গল্প- উষ্টা by হরিশংকর জলদাস
চোখ পাকিয়ে বললাম, ‘ছাড় ছাড়, পা ছাড়।’
তারপর ডান হাত বাড়িয়ে ডাবটি নিলাম। স্ট্র-এ একটা জোর টান দিয়ে আবার কঠিন
গলায় বললাম, ‘এই ছাড়লি না! দিব একটা উষ্টা।’
ধমক
খেয়ে ছেলেটি ফুট চারেক দূরে গিয়ে বসে পড়ল। ডান হাতটা বাড়িয়ে করুণ মুখে
ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়তে লাগল। তার অনুনয়ে ভিক্ষুকের অভিব্যক্তি। আরও একটু
দূরে সাত-আটজনের জটলা। বয়স দু-এক বছর এদিক-ওদিক।
২. আমি একটা বেসরকারি ব্যাংকের ওজনদার কর্মকর্তা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেতন পাই। থাকি আলিশান ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটা অবশ্য আমার নয়। ব্যাংকই ভাড়া দেয়। ব্যাংকারদের সকাল-সন্ধ্যার অফিস। আমারও একই অবস্থা। খালু পড়ে আছেন সিএসসিআর হাসপাতালে। তাঁকে যে একটু দেখতে যাব, সেই সময়টাও পাচ্ছি না। আগ্রাবাদ থেকে বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে কখনো সন্ধ্যা, কখনো রাত।
সেদিন শুক্রবার। হাসনা চেপে ধরল, ‘খালুকে একবার দেখে আসো। বারবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।’ আত্মীয় বলে কথা। মনটাও বলল, ‘তুমি ছাড়া আর কেউ চাকরি করে না! যাও, একবার দেখে আসো খালুকে। তুমি ভুলে গেছ বোধহয়, তোমার বাবার মৃত্যুর পর এই খালুই তোমার পড়ার খরচ চালিয়েছিলেন।’
৩.
ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেল। শুক্রবার সকালে হাসনা লুচি বানায়। সঙ্গে মুগডাল। মুগডালে মুরগির ছুটকা ছাটকা। এক মগ কফিও দেয় হাসনা, শুক্রবারে। আয়েশ করে খাওয়ার অন্য কোনো সকাল পাই না তো!
বাসা থেকে সিএসসিআর মাইল দুয়েক। রিকশায় গেলাম। গাড়ি কিনিনি। অফিসের গাড়িতে যাতায়াত করি। বন্ধের দিন অফিসের গাড়ি ব্যবহার করি না। ফিরতে ফিরতে সাড়ে ১২টার মতোন হলো। অক্টোবরের প্রথম দিক। হেঁটে বাসায় ফিরব, মনস্থ করলাম। হাঁটি না তো বহুদিন।
রাস্তাটা উঁচু মতোন। ওপর দিকে বেয়ে উঠতে হয়। দুদিকে ছোট-বড় নানা হাসপাতাল। সবই বেসরকারি। হাসপাতালগুলো চটকদারিতে ভরা। সামনে বাহারি ফুলের বাগান, গাড়ি রাখার সুন্দর জায়গা। রাস্তার দুই পাশে প্রশস্ত ফুটপাত। ফুটপাত ধরে হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম, ভেতরের যন্ত্রপাতি নড়বড়ে হয়ে গেছে। নইলে কেন আধা মাইল হাঁটার পর ছাতি শুকিয়ে গেল! মাথার ওপর সূর্যের তেজটাও বেশ চাগিয়ে উঠেছে। ভীষণ তৃষ্ণায় পেয়ে বসল আমাকে। আশপাশে কোনো দোকানপাট নেই যে পানি কিনে খাই। হঠাৎ সামনে নজর পড়ল। দেখলাম, ফুটপাত ঘেঁষে একটা রিকশাভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানে থরে থরে সবুজ ডাব সাজানো। পাশে দাও হাতে ডাববিক্রেতা। প্রায় জোর কদমে হেঁটে গেলাম ভ্যানের পাশে। একটা ডাবের অর্ডার দিলাম, দরাদরি করার ধৈর্য নেই। ডাবটার মুখাংশ কেটে একটা স্ট্র ঢুকিয়ে আমার হাতে দিতে-না দিতেই ঝুপ করে কী যেন আমার পায়ে এসে পড়ল। ত্বরিত তাকিয়ে দেখি সাত-আট বছরের একটা বালক আমার পা জড়িয়ে কী যেন বলতে চাইছে। চোখেমুখে সব বিরক্তি ঢেলে আমি বললাম, ‘ছাড়, ছাড়...।’
৪.
