‘ওরা প্রাণ দিল’
ভাষাসংগ্রামী ফজলুল করিম তাঁর স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ বায়ান্ন’র কারাগার-এর শেষাংশে ‘একুশের প্রথম স্মরণিকা: “ওরা প্রাণ দিল”-এর ইতিকথা’ শিরোনামের রচনায় আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন ওরা প্রাণ দিল নামক স্মরণিকার সঙ্গে। তাঁর বইয়ে ভূমিকাসহ ২০ পৃষ্ঠার সেই স্মরণিকাটি পুরোটাই ছেপে দেওয়া হয়েছে। স্মরণিকাটি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন আরেক ভাষাসংগ্রামী একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতানের বইয়ের দোকান ‘পুঁথিপত্র’ থেকে। স্মরণিকাটি তিনি কীভাবে সংগ্রহ করেছিলেন, তা তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃত করছি: ‘১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে আমি ও মতিন ভাই একত্রে জেল থেকে মুক্তি পাই। মুক্তির কিছুদিন পরে একদিন সুলতান ভাইয়ের...বুকস্টলে পত্রপত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে ওরা প্রাণ দিল স্মরণিকাটি আমার চোখে পড়ল। একটিই মাত্র কপি ছিল। একটি ক্লিপে ঝোলানো পুস্তিকাটি আমি কিনে নিই।’ ফজলুল করিমের ভূমিকা থেকে স্মরণিকাটি নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে জানতে পারি: ‘এই স্মরণিকাটি ঢাকা জেলে তখনো যাঁরা বন্দী জীবনযাপন করছিলেন, তাঁদের কাছে পাঠাবার মনস্থ করি। জেলখানায় গোপনে এটি পাঠাবার ব্যবস্থা ছিল।
...যেকোনো কারণেই হোক শেষ পর্যন্ত জেলখানায় এই স্মরণিকাটি প্রেরণ করা হলো না। কিছুদিন পর পূর্ববঙ্গ সরকার একটি বিশেষ গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই স্মরণিকাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে নিরাপত্তার খাতিরে এটি লুকিয়ে ফেলতে হয়।’ ওরা প্রাণ দিল স্মরণিকাটি নিষিদ্ধ হওয়া বিষয়ে ভাষাসংগ্রামী ফজলুল করিমের এই তথ্য ছাড়া আর কোনো তথ্য আমাদের জানা নেই। স্মরণিকাটি প্রকাশের উদ্দেশ্য জানতে নাতিদীর্ঘ সম্পাদকীয়টির পুরোটাই উদ্ধারযোগ্য: ‘মাতৃভাষার জন্যে যে ছাব্বিশজন প্রাণ দিল, আহত হল একশ’ পঁচিশজন, তাদের রক্তই মূর্তিমান পরিচয় হয়ে রইল তাদের ভাষার। কি ছাত্র, কি রিকশাওয়ালা, কি চাষী, কি কেরানী সবাই এসে দাঁড়াল সেই রক্তের পাশে! ঢাকার বীরদের শুধু চোখে দেখবার জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামে গ্রামে হাজার হাজার লোক এসে জড় হয়েছে। বীরদের আশীর্বাদ জানিয়েছে, মেয়েরা যুগ যুগের অন্ধকার পর্দ্দা সরিয়ে কেঁদেছে পথের মাঝে দাঁড়িয়ে। ‘এখানে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে কোনো গভীর আলোচনা নেই, বাংলা ভাষার উৎপত্তি বা গতিপ্রকৃতি নিয়ে নতুন কোনো বিশ্লেষণও না। কোনো রাজনৈতিক জটিল তত্ত্বের মীমাংসা করতেও বসিনি। শুধু বলতে চাই, ভাইসব, আমরা তোমাদের কথা ভেবেছিলাম। তবু জানি, আমাদের অক্ষমতার গ্লানি ঘুচবে না কিছুতেই। তোমাদের নমস্কার।’ ওরা প্রাণ দিলর সম্পাদকের নাম সহকর্মী। প্রকাশক শিবব্রত সেন, বেণু প্রকাশনী, ২০ বি, বালিগঞ্জ স্টেশন রোড, কলিকাতা ১৯। ছেপেছে প্রিন্টার্স কংগ্রেস লি., ৩ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিট, কলিকাতা ১। প্রচ্ছদপট এঁকেছেন গণ-আন্দোলনের অংশীদার জনৈক শিল্পী। প্রথম প্রকাশ, আশ্বিন ১৩৫৯। এই হলো ওরা প্রাণ দিল সম্পর্কে প্রকাশনাসংক্রান্ত তথ্য। স্মরণিকাটির সম্পাদক ‘সহকর্মী’ সম্পর্কে ফজলুল করিম জানাচ্ছেন: ‘এই সহকর্মী কে? এ ব্যাপারে অনুসন্ধান করে জানা যায় যে, ঢাকার মানিকগঞ্জের একজন বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী প্রমথ নন্দী এই স্মরণিকা সম্পাদনা করেন। বায়ান্নর একুশের ঘটনার পর তিনি কলকাতা গিয়ে নিজ নাম গোপন রেখে সহকর্মী নামে এই স্মরণিকা প্রকাশ করেন। এখানকার সেদিনে বৈরী পরিবেশের কথা বিবেচনা করে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণেই তিনি নিজকে আড়াল করেছেন।’
প্রমথ নন্দী সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য আমরা জানতে পেরেছি। তিনি ঢাকার প্রখ্যাত ডাক্তার এম এন নন্দীর ছোট ভাই। তাঁদের আরেক ভাই ভবেশ নন্দী ছিলেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক আমার দেশ-এর সম্পাদক। প্রমথ নন্দীর বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামে। বামপন্থী রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষকের চাকরি দেওয়া হয়নি। পরে তিনি আর সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। নিজ গ্রামের মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। আশির দশকে ভারতে চলে যান। সম্পাদকের মতো স্মরণিকাটির প্রচ্ছদশিল্পীর নামও গোপন রাখা হয়েছিল। কিন্তু স্মরণিকার লেখক চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর নিশ্চিত করেছেন, এর প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ভারতের খ্যাতিমান শিল্পী সোমনাথ হোড়। স্মরণিকাটির লেখকদের তালিকায় ছিলেন বিমলচন্দ্র ঘোষ, সৈয়দ আবুল হুদা, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, মুর্তজা বশীর, নিত্য বসু, তানিয়া বেগম ও সহকর্মী। এই তালিকার অন্তত তিনজনের পরিচয় জানা যায় না। হয়তো সেগুলো ছদ্মনাম। স্মরণিকায় অন্তর্ভুক্ত সাতটি রচনার মধ্যে ছয়টি কবিতা ও একটি গান। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের একুশের গান ‘ঢাকার ডাক’, মুর্তজা বশীরের ‘পারবে না’ ও বিমলচন্দ্র ঘোষের ‘শহীদ বাংলা’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্মরণিকায় প্রকাশিত রচনাগুলোতে একুশের শহীদদের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে; ব্যক্ত হয়েছে মাতৃভাষাপ্রেম, সংগ্রামী চেতনা ও প্রবল আশাবাদ। স্মরণিকাটির প্রকাশকাল হিসেবে উল্লেখ রয়েছে আশ্বিন ১৩৫৯। ইংরেজি তারিখের সঙ্গে মেলালে দাঁড়ায় সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সাল। কবি-সম্পাদক-সংগঠক হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রকাশকাল মার্চ ১৯৫৩। সন-তারিখের বিবেচনায় সে ক্ষেত্রে ওরা প্রাণ দিল একুশের প্রথম স্মরণিকা। একুশের এই ঐতিহাসিক স্মরণিকা ওরা প্রাণ দিল সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রকাশের জন্য ভাষাসংগ্রামী ফজলুল করিমকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি।
সাজ্জাদ আরেফিন: লেখক।
সাজ্জাদ আরেফিন: লেখক।
No comments