‘দীর্ঘমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকারের পথে বাংলাদেশ’ by কাউসার মুমিন
একটি
গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের পথে এসে পৌঁছেছে বাংলাদেশের রাজনীতি ও শাসন
ব্যবস্থা। ‘রিসেট বা একটি দীর্ঘমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকার ব্যবস্থাকেই শেষ
পর্যন্ত বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হিসেবে বেছে নিতে হতে
পারে’
বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের
প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন
ডিসিতে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ‘বাংলাদেশ অন দ্য ব্রিংক’
শীর্ষক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
‘বাংলাদেশ অন দ্য ব্রিংক’ বিষয়ক পাবলিক পলিসি আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের উচিত শুধু বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলা নয়; বরং নির্বাচন পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সঙ্গে কথা বলে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি নিশ্চিত করা, যাতে নির্বাচনে কোন দল হেরে গেলে তারা সরকারি দলের অন্যায় হত্যা সন্ত্রাস ও প্রতিশোধের শিকার না হন। পরাজিত হলে সরকারি দলের নির্যাতন ও প্রতিশোধের ভয়ই মূলত বাংলাদেশের নির্বাচনকে একটি জিরো-সাম গেইমে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশে ১৯৯০-৯৩ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী স্টেট ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র কূটনীতিবিদ ও বর্তমানে ‘উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলার্স’-এর দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকা বিষয়ক সিনিয়র স্কলার উইলিয়াম বি মাইলাম বলেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে আগামীতে বাংলাদেশে একটি পূর্ণ রাজনৈতিক দল (আওয়ামী লীগ) এবং আরেকটি অর্ধেক রাজনৈতিক দল (কয়েকটি ছোট ছোট রাজনৈতিক দল) মিলিয়ে দেড়টি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। রাষ্ট্রদূত মাইলাম মনে করেন, এরকম পরিস্থিতিতে নির্বাচিত সরকার বাংলাদেশকে একটি অধিকতর কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রে পরিণত করবে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত এবার যদি কোন একদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে ১৯৯৬ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। কারণ, ১৯৯৬ কিংবা ২০০৬ সালের পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতি এক নয়।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রাক্তন এই সিনিয়র ডিপ্লোমেট অতি সমপ্রতি তার বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সঙ্গে তার আলোচনার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামনে তিনটি পথ খোলা আছে বলে মনে হয়: ১) সব দলের অংশগ্রহণে একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচন, যার সম্ভাবনা ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসছে। ২) প্রধান বিরোধী দলগুলোকে ছাড়া একটি একতরফা নির্বাচন এবং সর্বশেষ ৩) সম্ভাব্য বিস্ফোরণোন্মুখ রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি দীর্ঘমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকার। উইলিয়াম বি মাইলাম গুরুত্ব দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেশটির রাজনীতি ও প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য এখন একটি ‘টিপিং পয়েন্টে’ এসে দাঁড়িয়েছে। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে রাষ্ট্রদূত মাইলাম বলেন, বাংলাদেশে আমার সামপ্রতিক সফরকালীন অভিজ্ঞতা এবং বেশ কিছু জরিপের ফলাফল থেকে দেখা গেছে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা’ এখনও বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়।’ এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ওয়ারক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে প্রচণ্ড বিরোধপূর্ণ অবস্থান রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রফেসর আলী রীয়াজ তার বক্তব্যে আরও বলেন, যদিও বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের জন্য অনেকেই সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীকেই প্রধান কারণ বলে মনে করেন- কিন্তু এটি একদিনেই ঘটেনি। বরং সংবিধানের পরপর তিনটি সংশোধনীর (১৩তম, ১৪তম ও ১৫তম) মাধ্যমে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। প্রফেসর আলী রীয়াজ পঞ্চদশ সংশোধনীকে কফিনের সর্বশেষ পেরেক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সংবিধানের ওই তিনটি সংশোধনী সম্পূর্ণ একপাক্ষিকভাবে বাংলাদেশের জনমতের তোয়াক্কা না করেই করা হয়েছে। প্রফেসর আলী রীয়াজ প্রশ্ন রেখে বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রচলন কিংবা বাতিলের বিষয়টি কোন রাজনৈতিক দলই তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে কখনও রাখেনি কেন?
সংবিধান সংশোধন বিষয়ক সংসদীয় কমিটির কার্যবিবরণীর উল্লেখ করে প্রফেসর রীয়াজ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান রাখার সংসদীয় কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যাওয়া ঠিক হয়নি। এছাড়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশে সুপ্রিম কোর্টের দীর্ঘসূত্রতাকেও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার জন্য দায়ী বলে মনে করেন তিনি। প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, শুধুমাত্র নির্বাচন অনুষ্ঠানেই বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংকটের সমাধান হবে না। বাংলাদেশের উচিত পুরো সংবিধান আবারও পুনর্মূল্যায়ন করা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটে জাতির সামনে দু্থটি পথ খোলা আছে: এক. অরুচিকর কোন কিছুকে গ্রহণ করা অথবা ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নেয়া। আর সব দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত কোন একতরফা নির্বাচন হবে একটি ধ্বংসাত্মক মন্দ আইডিয়া।
No comments