গল্প- তান্নিরা তিন বোন by মীম নোশিন নাওয়াল খান
মিতুর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। পরশু রাত
থেকে জ্বর। ছাপরা ঘরে ছেঁড়া কাঁথা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে ও। বাবা আসতে এখনো
অনেক দেরি। তিনি চায়ের দোকানে দোকানদারি করেন।
মা করেন
মাস্টারবাড়িতে ঝিয়ের কাজ। আর বড় ভাই মিজান, সে মাস্টারবাড়ির মালি। দিনরাত
ওখানেই থাকে। তাই জ্বর গায়ে একাই ঘরে শুয়ে থাকতে হচ্ছে মিতুকে।
টানা চার দিন জ্বর থাকল মিতুর। অবশেষে বাবা গ্রামের ফকিরকে ডেকে ঝাড়ফুঁক করালেন। কিন্তু তাতে কি আর কাজ হয়?
মিতুদের হতদরিদ্র পরিবার। চায়ের দোকান থেকে যা আয় হয়, তাতে কোনো রকমে সংসার চলে। বাবার সামর্থ্য হয়নি ঈদে মিজান আর মিতুকে নতুন জামা দেওয়ার। ওরা অসুস্থ হলে চিকিৎসকের কাছেও যায় না। দু-এক দিনে এমনিতেই সেরে ওঠে। নয়তো গাঁয়ের ফকিরকে ডেকে আনা হয়। তিনি তেঁতুল-পাতার বাতাস, নিমগাছের ডাল, বিভিন্ন গাছের শিকড় দিয়ে অসুখ সারান। এবার তাতেও কাজ হচ্ছে না।
বাধ্য হয়ে মিতুকে নিয়ে যাওয়া হলো চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক বললেন, ‘হুম, টাইফয়েড বাধিয়েছে দেখছি।’ একগাদা ওষুধ লিখে দিলেন তিনি।
মিতুকে চিকিৎসক দেখানোর টাকাই বহু কষ্টে জোগাড় করেছেন বাবা, আর তো ওষুধ! এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। পরদিন কাজে গিয়ে মিতুর মা মিতুর অসুস্থতার কথা বললেন বাড়ির কর্ত্রীর কাছে।
এদিকে ঈদে দাদুবাড়ি বেড়াতে এসেছিল তান্নি। মিতুর সঙ্গে ওর খুব ভালো বন্ধুত্ব। গতবারও বেড়াতে এসে একসঙ্গে কানামাছি খেলেছে ওরা। সেই মিতুর কিনা অসুখ?
‘দাদুনি, দাদুনি, তুমি মিতুর মাকে ওষুধ কেনার জন্য কিছু টাকা দাও না!’ বলল সে।
‘তা তো দিতে পারি রে দাদু, কিন্তু আমার হাতে যে এখন টাকা নেই।’ তান্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন তিনি।
তান্নি এবার দৌড়ে গেল মায়ের কাছে।
‘মা, জানো, মিতুর নাকি টাইফয়েড হয়েছে। কিন্তু টাকা নেই বলে ওর বাবা-মা ওষুধ কিনতে পারছে না। দাও না কিছু টাকা!’
‘যাকে যা দেওয়ার দিয়ে ফেলেছি রে তান্নি, আর এবার আমি খুব বেশি টাকা সঙ্গেও আনিনি।’
তান্নি এবার ওর নতুন হ্যান্ডব্যাগটা খুলল। ওটার মধ্যে ওর ঈদের সালামি, ঢাকা থেকে আসার আগে চাচা-ফুপিরা দিয়েছেন। টাকাগুলো বের করল তান্নি। গুনে দেখল, প্রায় সাড়ে চার শ টাকা। ছোট্ট তান্নির জন্য এ কটা টাকাই অনেক, কিন্তু এতে তো মিতুর অসুখ সারবে না। মিতুর মা বলছিলেন, ওষুধ কিনতে প্রায় দুই হাজার টাকা প্রয়োজন।
‘এত টাকা কোথায় পাই?’ ভাবল তান্নি। হঠাৎই একটা বুদ্ধি এল ওর মাথায়। তান্নির বড় আপু মুন্নি ওকে খুব আদর করেন। আপুর কাছেই ঘটনা খুলে বলল সে। বড় আপুও তান্নিকে নিরাশ করলেন না, তিনি দিলেন আড়াই শ টাকা।
কিন্তু দুই হাজার টাকা হতে তখনো অনেকখানি বাকি। কী করা যায়? এবার গ্রামের বন্ধু আর দূর সম্পর্কের চাচাতো-ফুফাতো ভাইবোনদের কাছেও সাহায্য চাইল তান্নি। কদিন আগে ঈদ গেছে। এ সুযোগে সবার কাছেই টুকটাক জমানো টাকা ছিল। সবাই মিলে সাহায্য করল। তান্নি গুনে দেখল, এক হাজার ৩২২ টাকা। টাকাগুলো নিয়ে এবার সে রওনা হলো বাবার কাছে।
‘বাবা বাবা, দেখো! মিতুর চিকিৎসার জন্য আমরা তেরো শ বাইশ টাকা জোগাড় করেছি। তুমি যদি আর সাত শ দিতে...’
