নদী দূষণকারীর শাস্তি নেই
শিল্প, গৃহস্থালী, পয়ঃবর্জ্যে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর দূষণ ভয়াবহ হয়ে উঠছে। নদী রক্ষায় পরিকল্পনা, প্রতিবেদনের কমতি নেই।
অভাব শুধু দূষণকারীর শাস্তি নিশ্চিত করা, দূষণের উৎস নিয়ন্ত্রণের।
ঢাকা ওয়াসা গেল বছর (২০১২) সায়েদাবাদের দ্বিতীয় পানি শোধনাগারটি তৈরি করে। এটি তৈরি করতে একটি প্রাক-শোধনাগার নির্মাণ করা হয়। শোধনাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি ছিল এক বিরল ঘটনা। শীতলক্ষ্যার পানির দূষণ এতটাই তীব্র ছিল যে বাধ্য হয়ে এটি নির্মাণ করতে হয়েছিল। আর এতে অতিরিক্ত ১৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
এখন ওয়াসা মেঘনা নদী থেকে পানি এনে সায়েদাবাদের তৃতীয় শোধনাগার তৈরির পরিকল্পনা করছে। দূর থেকে পানি আনতে অতিরিক্ত ১২৫ কোটি টাকা অপচয় হবে বলে জানিয়েছে ওয়াসা সূত্র। ঢাকার পাশের নদীগুলো ব্যবহার করতে পারলে খরচ অনেক কম হতো। কিন্তু পোশাকশিল্প ও ট্যানারি কারখানার দূষণে ঢাকার আশপাশের সব নদীর পানিও এখন ব্যবহারের পুরো অনুপযোগী।
শিল্পকারখানাগুলোর এই গুরু পাপে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিন্তু আছে লঘু শাস্তি। পরিবেশ অধিদপ্তর গত চার বছরে দূষণের অভিযোগে জরিমানা বাবদ ১১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা আদায় করেছে। এর প্রায় ৮০ শতাংশই আদায় করা হয় পোশাক ও রং তৈরির কারখানা থেকে।
প্রতি এক কিউবিক মিটার পানি পরিশোধন করতে কারখানাগুলোর (ডায়িং) ৩২ টাকা খরচ হয় ইটিপি চালাতে। দুই টন পণ্য উৎপাদন হয় এমন একটি কারখানার প্রতিবছর বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) চালাতে ব্যয় হয় এক কোটি সাড়ে ৩৩ লাখ টাকা। বছরে যদি দুই দফায় ১০ লাখ টাকাও জরিমানা দিতে হয়, তবে তা ইটিপি চালানোর চেয়ে বেশি লাভজনক। আর সেই লাভের কথা বিবেচনা করেই ইটিপি না চালানোর ‘চালাকি’ করে কারখানাগুলোর বর্জ্য স্থান পায় নদীতে।
নাম প্রকাশ না করে অধিদপ্তরের পদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, পোশাকমালিকেরা অনেক শক্তিশালী। তাঁদের জরিমানা করা হলে মন্ত্রী ও আমলারা পর্যন্ত তদবির করেন। পরিবেশবাদীরা বলছেন, নদীর ক্ষতি হলে তো কেবল একটি প্রাকৃতিক উপাদান নষ্ট করে ফেলা হয় না। পরিবেশ, পানি, কৃষি, পরিবহন, মৎস্যসম্পদ এসব নানা বিষয় নদীর ওপর নির্ভর করে। নদীর দূষণ এসব ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে।
বুয়েটের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক পানিবিশেষজ্ঞ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘নদী হারানোর ক্ষতি নির্ণয় করা যায় না। এটা একটা সভ্যতার ক্ষতি।’ তবে তিনি মনে করেন, যে বিশাল ক্ষতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করেছে তাদের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে তা আদায় করা যায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর ২০০৮ সালে ঢাকা ও আশপাশের এলাকার শিল্প দূষণ নিয়ে একটি জরিপ করে (এসএমইপি-জিডি জরিপ)। সেখানে ১০টি শিল্প এলাকা চিহ্নিত করা হয়, যেখান থেকে নদীর দূষণ ঘটে। এসব শিল্প এলাকার বেশির ভাগ ছিল পোশাকশিল্পের কারখানা।
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, পোশাকশিল্পের মালিকদের একটা অগ্রহণযোগ্য মনোভাব আছে যে ‘বাংলাদেশকে আমরা বাঁচিয়ে রেখেছি’। তাঁদের এই মনোভাব নেওয়ার অবকাশ নেই। রানা প্লাজার ঘটনার পর শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি এখন জোরেশোরে উঠে এসেছে। এখন পরিবেশের এই ক্ষতির বিষয়টিও ভাবতে হবে। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে আঁতাতের ফলে দূষণকারীরা সাধারণ ক্ষমা পেয়ে যাচ্ছেন।
