রহস্য গল্প- অনুসরণ by মশিউল আলম
হেমন্তের হিমেল বাতাস, সকাল দশটার ঝলমলে
রোদ, ঢাকার রাস্তার কালো পিচ, রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, বাস,
পথচারী—সবাই যেন ভয় পেয়েছে। সবখানে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে চাপা এক আতঙ্ক।
বিরামহীন ৮৪ ঘণ্টা হরতালের আজ প্রথম দিন। মাত্র পাঁচ দিন
আগেই ১৪ জন মানুষের প্রাণের ওপর দিয়ে বুলডোজারের মতো গড়িয়ে গেছে টানা ৭২
ঘণ্টার হরতাল।
অলংকরণ:
মাসুক হেলাল
সকাল সাড়ে ১০টায় কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের সার্ক ফোয়ারার চৌমাথায় দাঁড়িয়ে ভাবছি, গ্রিন রোডের শেষ মাথায় ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল পর্যন্ত হেঁটে যেতে কতটা সময় লাগতে পারে। এ সময় এক তরুণ রিকশাচালক জিজ্ঞাসা করে আমি কোথায় যাব। আমার বিরক্তি বোধ হয়; মনে মনে বলি, আমি কোথায় যাব সেটা জিজ্ঞাসা করার তুমি কে? মানতে পারি না যে রিকশাচালকদের এটা স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা। বিরক্তিটা অবশ্য প্রকাশ করি না; কোনো কথা না বলে পান্থপথের ফুটপাত ধরে গ্রিন রোডের দিকে হেঁটে যেতে আরম্ভ করি। পুরোটা পথ হেঁটেই যাব। প্রাণের ভয়ে। হরতালকারীরা যাত্রীসুদ্ধ রিকশায় আগুন ধরিয়ে দিতে উৎসবের আনন্দ পায়।
কিন্তু পান্থপথ আর গ্রিন রোড যেখানে পরস্পরকে ছেদ করেছে, সেই চৌরাস্তায় পৌঁছে মনে পড়ল, আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি রক্তচাপ ওঠানামার একটা বিহিত করতে। এতটা পথ হেঁটে গিয়ে ডাক্তারের সামনে হাজির হলে তিনি যখন আমার রক্তচাপ মাপবেন, সম্ভবত বিভ্রান্ত হবেন। তাতে আমারই ক্ষতি।
স্বাভাবিকের থেকে ১০ টাকা বেশি ভাড়ায় আমি একটা রিকশায় উঠে বসলাম।
***
‘আপনি যদি দিনে মাত্র একটা সিগারেটও খান, আপনি স্মোকার। আপনার হাইপারটেনশন, আর আপনি স্মোক করেন, আমি কেন, পৃথিবীর কোনো ডাক্তারই আপনার ব্লাডপ্রেশার কন্ট্রোলে আনতে পারবেন না। কোনো ওষুধেই কোনো কাজ হবে না...’
