কুফা ডিপটি by সেলিম হোসেন
ধীরে ধীরে
জ্ঞান ফিরল নিশার।
মুখের ওপর পানি ছিটাল কে যেন। চোখ কুঁচকে মাথা ঝাঁকাল নিশা। অমনি একজন চুল ধরে টেনে বসিয়ে দিল ওকে।
নড়ানো যাচ্ছে দেখে বুঝল, হাত-পা খোলাই আছে, বাঁধে নাই।
প্রয়োজন বোধ করে নাই, অবলা মেয়েমানুষ!
কোথায় যেন প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছে না। একটু পরে বুঝল—মাথার পেছনটায়, হাত দিয়ে অনুভব করল চুলের ভেতরে আলু। হঠাৎ করেই সব মনে পড়ল নিশার, বুঝে গেল ও কোথায়।
ঝামেলাটা লাগিয়েছে ডিপটি নামের কিপটা লোকটা, জাকি ভাইয়ের ম্যানেজার।
কেন তাকে কিপটা মনে হয়—জানে না নিশা, তবে ওর জন্য সে একটা মহা কুফা লোক—যতবার দেখা হয়েছে ততবারই কোনো বিপদে পড়তে হয়েছে। একটা শনি যেন!
এবার অবশ্য তেমন কিছু করেনি সে, শুধু একটা বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে।
হাওয়ায় ভেসে একটা খবর এল—ইয়াঙ্গুন থেকে ইয়াবাসম্রাট জ্যাকব আসছে ঢাকায়। সবাই তৈরি, কিন্তু এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশন থেকে বের হওয়ার পর পরই কীভাবে যেন হারিয়ে গেল সে। তক্ষুনি জাকি ভাইয়ের নির্দেশে ডিপটি তার নিজস্ব আন্ডারওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক দিয়ে পাত্তা লাগিয়ে খুঁজে পেল তাকে, উত্তরার এক বাসায় গোপন বৈঠকে বসেছে। রিপোর্ট করল বস জাকি ভাইয়ের কাছে। ঠিক তারপর থেকে নিশাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো ওই ব্যাপারটা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট করার জন্য।
দেরি না করে তখনই কাজে লেগে গেল নিশা। ঠিকানামতো বাড়িটার সামনে গিয়ে কীভাবে ঢুকবে সেটা ভাবছে মাত্র, হঠাৎ দেখে—কার্টুন চরিত্র হিল্লোলের মতো চেহারার বিদ্ঘুটে এক লোক এলোমেলো পায়ে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বেরিয়ে আসছে।
গাড়িতে উঠল।
ভাবনা-চিন্তার বেশি সময় পেল না নিশা, নিলও না।
নিজের ষষ্ঠেন্দ্রিয়কে গুরুত্ব দিয়ে দ্বিতীয় চিন্তা না করে তক্ষুনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল—ওদের মাইক্রোবাসের পেছনে পেছনে যেতে থাকল অফিসের দেওয়া ঝকঝকে প্রাডো চালিয়ে। পিছু নিয়ে নিকুঞ্জের কাছে একটা প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিগোছের এই কারখানার কাছে এসে থামল।
ওরা সবাই ভেতরে ঢুকছে।
গাড়িটা একটু দূরে রেখে হেঁটে ফিরে এসে ভেতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে উঁকিঝুঁকি মারছিল নিশা। হঠাৎ পেছন থেকে আঘাত এল।
বেমক্কা এক বাড়িতেই পড়ে গেল নিশা।
একদম আনাড়ির মতো। এবং তারপর এখন মেঝেতে পড়ে থেকে চারদিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করছে পরিস্থিতির গুরুত্ব।
