে প্রভাব কাটিয়ে ওঠা খুব দুষ্কর হয়ে ওঠে। মিসর আর পাকিস্তান তার জ্বলন্ত উদাহরণ। নওয়াজ শরিফের সরকারকে সে দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একধরনের সমঝোতার মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে। থাকতে হবে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র নিয়ে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
ইমরান খানের একধরনের অভ্যুত্থানের চেষ্টায় কতখানি রাজনৈতিক সমর্থন রয়েছে, তা নিরূপণ করতেই পাকিস্তান পার্লামেন্টের উভয় কক্ষ বিশেষ অধিবেশনে বসেছিল। সেখানে বিভিন্ন দল, পাকিস্তান পিপলস পার্টিসমেত (পিপিপি) নওয়াজ শরিফের নির্বাচিত সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এমনকি পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী থেেক শুরু করে বেশির ভাগ পত্রপত্রিকা ওই দেশে একটি নির্বাচিত সরকারকে সংসদে তৃতীয় স্থানে থাকা একটি দল দিয়ে উৎখাতের চেষ্টাকে সমর্থন করেনি। তাদের সমর্থনের কারণ নওয়াজপ্রীতি নয়, বরং অন্য আশঙ্কা। আশঙ্কাটা পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর পুনরায় ক্ষমতা দখল করার আশঙ্কা নিয়ে। যদিও এখন পর্যন্ত সামরিক বাহিনী প্রকাশ্যে সে ধরনের কোনো ইঙ্গিত দেয়নি, তথাপি এমন আশঙ্কা জনমন থেকে তিরোহিত হচ্ছে না।
প্রশ্ন উঠেছে যে একদার চৌকস ক্রিকেটার, ফাস্ট বোলার, রাজনীতির মাঠে এই সময় আউট সুইঙ্গার কেন মারলেন? এর পেছনে অনেক কারণের মধ্যে তাঁর ক্ষমতার শীর্ষে অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। অন্যদিকে দ্বিতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পারিবারিক এবং দলের সদস্যদের দুর্নীতি, শাসনগত অব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, বেকারত্ব এবং ওয়াজিরিস্তান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব ইত্যাদি কারণে তাঁর নিজের দলের জনসমর্থন কমেছে। নওয়াজ শরিফের দল পরিচালনা নিয়েও হতাশ তাঁরই সহযোগীরা।
পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক দলেই গণতন্ত্র নেই। অতীতেও ছিল না। দলগুলো চলছে একনায়কতন্ত্রে। এমনকি নওয়াজ শরিফের দলের নাম মুসলিম লীগ হলেও তার সঙ্গে যুক্ত নওয়াজ শরিফের নামের আদি অক্ষর ‘এন’ (পিএমএল-এন)। পিটিআই অথবা এমকিউএম অথবা পাকিস্তান পিপলস পার্টিরও একই অবস্থা। এর উদাহরণ পিটিআইয়ের প্রেসিডেন্ট বর্ষীয়ান নেতা জাভেদ হাশমির একাধিকবার প্রচারিত সাক্ষাৎকার এবং সংসদে তাঁর বক্তব্য। তিনি অভিযোগ করেন যে দলের নীতিনির্ধারকদের দ্বিমত সত্ত্বেও ইমরান খানের একক সিদ্ধান্তে পাকিস্তান টেলিভিশন স্টেশন দখল এবং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে হামলা হয়েছে, যা পিটিআইয়ের আন্দোলনকে শুধু দুর্বলই করেনি, জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ারও জন্ম দিয়েছে।
অনেকেই মনে করেন, পাকিস্তানের এই সমস্যা সৃষ্টির কারণ দৃশ্যত ইমরান-কাদরি জুটির মিসরের মতো অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা হলেও এর পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী পক্ষ। ধারণা করা হচ্ছিল যে ইমরান খানের পেছনে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পরোক্ষ সমর্থন ছিল বা এখনো কিছুটা রয়েছে। এমন ইঙ্গিত ইমরান খানের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মানও হয়েছে। নওয়াজ শরিফের ইসলামাবাদ থেকে লাহোরে অবস্থানও এ ধরনের ইঙ্গিত বহন করেছে। স্মরণযোগ্য যে এর আগেও একবার নওয়াজ শরিফকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষমতাচ্যুত করেছিল; যার জের এখনো চলছে।
নওয়াজ শরিফ প্রতিবারই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। প্রতিবারই তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এবারও তিনি যদি ক্ষমতাচ্যুত না-ও হন, তবে সামরিক বাহিনীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে থাকবেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যেসব বিষয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, সেখানে বেসামরিক সরকারের প্রবেশ নিষেধ। নওয়াজ শরিফ তাঁর প্রথম সরকারের সময়ও তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মোশাররফ দ্বারা উৎখাত হয়েছিলেন। তিনি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন মোশাররফের পূর্বসূরিকে অবসর প্রদান নিয়ে, এমনকি খোদ মোশাররফের সঙ্গেও কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন। মোশাররফ ওই সময় কাশ্মীর ইস্যুতে নওয়াজ শরিফের অবস্থান সমর্থন করেননি। বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে নওয়াজ শরিফের অকার্যকারিতা সামরিক বাহিনীকে উৎসাহ জুগিয়েছে মধ্যস্থতা করার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে। রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং এমন পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনী নওয়াজ শরিফকে ব্ল্যাকমেল করতে সক্ষম হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তিনটি বিষয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এগুলো হলো, পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ, আফগান নীতি এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক। অতীতেও নওয়াজ শরিফের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর এসব প্রশ্নেই টানাপোড়েন ছিল। মোদির আমন্ত্রণে নওয়াজ শরিফের দিল্লি গমন সহজে হজম করেনি পিন্ডির সামরিক বাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টার (জিএইচকিউ)। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাশ্মীর প্রধান অন্তরায় হয়ে থাকবে, যার রাজনৈতিক সমাধানে সামরিক নীতিনির্ধারকেরা কিছুতেই সম্মত নন। নওয়াজ শরিফ প্রথমবার ক্ষমতায় থাকার সময়েই তাঁরই অজান্তে কার্গিল যুদ্ধ ঘটিয়েছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মোশাররফ, সে কথা কারও অজানা নয়। এবারও কাশ্মীর আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ঠিক ওই সময়ে, যখন পাকিস্তান রাজনৈতিক ডামাডোলে রয়েছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মাথাব্যথার কারণ।