পানি খাওয়া শেষ করে ডাবটা একটু দূরে ছুড়ে ফেললাম। চোখের পলকে ওটার ওপর সাত-আটজন বালক ঝাঁপিয়ে পড়ল। পা জড়িয়ে ধরা ছেলেটি যেখানে ছিল ওখানেই বসে রইল। কিন্তু হাত বাড়িয়ে থাকল আমার দিকে।
ডাবওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলেগুলো ডাবটার জন্য এ রকম ঝটকাঝটকি করছে কেন?’
ডাবওয়ালা টাকা ফেরত দিতে দিতে বলল, ‘ডাবের ভেতরে শাঁস আছে।’
সামনের দিকে পা বাড়ানোর আগে ছেলেটার দিকে একপলক তাকালাম। আমার চাহনি দেখে ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। আমি হাঁটা শুরু করলাম। ছেলেটি আমার পিছু নিল। হাত সামনের দিকে প্রসারিত, আগের মতো। কিছুক্ষণের মধ্যে ওর আর আমার দূরত্ব কমিয়ে আনল সে। ওই মুহূর্তে আমার কী হলো জানি না, কষে একটা ধমক ছিলাম, ‘গেলি তুই।’ ছেলেটি থমকে দাঁড়াল। তার চোখেমুখে বিস্ময় আর ঘৃণার মেশামেশি। আমি আমার পায়ে জোর লাগালাম।
কিছু দূর যাওয়ার পর আমি অস্থির অস্থির বোধ করতে লাগলাম। মাথার ভেতর কিছু একটা চিড়বিড় করে উঠল। বুকটার ভেতর কিসের যেন একটা মোচড়। চট করে পেছনে ফিরলাম, দেখি ছেলেটা নেই।
কেন ছেলেটাকে ধমক দিলাম? আমার মতো একজন শিক্ষিত, সচ্ছল ব্যক্তির পেছনে একটা জীর্ণ-বিবর্ণ পোশাকের বালক হাঁটছে বলে! আমার মনে হলো, আমার মতো একজন পদস্থ কর্মকর্তার পেছনে একজন ভিক্ষুক হাঁটছে, আমি তাকে কোনো সাহায্য করছি না, আর তা পথচারীরা দেখে ঘৃণা ছুড়ে দিচ্ছে আমার দিকে। পথচারীর এই ঘৃণার হাত থেকে বাঁচার জন্য অথবা একটা বালকভিক্ষুক আমার পিছু নিয়েছে বলে আমার তথাকথিত ভদ্রতাবোধ মাথা চাগিয়ে উঠেছে, তাই ওভাবে ধমক দিয়েছি। অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা একজন আমি। আমার বর্তমান সাফল্যই কি প্ররোচিত করেছে বালকটিকে ধমক দেওয়ার জন্য! নাকি এ আমার আইডেনটিটি ক্রাইসিস! আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভোগা মানুষরাই কেবল কৃত্রিম অহমিকায় উদ্ভ্রান্ত হয়। আমি কি একজন অহংবোধে বিভ্রান্ত মানুষ! এ রকম ভাবনা আমার স্মৃতি-সত্তাকে গ্রাস করে ফেলল, পুরোদমে। কী নাম হতে পারে ছেলেটির! খলিল, খোকন, দুলাল, প্রশান্ত, জসিম অথবা ইত্যাদি ইত্যাদি।
ধরে নিই বালকটির নাম দুলাল। দুলালের কথা ভাবতে ভাবতে ঘোরের মধ্যে আমি সামনের দিকে হাঁটতে থাকলাম।