প্রায় গোল হয়ে চেয়ার, টুল এবং একটা লম্বা বেঞ্চে বসে আছে বিভিন্ন বয়সের কয়েকজন লোক—ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন স্তরের মাফিয়া চক্রের কর্মী-সদস্য কিংবা সরদার। সাদা লুঙ্গি পরা কালো কুচকুচে পেটমোটা যেমন আছে, আবার ফ্যাশনেবল জামাকাপড়ের টাই পরা সুদর্শনও আছে। নিশার মোবাইলটা পকেট থেকে তুলে নিয়ে ওদের দিকে দেখিয়ে ‘এইটা ছাড়া আর কিছু নাই’ বলে ‘অল ক্লিয়ার’ ভঙ্গি করল পানি ছিটানো লোকটা।
কেন নিশাকে ভেতরে নিয়ে এসেছে তাই নিয়ে বকাবকি করল একজন।
‘আমি বাইয়ের লাইগা সিগারেট লইয়া আইতাছি, দেহি এই, বিত্রে ঢুকনের পায়তারা করতাছে।’—কৈফিয়ত দিল লোকটা।
ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিল বলে তার কৈফিয়ত কেউ পাত্তা দিল না। কিন্তু চলে যেতেও বলল না, কেউ এখানে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে চায় না।
বেখাপ্পা চেহারার লোকটার কথা মন দিয়ে শুনছে সবাই। ও কি এখানে তাদের ব্যবসা বাড়াতে এসেছে? ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর’ কথাটা মনে পড়তে হাসি পেল নিশার, বিজনেস অ্যাম্বাসেডর! কথায় কিছুটা যেন চাটগাঁইয়া টান আছে লোকটার। আসলে শিখেছে তো ওই সীমান্ত অঞ্চলের জেলেদের ভাষা।
‘আর ইম্পোর্ট করতে হবে না, এখন অঁনেরাই অইবেন ইন্ডাস্ট্রির মালিক। টাকা লাগিবো অতি সামান্য—দরেন মাত্র...ফাইব মিলিয়ন ডলার।’ তারপর দ্রুত আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে যোগ করল সে, ‘পরে দেবেন, মাল বেচি মুনাফারতুন টাকা শোধ দিবেন। একবার প্রডাকশনে যাইতেন পাইরলেই ত টাকা আর টাকা!’—ব্যাখ্যা করার ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলতে লাগল, ‘দরেন, এই দ্যাশে কত লোক? প্রতিদিন যদি এক কোটি লোকও আমাদের মাল কেনে...দাম কমাই দি সস্তা করি ফালান, তাতে ইয়ুজ বাড়ি যাইব, তো যদি এক টাকা করিও আমনের প্রফিট থাকে, প্রতি-দি-ন এ-ক-কো-টি টাকা! কত খাইবেন, খান না!
‘হ্যাহ্ হ্যাহ্ হ্যাহ্্ শুধু ইয়ং জেনারেশন নয়, একবার মজা পাই গেলে বুড়ারাও খাইব হ্যাহ্ হ্যাহ্।’
‘এবং বেশি জায়গারও দরকার নাই, এই রকম একটা কার্টন ফ্যাক্টরিই যথেষ্ট।’ ব্রিফকেস খুলে একটা ফাইল বের করল লোকটা, ভেতর থেকে বের হলো একটা ড্রয়িং প্রিন্ট, ভাঁজ খুলে বোঝাতে লাগল সে,‘এই হইতেসে ফ্যাক্টরি লে-আউট, দেখেন কত কম জায়গা লাগে, এইখানে মেশিনের অপারেটিং সিস্টেম, ফ্লো ডায়াগ্রাম...সব দেওয়া আসে, দেখলেই বুঝবেন। কাঁচামাল ত আমরাই দিমু, একদম সাধারণ প্যাকেজে চাউলের বস্তা কিংবা ওই ধরনের মালের লগে আইব। আমেন খালি বস্তা খুইলবেন, মেশিনের ওই দিকে ঢাইলবেন আর এইদিক দিয়া আবার প্যাকেটে ভইরবেন, ব্যস, কোটিপতি!’
