রাষ্ট্রকে বিপন্ন করা চলবে না by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

১৮ অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে এক ভাষণ দেন। তার এ ভাষণ বিটিভিসহ দেশের সব স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল ও রেডিওতে একযোগে সম্প্রচারিত হয়। চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সমগ্র জাতি তাকিয়ে ছিল প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের দিকে। জাতি প্রত্যাশা করেছিল প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকবে। কিন্তু মানুষের সেই আশায় গুড়েবালি, যতটা আশা প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে মানুষ করেছিল; ততটা নিরাশ হয়েছে। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সিপিবি, বিকল্পধারা, জেএসডি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ আরও অন্য রাজনৈতিক দল প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে ১৯ অক্টোবর মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলন করে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্ট বলে অভিহিত করেছে। এ সংবাদ সম্মেলনের পর জাতীয় পার্টির জন্য খুলে যায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের দ্বার। জাতীয় পার্টির ডাক পড়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ২০ অক্টোবর রাতে ১৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে রাজকীয় মেজাজে এরশাদ সাহেব পা রাখেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। শুধু বৈঠকই নয়, নৈশভোজও সারেন এরশাদ সাহেব প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে; কিন্তু তার রাজনীতির প্রাপ্তির খাতা শূন্য, তিনি যে কিছুই পাননি উপরন্তু খুইয়েছেন, সেটি বুঝতে পারেন বৈঠক ও নৈশভোজ-পরবর্তী মিডিয়ার সামনে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য শুনে। অতঃপর তড়িঘড়ি করে ২০ অক্টোবর দুপুরে এক আকস্মিক সংবাদ সম্মেলন করেন এরশাদ সাহেব। ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি আশরাফ সাহেবের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। এমনকি তার বক্তব্যকে অসত্য ও বানোয়াট বলে অভিহিত করেন এবং বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান। তাতে বদলে যায় রাজনৈতিক দৃশ্যপট। কিন্তু এখন পর্যন্ত আশরাফ সাহেব তার বক্তব্য প্রত্যাহারও করেননি এবং এরশাদ সাহেবের অভিযোগের কোনো ব্যাখ্যাও দেননি।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের ঠিক এক দিন পর ডিএমপি ঢাকায় সভা-সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধের এলান জারি করে। তাতে বলা হয়, ২০ অক্টোবর সকাল ৬টা থেকে ঢাকায় কোনো সভ-সমাবেশ, মানববন্ধন ও মিছিল করা যাবে না, এমনকি ঘরোয়া সমাবেশও পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকবে। এ আদেশ শুনে সবার মাথায় হাত, সামনের দিনগুলো যে সুখকর হবে না এবং অনিশ্চয়তার অন্ধকার যে সহসা কাটছে না- এটি ঝুঝতে কারও বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না। এরই মধ্যে ২১ অক্টোবর গোধূলি বেলায় বিরোধী দলের নেতা হাজির হলেন গণমাধ্যমের সামনে, জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে এক যুগান্তকারী, সময়োপযোগী, দূরদর্শী ও রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য রাখলেন তিনি; প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে দিলেন নির্বাচনকালীন বিকল্প এক সরকারের প্রস্তাব। দ্রুত বদলে গেল রাজনীতি। খালেদা জিয়ার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এবং ব্রিটেন, কানাডাসহ অন্যান্য রাষ্ট্র। স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘও।
২২ অক্টোবরের সূর্যটা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য আশীর্বাদের বরপুত্র হয়ে উদয় হয়। বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবের ওপর আলোচনার চিঠি নিয়ে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল সবাইকে চমকে দিয়ে আকস্মিক হাজির হন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মিন্টো রোডের সরকারি বাসায়। আশরাফ সাহেব যথারীতি চিঠি গ্রহণ করে আচমকা ফোন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। কথা হয় দু’জনের মধ্যে কয়েক মিনিট। এ সময়টা বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির জন্য টার্নিং-পয়েন্ট হয়ে দেখা দেয়। সৈয়দ আশরাফ ও ফখরুল সাহেবের ফোনালাপ মিডিয়ায় দেখতে পেয়ে মানুষের আতংকিত চেহারা মুহূর্তের মধ্যেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে নাটকীয়ভাবে খবর আসে মির্জা ফখরুলকে ফোন করেছেন জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে প্রায় ৪০ মিনিট কথা হয় তাদের মধ্যে। রাতে গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। বৈঠক শেষে তিনি মিডিয়ার সামনে বলেন, দুই দলের মধ্যে সংলাপের দ্বার উন্মুক্ত হল। নাটকীয়তার এখানেই শেষ নয়, পরের দিন অর্থাৎ ২৩ অক্টোবর সবাইকে বিস্মিত করে ড্যান মজিনা সরাসরি চলে যান ভারতের রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরনের বাসায়। তাদের মধ্যে কী কথা হল এবং কেনইবা তিনি পঙ্কজ শরনের বাসায় ছুটে গেলেন- এটার হিসাব রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মিলাতে পারছে না। তবে সামনের দিলগুলোতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবশ্যই এটি দৃশ্যমান হবে। বিস্ময় এখানেই শেষ নয়, খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নিয়ে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার মাগরিবের নামাজের পর হাজির হন জাতীয় সংসদে। তিনি খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রস্তাব তুলে ধরেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। এর মাধ্যমে বল এখন আনুষ্ঠানিকভাবে চলে গেল সরকারি দলের কোর্টে। এখন দেখার বিষয় এ বল নিয়ে কেমন খেলা খেলে ক্ষমতাসীন দল।