এক দিনমজুরের ঘরে জন্ম আমার। বাবা রাজমিস্ত্রির হেলপারগিরি করত। পাঁচ সন্তান আর স্ত্রীর ভরণপোষণ নিয়ে বাপকে হিমশিম খেতে হতো। সব সময় বাবা কাজ পেত না। যেদিন বেকার থাকত বাবা, সেদিন চুলা জ্বলত না আমাদের। আমি ক্লাস এইটে পড়ার সময় বাবা এক নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের কার্নিশ ভেঙে নিচে পড়ে মারা গেল। কন্ট্রাক্টর হাজার পাঁচেক টাকা মায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে পার পেয়ে গেল।
আমি পড়া অব্যাহত রেখেই বাবার দিনমজুরিকে বেছে নিলাম। মা-ই ছিল আমার ভরসা ও শক্তি।
খালা ভীষণ সুন্দরী ছিল। এ জন্য ধনী ঘরের যুবক আবদুল হাকিম খালাকে বিয়ে করলেন। হাকিম খালু ধনান্ধ ছিলেন না। দরদি ছিলেন। খালার অনুরোধে হাকিম খালু আমার দায়িত্ব নিলেন। তারই দয়ায় আমি পড়াশোনা শেষ করলাম। চাকরিও পেয়ে গেলাম ব্যাংকে, তারপর আমার বর্তমান গৌরব, প্রতিপত্তি।
খালু-খালার দয়া না পেলে আমিও তো দুলাল হতে পারতাম! হাকিম খালুর আনুকূল্যের কারণে আজ আমি বিশাল ফ্ল্যাটে থাকি। সুখৈশ্বর্যের কারণে আমার চল্লিশ ছুঁই ছুঁই স্ত্রীকে ত্রিশের নিচে বলে মনে হয়। একমাত্র ছেলে আমার। তার কোনো কিছুর অভাব রাখিনি আমি। তার কয়টি প্যান্ট আর কয়টি শার্ট আছে আমি জানি না। কলেজ পড়ুয়া ছেলেটির হাতে বিশ হাজার টাকার মোবাইল। সকালের নাশতার টেবিলে মা-ছেলের ধস্তাধস্তি দেখি। মা বলে, খাও খাও; ছেলে বলে, খাব না, খিদে নেই। মা বলে, ডিমপোচ আর কমলার জুসটা অন্তত খেয়ে যাও। ছেলে বলে, মা বিরক্ত কোরো না, কলেজের দেরি হয়ে গেল।
আমাদের বাসায় খাবারের ছড়াছড়ি। উচ্ছিষ্টে উচ্ছিষ্টে ঘরের মিনিডাস্টবিন ভরে ওঠে।
৫.
দুলাল আমার কাছে কী চেয়েছিল? পাঁচ-দশটা টাকা! উদরপূর্তির জন্য। হয়তো সকালে সে কিছুই খেতে পায়নি। হয়তো গত রাতেও তার পেটে কিছু পড়েনি। কেউ তার হাতে দু-চারটা টাকা ফেলে দেয়নি। অথবা কোনো হোটেললগ্ন ডাস্টবিনে খাবার কাড়াকাড়িতে কমজোর দুলাল পরাস্ত হয়েছিল গত রাতে। তার বাপ নেই হয়তো। মা দশ মাস পরে তাকে প্রসব করেই টাকার জন্য অন্য পুরুষে মগ্ন হয়েছে। তার অন্নসংস্থানের জন্য মায়ের কোনো দায় নেই।
আমার মানিব্যাগ ভর্তি টাকা। স্বচ্ছন্দে কুড়ি টাকার ডাব ত্রিশ টাকা দিয়ে কিনে খেলাম। সেই আমি দুলালের হাতে দু-চার টাকা দেওয়াকে অপচয় মনে করলাম। নাকি এ আমার কার্পণ্য, নাকি ঘৃণা! একজন দিনমজুরের ছেলের মনে দুলালদের জন্য এত ঘৃণা লুকিয়ে ছিল!
