রানা প্লাজার প্রেতাত্মা
সময়ের হিসাবে নিউইয়র্কের তুলনায় ক্যালিফোর্নিয়া তিন ঘণ্টা পিছিয়ে। সে হিসাব না করেই আমি জেসন মটলাঘকে সকালে ফোন করেছিলাম। হয়তো তখনো ঘুমোচ্ছিলেন। বিকেলের দিকে তাঁর ফিরতি ফোন পেলাম। জেসন এ বছরের গোড়ার দিকে ও গত আগস্টে তাজরীন তৈরি পোশাক কারখানায় ও রানা প্লাজায় মারাত্মক দুর্ঘটনার ওপর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে কয়েক সপ্তাহ কাটিয়ে এসেছেন। পুলিৎজার সেন্টার অন ক্রাইসিস রিপোর্টিংয়ের জন্য প্রস্তুত তাঁর সর্বশেষ লেখাটি ছাপা হয়েছে নিউইয়র্কের সাপ্তাহিক নেশন পত্রিকায়। সে লেখা ‘বাংলাদেশে মৃতদের কোনো সুবিচার নেই’—পড়েই জেসনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা। তাঁর লেখার মতো কথায়ও গভীর বেদনার সুর। ‘আমি একদম নিঃস্ব এমন একদল মানুষ দেখেছি, যাদের আশা করার মতো কোনো আশ্রয় নেই, কোনো জায়গা নেই। যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রতিটি মৃত শ্রমিকের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্কের অর্থ দেবে, তারা সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। টেলিভিশন ক্যামেরা নেই, ফলে বড় কর্তারাও উধাও।’ রশিদা নামে এক নারীর কথা বললেন জেসন।
তাঁর লেখায়ও রশিদার কথা আছে আগাগোড়া। সাভারের অতিদরিদ্র দিনমজুরের স্ত্রী, তাঁদের ১৬ বছরের কন্যা ফাতেমা রানা প্লাজার এক পোশাক কারখানায় কাজ করত। প্রতি মাসে বেতন ছিল প্রায় ১১০ ডলার। বিধ্বস্ত ভবনের নিচে তার লাশ, কিন্তু সে লাশ এমন ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে সঠিকভাবে তাকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য স্থানীয় এক পরীক্ষাগারে নমুনা দেওয়া হয়েছে, কিন্তু দুর্ঘটনার ছয় মাস পরেও পরীক্ষার ফল মেলেনি। রশিদা প্রতিদিন রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের সামনে আরও কয়েক শ স্বজনহারা নারী-পুরুষের সঙ্গে জমায়েতে যোগ দিয়েছেন, বুকের ওপর ফাতেমার ছবি। বিদেশি সাংবাদিক জেনে জেসনের কাছে ছুটে এসেছেন, তাঁর হাত ধরে মিনতি করেছেন একটা কিছু করতে। অক্ষম সাংবাদিক, কাগজে নিজের নাম লিখে বিদায় নিয়েছেন, কিন্তু এখনো সে মহিলার আহাজারি তাঁর কানে বাজে। প্রতিশ্রুতির অবশ্য কমতি নেই। বলা হয়েছিল প্রতিটি মৃতের জন্য প্রাথমিকভাবে এক হাজার ২০০ ডলারের মতো সাহায্য দেওয়া হবে। বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের জানের মূল্য এক লাখ টাকা, তা দিতেই আমাদের কর্তাবাবুদের নাভিশ্বাস। কিন্তু সে টাকা পেতে হলে মৃতের পরিচিতি সুনিশ্চিত করতে হবে। সে পরিচয় সুনিশ্চিত করা যাচ্ছে না, ফলে প্রতিশ্রুত লাখ টাকাও মিলছে না রশিদা ও তার স্বামীর। এ রকম অসংখ্য রশিদার সঙ্গে জেসনের দেখা হয়েছে। কারও নাম মনে আছে, কারও নাম জানাই হয়নি। জানা নেই, শোনা নেই, অথচ তাদের প্রত্যেকে মনে হয় নিকটাত্মীয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানায় যে হরহামেশা আগুন ধরে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, জেসন তার জন্য শুধু বাংলাদেশের পোশাক কারখানার মালিক ও সরকারের ওপর ক্ষিপ্ত নন। বিদেশি আমদানিকারক, যারা ইচ্ছা