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
সকাল সাড়ে ১০টায় কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউয়ের সার্ক ফোয়ারার চৌমাথায় দাঁড়িয়ে ভাবছি, গ্রিন রোডের শেষ মাথায় ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতাল পর্যন্ত হেঁটে যেতে কতটা সময় লাগতে পারে। এ সময় এক তরুণ রিকশাচালক জিজ্ঞাসা করে আমি কোথায় যাব। আমার বিরক্তি বোধ হয়; মনে মনে বলি, আমি কোথায় যাব সেটা জিজ্ঞাসা করার তুমি কে? মানতে পারি না যে রিকশাচালকদের এটা স্বাভাবিক জিজ্ঞাসা। বিরক্তিটা অবশ্য প্রকাশ করি না; কোনো কথা না বলে পান্থপথের ফুটপাত ধরে গ্রিন রোডের দিকে হেঁটে যেতে আরম্ভ করি। পুরোটা পথ হেঁটেই যাব। প্রাণের ভয়ে। হরতালকারীরা যাত্রীসুদ্ধ রিকশায় আগুন ধরিয়ে দিতে উৎসবের আনন্দ পায়।
কিন্তু পান্থপথ আর গ্রিন রোড যেখানে পরস্পরকে ছেদ করেছে, সেই চৌরাস্তায় পৌঁছে মনে পড়ল, আমি ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি রক্তচাপ ওঠানামার একটা বিহিত করতে। এতটা পথ হেঁটে গিয়ে ডাক্তারের সামনে হাজির হলে তিনি যখন আমার রক্তচাপ মাপবেন, সম্ভবত বিভ্রান্ত হবেন। তাতে আমারই ক্ষতি।
স্বাভাবিকের থেকে ১০ টাকা বেশি ভাড়ায় আমি একটা রিকশায় উঠে বসলাম।
***
‘আপনি যদি দিনে মাত্র একটা সিগারেটও খান, আপনি স্মোকার। আপনার হাইপারটেনশন, আর আপনি স্মোক করেন, আমি কেন, পৃথিবীর কোনো ডাক্তারই আপনার ব্লাডপ্রেশার কন্ট্রোলে আনতে পারবেন না। কোনো ওষুধেই কোনো কাজ হবে না...’
অলংকরণ: মাসুক হেলাল
ডাক্তারের কথা শুনতে শুনতে আমি মনে মনে
বললাম, ‘আপনি তো ভালো ডাক্তার নন! মাঝেমধ্যে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দুই-একটা
সিগারেট খেলেই যদি ব্লাডপ্রেশার কন্ট্রোলের বাইরে চলে যায়, আর সেটা
কন্ট্রোলে আনার কোনো ওষুধই যদি আপনার জানা না থাকে, তাহলে আপনি ভালো
ডাক্তার হন কীভাবে?...’
আমাকে সম্ভবত অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। হঠাৎ লক্ষ করি ডাক্তার কথা থামিয়ে স্থির চেয়ে আছেন আমার মুখের দিকে। চোখাচোখি হতেই আমি লজ্জা পেলাম, আর আমার মনে হলো, লজ্জা বোধ হয় তিনিও পেলেন। কিন্তু কী কারণে লজ্জা, আমার এবং তাঁর—আমি জানি না।
তারপর ডাক্তার জানতে চাইলেন আমার ঘুম কেমন হয়। আমি বললাম, ভালো হয় না। আরও বললাম যে উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে যায়।
‘কী ধরনের উল্টাপাল্টা স্বপ্ন?’
আমি মনে মনে ইংরেজি ‘বিজার’ শব্দটার জুতসই একটা বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজতে খুঁজতে ভুলে যাই যে ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত; বরং আমার সব সময়ই যেটা হয়, এত ঘন ঘন চিন্তা ও মনোযোগের বিষয় বদলে যায় যে এক কথা শেষ না করে আরেক কথায় চলে যাই, বাক্য সম্পূর্ণ হয় না; বলি যে আমার ভয় লাগে, কিসের ভয় আমি জানি না, অথবা জানি, যেমন, আমার ছেলেমেয়েদের জন্য, ওদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। কারণ, ওরা অরক্ষিত, পাখির ছানাদের মতো, অথবা ওদের দিকে তাকিয়ে আমার এমন বোধ হয় যেন আমার হূৎপিণ্ডটা বুকের ভেতর থেকে বের করে রেখে দেওয়া হয়েছে একটা খোলা জায়গায়, কখন কাক বা চিল এসে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায়...শুধু এ রকম ভয় না, আমার নিজের জন্যও ভয় লাগে, সহকর্মীদের জন্য, বন্ধুদের জন্য, ভয় লাগে যে কিছু একটা ভয়ানক ব্যাপার ঘটে যেতে পারে, এমন ভয়ানক যা আগে কখনো ঘটেনি....