তবে তৈরি পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, মালিকদের জরিমানা হলে তাঁরা কোনো হস্তক্ষেপ করেন না। তিনি ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর স্থায়ী দূষণে পোশাক কারখানাগুলো কী পরিমাণ ক্ষতি করেছে, তার হিসাব চেয়েছেন। ক্ষতি নির্ধারণ করতে অর্থনীতিতে পোশাক কারখানার অবদানকেও বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বিজিএমইএর সভাপতির এই বক্তব্যের বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবীব বলেন, ‘এটা হলো চুরি করে বলা যে আমি কয় টাকার চুরি করেছি তা বলুন!’ তিনি বলেন, অবারিতভাবে যাঁরা নদীর ক্ষতি করে যাচ্ছেন, তাঁরা এভাবে কথা বলছেন কারণ রাষ্ট্র তাঁদের সঙ্গে আছে।
নদীদূষণের আরেক ক্ষেত্র হাজারীবাগ ট্যানারিশিল্পের দূষণের ফলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা করেছেন অধ্যাপক এনামুল হক, অধ্যাপক ইসলাম এম ফয়সাল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এ বায়েস। গবেষণাটি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সেই সময়ের বাজারের বিবেচনায় কেবল স্বাস্থ্য খাতে হাজারীবাগ এলাকার প্রতিটি মানুষের এক বছরে ১৫০ ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয় বলে ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি মানবস্বাস্থ্য দূষণের কারণে এলাকার সম্পদ নষ্ট এবং বাসাভাড়া কমে যাওয়ার ফলে মোট পাঁচ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। গবেষক ও বেসরকারি ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এনামুল হক বলেন, দেড় দশকেরও বেশি সময় পর আজ এই ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুস সোবহান এক গবেষণায় নদীদূষণের ফলে ট্যানারিশিল্প দুই হাজার ৪০৯ কোটি টাকার পরিবেশগত ক্ষতি করেছে বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিবছর তরল বর্জ্য নিক্ষেপের মাধ্যমে ৪০ কোটি ১৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়।
ঢাকা ওয়াসা গেল বছর (২০১২) সায়েদাবাদের দ্বিতীয় পানি শোধনাগারটি তৈরি করে। এটি তৈরি করতে একটি প্রাক-শোধনাগার নির্মাণ করা হয়। শোধনাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে এটি ছিল এক বিরল ঘটনা। শীতলক্ষ্যার পানির দূষণ এতটাই তীব্র ছিল যে বাধ্য হয়ে এটি নির্মাণ করতে হয়েছিল। আর এতে অতিরিক্ত ১৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয়।
এখন ওয়াসা মেঘনা নদী থেকে পানি এনে সায়েদাবাদের তৃতীয় শোধনাগার তৈরির পরিকল্পনা করছে। দূর থেকে পানি আনতে অতিরিক্ত ১২৫ কোটি টাকা অপচয় হবে বলে জানিয়েছে ওয়াসা সূত্র। ঢাকার পাশের নদীগুলো ব্যবহার করতে পারলে খরচ অনেক কম হতো। কিন্তু পোশাকশিল্প ও ট্যানারি কারখানার দূষণে ঢাকার আশপাশের সব নদীর পানিও এখন ব্যবহারের পুরো অনুপযোগী।
শিল্পকারখানাগুলোর এই গুরু পাপে রাষ্ট্রীয়ভাবে কিন্তু আছে লঘু শাস্তি। পরিবেশ অধিদপ্তর গত চার বছরে দূষণের অভিযোগে জরিমানা বাবদ ১১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা আদায় করেছে। এর প্রায় ৮০ শতাংশই আদায় করা হয় পোশাক ও রং তৈরির কারখানা থেকে।
প্রতি এক কিউবিক মিটার পানি পরিশোধন করতে কারখানাগুলোর (ডায়িং) ৩২ টাকা খরচ হয় ইটিপি চালাতে। দুই টন পণ্য উৎপাদন হয় এমন একটি কারখানার প্রতিবছর বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) চালাতে ব্যয় হয় এক কোটি সাড়ে ৩৩ লাখ টাকা। বছরে যদি দুই দফায় ১০ লাখ টাকাও জরিমানা দিতে হয়, তবে তা ইটিপি চালানোর চেয়ে বেশি লাভজনক। আর সেই লাভের কথা বিবেচনা করেই ইটিপি না চালানোর ‘চালাকি’ করে কারখানাগুলোর বর্জ্য স্থান পায় নদীতে।
