দুর্নীতির দায়মুক্তি -আবুল হোসেনের মন্ত্রিত্ব ফিরিয়ে দিন by এ কে এম জাকারিয়া
পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ
ও দুদকের তদন্ত নিয়ে দুটি লেখা লিখেছিলাম বছর দুয়েক আগে। ‘দুদক পরীক্ষায়
পাস করবে তো?’ (প্রথম আলো, ১১ অক্টোবর, ২০১২) ও ‘পাস-ফেলের মাঝামাঝি
দুদক’ (প্রথম আলো, ৯ ডিসেম্বর ২০১২)। দুদক পাস করল কি ফেল করল, তাতে অবশ্য
এখন পদ্মা সেতুর কিছু আসে-যায় না। কারণ, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল যাঁদের
বিরুদ্ধে, তাঁদের প্রতি সরকারের মায়া-মমতা আর সরকারের প্রতি দেশের
‘স্বাধীন’ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আনুগত্য দেখে ত্যক্ত-বিরক্ত
বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকা বহু আগেই পদ্মা সেতু প্রকল্প ছেড়েছে।
দীর্ঘদিন পর যে ফল বের হলো, তাতে কি পাস করল দুদক? নাকি ডাহা ফেল! দুদকের ফেল করার ‘বিষয়’ শুধু পদ্মা সেতু নয়, দুর্নীতিতে সরকার ও সরকারি দলের লোকজন জড়িত আছে এমন কোনো বিষয়েই তারা সম্ভবত পাস করতে পারবে না। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র মামলায় সাত আসামিকে দায়মুক্তি দেওয়ার পরদিনই সরকারদলীয় সাংসদ আসলামুল হককে দায়মুক্তি দিল দুদক। ‘পুনর্যাচাই’ করার নাম করে পিছিয়ে দেওয়া হলো আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগের অনুসন্ধান।
‘পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে মামলা করা হয়। তবে মামলা-পরবর্তী ষড়যন্ত্রেরও কোনো প্রমাণ পাইনি আমরা।’ বেশ ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করেই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দিয়েছে দুদক। দুদকের চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বললেন, ‘বিশ্বব্যাংক দাবি করেছিল, পরামর্শক নিয়োগেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে। গণমাধ্যমেও এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়। পরে আমরা অনুসন্ধান শেষে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এ বিষয়ে একটি মামলা দায়ের করি। তবে মামলা-পরবর্তী তদন্তে আমরা দুর্নীতি বা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগের কোনো সত্যতা পাইনি।’ দুর্নীতি ষড়যন্ত্রের অভিযোগ থেকে সাত আসামির সবাই এখন মুক্ত। ‘তদন্তের আওতায় থাকা’ সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকে ধুয়ে-মুছে সাফসুতরো করে দিয়েছে দুদুকের এই দায়মুক্তি।
দুদক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কোনো নাম-গন্ধ না পাক, এ নিয়ে কিন্তু মামলা চলছে কানাডায়। এসব নিয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চাইবেন, প্রশ্ন করবেন এটাই স্বাভাবিক। সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন দুদকের কমিশনার (তদন্ত) মো. সাহাবুদ্দিন। তিনি ব্যাখ্যা দিলেন এভাবে: ‘কানাডার মামলাটি হচ্ছে, এসএনসি-লাভালিনের করা স্পিড মানির তহবিল, যা দিয়ে তৃতীয় বিশ্বে কাজ বাগানো হয়। আর আমাদেরটি হচ্ছে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র করা নিয়ে। দুটি ভিন্ন বিষয়।’ কানাডার মামলা নিয়ে কী আজগুবি তথ্যই না তিনি দিলেন! মনে প্রশ্ন জাগে, তিনি কি না জেনে এসব বললেন, নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে অসত্য তথ্য দিলেন?