***
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তা আগের থেকে অনেক বেশি নির্জন। হাসপাতালের এক কোণে লাইটপোস্টের নিচে পান-সিগারেটের একটি দোকান দেখে মনে হলো, শেষ সিগারেটটা খেয়ে নিই। তারপর ডাক্তারকে বলব, ‘এবার? এখন ব্লাডপ্রেশার কন্ট্রোল হচ্ছে না কেন?’
সিগারেট খেতে খেতে হঠাৎ চোখে পড়ল, বেশ দূরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, চেয়ে আছে আমার দিকে। হালকা-পাতলা, বেশ লম্বা একটা লোক। এক হাত কোমরে রাখা, আরেক হাতে সিগারেট। কিছুক্ষণ পর পর সিগারেটে টান দিচ্ছে আর অপলক চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি তাকে চিনি না; কিন্তু সে এমনভাবে আমাকে দেখছে যেন সে আমাকে চেনে।
আমি অফিসের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করি গ্রিন রোডের ফুটপাত ধরে। কিছুদূর এগোনোর পর পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি সেই লোকটিও আসছে আমার পিছু পিছু। আমি জোরে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকি আর খালি রিকশার সন্ধানে রাস্তার দিকে ঘন ঘন তাকাই। এবার রোদটাকে বেশ তীব্র মনে হয়, গা ঘেমে ওঠে। আমি রোদ এড়াতে রাস্তা ক্রস করে পুব পাশের ছায়াময় ফুটপাতে উঠি। কিছুদূর যাওয়ার পর আবার পেছনে তাকিয়ে দেখি, সেই লোকটিও ফুটপাত পরিবর্তন করে আমার পিছু পিছু আসছে। একবার মনে হলো, থেমে লোকটার মুখোমুখি হই; জিগ্যেস করি কেন সে আমাকে এভাবে অনুসরণ করছে।
কিন্তু আমার দুই পা থামে না, ছুটতে থাকে আরও দ্রুতগতিতে। কিছুক্ষণ পর একটি খালি রিকশা পেয়ে ভাড়া ঠিক না করেই তাতে উঠে বসি, চালককে কারওয়ান বাজারের দিকে দ্রুত যেতে বলি। পেছনে তাকিয়ে দেখি লোকটি ফুটপাতের কিনারে দাঁড়িয়ে রাস্তার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সন্ধানী চোখে।
আমার রিকশা ছুটছে পান্থপথ ধরে কারওয়ান বাজারের দিকে। পেছনে তাকিয়ে দেখি, একটি রিকশা সেই লোকটিকে নিয়ে যেন উড়ে আসছে আমার দিকে।
কারওয়ান বাজারে অফিসের গেটে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে দিতে পেছনে তাকাই। সেই লোকটির দেখা আর পাই না।
***
সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করি। সার্ক ফোয়ারার চৌরাস্তা পার হয়ে সোনারগাঁও হোটেলের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলি বাংলামোটরের দিকে। হাতিরঝিলের পাড় ঘেঁষে নতুন রাস্তায় ঢোকার মুখে হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই লোকটা আসছে আমার পিছু পিছু। আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমি রিকশা খুঁজতে শুরু করি। কিন্তু একটিও খালি রিকশার দেখা পাই না। হাতিরঝিলের ধার ঘেঁষে দ্রুত পা চালিয়ে এগোতে থাকি। ভয় লাগছে বলে নিজের ওপরেই বিরক্ত হচ্ছি: এত ভীরু হলে চলবে কী করে? কেন আমি লোকটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে জিগ্যেস করতে পারছি না সে কেন আমাকে অনুসরণ করছে?
