প্রথম পাঠেই যাকে চিনি by কাজল ঘোষ
প্রথম পরিচয় আদর্শলিপি বইতে। ঋষিঠাকুর যখন
উঠোনে শক্ত লাঠি হাতে নিয়ে জোরে সুর করে পড়াতেন, অ-তে অজগর ঐ আসছে তেড়ে।
আ-তে আমটি আমি খাবো পেড়ে। সাদাকালো ছাপায় ব্লকে আঁকা থাকতো আমের ছবি। তারও
পরে ছড়ায় ছড়ায় পরিচয়। আম পাতা জোড়া জোড়া, মারবো চাবুক চড়বো ঘোড়া। বাড়ির
উঠোন ছেড়ে এক সময় বাইরে আসি।
ক্ষেতের
আল ধরে বুক জড়িয়ে প্রথম পাঠ নিয়ে ইশকুলে যাই। রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী
থাকেন মনের অগোচরে। কুলিয়ারচর মডেল প্রাইমারি ইশকুলের মাঠে দাঁড়িয়ে এক
কণ্ঠে আওয়াজ তুলি জাতীয় সংগীতে। সেখানেও সুরে সুরে তাকে জানি... ওমা ফাগুনে
তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে...। খনার বচনেও কম যাননি তিনি। আমে ধান,
তেঁতুলে বান। ছোট্ট ছোট্ট স্মৃতি নিয়েই বেড়ে ওঠা। ছেলেবেলার স্মৃতির কিছু
অংশ আমকে নিয়েও। ছুটির দিনে মামার বাড়িতে আম কুড়াতে যাওয়া। ঝড়ের দিনে আম
পড়ার শব্দে কতো না মাতামাতি। ছেলেবেলায় আকণ্ঠ চঞ্চলতায় মেতে থাকতাম। ইশকুল
শেষে বাড়ি ফিরে ছুতোনাতা নিয়ে খেলায় মেতে উঠতাম। শুকনো দিনে ক্ষেতে গিয়ে
গুল্লাছুট আর দাঁড়িয়াবান্দায় ঝাঁপ দিতাম। কিন্তু বর্ষায় আটকে যেতাম। তখন এ
বাড়ি আর ও বাড়ি করা ছাড়া গত্যন্তর থাকতো না। তখন সঙ্গী বলতে আহ্লাদের ওঠোন।
বাড়ির সামনে পথ পার হলেই দিগন্ত জোড়া মাঠ। বর্ষার আগে-আগে সেখানে পাট
বাড়ন্ত হলে বর্ষার চ্যাপচ্যাপে পানিতেই জাগান দিতে হতো। নদীর টলটল পানি
ধীরে ধীরে আশ্রয় নিতো বাড়ির আশপাশের গর্তগুলোতে। সে সময় আরেকটি ঘটনা ঘটতো।
পাটক্ষেত ভাঙলেই সেখানে থাকা বিছা বা ছ্যাঙ্গা যাই বলি না কেন বাসা নিতো
বাড়ির অন্দরের গাছপালায়। আমাদের উঠোনেই ছিল একটি আম গাছ। মায়ের লাগানো।
মামার বাড়ি থেকে মিষ্টি আমের বড়া এনে করা। হ্যাংলা টিংটিংয়ে গড়নের এ গাছে
বছর ঘুরে প্রচুর আম হতো। জাতটা ছিল লম্বা। খেতে মিষ্টি লাগতো। এ গাছেই
বর্ষায় বাসা বাঁধতো দলে দলে শুয়ো পোকা। ইশকুল থেকে বাড়ি ফিরেই আমার কাজ ছিল
শুয়ো পোকা পরিষ্কারে লেগে যাওয়া। খুঁজে খুঁজে একটি পাটকড়ি বা হুলা বা সোলা
যাই বলি না কেন তাই নিয়ে খুঁছিয়ে খুঁছিয়ে এদের পাতা থেকে ফেলা। কারণ,
প্রতিদিনই আমের পাতা খেয়ে ফেলে গাছটিকে ন্যাড়া করে দিচ্ছে এরা। এটা সহ্য
করা যায় না। মায়ের নানা বকুনি সত্ত্বেও আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টার এই করতাম। ঘাড়
বাঁকা হয়ে যাচ্ছে তাতে কি দম নেয়ার ফুরসত নেই। একটা পড়েছো তো সে কি খুশি।
এই করতে গিয়ে একবার বেঁধেছিল বিপত্তি। পাটকড়ি দিয়ে খুচাচ্ছি আর পায় কে, ওপর
থেকে সোজা পরলো বাম চোখের ওপর। আর আমার চিৎকার। বাড়িশুদ্ধ লোক জড়ো হলো।
শুয়ো পোকার সবচেয়ে বিষাক্ত বা ক্ষতিকর দিক হচ্ছে, এদের গাঁয়ের লোমগুলো খুবই
বিষাক্ত। শরীরে বিঁধলে ফুলে ওঠে আর ব্যথা করে। মা তাড়াতাড়ি প্রচুর পানি
চোখে দিলো। এই বুঝি আমার চোখ গেল। আমি কাঁদছি। মা-ও সমানতালে বকে যাচ্ছেন।
পরে তিনি মাথার চুল মুঠি করে চোখের ওপর বুলিয়ে দিতেই ঝরে পরলো শুয়ো পোকার
বিষাক্ত লোম। সেই থেকে এই বিপজ্জনক খেলা আমি ছেড়েছি। বাড়িতে দাঁত পরিষ্কারে
কিছু না পেলে আমের কচি পাতা প্যাঁচিয়ে ডলা দিলেই চকচক করতো। বাড়িতে
বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীর ব্রতে আমের পল্লব ছিল বাধ্যতামূলক। পাঁচপাতার একটি
আমের পল্লব ফুলের সঙ্গে নিয়ে আসতে হতো পূজোর দিনে।
জ্যৈষ্ঠের তপ্ত রোদে ইশকুলে যাওয়ার কাজ ছিল কোন না কোনভাবে প্যান্টের পকেটে একটা বা দুইটা আম নিয়ে যাওয়া। বাড়িতে না থাকলে যাওয়ার পথে পনির কোম্পানির আমগাছে ঢিল মেরে যা পাওয়া গেল, নতুবা ইশকুলের গাছ থেকে পেড়ে ক্লাসে যাওয়া। এ এক বিস্ময়কর রকমের নেশায় মত্ত থাকতাম বোশেখ জ্যৈষ্ঠ মাসে। বসন্ত শেষে যখন আমের মুকুল বা বোল হতো তখন থেকেই মন পড়ে থাকতো মুকুলে। কার বাড়ির গাছে বোল বেশি হয়েছে। কোন গাছে এবার আম বেশি হবে। কালবোশেখের ঝড়ে কোন কোন গাছের বোল বেশি পড়ে গেছে। এ নিয়ে নানা হা-পিত্যেশ। ভোরে ফুল কুড়াতে গিয়ে ঝড়ের দিনে আম কুড়াতাম। যেদিন রাতে ঝড় হতো সেদিনের ভোর ছিল অন্যরকম সুখের। খুব ভোরে ছুটতাম। কোন গাছের তলায় আম বেশি থাকতে পারে এমন ধারণা নিয়ে হাজির হতাম। ফুলের খাড়ি ভরতি থাকতো সেদিন আমে। আমি বেশি আম কুড়াতে পেরেছি ঐটুকুই ছিল আনন্দ। তৃপ্তি। খুব যে খাওয়া হতো তা মোটেও নয়। ইশকুলে কাঁচা আম খাওয়ার অদ্ভূত এক পদ্ধতি নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিয়েছিলাম। ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি। পরনে থাকতো ইংলিশ প্যান্ট বা রবারের প্যান্ট। ইংলিশ প্যান্ট পরলে পকেট উঁচু হয়ে থাকতো। আর রবারের প্যান্ট পেঁচিয়ে এক কিম্ভূৎকিমাকার লাগতো নিজেকে। তখন এটার বর্ণনা না দিতে পারলেও এখন মনে হয় এটা দেখতে পোয়াতি মেয়েদের মতোই দূর থেকে মনে হতো। স্যার, ক্লাসে এলেই বেত লাগাবেন। ভয়ে ক্লাস শুরুর আগেই আম শেষ করতে হবে। ক্লাসের লম্বা দরোজার ফাঁকে আম ঢুকিয়ে দিয়ে জোরে চাপ দিতেই আম ফেটে দুই-তিন ভাগ হয়ে যেত। হাতের মুঠি করে লবণ নিয়ে যেতাম। দোস্ত-বন্ধুদের নিয়ে ভাগাভাগি করে নিতাম। চতুর্থ শ্রেণীতে যখন ঢাকায় তখন আমের অন্য স্বাদ পেয়ে বসেছিল। টিফিনে বরাবরই কাঁচা আমের ভর্তা আর রকমারি আমসত্ব ইসকুলের গেটে বসতো। যখন আরও বড় হয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছি তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লনে থাকা গাছ থেকে আম পেড়ে ছাদে বসে ভর্তা করে খেতাম। আজ যদিও সেখানে বৃহৎ অট্টালিকা। আম নিয়ে স্মৃতির পাতায় নানা খেলা। এখন আম আসে রাজশাহী থেকে। রাজধানীর বাজারে অসংখ্য আমের জাত বিকিকিনি হয়। বসে হরেক আমের মেলাও। কিন্তু ভয় পাই। কারণ, আমের যৌবন ধরে রাখতে ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করেন জীবন ধ্বংসকারী কার্বাইট। তবু কবির ভাষায় বলতে হয়, মধু মাসে পাকের আমের মধুর রসে মুখ রঙিন করতে কার না ভাল লাগে।
আম নিয়ে মজার কিছু কথা না বলে পারছি না। এসবই বইপত্র ঘেঁটে জানা। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের চিরঞ্জীব বনৌষধি থেকে জানা যায়, বহু লড়াই করে আমাকে বেড়ে উঠতে হয়। বোল অবস্থাতে শুধু ঝড়-ঝঞ্ঝায় সে ঝরে পড়ে তা নয়, অধিক কুয়াশাতেও আমের বোল অসময়ে ঝরে যায়। আম ভিন্ন অন্য কোন ফলের এমনটি হয় না। সোহাগী প্রাণ আমকে নিয়ে লোককথায় তাইতো বলা হয়, যত কুয়ো আমের ক্ষয়, তাল তেঁতুলের কিছু নয়।
রামায়ণে এক মজার গল্প আছে আম নিয়ে- রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় লঙ্কায়। বন্দি অবস্থায় সীতাকে ফল খাওয়ানো হয়। নাম না-জানা ফল খেয়ে খুব মজা পান সীতা। নিজের ভাগের অংশ থেকে সীতা কয়েকটা ফল রাম, লক্ষ্মণ ও হনুমানের জন্য রেখে দেন। সীতার খোঁজে হনুমান লঙ্কায় হাজির হলে বন্দি সীতা হনুমানকে ওই ফলগুলো দিয়ে বলেন, এগুলো তোমার, রাম ও লক্ষ্মণের জন্য। তোমরা খেয়ো। হনুমান সেই ফলগুলো থেকে একটা ফল খেয়ে আর লোভ সামলাতে পারেনি। একে একে সব নিজেই সাবার করে। কি আর করা। রামভক্ত হনুমান মাঝপথ থেকে আবারও ফিরে আসে সীতার কাছে। বলে, মা, আমি অপরাধ করেছি। ফলগুলো রাম ও লক্ষ্মণকে না দিয়ে একাই খেয়েছি। এখন বলো এই ফলের নাম কী? কোথায় পাওয়া যায়?
সীতা বলে, আমি তো এখানে বন্দি। কোথায় পাওয়া যাবে তা কি করে বলবো। এই ফলের কী নাম, তা-ও জানি না। তবে আশপাশেই পাওয়া যাবে হয়তো। হনুমান ফলের সন্ধানে বের হয়। এতো স্বাদের ফল, কী নাম এর? খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় আমের বাগান। গাছ থেকে একটি আম খেয়ে হনুমান বুঝতে পারে সীতার দেয়া ফলের মতো এই ফলেরও স্বাদ একই রকম। আমগাছে উঠে হনুমান ইচ্ছেমতো খেতে থাকে আর আমের আঁটি এদিক-সেদিক ছুড়ে মারতে থাকে। কথায় বলে, হনুমানের ছুড়ে দেয়া আমের আঁটি থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম হয়েছে আমগাছের। ইতিহাসের নানা পটপরিবর্তনেও যুক্ত রয়েছে আম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আম তলায়। ১৯৭১-এর ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহর পরাজয় হয়েছিল পলাশীর আম্রকাননে। বলা হয়ে থাকে চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং ভারতে বেড়াতে এসে আমকে জনপ্রিয় করে তোলেন। মোগল সম্রাট আকবর ভারতের লাখবাগ দারভাঙা এলাকায় প্রায় এক লাখ আমগাছ রোপণ করেছিলেন।
নানান জাতের আম: ফলের রাজা আম নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছেন রাষ্ট্রের নথিপত্রে। ২০১০-এর ১৫ই নভেম্বর আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করেছে মন্ত্রিসভা। অন্যদিকে আমের প্রজাতি সংরক্ষণে রাজশাহীতে স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশ আম গবেষণা কেন্দ্র। আর দুনিয়ায় যত দেশে আম উৎপাদন হয় তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম- হরেক রকম আমের জাত আমাদের দেশেই রয়েছে। এদের নাম ও প্রকার বলে শেষ করা যাবে না। অতি পরিচিত ফজলি আম নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে মালদহের কালেক্টরেট র্যাভেনশ অবকাশযাপনে ফজলি বিবি নামে এক বৃদ্ধার কুঠির কাছে থিতু হয়েছিলেন। ফজলি বিবি ফকিরভোগ আম নিয়ে দেখা করেন কালেক্টরেটের সঙ্গে। তিনি আম খেয়ে এতই মুগ্ধ হন যে, এরই নাম রেখে দেন ফজলি আম। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত আমের মধ্যে সেরা হলো ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরসাপাতি (গোপালভোগ), হিমসাগর, লক্ষণভোগ, মোহনভোগ, গোপালভোগ, বোম্বাই, রানীপসন্দ, বেগম পসন্দ, বাদশাপসন্দ, বিশ্বনাথ, বউ ভোলানী, ডাব, মনোহরা, আপেল, ময়ূরপঙ্খী, আলফানসো, বাদশাহী, আলমশাহী, বৃন্দাবনী, দিলশাদ, কোহিনূর, কোহেতুর, ওয়াবজান, হায়াত, বড় শাহী, ছোট শাহী, দিলখোশ, ফেরদৌসপসন্দ, সুলতানপসন্দ, বোম্বাই, গোলাবখাস, ক্ষীরসাপাতি, বোম্বাই ক্ষীরসাপাতি, সর ক্ষীরসাপাতি, ছোট ক্ষীরসাপাতি, জাফরান, মোহনভোগ, বিসমনী, ভরত, বিড়া, ভোজ, বৃন্দাবনী, বাবুই ঝাঁকি, বাতাস, চম্পা, চকচকি, চাপাতি, দুধসর, দ্বারিকা, দুধকুমার, দুধভোগ, আক্কেল গরম, ডায়মন্ড, নীলম, দোকশলা, বারোমাসি, কাঁচামিঠে, মিছরিভোগ, মিঠুরা, তোতাপুরী, কপটভাঙ্গা, হাতিঝুল, অরুণা, সুবর্ণরেখা, মিশ্রিদানা, নিলাম্বরী, কারাবাউ, কেউই সাউই, কেন্ট, পাহুতান, ত্রিফলা, কোলোপাহাড়, ফারীয়া, লতা, তোতা ফজলি, চিনি ফজলি, মালদহ, গৌরজিৎ, কিষাণভোগ, কালিভোগ, শিকাভোগ, সীতাভোগ, চিনিভোগ।
আমের পুষ্টিগুণ বলে শেষ করা যাবে না। এতে আছে আঁশ, ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। হজমেও সহায়তা করে আম। আম পটাশিয়ামের একটি সমৃদ্ধ উৎস। যা হার্টবিট ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। আমে কোলন, স্তন, প্রোস্টেট ক্যান্সাররোধক গুণ রয়েছে। আমে আছে ভিটামিন ই, যা যৌনসংশ্লিষ্ট হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যৌনশক্তি বাড়ায়। এক টুকরো আম কেটে মুখে লাগালে তাতে মেছতা দূর হয়ে যায়। নারীর ঋতুস্রাবকালীন খাদ্যে আম বেশ উপকারী। আমে আরও রয়েছে উচ্চমাত্রার দ্রবনীয় পথ্য আঁশ, পেকটিন এবং ভিটামিন সি যা কোলেস্টরলের ক্ষতিকর মাত্রা কমায়।
সবশেষ: ছোটবেলায় বাড়িতে দুটি আম গাছ ছিল। যা কালক্রমে বাড়ির গতিপরিবর্তনে তা ধ্বংস হয়ে যায়। পরে নতুন করে আবারও বাড়িতে চারটি আমগাছ রোপণ করা হয়। বর্তমানে চার মূর্তি আমাদের ছায়া হয়ে আছে।
জ্যৈষ্ঠের তপ্ত রোদে ইশকুলে যাওয়ার কাজ ছিল কোন না কোনভাবে প্যান্টের পকেটে একটা বা দুইটা আম নিয়ে যাওয়া। বাড়িতে না থাকলে যাওয়ার পথে পনির কোম্পানির আমগাছে ঢিল মেরে যা পাওয়া গেল, নতুবা ইশকুলের গাছ থেকে পেড়ে ক্লাসে যাওয়া। এ এক বিস্ময়কর রকমের নেশায় মত্ত থাকতাম বোশেখ জ্যৈষ্ঠ মাসে। বসন্ত শেষে যখন আমের মুকুল বা বোল হতো তখন থেকেই মন পড়ে থাকতো মুকুলে। কার বাড়ির গাছে বোল বেশি হয়েছে। কোন গাছে এবার আম বেশি হবে। কালবোশেখের ঝড়ে কোন কোন গাছের বোল বেশি পড়ে গেছে। এ নিয়ে নানা হা-পিত্যেশ। ভোরে ফুল কুড়াতে গিয়ে ঝড়ের দিনে আম কুড়াতাম। যেদিন রাতে ঝড় হতো সেদিনের ভোর ছিল অন্যরকম সুখের। খুব ভোরে ছুটতাম। কোন গাছের তলায় আম বেশি থাকতে পারে এমন ধারণা নিয়ে হাজির হতাম। ফুলের খাড়ি ভরতি থাকতো সেদিন আমে। আমি বেশি আম কুড়াতে পেরেছি ঐটুকুই ছিল আনন্দ। তৃপ্তি। খুব যে খাওয়া হতো তা মোটেও নয়। ইশকুলে কাঁচা আম খাওয়ার অদ্ভূত এক পদ্ধতি নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিয়েছিলাম। ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি। পরনে থাকতো ইংলিশ প্যান্ট বা রবারের প্যান্ট। ইংলিশ প্যান্ট পরলে পকেট উঁচু হয়ে থাকতো। আর রবারের প্যান্ট পেঁচিয়ে এক কিম্ভূৎকিমাকার লাগতো নিজেকে। তখন এটার বর্ণনা না দিতে পারলেও এখন মনে হয় এটা দেখতে পোয়াতি মেয়েদের মতোই দূর থেকে মনে হতো। স্যার, ক্লাসে এলেই বেত লাগাবেন। ভয়ে ক্লাস শুরুর আগেই আম শেষ করতে হবে। ক্লাসের লম্বা দরোজার ফাঁকে আম ঢুকিয়ে দিয়ে জোরে চাপ দিতেই আম ফেটে দুই-তিন ভাগ হয়ে যেত। হাতের মুঠি করে লবণ নিয়ে যেতাম। দোস্ত-বন্ধুদের নিয়ে ভাগাভাগি করে নিতাম। চতুর্থ শ্রেণীতে যখন ঢাকায় তখন আমের অন্য স্বাদ পেয়ে বসেছিল। টিফিনে বরাবরই কাঁচা আমের ভর্তা আর রকমারি আমসত্ব ইসকুলের গেটে বসতো। যখন আরও বড় হয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছি তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লনে থাকা গাছ থেকে আম পেড়ে ছাদে বসে ভর্তা করে খেতাম। আজ যদিও সেখানে বৃহৎ অট্টালিকা। আম নিয়ে স্মৃতির পাতায় নানা খেলা। এখন আম আসে রাজশাহী থেকে। রাজধানীর বাজারে অসংখ্য আমের জাত বিকিকিনি হয়। বসে হরেক আমের মেলাও। কিন্তু ভয় পাই। কারণ, আমের যৌবন ধরে রাখতে ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করেন জীবন ধ্বংসকারী কার্বাইট। তবু কবির ভাষায় বলতে হয়, মধু মাসে পাকের আমের মধুর রসে মুখ রঙিন করতে কার না ভাল লাগে।
আম নিয়ে মজার কিছু কথা না বলে পারছি না। এসবই বইপত্র ঘেঁটে জানা। আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্যের চিরঞ্জীব বনৌষধি থেকে জানা যায়, বহু লড়াই করে আমাকে বেড়ে উঠতে হয়। বোল অবস্থাতে শুধু ঝড়-ঝঞ্ঝায় সে ঝরে পড়ে তা নয়, অধিক কুয়াশাতেও আমের বোল অসময়ে ঝরে যায়। আম ভিন্ন অন্য কোন ফলের এমনটি হয় না। সোহাগী প্রাণ আমকে নিয়ে লোককথায় তাইতো বলা হয়, যত কুয়ো আমের ক্ষয়, তাল তেঁতুলের কিছু নয়।
রামায়ণে এক মজার গল্প আছে আম নিয়ে- রাবণ সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় লঙ্কায়। বন্দি অবস্থায় সীতাকে ফল খাওয়ানো হয়। নাম না-জানা ফল খেয়ে খুব মজা পান সীতা। নিজের ভাগের অংশ থেকে সীতা কয়েকটা ফল রাম, লক্ষ্মণ ও হনুমানের জন্য রেখে দেন। সীতার খোঁজে হনুমান লঙ্কায় হাজির হলে বন্দি সীতা হনুমানকে ওই ফলগুলো দিয়ে বলেন, এগুলো তোমার, রাম ও লক্ষ্মণের জন্য। তোমরা খেয়ো। হনুমান সেই ফলগুলো থেকে একটা ফল খেয়ে আর লোভ সামলাতে পারেনি। একে একে সব নিজেই সাবার করে। কি আর করা। রামভক্ত হনুমান মাঝপথ থেকে আবারও ফিরে আসে সীতার কাছে। বলে, মা, আমি অপরাধ করেছি। ফলগুলো রাম ও লক্ষ্মণকে না দিয়ে একাই খেয়েছি। এখন বলো এই ফলের নাম কী? কোথায় পাওয়া যায়?
সীতা বলে, আমি তো এখানে বন্দি। কোথায় পাওয়া যাবে তা কি করে বলবো। এই ফলের কী নাম, তা-ও জানি না। তবে আশপাশেই পাওয়া যাবে হয়তো। হনুমান ফলের সন্ধানে বের হয়। এতো স্বাদের ফল, কী নাম এর? খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় আমের বাগান। গাছ থেকে একটি আম খেয়ে হনুমান বুঝতে পারে সীতার দেয়া ফলের মতো এই ফলেরও স্বাদ একই রকম। আমগাছে উঠে হনুমান ইচ্ছেমতো খেতে থাকে আর আমের আঁটি এদিক-সেদিক ছুড়ে মারতে থাকে। কথায় বলে, হনুমানের ছুড়ে দেয়া আমের আঁটি থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে জন্ম হয়েছে আমগাছের। ইতিহাসের নানা পটপরিবর্তনেও যুক্ত রয়েছে আম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আম তলায়। ১৯৭১-এর ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাহর পরাজয় হয়েছিল পলাশীর আম্রকাননে। বলা হয়ে থাকে চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাং ভারতে বেড়াতে এসে আমকে জনপ্রিয় করে তোলেন। মোগল সম্রাট আকবর ভারতের লাখবাগ দারভাঙা এলাকায় প্রায় এক লাখ আমগাছ রোপণ করেছিলেন।
নানান জাতের আম: ফলের রাজা আম নিজ যোগ্যতায় স্থান করে নিয়েছেন রাষ্ট্রের নথিপত্রে। ২০১০-এর ১৫ই নভেম্বর আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণা করেছে মন্ত্রিসভা। অন্যদিকে আমের প্রজাতি সংরক্ষণে রাজশাহীতে স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশ আম গবেষণা কেন্দ্র। আর দুনিয়ায় যত দেশে আম উৎপাদন হয় তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নবম- হরেক রকম আমের জাত আমাদের দেশেই রয়েছে। এদের নাম ও প্রকার বলে শেষ করা যাবে না। অতি পরিচিত ফজলি আম নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে মালদহের কালেক্টরেট র্যাভেনশ অবকাশযাপনে ফজলি বিবি নামে এক বৃদ্ধার কুঠির কাছে থিতু হয়েছিলেন। ফজলি বিবি ফকিরভোগ আম নিয়ে দেখা করেন কালেক্টরেটের সঙ্গে। তিনি আম খেয়ে এতই মুগ্ধ হন যে, এরই নাম রেখে দেন ফজলি আম। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত আমের মধ্যে সেরা হলো ল্যাংড়া, ফজলি, ক্ষীরসাপাতি (গোপালভোগ), হিমসাগর, লক্ষণভোগ, মোহনভোগ, গোপালভোগ, বোম্বাই, রানীপসন্দ, বেগম পসন্দ, বাদশাপসন্দ, বিশ্বনাথ, বউ ভোলানী, ডাব, মনোহরা, আপেল, ময়ূরপঙ্খী, আলফানসো, বাদশাহী, আলমশাহী, বৃন্দাবনী, দিলশাদ, কোহিনূর, কোহেতুর, ওয়াবজান, হায়াত, বড় শাহী, ছোট শাহী, দিলখোশ, ফেরদৌসপসন্দ, সুলতানপসন্দ, বোম্বাই, গোলাবখাস, ক্ষীরসাপাতি, বোম্বাই ক্ষীরসাপাতি, সর ক্ষীরসাপাতি, ছোট ক্ষীরসাপাতি, জাফরান, মোহনভোগ, বিসমনী, ভরত, বিড়া, ভোজ, বৃন্দাবনী, বাবুই ঝাঁকি, বাতাস, চম্পা, চকচকি, চাপাতি, দুধসর, দ্বারিকা, দুধকুমার, দুধভোগ, আক্কেল গরম, ডায়মন্ড, নীলম, দোকশলা, বারোমাসি, কাঁচামিঠে, মিছরিভোগ, মিঠুরা, তোতাপুরী, কপটভাঙ্গা, হাতিঝুল, অরুণা, সুবর্ণরেখা, মিশ্রিদানা, নিলাম্বরী, কারাবাউ, কেউই সাউই, কেন্ট, পাহুতান, ত্রিফলা, কোলোপাহাড়, ফারীয়া, লতা, তোতা ফজলি, চিনি ফজলি, মালদহ, গৌরজিৎ, কিষাণভোগ, কালিভোগ, শিকাভোগ, সীতাভোগ, চিনিভোগ।
আমের পুষ্টিগুণ বলে শেষ করা যাবে না। এতে আছে আঁশ, ভিটামিন, মিনারেল এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। হজমেও সহায়তা করে আম। আম পটাশিয়ামের একটি সমৃদ্ধ উৎস। যা হার্টবিট ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। আমে কোলন, স্তন, প্রোস্টেট ক্যান্সাররোধক গুণ রয়েছে। আমে আছে ভিটামিন ই, যা যৌনসংশ্লিষ্ট হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং যৌনশক্তি বাড়ায়। এক টুকরো আম কেটে মুখে লাগালে তাতে মেছতা দূর হয়ে যায়। নারীর ঋতুস্রাবকালীন খাদ্যে আম বেশ উপকারী। আমে আরও রয়েছে উচ্চমাত্রার দ্রবনীয় পথ্য আঁশ, পেকটিন এবং ভিটামিন সি যা কোলেস্টরলের ক্ষতিকর মাত্রা কমায়।
সবশেষ: ছোটবেলায় বাড়িতে দুটি আম গাছ ছিল। যা কালক্রমে বাড়ির গতিপরিবর্তনে তা ধ্বংস হয়ে যায়। পরে নতুন করে আবারও বাড়িতে চারটি আমগাছ রোপণ করা হয়। বর্তমানে চার মূর্তি আমাদের ছায়া হয়ে আছে।
No comments