আমার ভেতরে একধরনের কাঁপন অনুভব করতে লাগলাম আমি। আমার বিবমিষা জাগল হঠাৎ। সব ভদ্রতা ভুলে আমি নালার ধারে বসে পড়লাম। গলগল করে বমি বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।
আমি ঠিক করলাম, দুলালের কাছে ফিরে যাব।
ফিরে যেতে যেতে ভাবলাম, দুলালকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকব। কাচ্চি বিরিয়ানির অর্ডার দেব। এক্সট্রা এক প্লেট মাংস নেব। দুলালকে বলব, ‘খাও দুলাল, খাও। পেট ভরে খাও।’ আমি চেয়ে চেয়ে তার বিরিয়ানি খাওয়া দেখব, কর্তন দাঁত দিয়ে মাংস ছিঁড়ে খাওয়া দেখব। আসার সময় তার হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলব, ‘আমাকে মাফ করে দে দুলাল।’
ডাব-ভ্যানের চারপাশে আঁতিপাঁতি খুঁজেও দুলাল বা দুলালদের দেখতে পেলাম না। নিরুপায় আমি ডাবওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে যে একটা ছেলে ছিল সে কোথায়?’
ডাবওয়ালা নির্লিপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কোন ছেলেটা?’
‘ওই যে, আমার পা জড়িয়ে ধরেছিল যে ছেলেটা!’ ব্যগ্রভাবে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
উদাসীন গলায় ডাবওয়ালা বলল ‘কোন ছেলেটা আপনার পা জড়িয়ে ধরেছিল আমি তো খেয়াল করিনি।’
আমি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই যে সাত-আটজন ছেলে ছিল এখানে, ওদের থেকে একটু আলাদা হয়ে বসে ছিল সে।’
ডাবওয়ালা বিরক্ত মুখে বলল, ‘গরিব মানুষ, ডাব বেচায় ব্যস্ত থাকি। সবার দিকে নজর রাখা তো সম্ভব নয় স্যার।’ বুঝলাম ও আমার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নয়।
তার পরও আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম ভ্যানের পাশে। দীর্ঘক্ষণ। আশা, দুলাল একসময় ফিরে আসবে। কিন্তু দুলাল বা দুলালরা এল না। এত বড় শহর! অন্য কোনোখানে হয়তো খাবারের জন্য হামলে পড়েছে।
৬.
বাড়ি ফিরি। স্ত্রী জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে তোমার?’ আমি নিরুত্তর থাকি। রাতে স্বল্পাহার শেষে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাই। ওই রাতেই স্বপ্ন দেখি দুলালকে, ডান হাত আমার দিকে প্রসারিত, চোখেমুখে আকুতি। ঘুম ভেঙে যায় আমার। ছটফট করে রাত কাটে।
যথানিয়মে অফিসে যাই। সুযোগ পেলে সিএসসিআর হাসপাতালের সামনে যাই। ইতিউতি দুলালকে খুঁজি। পাই না। হতোদ্যম হয়ে বাসায় ফিরি। দু-একদিন পর আবার যাই। ব্যর্থ হয়ে ফিরি।
মাঝেমধ্যে রাতে স্বপ্ন দেখি দুলালকে, সামনে হাত বাড়িয়ে মিনতিভরা চোখে আমার কাছে কী যেন চাইছে।
ঘুমের ঘোরে কানে বাজে আমারই কণ্ঠ, ‘এই ছাড়লি! দেব একটা উষ্টা!’