সন্ধ্যা ছয়টা পার হয়ে গেছে, আঁধার নেমেছে। রাস্তার পাশের বাতিগুলো জ্বলছে বটে, কিন্তু তার ফলে আঁধার একটুও দূর হচ্ছে না। বরং পরিব্যাপ্ত অন্ধকারের সমুদ্রে হলদে, রোগাটে বৈদ্যুতিক বাতিগুলোকে ক্ষীয়মাণ একেকটা বিন্দু বলে মনে হচ্ছে, যেন তারা নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
হাতিরঝিলের পাড় ধরে আঁকাবাঁকা রাস্তাটি গড়ে উঠেছে আমারই চোখের সামনে; এই পাড়ায় আমার নিজের বাসস্থান, অথচ এখন এই পথ, এই ফুটপাত আমার অচেনা মনে হচ্ছে।
দিলু রোডে পানির ট্যাংকের কাছে রাস্তাটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে একটা চিকন গলি ঢুকে গেছে পাড়াটির ভেতরে। আমি সেখানে একটু থামি, পেছনে তাকাই। সেই লোকটি, অন্ধকারে সে এখন লম্বা একটা ছায়ার মতো, এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি গলির ভেতরে ঢুকে যাই। এই গলি থেকে আরও কয়েকটা গলি এগিয়ে গেছে এদিকে-ওদিকে। ওইসব গলির কোনো একটার মধ্যে হারিয়ে যাব আমি, লোকটি আর খুঁজে পাবে না আমাকে।
দুই পাশে ঘনবদ্ধ বাড়িঘর, গলি সরু এবং অন্ধকার। আমি দ্রুত পা চালিয়ে সরু গলিটা পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত চওড়া একটা রাস্তায় উঠি, যেটি আঁকাবাঁকা হয়ে শেষে গিয়ে মিশেছে বাংলামোটর থেকে মালিবাগের দিকে যাওয়ার বড় রাস্তায়। সেই রাস্তার পাশে আমার পরিচিত এক ওষুধের দোকানে যাচ্ছি এখন; আমার পিছু পিছু লোকটিও যদি সে পর্যন্ত যায়, তাহলে আমি সেখানে তাকে থামাব, তার মুখোমুখি হব; আশপাশের সব দোকানের লোকজন আমার পরিচিত; তাদের সঙ্গে নিয়ে আমি লোকটাকে আটকে ফেলব। সবাইকে বলব, এই লোকটা আমাকে ফলো করছে সেই সকাল থেকে। কে সে? কেন আমার পিছু লেগেছে? কী তার উদ্দেশ্য?
একটি বাড়ির সীমানা-প্রাচীরের ধার ঘেঁষে কী একটা গাছ, সে গাছের ধারে একটা লাইটপোস্টের মাথায় বাতি জ্বলছে। গাছের পাতা ও শাখা-প্রশাখার ছায়া পড়েছে রাস্তায়। আমার পা দুটো মন্থর হয়ে আসে; একটু থেমে দম নিই, পেছনে তাকাই—সেই ছায়াটি হেলেদুলে এগিয়ে আসছে যথারীতি। আমি সামনে ঘুরে পা বাড়াই। হঠাৎ দুপাশ থেকে দুটি মানুষ আমাকে ঘিরে ধরে। একজন আমার ডান হাতের মুঠি থেকে মোবাইল ফোনটা কেড়ে নেয়, অন্যজন খুলে নেয় বাম হাতের ঘড়ি; একই সঙ্গে সে হাত ঢুকিয়ে দেয় প্যান্টের সাইড পকেটে, অন্যজন হিপ-পকেট থেকে বের করে নেয় মানিব্যাগ। আমি ‘ছিনতাই’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠতেই হাড্ডিসার একটা হাত বেড় দিয়ে ধরে আমার গলা; বেশ চওড়া একটা ছুরিতে বিদ্যুতের আলো ঝলকে ওঠে; এক নিমেষে সেটা ঢুকে যায় আমার বুকের ঠিক মাঝখানে; আমার চারপাশটা ঝলকে উঠল এক বিদ্যুচ্চমকে। আমার