আফগান নীতি সামরিক বাহিনী তার এখতিয়ারের মধ্যেই রাখবে। সে কারণেই ওয়াজিরিস্তানের সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজছিল। ইমরান খান এই আলোচনায় সমর্থন জানালেও নওয়াজ শরিফ বিভিন্ন কারণে পিছিয়ে গিয়েছিলেন। এখনো ওই অঞ্চলে সামরিক অভিযান চলছে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর। পাখতুনদের বিরাগভাজন হতে হচ্ছে তাদের। স্মরণযোগ্য যে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম সদস্যসংখ্যা পাঠান ও বেলুচ। সমস্যা হচ্ছে, এই দুই সম্প্রদায়ের সৈনিকদের ওয়াজিরিস্তানে নিয়োগ নিয়ে; এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে জেনারেলদের মধ্যে। অন্যদিকে আফগানিস্তানে ভারত-পাকিস্তানের টানাপোড়েন একরকম উন্মুক্ত। পাকিস্তানের সামরিক প্রভাবিত নীতিনির্ধারকেরা কাবুলে পশতুন শাসক ছাড়া অন্যদের গ্রহণ করবেন না। অনেকে মনে করেন, হালে আফগানিস্তানের নির্বাচনে যে ফলাফল হয়েছে, তার মাধ্যমে পাকিস্তানের আফগান নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অন্যদিকে তালেবানদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগের পেছনেও পাকিস্তানের ‘অদৃশ্য সরকারের’, আইএসআইয়ের প্রভাব রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও পাকিস্তানের অবস্থান অগ্রাহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না।
২০১৩ সালের আগের জারদারি সরকারকেও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়েই পাঁচ বছর কাটাতে হয়েছে। অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেন হত্যার খবর এবং পরিকল্পনা পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা, আইএসআই জানলেও জারদারিকে আগে জানানো হয়নি। জারদারিও ছিলেন একধরনের চাপের মধ্যে। জারদারি সরকার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ফর্মুলার বাইরে যেতে পারেনি।
ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বেসামরিক রাজনৈতিক সরকার অধিকতর সহযোগিতার পথ যতবার খুঁজেছে, প্রতিবারই ওই পথ কাশ্মীর ইস্যুতে আটকে গিয়েছে। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর শক্তি হচ্ছে ভারতবিরোধিতা, বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যু। তিন-তিনবার পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কাশ্মীরে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ঘোষিত যুদ্ধের বাইরেও থেমে থাকেনি সংঘর্ষ। পাকিস্তানের ৬৭ বছরের ইতিহাসে সামরিক বা বেসামরিক এমন কোনো সরকার ছিল না, যারা কাশ্মীর বিষয়ে নমনীয় অথবা সমস্যা সমাধানের রাস্তায় হাঁটতে পেরেছে।
নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অসন্তোষের শেষ কারণ হিসেবে অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফের বিচার। মোশাররফকে নিয়ে এ ধরনের টানাহেঁচড়া তাঁর অনুসারীরা সহজে নিয়েছে বলে মনে হয় না। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ জেনারেল পারভেজ মোশাররফের অনুরক্ত বলেই পরিচিত। মোশাররফ জেনারেল শরিফকে প্রমোশন দিয়ে লাহোরে ডিভিশন কমান্ডে রেখেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে লক্ষণীয় হবে, নওয়াজ সরকার মোশাররফের বিচারিক কর্মকাণ্ডকে কীভাবে সামাল দেয়।
যা হোক, পাকিস্তানে রাজনৈতিক নতৃত্ব এবং দলের দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও প্রায় সব দল এখন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, যদিও ইমরান খান ও তাহির-উল কাদরি ছিটকে পড়েছেন। তবে সামরিক বাহিনীর অংশীদারত্ব ছাড়া পাকিস্তানের তথাকথিত গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার মতো বেসামরিক নেতৃত্ব অতীতেও ছিল না এবং নিকট ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে ইমরান খান একটি নির্বাচিত দলের প্রধান হয়ে ব্যবহৃত হচ্ছেন বলে মনে করা অযৌক্তিক নয়। পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক ডামাডোলে লাভবান হয়েছে পাকিস্তান সামরিক চক্র। ওই দেশে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ হয়তো আপাতত হবে না, কিন্তু অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে বেসামরিক সরকারকে সামরিক বাহিনীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এবং যে দেশে গণন্ত্রের মূলধারার চর্চা না থাকে, সেসব দেশে সামরিক বাহিনীর প্রভাব বাড়তে থাকে। সে প্রভাব কাটিয়ে ওঠা খুব দুষ্কর হয়ে ওঠে। মিসর আর পাকিস্তান তার জ্বলন্ত উদাহরণ। নওয়াজ শরিফের সরকারকে সে দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একধরনের সমঝোতার মাধ্যমে টিকে থাকতে হবে। থাকতে হবে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র নিয়ে।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com
No comments