বিনিয়োগে ভারতের পিছিয়ে থাকা by আসজাদুল কিবরিয়া

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশের একটা বড় আকুতির জায়গা। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য নানা ধরনের নীতি-সমর্থন দেওয়ার পরও তা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উপনীত হয়নি। বছরে এখনো আমরা ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আনতে সক্ষম হইনি। ২০০৮ সালে প্রথম শতকোটি ডলারের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ দেশে আসে। তারপর দুই বছর তা ছিল শতকোটি ডলারের নিচে। এরপর প্রতিবছরই শতকোটি (এক বিলিয়ন) ডলারের বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। আর এই বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নিকটতম প্রতিবেশী ভারত অনেক পিছিয়ে আছে। বলা যায়, বাংলাদেশে মোট বিদেশি বিনিয়োগের ৫ শতাংশও ভারত থেকে আসে না। কিংবা ভারতীয় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারছে না বাংলাদেশ।

অথচ নিকটতম প্রতিবেশী এবং এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারত থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বিনিয়োগ বোর্ডের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৮৪টি বিনিয়োগের প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়েছে, যার মধ্যে ৮৬টি পুরোপুরি ভারতীয় আর ১৯৮টি যৌথ উদ্যোগ। প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ মোট ২৮৮ কোটি ডলার। বাস্তব চিত্র অবশ্য ভিন্ন। গত পাঁচ বছরে প্রায় ১৭ কোটি ডলারের প্রকৃত ভারতীয় বিনিয়োগ এ দেশে এসেছে। এ থেকেই বোঝা যায় যে ভারতীয় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এখনো তেমন আগ্রহী হয়ে ওঠেননি। প্রাথমিকভাবে সম্ভাবনা দেখে প্রস্তাব নিয়ে অনেকেই আসছে, যা কিনা বিনিয়োগ বোর্ডে নিবন্ধিত হচ্ছে। পরবর্তীকালে কাজ করতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতায় বেশির ভাগই পিছিয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত বিদেশি বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে, তার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছিল ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকেই। ২০০৫ সালে টাটা শিল্পগোষ্ঠী বাংলাদেশে ৩০০ কোটি ডলার (প্রথমে ছিল ২০০ কোটি ডলার) বিনিয়োগ করার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়। আর ২০০৪ সাল থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছিল। টাটা ২৪ লাখ টন ইস্পাত, ১০ লাখ টন সার ও এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তিনটি কারখানা স্থাপন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। টাটার প্রস্তাব নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়। সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক হয় বিনিয়োগের শর্ত ও প্রণোদনা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত সস্তা দরে গ্যাসপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা নিয়ে মতবিরোধে ২০০৬ সালে টাটা তাদের প্রস্তাব স্থগিত এবং ২০০৭ সালে প্রত্যাহার করে নেয়। আসলে অতীতে কখনো এত বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রস্তাব যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনার অভিজ্ঞতা না থাকায় বিষয়টি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। সেই সময় টাটার বিনিয়োগ প্রস্তাবের ওপর বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কাছ থেকে একটি অভিমত সংগ্রহ করেছিল বিনিয়োগ বোর্ড। আরও অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ টাটার বিনিয়োগ প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। সব মিলিয়ে পুরো বিষয়টি জনগণের সামনে অনেকটাই খোলাখুলি তুলে ধরা সম্ভব হয়েছিল। আর এটা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের জন্য একটা ভালো অভিজ্ঞতা হিসেবেও বিবেচিত হয়।

এরপর বড় বিনিয়োগ প্রস্তাবটি আসে ২০১২ সালে সাহারা ইন্ডিয়া পরিবারের কাছ থেকে। গোষ্ঠীটি বাংলাদেশে আবাসন খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে আসে। শুরুতে বছরে ১২ থেকে ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দেয় সাহারা, যা পরবর্তীকালে বাড়বে বলেও তখন জানানো হয়। এর আগে অবশ্য দুই দেশের গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় এই বলে যে সাহারা বাংলাদেশে ৮০ হাজার কোটি রুপি বা প্রায়
এক হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে। সাহারা মাতৃভূমি উন্নয়ন করপোরেশন নামে বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হলেও তা আর অগ্রসর হয়নি। বরং পরবর্তীকালে খোদ নিজ দেশে সাহারার বিরাট অনিয়ম-কেলেঙ্কারি ধরা পড়ে। বিষয়টি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত গত মাসে আদালত সাহারার কর্ণধার সুব্রত রায় সাহারাকে জেলে পাঠানোর আদেশ দেন। অবশ্য বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের স্পনসর হিসেবে জায়গা করে নিতে সাহারার সমস্যা হয়নি।

বস্তুত বাংলাদেশে সীমিত ভারতীয় বিনিয়োগের একাধিক কারণ রয়েছে। আর তা ভারতীয় শিল্পোদ্যোক্তাদের নিজ দেশের বাইরে বিনিয়োগ করার দীর্ঘ পরিক্রমার সঙ্গে জড়িত। বলা হয়, ১৯৫৯ সালে বিড়লা শিল্পগোষ্ঠীর ইথিওপিয়ায় একটি বস্ত্র বা টেক্সটাইল কারখানা স্থাপন করার মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের বিদেশি বিনিয়োগ করা শুরু। ১৯৬০ সালে বিড়লা কেনিয়ায় একটি প্রকৌশল কারখানা স্থাপন করে। আর ১৯৬২ সালে শ্রী রাম গোষ্ঠী শ্রীলঙ্কায় স্থাপন করে সেলাই যন্ত্র কল। আর সত্তরের দশকে এসে ভারতীয়দের বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। তবে বিনিয়োগের পরিমাণ আহামরি কিছু ছিল না, এগুলো কেন্দ্রীভূত ছিল ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগে। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাইরে বিনিয়োগের জন্য নিয়ে যেতে মাত্র ২২ কোটি ডলার অনুমোদন করা হয়।