আস্তে নড়ছে নিশা। ও কখনো এ ধরনের কাজে বুকে বা কোমরে কিছু রাখে না, কারণ তল্লাশি করতে ওখানেই সবার আগে হাত যায়। বাঁ পায়ে গোড়ালি পর্যন্ত উঁচু জুতার ভেতরের দিকে আটকানো ছুরিটা এ মুহূর্তে দরকার নাই, ডান পায়ের জিনসটা একটু তুলে ভেতরের দিকে ফিতা দিয়ে আটকানো ছোট্ট পিস্তলটা আলগা করল সে অনেক সময় নিয়ে।
বের করে হাতের মুঠোয় ধরল শক্ত করে।
পুরোটা সময় খেয়াল রাখল, নিশ্চিত হয়ে নিল—ওকে কেউ দেখছে না।
ধীরেসুস্থে লক্ষ্য স্থির করে পানি ছিটানো লোকটার পায় গুলি করেই এক লাফে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল নিশা কোনার দিকে একটা সুবিধামতো জায়গায়। হকচকিত হয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে সবাইকে নির্দেশ দিল দুই হাত সামনে মেলে দিয়ে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে।
একটু এগিয়ে নিচু হয়ে রক্তাক্ত পায়ের ব্যথায় কাতরাতে থাকা লোকটার পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে নিল।
গুলির শব্দ, রক্তের দৃশ্য এবং সঠিক নিশানার চাক্ষুষ প্রমাণ সবাইকে সতর্ক করে দিয়েছে।
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল, সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে নির্দেশ মেনে মাটিতে এক লাইনে শুয়ে পড়েছে, শুধু...
জাকি ভাইকে ফোন করার জন্য সেটের কি-প্যাড লক খুলে কুইক ডায়াল বাটন চাপছে নিশা।
হঠাৎ নড়ে উঠল একটা ছায়া, ভাঁজ পড়ল দামি জুতায়, দুলে উঠল সুন্দর টাই। নিশার কাছেই ছিল লোকটা, মুহূর্তের অন্যমনস্কতার সুযোগে হামাগুড়ি অবস্থা থেকে স্রেফ একটা ব্যাঙের মতো লাফ দিল অর্বাচীন। পিস্তল, মোবাইল দুটোই হাতছাড়া হয়ে গেল অপ্রস্তুত নিশার।
কিন্তু এ যে নিশা!
ভগ্নাংশ সেকেন্ডে স্প্রিঙের মতো নড়ে উঠল উৎকণ্ঠ নিশার টানটান শরীর, কোথায় কীভাবে কিসের আঘাত লাগল বুঝে ওঠার আগেই পড়ে গেল সুদর্শন, উঠে বসতে গিয়ে দড়াম করে লাথি খেল পেটের পাশে। দেখাদেখি উঠে পড়েছিল আরেকজন, হঠাৎ দেখল নাকের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে একটা ঘুষি; কিন্তু স্বস্তি পাওয়ারও সময় পেল না বেচারা, মুষ্টির অপর প্রান্তের কনুই এসে কানের পাশে এমন জোরে বাড়ি খেল—মাথার ভেতরে মগজ নড়ে গেল তার। সেখান থেকেই এক গড়ান দিয়ে নিজের পিস্তলটা কুড়িয়ে নিল নিশা, গুলি করল আরেক আগুয়ানকে।
এবার আর কেউ তেমন একটা বীরত্ব দেখাবে বলে মনে হচ্ছে না। জ্যাকব শুয়েই আছে, চেয়ে আছে সতর্ক বিড়ালের মতো।
সরে গিয়ে সাবধানে ফোনটা মাটি থেকে তুলে নিল নিশা ওদের থেকে চোখ না সরিয়ে।
কাঁপছে সাইলেন্ট মুডে থাকা ফোন। কে ফোন করেছে দেখার জন্য একঝলক তাকাল স্ক্রিনে।
ওফ, আবার সেই কুফা!—একমুহূর্ত ভাবল সে। ‘হ্যাঁ, ডিপটি ভাই বলেন,’ বাটন চেপে সাড়া দিল।
‘ম্যাডাম, আপনে কই? আমরা ফুল গ্যাঙ আছি এয়ারপোর্টের সামনে, আপনে অহনে কুন জায়গায়? আমরা আমু?’
এবার হাসি এলেও ওদের গম্ভীরভাবে এই জায়গাটা নির্দিষ্ট করে বুঝিয়ে দ্রুত চলে আসতে বলল নিশা।
No comments