পাঠকদের উদ্দেশে বলি, এসএনসি-লাভালিন নিয়ে কানাডার আদালতে যে মামলাটি বিচারাধীন, সেটি পদ্মা সেতুর দুর্নীতি ষড়যন্ত্রসংক্রান্ত মামলা। এই মামলায় পদ্মা সেতু প্রকল্পে কানাডীয় কোম্পানি এসএনসি-লাভালিন কোনো দুর্নীতির ষড়যন্ত্রে জড়িত আছে কি না, সেটাই বিবেচনা করা হচ্ছে। তৃতীয় বিশ্বের অন্য কোথায় লাভালিন ‘স্পিড মানি’ দিয়েছে কি দেয়নি, সেটা আদৌ বিবেচনার বিষয় নয়। এই মামলা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে দুদকের আইনজীবী হিসেবে বর্তমান আইনমন্ত্রী দুই-দুবার কানাডা ঘুরে এসেছেন। দুদক কমিশনার, যাঁর পদবির ব্রাকেটে ‘তদন্ত’ বিষয়টি রয়েছে, তিনি না জেনে ভুল তথ্য দিয়েছেন, এটা বিশ্বাস করি কী করে!
তবে বিশ্বব্যাংক ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে যখন এসএনসি-লাভালিনকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে, তখন কোম্পানিটির বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘অসদাচরণের’ অভিযোগের পাশাপাশি কম্বোডিয়ায় বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট একটি প্রকল্পে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, এসএনসি-লাভালিন ইনকরপোরেটের শতাধিক প্রতিষ্ঠান ১০ বছরের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বাস্তবায়ন হবে এমন কোনো প্রকল্পে কোনোভাবেই জড়িত থাকতে পারবে না। (বিশ্বব্যাংকের বিবৃতি, ১৮ এপ্রিল, ২০১৩)।
এটা স্পষ্ট যে মূলত বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে ‘অসদাচরণের’ কারণেই লাভালিনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কম্বোডিয়ার দুর্নীতির বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এই এত বড় শাস্তি লাভালিন শুধু মেনেই নেয়নি, বিবৃতি দিয়ে দুর্নীতির কথা স্বীকারও করেছে। বিশ্বব্যাংক ও লাভালিনের মধ্যে এ নিয়ে একটি সমঝোতা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্ট লিওনার্দ ম্যাকার্থি তখন তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আশা করি এসএনসি–লাভালিন তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পে প্রতারণা ও দুর্নীতির ঝুঁকি কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।’ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলে কি লাভালিন বিশ্বব্যাংকের ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়ে তাদের সঙ্গে সমঝোতায় আসত? বা সামনে উন্নয়ন প্রকল্পে প্রতারণা ও দুর্নীতির ঝুঁকি কমানোর পদক্ষেপ নেওয়ার ‘প্রতিশ্রুতি’ দিত?
বিশ্বব্যাংক ও লাভালিনের মধ্যে এই সমঝোতার দুই দিন পর (২০ এপ্রিল, ২০১৩) কানাডার আদালতও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ করেছে। তদন্ত ও বিচারপূর্ব কয়েক দফা শুনানির পর কানাডার অন্টারিয়র কোর্ট অব জাস্টিস আগামী বছরের (২০১৫) ১৩ এপ্রিল পদ্মা সেতু দুর্নীতি ষড়যন্ত্র মামলার বিচার শুরুর দিন ঠিক করেছে। তদন্ত ও বিচারপূর্ব শুনানিতে যদি বিচারযোগ্য বিবেচিত না হতো, তবে মামলা শুরুর তারিখ দেওয়া হোত না। এসএনসিলাভালিনের যে তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হচ্ছে, তাঁদের সবাই দুদকের তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। পাঠকদের অনেকের হয়তো স্মরণে আছে, ২০১২ সালের শেষের দিকে প্রাথমিক অনুসন্ধানের কাজ শেষ হওয়ার পর দুদক কিন্তু দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের তথ্য পাওয়ার কথা স্বীকার করেছিল। ‘তখন’ আর ‘এখন’-এর এই ফারাক কেন? অনুমান করি, দুদকের এই অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া তখন বিশ্বব্যাংকের নিয়োজিত আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল পর্যবেক্ষণ করছিল আর বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে টাকাপয়সা পাওয়ার আশা যে তখনো টিকে ছিল! এখন তো সবই গেছে, ‘তখন’-এর সঙ্গে এই হচ্ছে ফারাক।