বুকের ভেতর থেকে কামানের গোলার মতো বেরিয়ে এলাম আমি, ছিটকে পড়লাম হাত দশেক দূরে এবং পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, দুটি লোক উন্মত্তের মতো ছুরি মেরে চলেছে আমার বুকে; আমি আর্তনাদ করে চলেছি, চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে এসেছে; তারা গোল হয়ে ঘিরে দেখছে রক্তাক্ত ছুরির খেলা; তাদের ভিড়ে সেই লোকটিও, যে আমাকে অনুসরণ করছে সেই সকাল থেকে।
আমি ঘুরে দৌড়াতে শুরু করলাম বাসার দিকে; পেছনে উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে একটি মানুষ। তার প্রাণফাটা আর্তনাদে বিদীর্ণ হচ্ছে দিলু রোডের আকাশ-বাতাস।
হাঁপাতে হাঁপাতে কলবেলের বোতামে চাপ দিলাম। দরজা খুলে গেল। আমার সামনে সেই লোকটি, যে আমার পিছু নিয়েছে সেই সকাল থেকে।
আমাকে সম্ভবত অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। হঠাৎ লক্ষ করি ডাক্তার কথা থামিয়ে স্থির চেয়ে আছেন আমার মুখের দিকে। চোখাচোখি হতেই আমি লজ্জা পেলাম, আর আমার মনে হলো, লজ্জা বোধ হয় তিনিও পেলেন। কিন্তু কী কারণে লজ্জা, আমার এবং তাঁর—আমি জানি না।
তারপর ডাক্তার জানতে চাইলেন আমার ঘুম কেমন হয়। আমি বললাম, ভালো হয় না। আরও বললাম যে উল্টাপাল্টা স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙে যায়।
‘কী ধরনের উল্টাপাল্টা স্বপ্ন?’
আমি মনে মনে ইংরেজি ‘বিজার’ শব্দটার জুতসই একটা বাংলা প্রতিশব্দ খুঁজতে খুঁজতে ভুলে যাই যে ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া উচিত; বরং আমার সব সময়ই যেটা হয়, এত ঘন ঘন চিন্তা ও মনোযোগের বিষয় বদলে যায় যে এক কথা শেষ না করে আরেক কথায় চলে যাই, বাক্য সম্পূর্ণ হয় না; বলি যে আমার ভয় লাগে, কিসের ভয় আমি জানি না, অথবা জানি, যেমন, আমার ছেলেমেয়েদের জন্য, ওদের নিরাপত্তার কথা ভেবে। কারণ, ওরা অরক্ষিত, পাখির ছানাদের মতো, অথবা ওদের দিকে তাকিয়ে আমার এমন বোধ হয় যেন আমার হূৎপিণ্ডটা বুকের ভেতর থেকে বের করে রেখে দেওয়া হয়েছে একটা খোলা জায়গায়, কখন কাক বা চিল এসে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায়...শুধু এ রকম ভয় না, আমার নিজের জন্যও ভয় লাগে, সহকর্মীদের জন্য, বন্ধুদের জন্য, ভয় লাগে যে কিছু একটা ভয়ানক ব্যাপার ঘটে যেতে পারে, এমন ভয়ানক যা আগে কখনো ঘটেনি....
***
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে দেখি রাস্তা আগের থেকে অনেক বেশি নির্জন। হাসপাতালের এক কোণে লাইটপোস্টের নিচে পান-সিগারেটের একটি দোকান দেখে মনে হলো, শেষ সিগারেটটা খেয়ে নিই। তারপর ডাক্তারকে বলব, ‘এবার? এখন ব্লাডপ্রেশার কন্ট্রোল হচ্ছে না কেন?’