তবে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ব্যাপক বাণিজ্য উদারীকরণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে যে পরিবর্তনের ঢেউ লাগে, তা ভারতীয়দের বিদেশি বিনিয়োগের প্রবণতাকে জোরদার করে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া দেশ থেকে পুঁজি বাইরে নিয়ে যাওয়ার বিধি-বিধান শিথিল করে। এরই প্রতিফলন ঘটে পরের দশকে। ১৯৯০ সালে যেখানে ভারতের মোট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল মাত্র ১২ কোটি ৪০ লাখ ডলার; ২০০০ সালে তা উন্নীত হয় ১৮৬ কোটি ডলারে। আর সাম্প্রতিক কালে এই পরিমাণ বছরে গড়ে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ কোটি ডলার পর্যন্ত হয়েছে। দেখা যায়, নব্বই-পরবর্তী সময়ে থেকে ভারতীয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ব্যাপক পরিসরে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বড় অবস্থান গড়ার জন্য সক্রিয়ভাবে মাঠে নামে। এ ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের গন্তব্য হয় উন্নত দেশগুলো। আর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশেও তারা বিনিয়োগ করতে থাকে।

প্রশ্ন হলো, কেন ভারতীয়রা বা যেকোনো দেশের উদ্যোক্তারা ভিনদেশে বিনিয়োগ করে থাকে? উত্তরটা সহজ—ভালো ব্যবসা ও মুনাফা করার জন্য। যেখানে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করে, যেখানে পুঁজি খাটালে তা কয়েক বছরের মধ্যে দ্বিগুণ বা কয়েক গুণ হয়ে ফিরে আসে, সেখানেই উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা পুঁজি বিনিয়োগ করতে যাবে। স্বভাবতই অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বিপুলসংখ্যক গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ঘাটতি থাকায় বাংলাদেশে বিনিয়োগ করাকে ভারতীয়রা তেমন লাভজনক বিবেচনা করেনি। তার বদলে ব্যবসা করা বা পণ্য বিক্রিকে অধিক লাভজনক বিবেচিত হয়েছে। ধীরে ধীরে এখন পর্যন্ত যেটুকু ভারতীয় বিনিয়োগ এসেছে, তার বড় অংশই কেন্দ্রীভূত হয়েছে ভোগ্যপণ্য ও বস্ত্রসামগ্রীতে।

লক্ষ করলে দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় ভারতের বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে। ২০১০ সালে যেখানে বাংলাদেশের মোট বিদেশি বিনিয়োগের মাত্র ৫ শতাংশ ছিল ভারতের, সেখানে ওই বছর নেপাল ও শ্রীলঙ্কার মোট বিদেশি বিনিয়োগের ৪৪ ও ২৭ শতাংশ ছিল ভারতীয় বিনিয়োগ। পাকিস্তানের সঙ্গে এখনো ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। কাজেই সেখানে ভারতীয় বিনিয়োগের প্রশ্ন অবান্তর। একইভাবে উল্টোটিও সত্যি। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপোড়েনও ভারতীয় বিনিয়োগের সম্ভাবনার পথে একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে। টাটার বিনিয়োগের প্রস্তাবের সমালোচনার অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের গ্যাস নিঃশেষ করে দেওয়ার বা বাংলাদেশকে দীর্ঘ মেয়াদে বিপদে ফেলার ভারতীয় ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন কেউ কেউ।

তবে ২০০৯ সালে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি ও দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারতীয় বিনিয়োগ আকর্ষণের সক্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়। বিনিয়োগ বোর্ড কলকাতা, চেন্নাই ও মুম্বাইয়ে গত বছর রোড শোর আয়োজন করে। সম্প্রতি বছরগুলোয় দুই দেশের ব্যবসায়ী পর্যায়ে পারস্পরিক সফর ও আলোচনা বেড়েছে। গঠিত হয়েছে ইন্দো-বাংলা চেম্বার। সরকারিভাবেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর নানা তৎপরতা রয়েছে। বিনিয়োগের জন্য নানা প্রণোদনা ও সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও উদীয়মান ভোক্তা শ্রেণী ভারতীয় উদ্যোক্তাদের নজর এড়িয়ে যায়নি। আর তাই আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগ ক্রমান্বয়ে বাড়বে, এমন আভাস মিলছে।

তবে বাংলাদেশও এখন বিদেশি বিনিয়োগপ্রাপ্তির প্রারম্ভিক পর্যায়ে নেই। আর তাই সাধারণত কোনো উন্নয়নশীল দেশে বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহের শুরুর দিকে অনেক বেশি মন্দ বা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ আসে—এই তত্ত্ব বাংলাদেশে এখন খাটবে না। বরং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বিনিয়োগকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতিকে সামনে রেখে ভারতীয় বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রয়াসই হবে অধিকতর কাঙ্ক্ষিত।

আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।

asjadulk@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.