জেগে উঠি। ভাবি, এই উষ্টা কার জন্য! দুলালদের জন্য! না আমার জন্য!
২. আমি একটা বেসরকারি ব্যাংকের ওজনদার কর্মকর্তা। প্রয়োজনের অতিরিক্ত বেতন পাই। থাকি আলিশান ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটা অবশ্য আমার নয়। ব্যাংকই ভাড়া দেয়। ব্যাংকারদের সকাল-সন্ধ্যার অফিস। আমারও একই অবস্থা। খালু পড়ে আছেন সিএসসিআর হাসপাতালে। তাঁকে যে একটু দেখতে যাব, সেই সময়টাও পাচ্ছি না। আগ্রাবাদ থেকে বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে কখনো সন্ধ্যা, কখনো রাত।
সেদিন শুক্রবার। হাসনা চেপে ধরল, ‘খালুকে একবার দেখে আসো। বারবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন।’ আত্মীয় বলে কথা। মনটাও বলল, ‘তুমি ছাড়া আর কেউ চাকরি করে না! যাও, একবার দেখে আসো খালুকে। তুমি ভুলে গেছ বোধহয়, তোমার বাবার মৃত্যুর পর এই খালুই তোমার পড়ার খরচ চালিয়েছিলেন।’
৩.
ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে একটু দেরিই হয়ে গেল। শুক্রবার সকালে হাসনা লুচি বানায়। সঙ্গে মুগডাল। মুগডালে মুরগির ছুটকা ছাটকা। এক মগ কফিও দেয় হাসনা, শুক্রবারে। আয়েশ করে খাওয়ার অন্য কোনো সকাল পাই না তো!
বাসা থেকে সিএসসিআর মাইল দুয়েক। রিকশায় গেলাম। গাড়ি কিনিনি। অফিসের গাড়িতে যাতায়াত করি। বন্ধের দিন অফিসের গাড়ি ব্যবহার করি না। ফিরতে ফিরতে সাড়ে ১২টার মতোন হলো। অক্টোবরের প্রথম দিক। হেঁটে বাসায় ফিরব, মনস্থ করলাম। হাঁটি না তো বহুদিন।
রাস্তাটা উঁচু মতোন। ওপর দিকে বেয়ে উঠতে হয়। দুদিকে ছোট-বড় নানা হাসপাতাল। সবই বেসরকারি। হাসপাতালগুলো চটকদারিতে ভরা। সামনে বাহারি ফুলের বাগান, গাড়ি রাখার সুন্দর জায়গা। রাস্তার দুই পাশে প্রশস্ত ফুটপাত। ফুটপাত ধরে হাঁটতে গিয়ে টের পেলাম, ভেতরের যন্ত্রপাতি নড়বড়ে হয়ে গেছে। নইলে কেন আধা মাইল হাঁটার পর ছাতি শুকিয়ে গেল! মাথার ওপর সূর্যের তেজটাও বেশ চাগিয়ে উঠেছে। ভীষণ তৃষ্ণায় পেয়ে বসল আমাকে। আশপাশে কোনো দোকানপাট নেই যে পানি কিনে খাই। হঠাৎ সামনে নজর পড়ল। দেখলাম, ফুটপাত ঘেঁষে একটা রিকশাভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানে থরে থরে সবুজ ডাব সাজানো। পাশে দাও হাতে ডাববিক্রেতা। প্রায় জোর কদমে হেঁটে গেলাম ভ্যানের পাশে। একটা ডাবের অর্ডার দিলাম, দরাদরি করার ধৈর্য নেই। ডাবটার মুখাংশ কেটে একটা স্ট্র ঢুকিয়ে আমার হাতে দিতে-না দিতেই ঝুপ করে কী যেন আমার পায়ে এসে পড়ল। ত্বরিত তাকিয়ে দেখি সাত-আট বছরের একটা বালক আমার পা জড়িয়ে কী যেন বলতে চাইছে। চোখেমুখে সব বিরক্তি ঢেলে আমি বললাম, ‘ছাড়, ছাড়...।’
৪.