প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক আছে। এটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি নতুন প্রস্তাব। এ সরকারের রূপরেখা কী হবে, সংসদ ভেঙে দিয়ে, না রেখে হবে, এ সরকারের প্রধান কে হবেন, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়- যেমন স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে কোন দলের মন্ত্রী থাকবে ইত্যাদি প্রশ্ন থেকেই যায়। আর বাংলাদেশের সংবিধানে সর্বদলীয় সরকার বলতে কোনো দিকনির্দেশনাও নেই। এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। বিরোধী দল মনে করে, সর্বদলীয় সরকারের নামে প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করতে চান। তাই তাদের দাবি নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে কিছুতেই প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। কারণ তাকে নির্দলীয় সরকারের প্রধান রেখে পক্ষপাতহীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। দৃশ্যত সর্বদলীয় সরকারের নামে একটা নোংরা রাজনৈতিক খেলা চলবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। সরকার চাইবে সর্বদলীয় সরকারের নামে কিছু অস্তিত্বহীন দলকে দিয়ে ও অনুগত কিছু মিডিয়ার সাহায্যে বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচনের একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করতে। আসলে কোনো দুরভিসন্ধিমূলক চিন্তা নিয়ে সংকটের সমাধান করা যায় না, বরং সংকট আরও বাড়ে। তাতে দেশ সংকটে পড়ে। এমনিতেই দেশ চরম সংকটে নিপতিত। সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। অনেকে বলছেন, দেশে একটি গৃহযৃদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠছে। এমনটি হলে ধ্বংস হবে মানুষের সব স্বপ্ন, ধ্বংস হবে সম্ভাবনা।
শান্তিতে নেই ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা। তারা মনে করছেন একটা দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ, যা ধ্বংস করবে অর্থনীতি; ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে পড়বে স্থবির, উৎপাদন কমে যাবে, রফতানি বাণিজ্য নিয়ে দেখা দেবে অনিশ্চয়তা। আমদানি-রফতানি ব্যাহত হবে। বন্ধ হবে কল-কারখানা। কর্ম হারিয়ে বেকার হবে হাজার হাজার শ্রমিক। দেখা দেবে সামাজিক বিশৃঙ্খলা। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ হবে রুদ্ধ।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এর ফলে জাতীয় অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে, জিডিপি নিচের দিকে নামবে, সর্বোপরি মধ্য আয়ের দেশের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হবে। কাজেই বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি হওয়া উজ্জ্বল ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এ নির্মোহ সত্যটি শাসক দল যত তাড়াতাড়ি উপলদ্ধি করবে, ততই তাদের জন্য এবং দেশের জন্য মঙ্গল হবে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাবে তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবের পর ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয়েছে। ব্রিটেন, কানাডা ও জাতিসংঘসহ সুশীল সমাজ, গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সর্বস্তরের মানুষ বিরোধীদলীয় নেতার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে; এখন সরকার এটাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করলে সমাধান দোরগোড়ায়। আর মানুষ চায় সংকটের সমাধান, চায় সংলাপ; চায় পক্ষপাতহীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন, এর জন্য এগিয়ে আসতে হবে সর্বপ্রথম সরকারকেই।
খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় বসলেই সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে মানুষ মনে করে। কারণ খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে কোনো পক্ষপাতিত্বের লেশ মাত্র নেই। তাই এ প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কোনো সুযোগ নেই। দুই দল বসে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কে হবেন এটি ঠিক করতে পারলে অন্যান্য বিষয় সহজেই সমাধানযোগ্য বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খালেদা জিয়ার প্রস্তাব নাকি পেছনে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব; প্রধানমন্ত্রীকে সবিনয়ে বলছি, বর্তমান ক্রান্তি সময়ে যত পেছনে তাকাবেন ততই সামনে তাকাতে পারবেন।
রাজনৈতিক সহিংসতায় গত কয়েক মাসে অনেক সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একই জাতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে একটি নির্বাচন নিয়ে এমন আÍঘাতী ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। ক্ষমতার পালাবদলকে কেন্দ্র করে জেনেশুনে কৌশলে জাতিকে ভয়ানক বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে; যাতে এ জাতি বিপন্ন জাতিতে পরিণত হয়, একটা বাইরের অপশক্তির হস্তক্ষেপ যাতে অনিবার্য হয়। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে কোনো রাজনীতি হতে পারে না। রাজনীতি করতে গিয়ে রাষ্ট্রই যদি বিপন্ন হল, তাহলে রাজনীতি কার স্বার্থে? কাজেই রাজনৈতিক সহিংসতায় আর যাতে কোনো প্রাণ ঝরে না যায়, আর যাতে কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.