শৃঙ্খলিত গণতন্ত্র by কাজী জেসিন

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা প্রবল ঝড়ের সম্ভাবনার আগে মধ্য-শ্রাবণের আকাশের মতো। সাধারণ মানুষের বোঝার উপায় নেই পরর্মুহুর্তে কি ঘটবে।
দেশের প্রতিটি মানুষ আজ  উদ্বিগ্ন। কিন্তু এমন একটি অবস্থা যে সৃষ্টি হবে তা অনেক আগে থেকেই বোঝা গিয়েছিলো। এর মাঝে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সরকারি দলের প্রস্তাব ও বিরোধী দলের পাল্টা প্রস্তাব অনেকের মাঝে আশার সঞ্চার করেছিলো। কিন্তু গতকাল সংসদে বিরোধীদলের প্রস্তাব উত্থাপনের পর, সরকারি দলের প্রবীণ নেতাদের প্রতিক্রিয়া অনেকের কাছেই ঝড়ের পূর্বাভাস বলে মনে হয়েছে। সরকারি দলের নেতাদের কন্ঠে ছিল সারাদিন সংবিধান এর সুর। তাদের প্রতিটি ভাষণ, প্রতিটি বক্তৃতায় সংবিধানের নানান বিধির বর্ণনা। কিন্তু আমার প্রশ্ন কে লিখেছে এই সংবিধান যার অজুহাতে জনতাকে শাসানো হচ্ছে ? সংবিধান পরিবর্তনের আগে কবে, কোন নেতা সাধারণ মানুষের দ্বারপ্রান্তে  এসেছিলো, কেমন সংবিধান চাই জানতে? এমনকি কমিটি যাদের বেছে বেছে মতামত দিতে ঢেকেছিল তাদের কারও পরামর্শই শোনা হয়নি। তবে কার আকাঙ্খার প্রতিফলন এই সংবিধানে? সরকারি দল যখন একটি রায়ের অজুহাতে, সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে সংবিধান নিজেদের মতো করে সংশোধন করে নিলেন তখন আমরা স্পষ্টভাবে নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের রূপ দেখলাম। গণতন্ত্রের মুখোস খুলে শাসকের অবয়ব বেরিয়ে এসেছে আরো আগে সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ, বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতার, হেনস্থার মধ্য দিয়ে। বর্তমান সরকার সংবাদ কর্মীদের নির্যাতন, ভয়ভীতি প্রদর্শন, টকশো, পত্রিকা, টেলিভিশন চানেল বন্ধ এমনকি পত্রিকার সম্পাদককে  গ্রেফতার নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে অতীতের সমস্ত সরকারকে পেছনে ফেলে সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা,   অরাজকতা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ফিরিস্তি দিয়ে এই লেখা দীর্ঘ করতে চাইনা তবে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল দেশের আপামর জনগণের যন্ত্রণাকে অনুধাবন করে বিরোধী দল আন্দোলন চালিয়ে যাবে। কার অনুরোধে, কিসের প্রত্যাশায় বিরোধী দল সাধারণ মানুষের কাঙ্খিত আন্দোলন করেনি তা বোধগম্য না।

