স্বপ্ন দেখতে মানা! by আনোয়ার হোসেন
ঝিরিনা মুন্ডাকে খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় ধানখেতে। তিনি তখন পরের জমিতে গ্রামের অন্য নারীদের সঙ্গে ধানের চারা রোপণ করছিলেন।
মজুরির বিনিময়ে তাঁর ধান বোনা, ধান কাটা, ধানখেতের আগাছা পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই। ভাত-কাপড় আর লেখাপড়ার খরচের জন্য এ ছাড়া কোনো উপায় ছিল না শিশু ঝিরিনার সামনে। বাবার স্মৃতি মনে নেই। তিনি যখন কেবল হাঁটতে শেখেন, তখনই দিনমজুর বাবা নগেন মুন্ডার মৃত্যু হয়। পরিবারে তিন বোন আর মা। বোনদের মধ্যে তিনি ছোট। এক বোন আবার দুই সন্তান নিয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এ অবস্থায় শিশুকাল থেকেই খেটে খাওয়া ছাড়া আর কি উপায় থাকতে পারে ঝিরিনার সামনে?
খেটে খাওয়া মা আরতি মুন্ডাও মাঝেমধ্যে ভেবেছেন বিয়ে দিয়েই একটা উপায় বের করার কথা। কিন্তু ঝিরিনার প্রবল আপত্তির মুখে মা আর ওমুখো হননি। লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে মা মেয়ের ইচ্ছাকে সম্মান দিতে বাধ্য হয়েছেন। অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে লেখাপড়ায় সম্মানজনক ফলাফলও অর্জন করতে পেরেছেন এই কর্মঠ আদিবাসী মেয়ে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল মহিলা ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী ঝিরিনা মানবিক বিভাগ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছেন। গত ১৩ আগস্ট এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়।
সম্প্রতি নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার রসুলপুর ইউপির বনগাঁ গ্রামে গিয়ে কথা হয় ঝিরিনা, তাঁর মা আরতি, মেজো বোন মিরিন, পাড়া-প্রতিবেশী ও গ্রামের মোড়ল রায়চরণ মুন্ডার সঙ্গে। আরতি জানান, ঝিরিনার হাঁটতে শেখার সময় স্বামী মারা যান। তার আগে তিনি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে তিন বছর পঙ্গু হয়ে বাড়িতে বসে ছিলেন। তখন থেকে অনাহার-অর্ধাহার আর দুঃখ-কষ্ট ছিল তাঁদের প্রতিদিনের সঙ্গী। প্রথমে বড় মেয়েকে নিয়ে খেতে-খামারে ও পরের বাড়িতে কাজ করে দিন চলত খেয়ে না খেয়ে। বড় মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পর মেজো মেয়ে, তারপর ঝিরিনাকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকার যুদ্ধে নামতে হয়েছে তাঁকে। মেজো মেয়ে মিরিনও কাজ করার পাশাপাশি লেখাপড়া করেছেন। তিনিও এখন নাচোল মহিলা কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে পড়েন। আর ঝিরিনাও অভাব-অনটন দেখতে দেখতেই বড় হচ্ছেন। তবে তিনি এটাও দেখছেন যে, তাঁর মেজো বোনও কাজ করার পাশাপাশি লেখাপড়া করেছেন মনোযোগ দিয়ে। কুপিবাতির আলোতেই পড়েছেন ওঁরা। ভাইদের সহযোগিতায় বছর খানেক আগে বিদ্যুৎ নিয়েছেন। মেজো মেয়ে লেখাপড়ায় খারাপ না হলেও ঝিরিনা তাঁর চেয়ে ভালো। কিন্তু ঝিরিনা তো ভালোভাবে পাস করলেন। এখন তিনি কী করবেন? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে থাকেন তাঁরা। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা মা আরতি, মেয়ে ঝিরিনা ও মিরিনা।
ঝিরিনা তুমি কী স্বপ্ন দেখো? এ প্রশ্নেও চুপচাপ। ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। মাথা নিচু করে থাকেন ঝিরিনা। তাঁর চোখের কোণ চিক চিক করে ওঠে।
নীরবতা ভেঙে মা আরতি মুন্ডা এবার বলেন, ‘হামরা গরিব আদিবাসী। বড় বড় স্বপনো কি হামরা দেখতে পারি। ভালো বিহা আসলে দিয়া দিব। আর এক বেটিও তো লিখাপড়া করছে, চাকরি তো পায় না। হামাদের গরিবের ছ্যালা-পিলাকি চাকরি পাইবে? অত লিখাপড়া কইর্যাই কী হোইবে?’
মিরিনা জানান, তাঁর মতো ঝিরিনাকেও শেষ পর্যন্ত নাচোল কলেজে ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হতে হবে। এ ছাড়া তো তাঁদের আর সামর্থ্য নেই। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোনো কোচিং সেন্টারে ভর্তি হতে পারেননি। এসব শুনে ঝিরিনা স্থান ত্যাগ করেন। চোখের জল গোপন করতেই হয়তোবা। তা ছাড়া তাঁকে তো আবার পরে জমিতে ধান বুনতে যেতে হবে। বাড়ির পাশে ধানখেত থেকে তাঁকে ডেকে নিয়ে আসা হয় কথা বলার জন্য।
প্রতিবেশীরা বলেন, বড়ই লক্ষ্মী আর মেধাবী মেয়ে ঝিরিনা। তিনি যদি সুযোগ পেতেন অনেক দূর যেতে পারতেন।
নাচোল মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ওবায়দুর রহমান বলেন, নাচোল উপজেলায় এই প্রথমবারের মতো একজন আদিবাসী মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলেন। অনেক দূর থেকে (১৮ কিমি) এসে ক্লাস করতেন। তাঁর উচ্চশিক্ষার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়াটা হবে খুবই দুঃখজনক।
No comments