নাম প্রকাশ না করে অধিদপ্তরের পদস্থ এক কর্মকর্তা বলেন, পোশাকমালিকেরা অনেক শক্তিশালী। তাঁদের জরিমানা করা হলে মন্ত্রী ও আমলারা পর্যন্ত তদবির করেন। পরিবেশবাদীরা বলছেন, নদীর ক্ষতি হলে তো কেবল একটি প্রাকৃতিক উপাদান নষ্ট করে ফেলা হয় না। পরিবেশ, পানি, কৃষি, পরিবহন, মৎস্যসম্পদ এসব নানা বিষয় নদীর ওপর নির্ভর করে। নদীর দূষণ এসব ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করে।
বুয়েটের পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক পানিবিশেষজ্ঞ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘নদী হারানোর ক্ষতি নির্ণয় করা যায় না। এটা একটা সভ্যতার ক্ষতি।’ তবে তিনি মনে করেন, যে বিশাল ক্ষতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান করেছে তাদের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে তা আদায় করা যায়।
পরিবেশ অধিদপ্তর ২০০৮ সালে ঢাকা ও আশপাশের এলাকার শিল্প দূষণ নিয়ে একটি জরিপ করে (এসএমইপি-জিডি জরিপ)। সেখানে ১০টি শিল্প এলাকা চিহ্নিত করা হয়, যেখান থেকে নদীর দূষণ ঘটে। এসব শিল্প এলাকার বেশির ভাগ ছিল পোশাকশিল্পের কারখানা।
অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেছেন, পোশাকশিল্পের মালিকদের একটা অগ্রহণযোগ্য মনোভাব আছে যে ‘বাংলাদেশকে আমরা বাঁচিয়ে রেখেছি’। তাঁদের এই মনোভাব নেওয়ার অবকাশ নেই। রানা প্লাজার ঘটনার পর শ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি এখন জোরেশোরে উঠে এসেছে। এখন পরিবেশের এই ক্ষতির বিষয়টিও ভাবতে হবে। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে আঁতাতের ফলে দূষণকারীরা সাধারণ ক্ষমা পেয়ে যাচ্ছেন।
তবে তৈরি পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি আতিকুল ইসলাম এই অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেন, মালিকদের জরিমানা হলে তাঁরা কোনো হস্তক্ষেপ করেন না। তিনি ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর স্থায়ী দূষণে পোশাক কারখানাগুলো কী পরিমাণ ক্ষতি করেছে, তার হিসাব চেয়েছেন। ক্ষতি নির্ধারণ করতে অর্থনীতিতে পোশাক কারখানার অবদানকেও বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
বিজিএমইএর সভাপতির এই বক্তব্যের বিষয়ে স্থপতি ইকবাল হাবীব বলেন, ‘এটা হলো চুরি করে বলা যে আমি কয় টাকার চুরি করেছি তা বলুন!’ তিনি বলেন, অবারিতভাবে যাঁরা নদীর ক্ষতি করে যাচ্ছেন, তাঁরা এভাবে কথা বলছেন কারণ রাষ্ট্র তাঁদের সঙ্গে আছে।
নদীদূষণের আরেক ক্ষেত্র হাজারীবাগ ট্যানারিশিল্পের দূষণের ফলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা করেছেন অধ্যাপক এনামুল হক, অধ্যাপক ইসলাম এম ফয়সাল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এ বায়েস। গবেষণাটি হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। সেই সময়ের বাজারের বিবেচনায় কেবল স্বাস্থ্য খাতে হাজারীবাগ এলাকার প্রতিটি মানুষের এক বছরে ১৫০ ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয় বলে ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি মানবস্বাস্থ্য দূষণের কারণে এলাকার সম্পদ নষ্ট এবং বাসাভাড়া কমে যাওয়ার ফলে মোট পাঁচ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে ওই গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। গবেষক ও বেসরকারি ইউনাইটেড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এনামুল হক বলেন, দেড় দশকেরও বেশি সময় পর আজ এই ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুস সোবহান এক গবেষণায় নদীদূষণের ফলে ট্যানারিশিল্প দুই হাজার ৪০৯ কোটি টাকার পরিবেশগত ক্ষতি করেছে বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিবছর তরল বর্জ্য নিক্ষেপের মাধ্যমে ৪০ কোটি ১৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়।
No comments