সিগারেট খেতে খেতে হঠাৎ চোখে পড়ল, বেশ দূরে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, চেয়ে আছে আমার দিকে। হালকা-পাতলা, বেশ লম্বা একটা লোক। এক হাত কোমরে রাখা, আরেক হাতে সিগারেট। কিছুক্ষণ পর পর সিগারেটে টান দিচ্ছে আর অপলক চেয়ে আছে আমার দিকে। আমি তাকে চিনি না; কিন্তু সে এমনভাবে আমাকে দেখছে যেন সে আমাকে চেনে।
আমি অফিসের উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করি গ্রিন রোডের ফুটপাত ধরে। কিছুদূর এগোনোর পর পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি সেই লোকটিও আসছে আমার পিছু পিছু। আমি জোরে পা চালিয়ে হাঁটতে থাকি আর খালি রিকশার সন্ধানে রাস্তার দিকে ঘন ঘন তাকাই। এবার রোদটাকে বেশ তীব্র মনে হয়, গা ঘেমে ওঠে। আমি রোদ এড়াতে রাস্তা ক্রস করে পুব পাশের ছায়াময় ফুটপাতে উঠি। কিছুদূর যাওয়ার পর আবার পেছনে তাকিয়ে দেখি, সেই লোকটিও ফুটপাত পরিবর্তন করে আমার পিছু পিছু আসছে। একবার মনে হলো, থেমে লোকটার মুখোমুখি হই; জিগ্যেস করি কেন সে আমাকে এভাবে অনুসরণ করছে।
কিন্তু আমার দুই পা থামে না, ছুটতে থাকে আরও দ্রুতগতিতে। কিছুক্ষণ পর একটি খালি রিকশা পেয়ে ভাড়া ঠিক না করেই তাতে উঠে বসি, চালককে কারওয়ান বাজারের দিকে দ্রুত যেতে বলি। পেছনে তাকিয়ে দেখি লোকটি ফুটপাতের কিনারে দাঁড়িয়ে রাস্তার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে সন্ধানী চোখে।
আমার রিকশা ছুটছে পান্থপথ ধরে কারওয়ান বাজারের দিকে। পেছনে তাকিয়ে দেখি, একটি রিকশা সেই লোকটিকে নিয়ে যেন উড়ে আসছে আমার দিকে।
কারওয়ান বাজারে অফিসের গেটে রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে দিতে পেছনে তাকাই। সেই লোকটির দেখা আর পাই না।
***
সন্ধ্যায় অফিস থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করি। সার্ক ফোয়ারার চৌরাস্তা পার হয়ে সোনারগাঁও হোটেলের পাশ দিয়ে এগিয়ে চলি বাংলামোটরের দিকে। হাতিরঝিলের পাড় ঘেঁষে নতুন রাস্তায় ঢোকার মুখে হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই লোকটা আসছে আমার পিছু পিছু। আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমি রিকশা খুঁজতে শুরু করি। কিন্তু একটিও খালি রিকশার দেখা পাই না। হাতিরঝিলের ধার ঘেঁষে দ্রুত পা চালিয়ে এগোতে থাকি। ভয় লাগছে বলে নিজের ওপরেই বিরক্ত হচ্ছি: এত ভীরু হলে চলবে কী করে? কেন আমি লোকটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে জিগ্যেস করতে পারছি না সে কেন আমাকে অনুসরণ করছে?
সন্ধ্যা ছয়টা পার হয়ে গেছে, আঁধার নেমেছে। রাস্তার পাশের বাতিগুলো জ্বলছে বটে, কিন্তু তার ফলে আঁধার একটুও দূর হচ্ছে না। বরং পরিব্যাপ্ত অন্ধকারের সমুদ্রে হলদে, রোগাটে বৈদ্যুতিক বাতিগুলোকে ক্ষীয়মাণ একেকটা বিন্দু বলে মনে হচ্ছে, যেন তারা নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
হাতিরঝিলের পাড় ধরে আঁকাবাঁকা রাস্তাটি গড়ে উঠেছে আমারই চোখের সামনে; এই পাড়ায় আমার নিজের বাসস্থান, অথচ এখন এই পথ, এই ফুটপাত আমার অচেনা মনে হচ্ছে।