বিরোধীদলের নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান, অপরদিকে বিরোধী নেত্রী দেশকে পেছনের দিকে টানতে চান। আমরাও এগিয়েই যেতে চাই কিন্তু সামনের দিক দেখতে হলে যে আগে পেছনে ফিরে তাকাতে হয় এই কথাটি আমরা ভুলি কি করে? উইন্সটন চার্চিল এই প্রসঙ্গে চমৎকার করে বলেছেন- The father back you can look. The farther forward you are likely to see. দেশে  কখন কি হবে তা কেউ বলতে পারছে না। তবে মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ। কারণ ২০০৬ এর ঠিক এই মাসে ২৮ অক্টোবর, খুব বেশি পেছনের কথা নয়, মানুষ,  লগি, বৈঠা, ধারালো অস্ত্রের যে মহড়া দেখেছে, মানুষ মারার যে কুৎসিত দৃশ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে অবলোকন করেছে  তা খুব সহজে ভুলে যাবার কথা না। বর্তমান সরকারি দলের দাবি আদায়ে তখন আন্দোলন ছাড়া কোনো উপায় ছিল না, মানলাম। কিন্তু সরকারি দল কি ধরেই নিয়েছে আন্দোলন করে, আতঙ্ক ছড়িয়ে দাবি আদায় শুধু তাদের বেলায় প্রযোজ্য? দেশের মানুষ আন্দোলনের নামে কোনো বর্বরতা দেখতে চায় না। তেমনি দেখতে চায়না ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার উদ্দেশে কোনো অগণতান্ত্রিক কর্মকান্ড। সামনে এগিয়ে যাবার অর্থ যদি হয় উন্নত দেশের নির্বাচনী ফর্মুলা কে অনুসরণ করা তবে তা ভাঙ্গা ঘরে অভুক্ত নারীর হীরার স্বপ্নের মতো শোনায়। যে দেশে প্রতিনিয়ত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হচ্ছে, যেখানে মানুষের সংগঠন, সভা সমাবেশের অধিকার মানুষ হারাচ্ছে, শ্রমিকের অধিকার নিষ্পেষিত হচ্ছে, কৃষক ন্যায্যমুল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, গণমানুষের সম্পদ লুটপাট হচ্ছে সেই দেশে শুধু নির্বাচনে কোনো উন্নত দেশের একটি ফর্মুলাকে অনুসরণ করে এগিয়ে যাবার কথা আমাদের কাছে তাই উপহাসসম। হলমার্ক, ডেসটিনি, শেয়ার বাজার লুট, সর্বস্ব হারানো মানুষের আত্মহত্যা, বিশ্বজিৎকে  দিনে দুপুরে জনসম্মুখ্যে কুপিয়ে হত্যা আমাদের গনতন্ত্রের, সুশাসনের গলার কাটা হয়ে বিঁধে আছে। যেদেশে সংসদ প্রধান এবং দলীয় প্রধান, প্রধানমন্ত্রী  একই ব্যাক্তি সেখানে হঠাৎ করে ব্রিটিশ পদ্ধতিতে নির্বাচন ইচ্ছা আমাদের মনে কোনো আশাবাদ জাগায় না। যেখানে প্রশাসন সাজানো হয়েছে সরকারের দলীয় লোকজন দিয়ে সেখানে নিরপেক্ষ নির্বাচন এর অর্থ কি? বর্তমান সরকার নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করে নি। আজও আমাদের দেশে একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। নির্বাচন কমিশন নিজেদের ক্ষমতা  বাড়ানোর পরিবর্তে  নিজেই কমিয়ে ফেলেন কাদের স্বার্থে? এসবের উত্তর আমাদের জানা।
মাননীয়  প্রধানমন্ত্রী যখন পেছনের উদাহরণ, অভিজ্ঞতা ভুলে নিজেদের প্রস্তাবিত নতুন  পদ্ধতিতে নির্বাচন করার প্রত্যয় ব্যাক্ত করছেন, এক চল পরিমান না নড়ার দৃঢ় মনোভাবের কথা জানাচছেন  ঠিক তখন, সংসদে দাঁড়িয়ে বিরোধী দলের দেয়া নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাবের প্রতিউত্তরে বলতে গিয়ে সরকারি দলের প্রবীণ নেতা ইতিহাস থেকে উদাহরণ টানলেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে বিএনপির  অবস্থা ভাসানী ন্যাপ  এর মতই হবে ভয় দেখালেন। কয়েকটি  প্রশ্ন সাথে সাথেই সামনে এসে দাঁড়ায়। আওয়ামীলীগ কি ইয়াহিয়ার সরকারের সাথে নিজেদের তুলনা করছে? সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও তো শেখ মুজিবর রহমান ক্ষমতায় যেতে পারেন নি।  নির্বাচনের ফলাফল ঘরে তুলতে না পেরে, স্বাধীন দেশের জন্যে দেশের লাখ মানুষকে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে। তাছাড়া আমাদের প্রবীন নেতা মনে হয় ভুলে গেছেন কিভাবে সাধারণ মানুষকে ভোট  বাক্স পাহারা দিতে হয়েছে নির্বাচনের কারচুপি ঠেকাতে।  ভাসানী বলেছিলেন,’’ ভোট এর বাক্সে লাঠি মারো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো ।’’ ইয়াহিয়া খানের আইনগত কাঠামোর আওতায় যখন আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে তখন এদেশের জনগণ জানতেন, এম-এন-এ সাহেবরা পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রনয়ণ করবেন এনং তাতে ছয়দফা আদায় করে বড় জোর ‘ পূর্ব পাকিস্তানের’ পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন অর্জিত হবে। তা হয়নি। কেউ চাইলে বলতেই পারেন ভাসানীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহন না করলে হয়তো স্বাধীনতা অর্জনে আমাদের এত রক্ত দিতে হত না। ভাসানী ও তাঁর ন্যাপ   আজ ময়দানে না থাকলেও, দেশের মানুষের মনে তিনি, তার দল আজো নক্ষত্রের মতো জেগে আছে। আমাদের প্রবীন আওয়ামী নেতা ভাসানীর  সাথে তুলনা  করে বিএনপিকেই বরং বড় করেছেন। কারণ কোন দলবাজির ক্ষমতা   ভাসানীর লক্ষ্য ছিল না বরং সাধারণ মানুষকে ক্ষমতাবান করাই ভাসানীর লক্ষ্য ছিল।