বাবা খুব খুশি হলেন। বললেন, ‘তান্নি মা, তুমি তো দারুণ একটা কাজ করছ! কিন্তু এখন যে মা আমার কাছে সাত শ টাকা নেই। কাল সকালে আলমারি থেকে বের করে দেব। অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পড়ো।’ হ্যান্ডব্যাগটা বালিশের পাশে রেখে শুয়ে পড়ল তান্নি। ভাবতে লাগল, কাল সকালে যখন মিতুর মায়ের হাতে টাকাগুলো দেবে, কী খুশিই না হবেন তিনি!
পরদিন বাবার ডাকে ঘুম ভাঙল।
‘তান্নি মা আমার, ওঠো। কত বেলা হয়ে গেছে, এখনো তুমি ঘুমাচ্ছ। এই যে তোমার টাকা। আর দেখো দেখো, সঙ্গে কী এনেছি! মিতুর জন্য একটা জামা!’ বাবার কথা শুনে লাফিয়ে উঠে বসল তান্নি।
‘তুমি এত সকালে বাজারে গিয়েছিলে বাবা!’
‘হুম! তোমার জন্য মাছ এনেছি, আর মিতুর জন্য জামা। নাও নাও, আগে তোমার টাকা নাও।’ তান্নির হাতে এক হাজার টাকা আর জামার প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন বাবা।
বাবা-মাকে সঙ্গে নিয়েই এবার মিতুদের বাড়ি রওনা হলো তান্নি। মিতুদের ঘরটাকে অবশ্য ঠিক বাড়ি বলা যায় না। একটা ভাঙা ছাপরা, তার ভেতর পাটিতে শুয়ে ছিল মিতু। মিতুর মা-বাবা ওদের দেখে পিড়ি এগিয়ে দিলেন বসার জন্য। মিতুর মাকে নিজের হাতে পুরো টাকাটা বুঝিয়ে দিল তান্নি।
‘এই টাকায় মিতুর ওষুধ কিনবেন। আর যা বাঁচবে, তাতে ওর জন্য ফলমূল কিনবেন। অসুখ হলে ভালো করে খাওয়াদাওয়া করতে হয়।’ বড়দের মতো করে বলল তান্নি।
মিতুর মায়ের চোখে পানি এসে গেল। এরপর মিতুর হাতে গোলাপি জামাটা তুলে দিল তান্নি।
‘মিতু, এই ড্রেসটা তোমার জন্য। ঠিকমতো ওষুধ খেলে তুমি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবে। তারপর নতুন জামা পরে আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে।’
রোগা শরীর নিয়ে মিতু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
তান্নির মা বললেন, ‘মিতুর মা, তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি। মিতু আমাদের সঙ্গে এবার ঢাকায় যাক। ওখানে থেকে তান্নি-মুন্নীর সঙ্গে লেখাপড়া করবে।’
একটু ভেবে মিতুর মা-বাবাও রাজি হয়ে গেলেন। বাবা বললেন, ‘তাহলে আজ থেকে মিতুও আমার একটা মেয়ে। এখন আমার তিন মেয়ে—মুন্নী, তান্নি আর...
‘আর মিতু!’ খুশিতে হাতে তালি দিয়ে বলে উঠল তান্নি!
সপ্তম শ্রেণী (ইংরেজি মাধ্যম)
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
No comments