করলেই পোশাক কারখানার নিরাপত্তার প্রশ্নটি অগ্রাধিকার নিয়ে বিবেচনায় আনতে পারত, তাদেরও সমানভাবে দোষী ভাবেন। শুধু সমান কেন, তারা হয়তো একটু বেশিই দোষী। একদম পানির দামে তৈরি পোশাক আসছে আমেরিকার সাজানো দোকানে। ওয়াল-মার্ট, সিয়ার্স, ডিজনি ইত্যাদি নামজাদা সব কোম্পানি বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের ক্লায়েন্ট। যেসব কারখানায় পোশাক তৈরি হচ্ছে, তার নিরাপত্তা যে খুবই নড়বড়ে, এ কথা তো তারা খুব ভালো করেই জানে। তার পরেও এ প্রশ্নে মালিকপক্ষের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট দাবি তোলেনি। কারণটা সহজ, সে প্রশ্ন তুললেই দাবি উঠবে তৈরি পোশাকের ক্রয়মূল্য বাড়াও। আমেরিকার কোম্পানিগুলোর তুলনায় ইউরোপীয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বেশি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছে। গত বছর দেশি-বিদেশি শ্রমিক অধিকার সংস্থাসমূহের উদ্যোগে ও বিভিন্ন দাতা দেশের সমর্থনে যে অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা চুক্তি প্রস্তুত হয়, ইউরোপের অধিকাংশ প্রধান তৈরি পোশাক আমদানিকারকেরা তাতে স্বাক্ষর করেছে। আইনত বলবৎযোগ্য এই চুক্তি অনুসারে কারখানার মালিকেরা কারখানা ভবনের নিরাপত্তার জন্য দায়ী থাকবেন, তা রক্ষায় ব্যর্থ হলে বিদেশে পণ্য রপ্তানির অধিকার হারাবেন।
পাঁচ বছর মেয়াদি এই চুক্তি অনুসারে কারখানার মালিকেরা প্রতিটি কারখানায় অগ্নিরোধের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন এবং নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে ভবনের নিরাপত্তা পরীক্ষার ব্যবস্থা করবেন। এ জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী বিদেশি কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সাহায্য প্রদানে সম্মত হয়েছে। খুবই সামান্য সে অর্থের পরিমাণ, তবে কাজ শুরুর জন্য তার গুরুত্ব অপরিসীম। এ পর্যন্ত শ খানেক বিদেশি কোম্পানি চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু তাদের মধ্যে মার্কিন এমন কোম্পানির সংখ্যা মোটে তিন (অ্যাবারক্রম্বি অ্যান্ড ফিচ, পিভিএইচ ও আমেরিকার ইগল)। ওয়াল-মার্টসহ ১৫টি মার্কিন কোম্পানি অবশ্য একটি ভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, তাতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার থাকলেও চুক্তিটি আইনত বলবৎযোগ্য নয়। অর্থাৎ, প্রথম চুক্তির মতো এই দ্বিতীয় চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী কোম্পানিগুলো ভবিষ্যতের কোনো অগ্নিকাণ্ড বা অন্য কোনো দুর্ঘটনার জন্য আইনগত ব্যবস্থার সম্মুখীন হবে না। ইউরোপীয় কোম্পানিসমূহ কারখানার নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে অর্থ সংস্থানে সম্মত হয়েছে, কিন্তু মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের স্বাক্ষর করা চুক্তি অনুসারে বড়জোর কারখানার মালিক ও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ‘যৌথ দায়িত্ববোধ’ অনুসরণ করবে। সোজা কথায়, শ্রমিকস্বার্থ রক্ষায় তারা কোনো দায়দায়িত্ব নিতে রাজি নয়।