১/১১ পরবর্তী সময়ে মানুষের মধ্যে নানাবিধ আশা জাগিয়ে ক্ষমতায় এসে শেষে বর্তমান যে সরকারকে বসিয়ে দেয়া হয় এটা বরং আমাদের আরো দুই ক্রোশ পেছনে নিয়ে গেছে। আজ যখন সাধারণ মানুষ নির্বাচনের আগে তাদের দাবি উত্থাপন করবে, যখন দেশের মানুষ বিবেচনা করবে কে আন্তরিকভাবে দেশকে এগিয়ে নিতে চায় তখন মানুষের চিন্তা স্থবির হয়ে আছে এক অনাকাংখিত সংঘর্ষের আশঙ্কায়; যে সংঘর্ষ, আন্দোলন থেকে জনতা ঠিক কি পাবে আমরা জানি না। দ্বিধাগ্রস্থ জনতা জানেনা তারা সরকারের এই আচরণের প্রতিবাদে বিএনপির পাশে এসে দাঁড়াবে কিনা। লড়াই এ শরিক হবে কিনা তা দেখার বিষয়। আজকের এই ঘন মেঘ যেমন চারদিক অন্ধকার করে দিচ্ছে, তেমনি এর পেছনে লুকিয়ে আছে আলোর ছটা।  আর এই আলো আসবে যদি বিরোধীদলের আসন্ন আন্দোলন শুধু তাদের আখের গুছানোর ক্ষমতা নয়, দেশকে সত্যিকার ভাবে এগিয়ে নেবার প্রত্যয়ে এগিয়ে যায়। দেশের সাধারণ মানুষ দেশের সম্পদ বিদেশের স্বার্থে  বিকিয়ে দিতে চায় না, চায় না পার্শ্ববর্তিদেশের করিডোর হতে বা সুন্দরবনে রামপাল গড়তে, দেশের মানুষ শেয়ার বাজারে সর্বস্ব হারাতে চায় না, কৃষক ন্যায্যমুল্যের অভাবে খেয়ে না খেয়ে আর  দিনাতিপাত করতে চায় না। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্যে আন্দোলন নয়, বিরোধী দলকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে, আস্থায় নিতে হবে যে ক্ষমতায় গেলে তারা দেশকে, দেশের মানুষকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার স্বাদ এনে দেবে, সাধারণ মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পূর্ণভাবে ফিরে পাবে। তবেই দল মতের ঊর্ধে উঠে সাধারণ মানুষ তাদের আন্দোলনে শরিক হবে।নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র নয়, বরং সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এই মুহুর্তে আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। সম্রাট অশোকের মতো শুধু প্রেম দিয়ে জয় লাভ যখন সম্ভব নয় তখন আন্দোলনের কোনো বিকল্প বিরোধীদলের সামনে আর নেই। পেছনে তাকালে দেখা যায় যেকোনো মহৎ অর্জন বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত হবার পরই এসেছে।  ইতালিয়ান বিখ্যাত সাংবাদিক জিউসেপ্পে প্রেজ্জোলিনি তার একটি লেখায় বলেছেন,তথাকথিত প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র এক ধরণের চালাকি, এক ধরনের রাজনৈতিক মিথ যা স্বনির্বাচিত, যা নিজেদেরকে অনন্ত কালীন স্থায়িত্ব দেবার, নিজস্ব স্বার্থপর ক্ষমতাসীন শ্রেণীকে ক্ষমতায় রাখার জন্যে পরিকল্পিত’। এই রাজনৈতিক মিথ, গণতন্ত্রের এহেন চালাকি সাধারণ মানুষ বুঝে গেছে। তাই ক্ষমতাসীনদের পরিকল্পনা ভেস্তে দেবার দায়িত্ব এখন জনতার। বিএনপি কি পারবে জনতার আস্থাভাজন হয়ে জনতার এই আকাংখাকে বাস্তবে রূপ দিতে? 

No comments

Powered by Blogger.