দিলু রোডে পানির ট্যাংকের কাছে রাস্তাটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে একটা চিকন গলি ঢুকে গেছে পাড়াটির ভেতরে। আমি সেখানে একটু থামি, পেছনে তাকাই। সেই লোকটি, অন্ধকারে সে এখন লম্বা একটা ছায়ার মতো, এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি গলির ভেতরে ঢুকে যাই। এই গলি থেকে আরও কয়েকটা গলি এগিয়ে গেছে এদিকে-ওদিকে। ওইসব গলির কোনো একটার মধ্যে হারিয়ে যাব আমি, লোকটি আর খুঁজে পাবে না আমাকে।
দুই পাশে ঘনবদ্ধ বাড়িঘর, গলি সরু এবং অন্ধকার। আমি দ্রুত পা চালিয়ে সরু গলিটা পেরিয়ে অপেক্ষাকৃত চওড়া একটা রাস্তায় উঠি, যেটি আঁকাবাঁকা হয়ে শেষে গিয়ে মিশেছে বাংলামোটর থেকে মালিবাগের দিকে যাওয়ার বড় রাস্তায়। সেই রাস্তার পাশে আমার পরিচিত এক ওষুধের দোকানে যাচ্ছি এখন; আমার পিছু পিছু লোকটিও যদি সে পর্যন্ত যায়, তাহলে আমি সেখানে তাকে থামাব, তার মুখোমুখি হব; আশপাশের সব দোকানের লোকজন আমার পরিচিত; তাদের সঙ্গে নিয়ে আমি লোকটাকে আটকে ফেলব। সবাইকে বলব, এই লোকটা আমাকে ফলো করছে সেই সকাল থেকে। কে সে? কেন আমার পিছু লেগেছে? কী তার উদ্দেশ্য?
একটি বাড়ির সীমানা-প্রাচীরের ধার ঘেঁষে কী একটা গাছ, সে গাছের ধারে একটা লাইটপোস্টের মাথায় বাতি জ্বলছে। গাছের পাতা ও শাখা-প্রশাখার ছায়া পড়েছে রাস্তায়। আমার পা দুটো মন্থর হয়ে আসে; একটু থেমে দম নিই, পেছনে তাকাই—সেই ছায়াটি হেলেদুলে এগিয়ে আসছে যথারীতি। আমি সামনে ঘুরে পা বাড়াই। হঠাৎ দুপাশ থেকে দুটি মানুষ আমাকে ঘিরে ধরে। একজন আমার ডান হাতের মুঠি থেকে মোবাইল ফোনটা কেড়ে নেয়, অন্যজন খুলে নেয় বাম হাতের ঘড়ি; একই সঙ্গে সে হাত ঢুকিয়ে দেয় প্যান্টের সাইড পকেটে, অন্যজন হিপ-পকেট থেকে বের করে নেয় মানিব্যাগ। আমি ‘ছিনতাই’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠতেই হাড্ডিসার একটা হাত বেড় দিয়ে ধরে আমার গলা; বেশ চওড়া একটা ছুরিতে বিদ্যুতের আলো ঝলকে ওঠে; এক নিমেষে সেটা ঢুকে যায় আমার বুকের ঠিক মাঝখানে; আমার চারপাশটা ঝলকে উঠল এক বিদ্যুচ্চমকে। আমার বুকের ভেতর থেকে কামানের গোলার মতো বেরিয়ে এলাম আমি, ছিটকে পড়লাম হাত দশেক দূরে এবং পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, দুটি লোক উন্মত্তের মতো ছুরি মেরে চলেছে আমার বুকে; আমি আর্তনাদ করে চলেছি, চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে এসেছে; তারা গোল হয়ে ঘিরে দেখছে রক্তাক্ত ছুরির খেলা; তাদের ভিড়ে সেই লোকটিও, যে আমাকে অনুসরণ করছে সেই সকাল থেকে।
আমি ঘুরে দৌড়াতে শুরু করলাম বাসার দিকে; পেছনে উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে একটি মানুষ। তার প্রাণফাটা আর্তনাদে বিদীর্ণ হচ্ছে দিলু রোডের আকাশ-বাতাস।
হাঁপাতে হাঁপাতে কলবেলের বোতামে চাপ দিলাম। দরজা খুলে গেল। আমার সামনে সেই লোকটি, যে আমার পিছু নিয়েছে সেই সকাল থেকে।
No comments