বলাই বাহুল্য, মার্কিন কোম্পানিসমূহের একমাত্র লক্ষ্য মুনাফা। জেসনের মতো সাংবাদিকেরা সে-কথা খুব ভালো করেই জানেন। বাংলাদেশে তৈরি পোশাকে শ্রমিকের রক্তের দাগ রয়েছে, এই অভিযোগ তুলে সে পণ্য বয়কটের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহলে। আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পণ্যের বাণিজ্যিক অগ্রাধিকার বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জেসন আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, বাংলাদেশে প্রস্তুত তৈরি পোশাক এ দেশে বিনা শুল্কের সুবিধা কখনো পায়নি। ফলে এই অর্থহীন হুমকির কোনো মানে নেই। তবে বাংলাদেশের জন্য তা এক ধরনের হুঁশিয়ারি বটে। ইউরোপীয়রাও যদি সেই পথ অনুসরণ করে, তাহলে সংকটের সৃষ্টি হবে। জেসনের ধারণা, ‘ব্যাড পাবলিসিট’-এর পরেও আমেরিকায় বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বিঘ্নিত হবে না। ‘এত সস্তায় তৈরি পোশাক আর কে দেবে, বলুন?’ জেসন ফিরে ফিরে আমাকে রশিদার মতো অসহায় মানুষের কথা বলছিলেন। যে শান-শওকতের সঙ্গে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা জীবনযাপনে অভ্যস্ত, সে তুলনায় পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা কার্যত নিঃস্ব। তাঁদের ন্যূনতম বেতন পাঁচ হাজার ৩০০ টাকা করতেই এই মালিকদের তা মানতে বুক ফেটে যাচ্ছে। কাদের ঘামের ওপর তাঁদের ইমারত গড়ে উঠেছে,
সে কথা কি তাঁরা কখনো ভাবেন? আমি জানতে চেয়েছিলাম, পোশাকশ্রমিকদের প্রতি কারখানার মালিক ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে কি একধরনের শ্রেণীবৈষম্য রয়েছে? রানা প্লাজা বা তাজরীনের ভুক্তভোগীদের নিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে এখন আর কোনো উচ্চবাচ্য নেই। একদম ভিখারি এমন একদল মানুষের ভাগ্য নিয়ে ভাবার মতো বাড়তি সময় বাংলাদেশি মিলের মালিকদের তো নেই-ই, তথ্যমাধ্যমেরও নেই। সে কথা মাথায় রেখেই এই প্রশ্ন। জেসন আমার প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দিলেন না, পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী ভাবো? উত্তরে আমি কী বলেছিলাম, সে-কথা বলার বদলে আমি বরং আপনাদেরই সে-কথা জিজ্ঞেস করি। সত্যি কি রানা প্লাজার নিহত শ্রমিকদের অথবা তাঁদের অসহায় স্বজনদের বিপন্ন অস্তিত্বের কথা আপনাদের কারও মনে পড়ে? নির্বাচনের আয়োজনে পুরো বাংলাদেশ এখন মশগুল। ডান-বাম বা মধ্যপন্থী কোনো রাজনৈতিক দলের কর্তাব্যক্তিরা কি তাঁদের সমস্যার সঙ্গে আদৌ পরিচিত? তাঁদের কারও আগাম নির্বাচনী ঘোষণায় তো এ নিয়ে একটি বাক্য ওপরে লিখিত হয়েছে, তা নজরে আসেনি। এই গরিব মানুষগুলোকে চোখের যত দূরে রাখা যায়, তাতেই কি আমরা অধিক স্বস্তি বোধ করি না? জানতে ইচ্ছা করে, দুঃখী রশিদা কি শেষ পর্যন্ত নিহত কন্যার জানের বদলা হিসেবে সামান্য কয়েক হাজার টাকা পেয়েছেন? তাঁর স্বামী মজিদ একটি চায়ের দোকান দেবেন, ফাতেমার আয়ের ওপর ভরসা করেই সে স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন। সে দোকান কি তাঁর হলো? আমেরিকা থেকে একজন জেসন মটলাঘ আবার বাংলাদেশে এসে খবর না করা পর্যন্ত এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথাই হয়তো নেই।
No comments