পানি খাওয়া শেষ করে ডাবটা একটু দূরে ছুড়ে ফেললাম। চোখের পলকে ওটার ওপর সাত-আটজন বালক ঝাঁপিয়ে পড়ল। পা জড়িয়ে ধরা ছেলেটি যেখানে ছিল ওখানেই বসে রইল। কিন্তু হাত বাড়িয়ে থাকল আমার দিকে।
ডাবওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছেলেগুলো ডাবটার জন্য এ রকম ঝটকাঝটকি করছে কেন?’
ডাবওয়ালা টাকা ফেরত দিতে দিতে বলল, ‘ডাবের ভেতরে শাঁস আছে।’
সামনের দিকে পা বাড়ানোর আগে ছেলেটার দিকে একপলক তাকালাম। আমার চাহনি দেখে ছেলেটি উঠে দাঁড়াল। আমি হাঁটা শুরু করলাম। ছেলেটি আমার পিছু নিল। হাত সামনের দিকে প্রসারিত, আগের মতো। কিছুক্ষণের মধ্যে ওর আর আমার দূরত্ব কমিয়ে আনল সে। ওই মুহূর্তে আমার কী হলো জানি না, কষে একটা ধমক ছিলাম, ‘গেলি তুই।’ ছেলেটি থমকে দাঁড়াল। তার চোখেমুখে বিস্ময় আর ঘৃণার মেশামেশি। আমি আমার পায়ে জোর লাগালাম।
কিছু দূর যাওয়ার পর আমি অস্থির অস্থির বোধ করতে লাগলাম। মাথার ভেতর কিছু একটা চিড়বিড় করে উঠল। বুকটার ভেতর কিসের যেন একটা মোচড়। চট করে পেছনে ফিরলাম, দেখি ছেলেটা নেই।
কেন ছেলেটাকে ধমক দিলাম? আমার মতো একজন শিক্ষিত, সচ্ছল ব্যক্তির পেছনে একটা জীর্ণ-বিবর্ণ পোশাকের বালক হাঁটছে বলে! আমার মনে হলো, আমার মতো একজন পদস্থ কর্মকর্তার পেছনে একজন ভিক্ষুক হাঁটছে, আমি তাকে কোনো সাহায্য করছি না, আর তা পথচারীরা দেখে ঘৃণা ছুড়ে দিচ্ছে আমার দিকে। পথচারীর এই ঘৃণার হাত থেকে বাঁচার জন্য অথবা একটা বালকভিক্ষুক আমার পিছু নিয়েছে বলে আমার তথাকথিত ভদ্রতাবোধ মাথা চাগিয়ে উঠেছে, তাই ওভাবে ধমক দিয়েছি। অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা একজন আমি। আমার বর্তমান সাফল্যই কি প্ররোচিত করেছে বালকটিকে ধমক দেওয়ার জন্য! নাকি এ আমার আইডেনটিটি ক্রাইসিস! আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভোগা মানুষরাই কেবল কৃত্রিম অহমিকায় উদ্ভ্রান্ত হয়। আমি কি একজন অহংবোধে বিভ্রান্ত মানুষ! এ রকম ভাবনা আমার স্মৃতি-সত্তাকে গ্রাস করে ফেলল, পুরোদমে। কী নাম হতে পারে ছেলেটির! খলিল, খোকন, দুলাল, প্রশান্ত, জসিম অথবা ইত্যাদি ইত্যাদি।
ধরে নিই বালকটির নাম দুলাল। দুলালের কথা ভাবতে ভাবতে ঘোরের মধ্যে আমি সামনের দিকে হাঁটতে থাকলাম।
এক দিনমজুরের ঘরে জন্ম আমার। বাবা রাজমিস্ত্রির হেলপারগিরি করত। পাঁচ সন্তান আর স্ত্রীর ভরণপোষণ নিয়ে বাপকে হিমশিম খেতে হতো। সব সময় বাবা কাজ পেত না। যেদিন বেকার থাকত বাবা, সেদিন চুলা জ্বলত না আমাদের। আমি ক্লাস এইটে পড়ার সময় বাবা এক নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের কার্নিশ ভেঙে নিচে পড়ে মারা গেল। কন্ট্রাক্টর হাজার পাঁচেক টাকা মায়ের হাতে গুঁজে দিয়ে পার পেয়ে গেল।
আমি পড়া অব্যাহত রেখেই বাবার দিনমজুরিকে বেছে নিলাম। মা-ই ছিল আমার ভরসা ও শক্তি।
খালা ভীষণ সুন্দরী ছিল। এ জন্য ধনী ঘরের যুবক আবদুল হাকিম খালাকে বিয়ে করলেন। হাকিম খালু ধনান্ধ ছিলেন না। দরদি ছিলেন। খালার অনুরোধে হাকিম খালু আমার দায়িত্ব নিলেন। তারই দয়ায় আমি পড়াশোনা শেষ করলাম। চাকরিও পেয়ে গেলাম ব্যাংকে, তারপর আমার বর্তমান গৌরব, প্রতিপত্তি।
খালু-খালার দয়া না পেলে আমিও তো দুলাল হতে পারতাম! হাকিম খালুর আনুকূল্যের কারণে আজ আমি বিশাল ফ্ল্যাটে থাকি। সুখৈশ্বর্যের কারণে আমার চল্লিশ ছুঁই ছুঁই স্ত্রীকে ত্রিশের নিচে বলে মনে হয়। একমাত্র ছেলে আমার। তার কোনো কিছুর অভাব রাখিনি আমি। তার কয়টি প্যান্ট আর কয়টি শার্ট আছে আমি জানি না। কলেজ পড়ুয়া ছেলেটির হাতে বিশ হাজার টাকার মোবাইল। সকালের নাশতার টেবিলে মা-ছেলের ধস্তাধস্তি দেখি। মা বলে, খাও খাও; ছেলে বলে, খাব না, খিদে নেই। মা বলে, ডিমপোচ আর কমলার জুসটা অন্তত খেয়ে যাও। ছেলে বলে, মা বিরক্ত কোরো না, কলেজের দেরি হয়ে গেল।
আমাদের বাসায় খাবারের ছড়াছড়ি। উচ্ছিষ্টে উচ্ছিষ্টে ঘরের মিনিডাস্টবিন ভরে ওঠে।
৫.
দুলাল আমার কাছে কী চেয়েছিল? পাঁচ-দশটা টাকা! উদরপূর্তির জন্য। হয়তো সকালে সে কিছুই খেতে পায়নি। হয়তো গত রাতেও তার পেটে কিছু পড়েনি। কেউ তার হাতে দু-চারটা টাকা ফেলে দেয়নি। অথবা কোনো হোটেললগ্ন ডাস্টবিনে খাবার কাড়াকাড়িতে কমজোর দুলাল পরাস্ত হয়েছিল গত রাতে। তার বাপ নেই হয়তো। মা দশ মাস পরে তাকে প্রসব করেই টাকার জন্য অন্য পুরুষে মগ্ন হয়েছে। তার অন্নসংস্থানের জন্য মায়ের কোনো দায় নেই।
আমার মানিব্যাগ ভর্তি টাকা। স্বচ্ছন্দে কুড়ি টাকার ডাব ত্রিশ টাকা দিয়ে কিনে খেলাম। সেই আমি দুলালের হাতে দু-চার টাকা দেওয়াকে অপচয় মনে করলাম। নাকি এ আমার কার্পণ্য, নাকি ঘৃণা! একজন দিনমজুরের ছেলের মনে দুলালদের জন্য এত ঘৃণা লুকিয়ে ছিল!
আমার ভেতরে একধরনের কাঁপন অনুভব করতে লাগলাম আমি। আমার বিবমিষা জাগল হঠাৎ। সব ভদ্রতা ভুলে আমি নালার ধারে বসে পড়লাম। গলগল করে বমি বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।
আমি ঠিক করলাম, দুলালের কাছে ফিরে যাব।
ফিরে যেতে যেতে ভাবলাম, দুলালকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকব। কাচ্চি বিরিয়ানির অর্ডার দেব। এক্সট্রা এক প্লেট মাংস নেব। দুলালকে বলব, ‘খাও দুলাল, খাও। পেট ভরে খাও।’ আমি চেয়ে চেয়ে তার বিরিয়ানি খাওয়া দেখব, কর্তন দাঁত দিয়ে মাংস ছিঁড়ে খাওয়া দেখব। আসার সময় তার হাতে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট গুঁজে দিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলব, ‘আমাকে মাফ করে দে দুলাল।’
ডাব-ভ্যানের চারপাশে আঁতিপাঁতি খুঁজেও দুলাল বা দুলালদের দেখতে পেলাম না। নিরুপায় আমি ডাবওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে যে একটা ছেলে ছিল সে কোথায়?’
ডাবওয়ালা নির্লিপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কোন ছেলেটা?’
‘ওই যে, আমার পা জড়িয়ে ধরেছিল যে ছেলেটা!’ ব্যগ্রভাবে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
উদাসীন গলায় ডাবওয়ালা বলল ‘কোন ছেলেটা আপনার পা জড়িয়ে ধরেছিল আমি তো খেয়াল করিনি।’
আমি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওই যে সাত-আটজন ছেলে ছিল এখানে, ওদের থেকে একটু আলাদা হয়ে বসে ছিল সে।’
ডাবওয়ালা বিরক্ত মুখে বলল, ‘গরিব মানুষ, ডাব বেচায় ব্যস্ত থাকি। সবার দিকে নজর রাখা তো সম্ভব নয় স্যার।’ বুঝলাম ও আমার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী নয়।
তার পরও আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম ভ্যানের পাশে। দীর্ঘক্ষণ। আশা, দুলাল একসময় ফিরে আসবে। কিন্তু দুলাল বা দুলালরা এল না। এত বড় শহর! অন্য কোনোখানে হয়তো খাবারের জন্য হামলে পড়েছে।
৬.
বাড়ি ফিরি। স্ত্রী জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে তোমার?’ আমি নিরুত্তর থাকি। রাতে স্বল্পাহার শেষে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাই। ওই রাতেই স্বপ্ন দেখি দুলালকে, ডান হাত আমার দিকে প্রসারিত, চোখেমুখে আকুতি। ঘুম ভেঙে যায় আমার। ছটফট করে রাত কাটে।
যথানিয়মে অফিসে যাই। সুযোগ পেলে সিএসসিআর হাসপাতালের সামনে যাই। ইতিউতি দুলালকে খুঁজি। পাই না। হতোদ্যম হয়ে বাসায় ফিরি। দু-একদিন পর আবার যাই। ব্যর্থ হয়ে ফিরি।
মাঝেমধ্যে রাতে স্বপ্ন দেখি দুলালকে, সামনে হাত বাড়িয়ে মিনতিভরা চোখে আমার কাছে কী যেন চাইছে।
ঘুমের ঘোরে কানে বাজে আমারই কণ্ঠ, ‘এই ছাড়লি! দেব একটা উষ্টা!’
জেগে উঠি। ভাবি, এই উষ্টা কার জন্য! দুলালদের জন্য! না আমার জন্য!
No comments