দুদক কেন দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কোনো সত্যতা পেল না, তা আমরা অনুমান করতে পারি। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সরকারের পছন্দের লোক। দুর্নীতিতে জড়িত অভিযোগ ওঠার পর যখন সরকারের তরফ থেকে কাউকে ‘দেশপ্রেমিকের’ সনদ দেওয়া হয়, তখন আমাদের মতো দেশে দুদক কী-ই বা করতে পারে! নামের আগে আমরা যতই ‘স্বাধীন’ শব্দটি ব্যবহার করি না কেন! তবে দুদক শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দায়মুক্তিই দেয়নি, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগটিকে উদ্দেশ্যমূলক বলেও মনে করছে তারা। দুদক কমিশনার বলেছেন, ‘টু বি ফ্রাঙ্ক, সামথিং ওয়াজ দেয়ার।’ দুদকের একজন কমিশনার যদি এমন মনে করে থাকেন, তবে এই ‘সামথিং’ বিষয়টি কী, তা তো আমাদের জানা দরকার।
অবশ্য অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর তরফেও আগে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ তোলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী সংসদে অভিযোগ করেছেন, সিআরসিসি নামে একটি চীনা কোম্পানিকে প্রাক্যোগ্যতায় গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনার জন্য বিশ্বব্যাংক তিন-তিনবার পরামর্শ দেয়। (প্রথম আলো, ৩ জুলাই ২০১২) প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, ‘একটি বিশেষ কোম্পানিকে কাজ দিতে বিশ্বব্যাংক তিনবার চিঠি দেয়, পরে জানা যায় যে সেই কোম্পানি ভুয়া। (৫ জুলাই, ২০১২)।
দুনিয়াজুড়ে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ নতুন কিছু নয়। এসব অভিযোগ তদন্তে একটি স্বাধীন ইন্টিগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি (আইএনটি) কাজ করছে সেই ২০০১ সাল থেকে। আইএনটি বিশ্বব্যাংকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অনিয়মেরও তদন্ত করে থাকে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ বিশ্বব্যাংক করেছে তা যদি উদ্দেশ্যমূলক হয়ে থাকে, বিশ্বব্যাংক যদি কোনো ভুয়া কোম্পানির পক্ষে দালালি করে থাকে, তবে বাংলাদেশ আইএনটির কাছে অভিযোগ করছে না কেন! সরকারের দুর্বলতা কোথায়? সংসদে, সংবাদ সম্মেলনে এ ধরনের কথা বলে কী লাভ?
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই’—এই প্রচলিত ধারণা যে বাংলাদেশে খাটবে না, সেটা আমরা বুঝে গেছি। যেকোনো মামলার তদন্ত, অনুসন্ধান ইত্যাদি কাজে দুদকের অনেক অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হয়। দুদকের উদ্দেশে তাই বলি, খামোখা তাঁদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান, তদন্ত—এসব বাদ দিন। তাতে অন্তত কিছু অর্থ ও সময়ের সাশ্রয় হবে। আমাদের দেশে দুদক বরং শুধু আগের ক্ষমতাসীন সরকারের কারা দুর্নীতি করেছে, সেটাই দেখুক! তাঁদের শাস্তি নিশ্চিত করুক। এখন যাঁরা ‘বর্তমান’, তাঁরা যদি কোনো দিন ‘অতীত’ হন, তখন নাহয় এসব বিচার, তদন্ত করা যাবে।
দুদক তার দায়িত্ব পালন করছে। সরকারের পছন্দের লোকজন পদ্মা সেতুর ষড়যন্ত্র মামলা থেকে দায়মুক্তি পেয়েছেন। এখন সরকারের উচিত তার দায়িত্ব পালন করা। সরকারের হয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের কাজ করতে গিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এত দিন যে ‘কলঙ্কের দায়ভার’ নিতে হলো, তার ক্ষতিপূরণ দেওয়া। সসম্মানে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত তাঁদের পদ–পদবিও। দুদকের তদন্তে যিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেন, সেই সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন এখন কোন দোষে মন্ত্রিত্বের বাইরে থাকবেন!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments