ভোটাররা সিদ্ধান্তে অনড় by সাজেদুল হক
তারা ছিলেন একদিনের বাদশা। পাঁচ বছরে
একবার ব্যালটের মাধ্যমে জানান দিতেন নিজেদের ক্ষমতার। ৫ই জানুয়ারি তাদের
কাছ থেকে সে ক্ষমতাও কেড়ে নেয়া হয়।
দেশের মালিকরা দেখলেন
তাদের কোন কিছু জিজ্ঞেস না করেই সরকার গঠন হয়ে গেছে। তবে আবারও সুযোগ পেয়ে
নিজেদের ক্ষমতার জানান দিলেন অসহায় জনগণ। যদিও এক সহযোগী দৈনিকের ভাষায়, এই
হলো দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। ক্ষমতার কেন্দ্রে এ নির্বাচন কোন পরিবর্তনই
আনবে না। তবুও আপাত অসহায়, পর্যুদস্তু ভোটাররা প্রমাণ করলেন, তারা নিজ
সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন। দশম সংসদ নির্বাচনের পর যে বিএনপি-জামায়াত জোটকে
রাজনীতি থেকে আউট মনে হচ্ছিল উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বে সে জোটই
সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজেলায় জয়ী হয়েছে। প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যাচ্ছে- বিএনপি
সমর্থিত প্রার্থীরা ৪২, আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা ৩৪, জামায়াত সমর্থকরা ১২,
জাতীয় পার্টি সমর্থকরা একটি উপজেলায় জয়ী হয়েছেন। এতে দেখা যাচ্ছে,
বিএনপি-জামায়াত জোট একসঙ্গে ৫৪টি উপজেলায় জয়ী হয়েছে। উপজেলা নির্বাচন একটি
বার্তা পরিষ্কার করেছে, সংসদে প্রতিনিধিত্ব না থাকা বিএনপিই এখন তৃণমূলে
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। ৫ সিটি করপোরেশনের পর ৪০টি জেলার ৯৭টি
উপজেলা নির্বাচনেও এটা প্রমাণ হয়েছে সুযোগ পেলে মানুষ বিএনপিকেই ভোট দেবে।
বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে কমপক্ষে ১০টি জেলায় আওয়ামী লীগ প্রভাব বিস্তার
করেছে। নির্বাচনে সরকারি দলের সরকারি ক্ষমতা ব্যবহারের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে
আবারও। জাল ভোট, অস্ত্রবাজি আর কেন্দ্র দখলের ঘটনাও ঘটে। এ কারণে নয়টি
উপজেলায় বিএনপি সমর্থক প্রার্থীরা নির্বাচন বর্জন করেন। শক্তির প্রদর্শনীর
ঘটনা না ঘটলে বিএনপি আরও বেশি উপজেলায় জয়ী হতেন বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকরা।
শত বাধা-বিপত্তির মধ্যেও এ বিজয় বিএনপির রাজনীতির জন্য অক্সিজেন নিয়ে
আসবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময়ই তৃণমূলে সবচেয়ে শক্তিশালী দল হিসেবে
পরিচিত আওয়ামী লীগ। তৃণমূলই ছিল দলটির সবচেয়ে বড় ভরসা। কিন্তু একের পর এক
স্থানীয় নির্বাচনে পরাজয় প্রমাণ করে সে ভরসা নড়বড়ে হয়ে এসেছে অনেকখানি।
বৃহস্পতিবারের উপজেলা নির্বাচনে ৯৭টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩৪টিতে জয়
পেলেও ২০০৯ সালের এসব উপজেলার নির্বাচনে প্রায় দ্বিগুণ আসনে জয়ী হয়েছিল
আওয়ামী লীগ। এবারের উপজেলা নির্বাচন সবচেয়ে বিস্ময় নিয়ে এসেছে জামায়াতের
জন্য। এ দলের ১২ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন, যা বিস্ময়করই বটে।
কারণ যুদ্ধাপরাধের বিচার আর সহিংসতাকে ঘিরে দলটি পুরোমাত্রায় কোণঠাসা।
সংসদ নির্বাচনের রাজনীতিতে নিষিদ্ধ দলটির নেতারা প্রায় সবাই পলাতক। এ
অবস্থাতেও তারা জয়ী হয়েছেন, যে জয় রাজনীতির মাঠে তাদের ফেরার উপকরণ হিসেবে
দেখা দিতে পারে। আর তৃণমূলের রাজনীতিতে জামায়াত যে ক্রমেই প্রবেশ করছে এ ফল
তারই প্রমাণ। অন্যদিকে, এ নির্বাচন মৃত্যু বার্তা নিয়ে এসেছে জাতীয়
পার্টির জন্য। সংসদে কথিত প্রধান বিরোধী দল উপজেলা নির্বাচনে মাত্র একটি
উপজেলায় জয়ী হয়েছে। অথচ যেসব উপজেলায় নির্বাচন হয়েছে এসব এলাকায় একসময়
জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা ছিল। সংসদ নির্বাচনে প্রভাবশালী দল হিসেবে
আবির্ভূত ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরিকত ফেডারেশন উপজেলা নির্বাচনে কোথাও
জয়ী হয়নি। এতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে তোলে। প্রায়
তিন মাস আগে আপলোড করা আল-কায়েদা নেতা আল-জাওয়াহিরির একটি কথিত অডিও বার্তা
বাংলাদেশে আলোচনায় আসে উপজেলা নির্বাচনের আগে। ওই বার্তায় বাংলাদেশীদের
জিহাদে যোগ দেয়ার ডাক দেন তিনি। এ বার্তা নিয়ে আলোচনার ঝড় তোলেন
ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচনের আগে আবার ফিরে আসে জঙ্গি কার্ড। তবে এ কার্ড কোন
সফলতা নিয়ে আসেনি। বরং বুমেরাংই হয়েছে। সরব না থাকলেও হেফাজত সমর্থকরা
নীরবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। উপজেলা নির্বাচনের ফল কমপক্ষে দু’টি
জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে। যদিও এর ভিন্ন ব্যাখ্যাও দেয়া সম্ভব। দশম সংসদ
নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের দু’টি জরিপে
পরিষ্কার করে নির্বাচনে বিএনপির বিপুল জয়ের কথা বলা হয়েছিল। তবে ওই
নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। নির্বাচনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক
গবেষণা সংস্থা ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই)-এর এক জরিপে বলা হয়, এখন
ভোট হলে আওয়ামী লীগের জয়ের সম্ভাবনা বেশি। যদিও এ জরিপে প্রায় ১৪ ভাগ
উত্তরদাতা কাকে ভোট দেবেন তা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তারাই নির্বাচনে
তুরুপের তাস হবেন বলে মানবজমিনে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল। উপজেলা
নির্বাচন তার সত্যতা প্রমাণ করে। দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনের জরিপেও এখন
নির্বাচন হলে কম ব্যবধানে আওয়ামী লীগের জয়ী হওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এখানেও
১৪ দশমিক ৫ ভাগ উত্তরদাতা বলেন, তারা এখনও সিদ্ধান্ত নেননি কাকে ভোট দেবেন।
মূলত এ ভাসমান ভোটাররাই বাংলাদেশের নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করে থাকেন। বহু
মতের ভীতিহীন চর্চাই গণতন্ত্র। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস বুকাননের
ভাষায়, মুক্ত মানুষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির সবচেয়ে ভাল মাধ্যম ব্যালট।
বাংলাদেশে ব্যালটের পরিবর্তে চলছে নির্মূলের রাজনীতি। কিন্তু উপজেলা
নির্বাচন এ বার্তাই দিয়ে গেল আপনি চাইলেও ভিন্নমতকে গণতন্ত্রের ক্লাব থেকে
মাইনাস করতে পারবেন না।
No comments